১.
সময়টা ১৯৩২ সাল। লন্ডনের পিকাডিলি হোটেলের এক ডিনারে চারজন ভদ্রলোককে নিমগ্ন হয়ে একটা আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে দেখা গেল। আলোচনা না করে উপায়ও ছিল না। অ্যাশেজ জয় করতে হলে খেলার সাথে সাথে তার বাইরেও কী করা যায় সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
টেস্ট ক্রিকেটে সব ব্যাটসম্যানই রান করতে চান। সেটাই স্বাভাবিক। তবে ১৯৩০ সালের ইংল্যান্ড সফরে ব্র্যাডম্যান নামের ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার একজন ছোটখাটো ব্যাটসম্যান যে বিস্ময়কর কাণ্ডটা করলেন, সেটা তখন পর্যন্ত কেউ দেখেনি। ৫ টেস্টের ৭ ইনিংসে তার রান ছিল যথাক্রমে ৮ ও ১৩১, ২৫৪ ও ১, ৩৩৪, ১৪, ২৩২। ফলাফল, অস্ট্রেলিয়া ২-১ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জয়ী। ১৩৯.১৪ গড়ে করা ব্র্যাডম্যানের ৯৭৪ রানের সেই রেকর্ডটি এই রান বন্যার যুগেও কোনো ব্যাটসম্যান ভাঙতে পারেননি। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সিরিজে ৯০০-র বেশি রান করার রেকর্ডই আছে আর মাত্র ১টি, ওয়ালি হ্যামন্ডকে ৯০৫ রান করতে ইনিংস খেলতে হয়েছিল আরো দুটো বেশি। সর্বশেষ ইংল্যান্ড সফরের কথা বাদ দিলেও ব্র্যাডম্যান তার সর্বশেষ টেস্ট সিরিজে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫ ইনিংসে ৪টি সেঞ্চুরির সাহায্যে ২০১.৫০ গড়ে করেছিলেন ৮০৫ রান, যা কিনা ৪ অথবা এর চেয়ে বেশি ম্যাচে খেলা সিরিজে সর্বোচ্চ গড়।
অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করার জন্য তাই তৎকালীন অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিনের আলোচনায় বসা ছাড়া বিকল্প ছিল না। জার্ডিন ছিলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়া এমন একজন অধিনায়ক, যিনি কিনা নিয়মের মধ্যে থেকে যেকোনো উপায়েই জয় পেতে পিছপা হতেন না। তিনি বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন, অ্যাশেজ জিততে হলে যেকোনো উপায়েই হোক ব্র্যাডম্যানকে স্তব্ধ করতে হবে। তবে চাইলেই তো এরকম কাজ করা সম্ভব নয়। অবশ্য যেকোনো মানুষেরই দুর্বল দিক থাকে। চতুর জার্ডিন লক্ষ্য করেছিলেন যে, লেগ স্টাম্পের উপর পিচ করে শরীরের দিকে ধেয়ে আসা দ্রুতগতির বলে একটু যেন নড়বড়ে মনে হয় ব্র্যাডম্যানকে। কিন্তু এর সাথে জার্ডিন এটাও জানতেন, ব্র্যাডম্যানের দ্রুত ফুটওয়ার্ক আর বিদ্যুৎ গতির রিফ্লেক্সের বিরুদ্ধে কেবল এই থিওরিতে কাজ হবে না, এর সাথে বলে থাকতে প্রচণ্ড গতি এবং বোলারকে হতে হবে নিখুঁত নিশানার অধিকারী।
দীর্ঘ আলোচনার পর জার্ডিন সিদ্ধান্ত নিলেন, কোন মানুষটি দায়িত্ব নেবেন ব্র্যাডম্যানকে থামানোর।
সেই বোলারটির নাম হচ্ছে হ্যারল্ড লারউড ।
২.
কে ছিলেন এই হ্যারল্ড লারউড?
খুব অল্প বয়স থেকেই জীবনের কঠিন দিকটা দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল লারউডের। ১৯০৪ সালের ১৪ই নভেম্বর জন্ম নেওয়া এই ছেলেটার আর পাঁচ-দশজনের মতো হেসে-খেলে শৈশব কাটানোর সুযোগ হয়নি। বাবা কয়লা খনির শ্রমিক হওয়ায় তাকেও খনিতে কাজ শুরু করতে হয়েছিল মাত্র ১৪ বছর বয়সেই। ৪ বছর পর তিনি নটিংহ্যাম এর ট্রেন্টব্রিজে মাঠকর্মী হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে জো হার্ডস্টাফ এর সৌজন্যে ট্রায়ালে বোলিং করার সুযোগ পেয়েই নিজেকে চিনিয়ে ফেললেন। উচ্চতায় খাটো হলেও, গতি এবং নিখুঁত নিশানার জন্য তিনি ১৯২৫ সালেই নটিংহ্যাম্পশায়ারের মূল দলে সুযোগ পেয়ে যান। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, পরের বছরেই ইংল্যান্ডের মূল দলে ডাক পান লারউড।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অভিষেকটা তার একেবারে মন্দ হয়নি। সে ম্যাচেই তিনি ৩ উইকেট পান। তবে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ইনিংসে ৫ উইকেট পাওয়ার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয় আরও ৪ টেস্ট। ব্যক্তিগত ৫ম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে তিনি পান ৩২ রানে ৬ উইকেট। তবে ক্যারিয়ারের শুরুটা মোটামুটি ভালো হলেও, প্রথম ১৬ টেস্টে তার উইকেট ছিল মাত্র ৪৫টি। খুব সাধারণ একটা বোলিং রেকর্ড নিয়েই তিনি মাঠে নামেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে।
কিন্তু অধিনায়ক জার্ডিনের মাথায় যে তখন লারউড এবং আরেক ফাস্ট বোলার বিল ভোসকে নিয়ে ভিন্ন পরিকল্পনা ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল, লেগ সাইডে ৬/৭ জন ফিল্ডার রেখে লেগস্টাম্পের লাইনে ব্যাটসম্যানের শরীর লক্ষ্য করে টানা শর্ট পিচ বল করে যাওয়া। এই কৌশলটাই পরবর্তীতে ‘বডিলাইন সিরিজ’ নামে কুখ্যাতি অর্জন করে।
প্রথম ম্যাচটা অসুস্থতার জন্য ব্র্যাডম্যান খেলতে পারেননি। তাই বোঝা যায়নি, জার্ডিন তার কৌশলে জয়ী হতে পারবেন কিনা। তবে লারউড প্রথম ম্যাচে ঠিকই আলো ছড়িয়েছিলেন। দুই ইনিংসেই পেয়েছিলেন ৫টি করে উইকেট। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ম্যাচে ১০ উইকেট প্রাপ্তি আর অপর প্রান্তের ভোসের ৬ উইকেট ম্যাচটিতে ইংল্যান্ডকে ১০ উইকেটের একটি সহজ জয় পেতে সাহায্য করে।
পরের ম্যাচে ফিরলেন ডন ব্র্যাডম্যান।
৩.
প্রথম ইনিংসে জার্ডিন তার কৌশল ব্র্যাডম্যানের বিপক্ষে কাজে লাগানোর সুযোগ পেলেন না। পাবেন কীভাবে? ব্র্যাডম্যান যে ভোসের প্রথম বলেই শূন্য রানে বোল্ড হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরত গেলেন। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত সেঞ্চুরি করে ব্র্যাডম্যানও বুঝিয়ে দিলেন, লড়াই করেই জবাব দিতে তিনি প্রস্তুত। লারউড দুই ইনিংসেই ২টি করে উইকেট পাওয়ার পরও ম্যাচটিতে ১১১ রানে জিতে অস্ট্রেলিয়া সিরিজে সমতা আনল।
ঝামেলা শুরু হলো তৃতীয় টেস্টে। উইকেটকিপার ওল্ডফিল্ড লারউডের বাউন্সারে হুক করতে গিয়ে মিস করায় বল লাগলো মাথায়। হাড়ে সূক্ষ চিড় ধরলো তার, মাঠে লুটিয়ে পড়লেন সাথে সাথেই। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের প্রতি বার্তা পাঠানো হলো, যাতে তারা এই অখেলোয়াড়সুলভ কৌশল বন্ধ করেন। কিন্তু নিয়মের ব্যত্যয় না হওয়ায় ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড তাতে পাত্তা দিল না।
পরের ৩ টেস্টে ব্র্যাডম্যানের রান ছিল যথাক্রমে ৪ ও ৬৬, ৭৬ ও ২৪ এবং ৪৮ ও ৭১। এর মাঝে লারউডের বলেই আউট হলেন ৪ বার। সিরিজে ৫৬.৬৭ গড়ে ৩৯৬ রান করতে পারাটা একজন ব্যাটসম্যানের জন্য মোটেও খারাপ পারফর্মেন্স নয়। তবে ব্যাটসম্যানটা ব্র্যাডম্যান বলেই এত আলোচনা। তাছাড়া সিরিজটাও ইংল্যান্ড জিতে নেয় ৪-১ ব্যবধানে।
পরবর্তীতে সিরিজ জয়ে লারউডের অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন অধিনায়ক জার্ডিনও। ১৯৩৩ সালে নটিংহ্যাম্পশায়ার আর সারের একটি ম্যাচ চলাকালীন ২০ হাজার দর্শকের সামনে জার্ডিন ঘোষণা দেন, লারউডের জন্যই অ্যাশেজ জিতেছে ইংল্যান্ড।
সিরিজে ৫ টেস্টে ১৯.৫১ গড়ে লারউড উইকেট পেয়েছিলেন ৩৩টি। এর সাথে সিরিজের শেষ টেস্টে চার নম্বরে নেমে খেলেছিলেন ৯৮ রানের একটি ইনিংস।
৪.
দেশে ফেরার পর সেই সিরিজের ‘স্টোরি’ কিনে ফেলার জন্য ইংল্যান্ডের প্রায় সকল পত্রিকাই ভিড় জমাল লারউডের কাছে। ‘ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকাটি তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল প্রতি ৩০০ শব্দের জন্য ১০০ পাউন্ড করে! লন্ডনেরই আরেকটি পত্রিকা প্রস্তাব দিয়েছিল শব্দপ্রতি ১ পাউন্ড করে। সেই সময়ের বিবেচনায় প্রস্তাবগুলো যথেষ্ট লোভনীয়ই ছিল।
পরবর্তীতে ‘সানডে এক্সপ্রেস’ তিনি যা লিখলেন, তাতেই বোমাটা ফাটল।
আমার বোলিংয়ে ব্র্যাডম্যান ছিলেন ভীত, উডফুল ছিলেন ধীরগতির। অস্ট্রেলীয় দর্শকেরা ছিল উচ্ছৃঙ্খল এবং শুধুমাত্র নিজের দলের জয় দেখতে আগ্রহী। আমি কখনোই কোনো ব্যাটসম্যানকে আহত করার উদ্দেশ্য নিয়ে বল করিনি। তবে তাদেরকে ভয় দেখানো একটা উদ্দেশ্য ছিল বটে।
লারউডের এই লেখা প্রকাশিত হবার পর, আগেই উত্তপ্ত হয়ে থাকা দুই দেশের ক্রিকেট সম্পর্কের মাঝে আগুন লেগে গেল। ১৯৩৪ সালের সিরিজের আগে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিল যে, বডিলাইন কৌশল আর ব্যবহৃত হবে না। এতটুকু হলেও হয়তো ঠিক ছিল। কিন্তু খেলাটার মাঝে অন্য বিষয় ঢুকে যাওয়াতেই হয়ে গেল সমস্যা। দুই দেশের ক্রিকেট সম্পর্ক ঠিক করতে চেয়ে এমসিসি লারউডকে বলল, বডি লাইন সিরিজের বোলিংয়ের জন্য ক্ষমা চাইতে।
প্রস্তাব শুনে লারউড হতভম্ব হয়ে গেলেন। অথচ এই এমসিসিই লারউডকে অভিনন্দন বার্তা জানিয়েছিল টেস্ট চলার সময়। ‘নিয়মের বাইরে কিছুই করেননি এবং ক্রিকেট মাঠে অধিনায়কের নির্দেশই মানতে হবে’– এই নীতিতে বিশ্বাসী লারউড ক্ষমা চাওয়ার চেয়ে টেস্ট ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়াটাকেই সমীচীন ভাবলেন।
বডিলাইন সিরিজের শেষ টেস্টটাই তাই তার ক্যারিয়ারেরও শেষ টেস্ট হয়ে রইল।
৫.
টেস্ট ছেড়ে দিলেও নটিংহ্যাম্পশায়ারের হয়ে লারউড খেলা চালিয়ে গিয়েছিলেন আরো ৫টি বছর। ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে ১৭.৫১ গড়ে উইকেট পেয়েছিলেন ১,৪২৭টি। এছাড়া ব্যাটসম্যান হিসেবেও করেছিলেন ৭,২৯০ রান, যার মাঝে ৩টি সেঞ্চুরিও ছিল।
১৯৫০ সালে স্ত্রী আর পাঁচ কন্যা নিয়ে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য লারউড চলে আসেন অস্ট্রেলিয়াতে। একসময় যে দেশের ক্রিকেটারদের সাথে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, সেই অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়েরাই ‘সব কিছু খেলার অংশ’ ভেবে তাকে আপন করে নিয়েছিলেন। ডন ব্র্যাডম্যানের সাথেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার।
১৯৯৫ সালের ২২শে জুলাই সিডনির এক হাসপাতালে ৯০ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন লারউড। বডিলাইন সিরিজের কারণে ইতিহাসে কুখ্যাত কিংবা বিখ্যাত হলেও, তিনি ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাবান ফাস্ট বোলারদের একজন। সেই সিরিজের পর তার আচরণই আসলে বলে দেয়, দলীয় আনুগত্য মেনে চলা লারউড হয়তো কোনো ‘অখেলোয়াড়সুলভ’ আচরণ করতে চাননি, ক্রিকেটের সেই যুগে তিনি নিতান্তই কৌশলী হতে চেয়েছিলেন বিশ্বসেরা ব্র্যাডম্যানকে আটকানোর জন্য। ইতিহাস নিশ্চয়ই তাকে মনে রাখবে।