চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপপর্ব থেকে বিদায়। ‘০৩-‘০৪ মৌসুমের পর প্রথমবার ইউরোপাতে খেলতে বাধ্য হবার পর সেখানেও ঘরের মাঠে ভরাডুবি। সাথে কোপা ডেল রে থেকে বিদায় এবং লিগ জেতার দৌড়ে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে আগেভাগে পিছিয়ে পড়া। গত মৌসুমে বার্সেলোনা যেন নিজেদের অবনতির মাত্রা অতিক্রম করে ফেলেছে। এই হতাশাজনক মৌসুমে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আছে একগাদা ঋণ ও বেহাল অর্থনৈতিক অবস্থা। সাথে লা লিগার গছিয়ে দেওয়া ফিন্যানশিয়াল ফেয়ার প্লে এবং স্যালারি ক্যাপ তো রয়েছেই। সবদিক বিবেচনা করলে বার্সেলোনার টালমাটাল অবস্থা। এবং এই অবস্থায় ক্লাবের অন্যতম তরুণ মিডফিন্ডার ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংকে নিয়ে ইউরোপজুড়ে কানাঘুষো। তাকে নাকি এই মৌসুমে বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভাবছে কাতালান ক্লাবটি।
এই গুজব নিয়ে এখন বার্সেলোনার সমর্থকেরা দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদল মনে করে ডি ইয়ংকে বিক্রি করা বড় ধরনের ভুল পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়। অন্যদলের ধারণা, তাকে বিক্রি করাই উত্তম সিন্ধান্ত। তবে এই সরল দোলকের দোলুনির মাঝে না-ই বা যাওয়া যাক। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বার্সেলোনার জন্য আসলে কোনটি উত্তম সিদ্ধান্ত হতে পারে?
প্রথমে বলে নেওয়া উচিত বার্সেলোনার বর্তমান পরিস্থিতি কেমন। করোনা মহামারীর আগে থেকেই ক্লাবটি বিশাল এক ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছিল। মহামারী না এলে হয়তো এই প্রসঙ্গ সামনে আসতো না, কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারী থলের বিড়ালকে বাইরে বের করে এনেছে। নতুন খেলোয়াড় কেনার জন্য জন্য বাজেট তাদের হাতে নেই। আয় ও ব্যয়ে সমতা নেই বলে স্যালারি ক্যাপের নিয়মে আটকে যাচ্ছে ক্লাবটি। তাই নতুন খেলোয়াড় রেজিস্ট্রেশন করানো নিয়েও বিশাল সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। এজন্য দলটির এখন খেলোয়াড় বিক্রি করে আয় করতে হবে, এবং পুরনো খেলোয়াড়দের বেতন কমিয়ে সমতায় আনতে হবে। খেলোয়াড় বিক্রি ও বেতন কমানো ছাড়াও অন্যান্য উপায় রয়েছে বটে, কিন্তু সেখানে জটিলতা খুবই বেশি।
এখন মূল প্রসঙ্গ, ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং। ২০১৯ সালে আয়াক্স থেকে এই ডাচ ফুটবলারকে ৭৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে দলে এনেছিল বার্সা। আয়াক্সে ডি ইয়ং খেলতেন সিঙ্গেল পিভটে, মানে তিনজন মিডফিল্ডারের ঠিক মাঝে। আবার মিডফিল্ডের বাম অথবা ডান পাশেও তাকে দেখা যেতো। আয়াক্সে তিনি কোন ভূমিকায় খেলতেন, সে প্রসঙ্গে না যাই। তবে ডি ইয়ং দুর্দান্ত একজন ‘বল ক্যারিয়ার।’ অনায়াসে মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে ঢুকে যাওয়ার সক্ষমতা তার রয়েছে। এছাড়াও তার পাস দেবার দক্ষতা নজরকাড়া। হাই-প্রেসিং এর মাঝেও অনায়াসে খেলতে পারেন। এ সকল বৈশিষ্ট্য থাকার জন্যই বার্সা তাকে বেশ বড়সড় অর্থের বিনিময়ে দলে নিয়ে এসেছিল।
লা লিগায় তার অভিষেক হয়েছিল সিঙ্গেল পিভট হিসেবে। অ্যাটলেটিকো ক্লাবের বিপরীতে রবার্তো এবং এলেনাকে দু’পাশে রেখে তিনি সেদিন ছিলেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের ভূমিকায়। কিন্তু পরবর্তী ম্যাচগুলো থেকেই ডি ইয়ং মাঠের ডানপাশে নামতে শুরু করলেন। মাঠে তখন তার ভূমিকা খুবই সোজা। বুসকেটস খেলবেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে, যিনি বল নিয়ে তেমন উপরে আসেন না। তার কাজ নিজ থেকে লম্বা লং বল অথবা থ্রু বল দিয়ে খেলা গড়ে দেওয়া। আর এই অংশ থেকে ডি ইয়ং-এর কাজ শুরু। তিনি বল পায়ে রেখে সোজা ঢুকে যাবেন প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে। এবং আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের কাছে বল পোঁছে দেবেন। সোজা কথায় রক্ষণ এবং আক্রমণভাগের খেলোয়াডের মাঝে ডি ইয়ং একজন সাঁকো হিসেবে কাজ করবেন। কিন্তু তাকে আবার প্রথাগত বক্স-টু-বক্স খেলোয়াড়ও বলা যাবে না।
বর্তমানে, পেদ্রি-বুসকেটস-ডি ইয়ংত্রয়ী এই কাজ করে আসছেন। যেখানে পেদ্রির ভূমিকা হচ্ছে ডি ইয়ং-এর মতো বল সরাসরি এগিয়ে না নিয়ে চকিতে গোল সুযোগ তৈরি করা। একটা সময় মেসি যেমন মধ্যমাঠে এসে সৃষ্টিশীলতার দায়িত্ব পালন করতেন, ঠিক তেমনই। এবং মধ্যমাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্বও তার ঘাড়েই বর্তায়। ডি ইয়ং-এর অন্যতম বড় একটা গুণ হচ্ছে, প্রেস অথবা চাপের মুহূর্তে পজেশন ঠিক রেখে ঠাণ্ডা মাথায় খেলে পাস দেওয়া অথবা বল বের করে দেওয়া। এই প্রেসের বিপরীতে খেলার জন্য ভালো ড্রিবল করা জানতে হয়। ডি ইয়ং বেশ ভালো ধরণের একজন ড্রিবলার।
একজন খেলোয়াড়, বিশেষ করে মিডফিল্ডারের প্রথম মৌসুমকে কেন্দ্র করে আলোচনা অথবা সমালোচনা না করাই ভালো। নতুন ক্লাবে এসে খাপ খাওয়ানোর মতো একটা ব্যাপার সেখানে থাকে। রোনাল্ড ক্যোমানের অধীনে ডি ইয়ং তার দ্বিতীয় মৌসুমে এসে বেশ সাবলীল খেলা উপহার দিতে শুরু করেছিলেন। পুরো মৌসুমে গোলসুযোগ তৈরি, পাস রিসিভ এবং সফলতার সাথে পাস দেয়া, গোলমুখে শট, প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে পাসের মতো পরিসংখ্যানগুলো ছিল তার আয়াক্সে কাটানো শেষ মৌসুমের কাছাকাছি। ‘২০-‘২১ মৌসুমের মাঝের একটা সময়ে বার্সা প্রায় অপ্রতিরোধ্য একটা সময় পার করেছিল, ডি ইয়ং তখন ছিলেন ফর্মের তুঙ্গে। এরপর একটা ইনজুরি। তিনি ফর্মের তুঙ্গে থেকে সোজা নিচে নেমে গেলেন।
সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমে ডি ইয়ং-এর পারফরম্যান্স আগের মৌসুম থেকে বেশ চোখে পড়ার মতো। হয়তো হিটম্যাপ এবং অন্যান্য কিছু পরিসংখ্যান থেকে এই কথা ঠিক বোধগম্য হবে না। কিন্তু এটাই সত্য যে, জাভির অধীনে লম্বা একটা সময় নিয়মিত খেললেও ডি ইয়ং ধারাবাহিকভাবে আশানুস্বরূপ পারফরম্যান্স করতে পারেননি। কারণ যে ‘বল ক্যারি’ করার কাজের জন্যই মূলত তাকে কেনা – পুরো মৌসুমে সে কাজে তার সফলতার হার হতাশাজনক।
কিন্তু একটা কথা আছে, ক্লাব যখন বিরূপ একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যায় তখন অনেক তারকা খেলোয়াড়ও ভালো পারফর্ম করতে পারেন না। জাভি হয়তো এমন কিছুই বিশ্বাস করেন, অথবা মনে-প্রাণে মানেন ডি ইয়ং থেকে আরও ভালো কিছু তিনি বের করে নিতে সক্ষম হবেন। এজন্য প্রথম থেকেই তাকে দলে রাখতে চান তিনি। কিন্তু এখন বার্সা কী ভাবছে?
প্রথমত মনে রাখা প্রয়োজন, বার্সা এখন চিন্তা করছে অর্থ আয় করার। এবং বর্তমানে দল থেকে একমাত্র ডি ইয়ং একটা বড় ধরনের অর্থ ক্লাবকে এনে দিতে পারেন। তবে পেদ্রিও কিন্তু বড় ধরনের একটা অর্থ ক্লাবকে এনে দিতে সক্ষম। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, পেদ্রিকেও কি বার্সা বিক্রি করে দেবে? উত্তর হচ্ছে, ‘না’। মাত্র ১৯ বছর বয়সী কিশোর মাত্র দু’টো মৌসুম খেলে নিজেকে যতটা প্রমাণ করেছে, ডি ইয়ং সেটা পারেননি। তাই পেদ্রি যে আগামীতে এই দলের মধ্যমাঠের হাল ধরবে, সেটা নিয়ে বার্সার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।
এখন বার্সা চাইলে ডি ইয়ংয়ের জন্য ৭০-৮৫ মিলিয়ন ইউরো দাবি করতেই পারে। এবং তাদের একটা বড় ভয়, তিন বছর পর ডি ইয়ংয়ের যে উন্নতি হবার কথা ছিল, সেটা না হওয়া। কারণ একজন মিডফিল্ডার ২৫ বছর বয়স স্পর্শ করা শুরু করলেই তার ক্যারিয়ারের ‘পিক টাইম’ শুরু হয়ে গেছে বলে ধরা হয়। সেখানে ডি ইয়ংয়ের এখনও খোলস ছেড়ে বের হওয়া বাকি। এখন আরও ২ বছর এভাবেই যদি কাটে, তখন বার্সা তাকে বিক্রি করে বড় ধরণের একটা অংক নিতে পারবে না। আর তার চেয়ে বড় কথা, বেতনটা বাঁচানোর পাশাপাশি অর্থটা তো বার্সার ৩০ জুলাইয়ের পূর্বেই লাগবে। তবে বার্সা যে পরিমাণ দাম চাচ্ছে, সেটা যদি কোনো ক্লাব দিতে রাজি না হয়, তবে তাকে বিক্রির প্রসঙ্গ আসছেই না।
তবে ডি ইয়ংকে যদি অবশেষে বিক্রি করেই দেয়, তবে বার্সার কতটা ক্ষতি হবে?
প্রথম ক্ষতি হবার প্রশ্ন আসছেই না। কারণ ডি ইয়ং এর মূল যে দায়িত্ব, সেটা ধারাবাহিকভাবে তিনি পালন করতে কখনোই পারেননি। তাই একই ঘরানার খেলোয়াড় যদি তার শূন্যস্থানে আসে এবং তিনি ডি ইয়ং থেকে সামান্য ভালো পারফর্ম করতে পারেন, বার্সা ডি ইয়ংকে কখনোই মিস করবে না।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ডি ইয়ংকে বিক্রি করার পর বার্সা কিনতে পারে উলভের রুবেন নেভেস অথবা ভ্যালেন্সিয়ার কার্লোস সোলেরকে, যাদের কেউ ডি ইয়ং ঘরানার খেলোয়াড় নন। বেশ কয়েক মাস আগে চুক্তি করে রাখা ফ্রাঙ্ক কেসিকেও এই ধরনের খেলোয়াড় বলা যায় না। দলে থাকা গাভি, রবার্তো, এবং নিকোকেও নয়। যদি বার্সেলোনা ম্যানচেস্টার সিটি থেকে বের্নার্দো সিলভা অথবা মোনাকো থেকে অরিয়ে শুয়ামিনিকে উড়িয়ে নিয়ে আসেন, তাহলে অন্য কথা। কিন্তু এ দু’জন তো দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। আশা করি উত্তরটা পেয়ে গেছেন।
বার্সেলোনা ইকোনমিক সহ-সভাপতি এদুয়ার্দো রোমেউ ক্লাবের নতুন মৌসুমের জার্সি উন্মোচন অনুষ্ঠানে বলেছেন,
“ক্লাবের এই দৈন্যদশা কাটিয়ে উঠতে আরও দুই থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে, আমরা ধৈর্য্য ধরার জন্য বিশেষ অনুরোধ করছি। ক্লাবের আয় বাড়ানো এবং খরচাপাতি কমানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছি।”
বার্সেলোনার বোর্ডের সদস্য যখন ক্লাবের এ অবস্থার কথা শোনান, এবং উলটো দিকে এরিক টেন হাগ ডি ইয়ংকে ওল্ড ট্রাফোর্ডে পাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে ডি ইয়ংয়ের ভবিষ্যতের আরও বিশদ ব্যাখ্যার কোনো দরকার রয়েছে কি? এখন শুধু ৭৫ মিলিয়ন ইউরোর বেশি একটা প্রস্তাব হলেই তো চলে। এমনটা ভাবছেন নিশ্চয়ই?
কিন্তু ডি ইয়ং এর পক্ষ থেকে আরও একটা ঝামেলা বাকি রয়ে গেছে। তিনি এমনিতেই কাতালান ক্লাব ছাড়তে রাজি নয়, আর ছাড়লেও চ্যাম্পিয়নস লিগে না খেলা একটা ক্লাবে তিনি যেতে ইচ্ছুক নন।
অর্থাৎ, ডি ইয়ং এবং বার্সার মধ্যকার নাটক এইটুকুর মধ্যেই শেষ নয়। উভয়ের ভবিষ্যৎ পুরোটাই অনিশ্চিত এখন পর্যন্ত। কারণ, বার্সেলোনা যদি অন্য কোনোভাবে অর্থনৈতিক এই ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে পারে, তাহলে আর ডি ইয়ংকে বিক্রি করা লাগছে না। অন্তত তখন জাভি সেটা হতে দেবেন না। কিন্তু বার্সার এই সমস্যা পূরণ করতে খেলোয়াড় বিক্রি করাই একমাত্র উপায় হয়ে থাকে, তখন বলির পাঁঠা ডি ইয়ং ছাড়া আর কেউ নয়। এজন্য, নাটকের বেশ কয়েক অংশ এখনও সামনে আসা যে বাকি।