তিনি শেষ হয়ে গিয়েছিলেন। তার এপিটাফ লেখা হয়ে গিয়েছিলো।
তিনি নিজেও বলেছিলেন, তাকে দিয়ে আর হয়তো হবে না। সারা বিশ্ব হাল ছেড়ে দিয়েছিলো তার ব্যাপারে। কেবল নিয়তি হয়তো এমন পরিণতি চায়নি। সর্বকালের সেরা গলফার এরকম শূন্য হাতে, কেবল কেলেঙ্কারি সম্বল করে চলে যাবেন; এটা হয়তো ভাগ্যে লেখা ছিলো না। তাই ধ্বংসস্তুপ থেকে আবার উঠে এলেন তিনি।
হ্যাঁ, আবার একটা শিরোপা জিতলেন এলড্রিক টন্ট উডস; ওরফে টাইগার উডস।
একটা দুটো বছর নয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আবার একটা পিজিএ ট্যুর জিতলেন টাইগার উডস। আটলান্টার ইস্ট লেক গলফ কোর্সে জিতে নিলেন তিনি ক্যারিয়ারের ৮০তম শিরোপা। সেই সাথে প্রমাণ করলেন, কোনো কিছুই মানুষকে শেষ করে দিতে পারে না। আরও একবার ঘুরে দাঁড়ালেন সেই উডস।
নারী কেলেঙ্কারি, গ্রেপ্তার, ড্রাগসের সন্দেহ, চারবারের পিঠে অপারেশন; সব মিলিয়ে গলফ ইতিহাসের সফলতম খেলোয়াড় টাইগার উডস প্রায় হারিয়েই গিয়েছিলেন। এই ছোট্ট একটা পিজিএ শিরোপা হয়তো তার ক্যারিয়ারের তুলনায় কিছুই নয়। কিন্তু এই শিরোপাই উডসকে আবার আলোয় নিয়ে এলো পাঁচ বছর পর।
একটা বৃত্ত পূরণ হলো বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ারের।
সোনালী অপেশাদার ক্যারিয়ার
টাইগার উডসের জন্ম ১৯৭৫ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায়। বাবা আর্ল উডস ভিয়েতনাম যুদ্ধের সৈনিক। আর মা কুটিডা উডস থাইল্যান্ড থেকে আসা একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নারী। এই পরিবারের একমাত্র ছেলে হিসেবে বড় হয়ে উঠেছিলেন টাইগার। তবে দুই পক্ষেরই একাধিক সৎ ভাই-বোন ছিলো তার।
বাবা আর্ল উডস একজন অপেশাদার গলফার ছিলেন। বাবার হাত ধরেই মাত্র দুই বছর বয়সে হাতে প্রথম গলফ স্টিক তুলে নেন টাইগার। মাত্র ৫ বছর বয়সে টাইগার তার গলফ প্রতিভা দিয়ে হৈ চৈ ফেলে দেন। তাকে নিয়ে গলফ ডাইজেস্ট ও এবিসি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে। বিভিন্ন অপেশাদার টুর্নামেন্টে তিনি ওই বয়সেই চমক দেখাতে শুরু করেন।
১৯৮৪ সালে, ৮ বছর বয়সে বিশ্ব জুনিয়র গলফ চ্যাম্পিয়নশিপে ৯-১০ বছর বয়সী বালকদের ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন হন টাইগার। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ অবধি ছয়বার এই চ্যাম্পিয়নশিপে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক ইভেন্ট জেতেন তিনি।
১২ বছর বয়সে পূর্ণাঙ্গ আকারের গলফ কোর্সে খেলা শুরু করেন তিনি। কৈশোরে একটি গলফ প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তার সাথে সাক্ষাত হয় আরেক কিংবদন্তী গলফার জ্যাক নিকলাসের। আর এখানে নিকলাসের কাছ থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শ পান উডস, যেটা তার ক্যারিয়ারে অনেক প্রভাব ফেলে বলে পরে টাইগারের বাবা বলেছেন।
১৫ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন হন। তখন কলেজগুলোর মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হচ্ছিলো, কারা টাইগারকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে পারেন। উডস স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নেন। আর এই প্রতিষ্ঠানকে জেতান অনেকগুলো শিরোপা।
অর্থ ও পেশাদার জীবনের ঝলকানি
২০ বছর বয়সে, ১৯৯৬ সালে টাইগার উডস পেশাদার গলফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সাথে সাথে নাইকি ইনকর্পোরেশন ও টাইটেলিস্ট তাদের সেই সময় অবধি সবচেয়ে দামী চুক্তি করে ফেলে উডসের সাথে। বিশ্ববাজার যেন উডসের আশার অপেক্ষায় ছিলো। উডস এলেন, জিততে শুরু করলেন এবং দেখতে না দেখতে দুনিয়ার সবচেয়ে দামী অ্যাথলেটে পরিণত হলেন।
১৯৯৬ সালে স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড তাদের বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ ঘোষণা করলো উডসকে। ১৯৯৭ সালে উডস নিজের প্রথম মেজর জিতলেন- দ্য মাস্টার্স। এই টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে শিরোপা জিতলেন তিনি। দুই মাসের মধ্যে গলফ দুনিয়ায় ঝড় তুলে বিশ্বের দ্রুততম সময়ে এক নম্বর র্যাংকিংয়ে পৌঁছে গেলেন। উডস তখন যা স্পর্শ করছেন, তাতেই সোনা ফলছে।
২০০০ সালে উডস টানা ছয়টি বড় টুর্নামেন্ট জিতলেন, যা ১৯৪৮ সালের পর গলফ দুনিয়ায় প্রথম দেখা গেলো। এরপর একটার পর একটা রেকর্ড করতে থাকলেন তিনি।
একটার পর একটা করে ১৪টা মেজর জিতে ফেললেন। এই তালিকায় এখনও উডস অবশ্য দুই নম্বরে আছেন। এক নম্বর স্থানটা এখনও দখলে রেখেছেন ১৮ মেজর জিতে জ্যাক নিকলাস। উডস দ্য মাস্টার্স ও ইউএস পিজিএ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন চারবার করে।
এই বছরের শিরোপা জয়ের সাথে সাথে উডসের পিজিএ শিরোপা সংখ্যা দাঁড়ালো ৮০টিতে। এটা সর্বকালের দ্বিতীয় সেরা। স্যাম স্নিড ৮২টি পিজিএ শিরোপা জিতে সবার ওপরে আছেন। তবে মনে রাখতে হবে, উডস আজ থেকে ৫ বছর আগেই ৭৯টি জিতে ফেলেছিলেন।
১৯৮৬ সালে অফিশিয়াল গলফ র্যাংকিং শুরু হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি সময়, ৬৮৩ সপ্তাহ ধরে এটার শীর্ষে ছিলেন টাইগার উডস। তার কাছাকাছি প্রতিদ্বন্দ্বী এক্ষেত্রে গ্রেগ নরম্যান; তিনি ৩৩১ সপ্তাহ শীর্ষে থাকতে পেরেছিলেন। আট বছর টাইগার উডস বছরের পুরো ৫২ সপ্তাহই র্যাংকিংয়ের শীর্ষে ছিলেন। ২০০৫ সালের জুন থেকে ২০১০ সালের অক্টোবর অবধি টানা ২৮১ সপ্তাহ র্যাংকিংয়ের শীর্ষে ছিলেন টাইগার।
ক্যারিয়ারে স্রেফ পিজিএ ট্যুর থেকেই ১১ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি পুরষ্কার জিতেছেন। ফোর্বসের সেরা ধনী অ্যাথলেটের তালিকায় শীর্ষ স্থানগুলোর মধ্যেই ছিলেন লম্বা সময় ধরে।
১৯৯৮ থেকে ২০০৫ অবধি উডস টানা ১৪২টি পিজিএ ট্যুরে কাট পার করেছেন; মানে বাছাই উৎরে চূড়ান্ত দিনের খেলা অবধি গেছেন। এটাও একটা বিশ্ব রেকর্ড।
বিশ্বের গলফ ইতিহাসে মাত্র ৫ জন খেলোয়াড়ের একজন টাইগার উডস, যিনি চারটি মেজরই জিতেছেন। সর্বশেষ মেজর জেতেন তিনি ২০০৮ সালে। আর এখান থেকেই গল্পটা নতুন বাঁক নিতে শুরু করে।
কলঙ্কময় এক জীবন ও যন্ত্রণা
উডসের নারী কেলেঙ্কারির খবরটা বিনা মেঘে বজ্রপাত বললেও কম বলা হয়।
টাইগার উডসকে একটা স্ক্যান্ডালমুক্ত ও নির্বিরোধী মানুষ হিসেবেই দুনিয়া চিনতো। কিন্তু সেই পরিচয়টাই এলেমেলো হয়ে গেলো ২০০৯ সালে এসে।
২০০৩ সালে উডসের বাগদান হয় এলেন নর্ডগ্রিনের সাথে। সাবেক এই মডেলের সাথে ২০০৪ সালে বিয়ে হয় তার। ফ্লোরিডায় বিলাসবহুল বাড়িতে সুখে শান্তিতে জীবন কাটাচ্ছিলেন এই সুখী দম্পত্তি। ২০০৭ সালে তাদের একটি মেয়ে এবং ২০০৯ সালে একটি ছেলে আসে দুনিয়ায়।
সেই ২০০৯ সালের নভেম্বরেই ন্যাশনাল এনকুইরার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, নিউইয়র্কের এক নাইটক্লাবের ম্যানেজারের সাথে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক আছে টাইগারের। এই খবর অস্বীকার করেন উডস। এর কিছুদিন পর তিনি মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটান। ডিসেম্বরে এসে আরও একটি পত্রিকা উডসের চারিত্রিক দুর্বলতা নিয়ে কিছু তথ্য প্রকাশ করে। পরের কয়েক দিনে প্রায় এক ডজন নারী বিভিন্ন পত্রিকায় স্বীকারোক্তি দেন যে, উডসের সাথে তাদের অবৈধ সম্পর্ক ছিলো। এর মধ্যে উডস একটার পর একটা বিবৃতি দিয়ে নিজেকে অসহায় ও দোষী বলে স্বীকার করে নিতে থাকেন।
উডসের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় ২০১০ সালে এসে। গলফ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে থাকেন উডস। তার মানসিক চিকিৎসা চলতে থাকে। ২০১৩ সাল অবধি কোনোক্রমে টুকটাক গলফ খেলতে থাকেন। এর মধ্যে একটা দুটো ছোট শিরোপা জেতেন।
২০১৩ সাল থেকে শুরু হয় নতুন যন্ত্রণা-শারীরিক অসুস্থতা।
একটার পর একটা পিঠের অপারেশন করাতে হয় তাকে। একটা সময় মনে হচ্ছিলো, এত অস্ত্রপচারের ধকল সামলে আর গলফ কোর্সে ফেরা হবে না কখনো। এর মধ্যে ২০১৭ সালে মাদক সেবন করে গাড়ি চালানোর দায়ে গ্রেপ্তারও হন উডস।
একেবারে সর্বশান্ত অবস্থা তখন তার।
আর এখান থেকেই ফিনিক্স পাখির মতো ২০১৮ সালে এসে ঘুরে দাঁড়ালেন। জানালেন, আরেকটা লড়াই করে দেখতে চান। নিজেকে অনেকটাই শুধরে ফিরে আসেন গলফ কোর্সে। স্বপ্ন আবার মেজর শিরোপা জেতা।
আবার মেজর শিরোপা উডস জিততে পারবেন কি না, সেটা সময় বলবে। তবে তিনি ফিরে আসার ইঙ্গিতটা দিয়ে রাখলেন।