উইকেট পাওয়ার পর সেই চিরাচরিত চেনা দৌড়। তারপর মুষ্ঠিবদ্ধ হাত শূন্যে ছুড়ে দেওয়া। একজন ক্রিকেটপ্রেমী হলে আপনি এতক্ষণে বুঝে গেছেন নিশ্চয়ই, কার কথা বলছি। সদ্যই বিশ্বকাপ অভিযান শেষ করে অবসরের ঘোষণা দেওয়া ইমরান তাহির। তার সেই চেনা উদযাপন হয়তো আমরা ক্রিকেটপ্রেমীরা মিস করবো। কিন্তু একজন ইমরান তাহিরের অভাব কতটা অনুভব করবে প্রোটিয়ারা?
সাদা বলের আধুনিক ক্রিকেটে লেগস্পিনার হিসেবে একজন ইমরান তাহির আদতে সর্বেসর্বা। তাহির সম্পর্কে বলতে গিয়ে নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটার ইশ সোধি বলেছেন যে, যদি লেগ স্পিনারদের নিয়ে কোনো হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থাকত, তাহলে সেটির প্রেসিডেন্ট হতেন ইমরান তাহির। শুধুমাত্র সমসাময়িকদের চেয়ে বয়সে বড় সেজন্যই নয়, বরং ইমরান তাহিরই হলেন আধুনিক ক্রিকেটে সাদা বলে লেগ স্পিনারের নতুন জনক।
ইমরান তাহিরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আগমন ২০১১ বিশ্বকাপের আগ মুহূর্তে। ততদিনে ক্রিকেটের ওয়ানডে সংস্করণে লেগ স্পিনাররা বিলুপ্তপ্রায়। মুশতাক আহমেদ কিংবা ওয়ার্নারের সাফল্যেই বিশ্বকাপ ঘরে তুলেছিল পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু সেসব বেশ পুরানো স্মৃতি। বরং তাহিরের অভিষেকের আগের দশ বছরে মাত্র ৫ জন লেগ স্পিনার ৫০-এর উপর ওয়ানডে উইকেট নিয়েছেন, যাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ও ধারাবাহিক ছিলেন শহীদ আফ্রিদি (২১৯ উইকেট)। আর বাকিরা হলেন: ব্র্যাড হগ (১৫৩ উইকেট), উপুল চন্দনা (৭৩ উইকেট), অনিল কুম্বলে (৬৩ উইকেট) ও শচীন টেন্ডুলকার। কিন্তু তাহিরের অভিষেকের পর থেকে বর্তমানে এতদিনে ১০ জন লেগ স্পিনার আছেন, যাদের উইকেটসংখ্যা ৫০ এর উপরে।
২০১১ বিশ্বকাপে মোট ১৪টি দলের মধ্যে মাত্র আটটি দলে আটজন লেগস্পিনার বিদ্যমান ছিল, যার মধ্যে আদিল রশিদ সেই বিশ্বকাপে খেলেননি একটি ম্যাচও। আর সেখান থেকে চলতি বিশ্বকাপে ১০ দলের মধ্যে আট দলেই বিদ্যমান ৯ জন লেগ স্পিনার। তার মানে এই নয় যে, তাহির লেগ স্পিনের বীজ বপন করেছেন বিশ্বজুড়ে, কিংবা লেগ স্পিনারদের জন্য একাডেমি করেছেন তিনি। কিন্তু তাহির তরুণদের জন্য রেখে গেছেন নিজের দেখানো পথ। সোধিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সাবেক কোনো লেগ স্পিনার থেকে কোনো গুণ নিতে চাইলে তিনি কোনটি নিবেন। কোনো নির্দিষ্ট স্কিলের কথা না বলে সোধি বলেছিলেন তাহিরের উদ্যম ও উদ্দীপনার কথা। এর মূল কারণ হচ্ছে, বর্তমানে লেগ স্পিনারদের থেকে আমরা যত কিছু পেয়ে থাকি সবকিছুই ক্রিকেটবিশ্ব প্রথম দেখেছিল তাহিরের হাতের ঘূর্ণিতে। ফ্ল্যাটার, কুইকার ট্র্যাজেক্টরি, বিগ লেগব্রেক, কিংবা গুগলিকে স্টক বলে রূপান্তর করা। এর পাশাপাশি নিজের ‘রহস্য ডেলিভারি’ তো রয়েছেই। এ সবকিছুই সাদা বলে পূর্ণতা পেয়েছে তাহিরের হাত ধরে।
বর্তমানে ক্রিকেট বোলারদের আনূকুল্য থেকে সরে গেছে অনেকখানিই। এই মারকাটারি আধুনিক ক্রিকেটের যুগে খেলার মাঝখানের ওভারে উইকেট পাওয়ার স্বপ্ন এখন প্রায় এক ধরণের বিলাসিতাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পুরো ক্যারিয়ারজুড়েই ইনিংসের মিড ওভারেই উইকেট তুলে নিয়েছেন ইমরান তাহির। শুধু এইটুকু বললে আসলে অন্যায় হয়ে যায় এই প্রোটিয়া লেগ স্পিনারের প্রতি। শুধু মিড ওভারেই নয়, শুরুর পাওয়ারপ্লে’তেও অনেকবার তাহিরকে বল হাতে দেখা গিয়েছে। সেই জায়গাতেও সমানভাবে সফল তিনি।
চারজন ফিল্ডার বাইরে, কিংবা পাঁচজন ফিল্ডার বাইরে, অথবা ব্যাটসম্যান মেরে খেলার ঝুঁকি নিচ্ছে কিংবা নিচ্ছে না, এর কোনোটিই তাহিরের উইকেট পাওয়ার ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বরং ২০১১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে তাহিরের অভিষেকের পর থেকে স্পিনারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেটসংখ্যা এই প্রোটিয়া বোলারের দখলে। তাহিরের ১৭২ উইকেটের বিপরীতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা রবীন্দ্র জাদেজার দখলে রয়েছে ১৪৫টি উইকেট।
এছাড়াও আরো বেশ কিছু রেকর্ড রয়েছে তাহিরের দখলে। ৫৮ ওয়ানডে ম্যাচেই ১০০ উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সবচেয়ে দ্রুত এই মাইলফলক অর্জন করেন তাহির। পাশপাশি দ্রুততম ১৫০ উইকেট নেওয়ার ক্ষেত্রেও কিংবদন্তি অ্যালান ডোনাল্ডকে স্পর্শ করেন এই লেগি। দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছে, এমন ম্যাচে তাহিরের বোলিং গড় ১৮.৪৮। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে কমপক্ষে ৫০ উইকেট নিয়েছেন, এইরকম ২১ জন বোলারের ক্ষেত্রে এদিক দিয়ে তাহিরই রয়েছেন এক নাম্বার স্থানে। দ্বিতীয় থাকা ডোনাল্ডের গড় ১৯.০৫। নিজের ক্যারিয়ারের ৭৮.৫% উইকেট পেয়েছেন জেতা ম্যাচে, যেটি কি না দক্ষিণ আফ্রিকান বোলার হিসেবে নতুন রেকর্ড।
বিশ্বকাপে তাহির ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়েছেন ৪ বার। তার সামনে রয়েছেন শুধু মিচেল স্টার্ক। বিশ্বকাপে ৩৯ উইকেট দখল করে পেছনে ফেলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেট পাওয়া ডোনাল্ডকে (৩৮ উইকেট)। ২০১৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাত্র ৪৫ রানে ৭ উইকেট তুলে নেন তাহির। দক্ষিন আফ্রিকার হয়ে যেটি সেরা ওডিআই বোলিং ফিগার। একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে সাত উইকেট নেওয়ার কীর্তিও গড়েন তাহির। ৩৫ বছরের পর তাহিরের ওডিআই উইকেট সংখ্যা ১৪৬টি, যেখানে এই বয়সের পর ১০০ উইকেটও নেই কারো দখলে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা মুরালিধরনের সংগ্রহ ৮৭ উইকেট।
নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে সর্বমোট ১৭২ উইকেটের মধ্যে ১৩৩টি উইকেটই তাহির নিয়েছেন ইনিংসের মাঝখানে। এক্ষেত্রে মাঝ ইনিংসে উইকেট পাওয়ার দিক দিয়ে স্ট্রাইকরেটে তাহিরের চেয়ে এগিয়ে আছেন মাত্র দুইজন। একজন হলেন রশিদ খান। তবে প্রতিপক্ষের বিচারে রশিদ খান থেকে তাহিরই বেশি বাহবা পাওয়ার দাবিদার। আরেকজন হলেন কুলদীপ যাদব, যেখানে কুলদীপের ক্যারিয়ার সবেমাত্র শুরু। শেষ পর্যন্ত তিনি তাহিরকে পেছনে ফেলতে পারেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে একটি দিক দিয়ে ইমরান তাহির অবিস্মরণীয়। লাল বলে তেমনভাবে পারফর্ম না করেও সাদা বলে একজন দুর্দান্ত লেগি হওয়ার জন্য ইমরান তাহির সবার চেয়ে এগিয়ে। বলা হয়ে থাকে যে, একজনকে পুরোদস্তুর লেগ স্পিনার হতে হলে আগে লাল বলে তার ভেলকি দেখাতে হয়। আর এই ধরণের তত্ত্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ইমরান তাহির হয়ে উঠেছেন সাদা বলের সেরা লেগি।
তবে ক্যারিয়ারকে এভাবে গড়তে পারা দূরে থাক, তাহিরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার স্বপ্নটাও স্বপ্নই থেকে যেত একসময়। লাহোরে জন্ম নেওয়া এই ক্রিকেটারের ছোট থেকেই বেড়ে ওঠা পাকিস্তানে। সেখানেই ক্রিকেটের হাতেখড়ি। সেখান থেকে ভাগ্যের পালাবদলের জন্য পাড়ি জমান দক্ষিণ আফ্রিকায়, যেটি মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। একের পর এক পারফর্ম করার পর অবশেষে নিজের ৩২ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের দরজা খুলে যায় তাহিরের সামনে। সেজন্য তাহির বারবার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন দক্ষিন আফ্রিকাণ ক্রিকেট বোর্ডকে। প্রতিটি উইকেট পাওয়ার পর উন্মত্তভাবে দৌঁড়ে ছুটে চলা, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট লোগোকে ধরে চুমু খাওয়া, সবই তার কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। তাহির জানিয়েছেন, প্রতিটি উইকেটই তার কাছে নিজের প্রথম উইকেট মনে হয়। কারণ, একটা সময় তিনি নিজেও আশা হারিয়ে ফেলেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার স্বপ্ন। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে প্রচণ্ডরকমের প্যাশন নিয়েই তাহিরের পথচলা।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আরো একবারের মতো দেখা গেল সেই দৌঁড়, আরো একবারের মতো সেই গুগলি, কিংবা আরো একবারের মতো কোণাকুণি সেই রানআপ। তারপর বিদায়। তাহিরের চিরচেনা দৌড় সম্পর্কে দক্ষিন আফ্রিকার কোচ ওটিস গিবসন বলেছিলেন যে, প্রতিবার তাহির উইকেট পাওয়ার পরই ভয়ে থাকেন তিনি ও দক্ষিণ আফ্রিকান খেলোয়াড়েরা। এই বুঝি হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়ল তাহির!
তার বিদায়ে হয়তো সেই ভয়ে আর কাউকে থাকতে হবে না। কিন্তু সেই ভয় পাওয়াটাকে মিস করবে দক্ষিণ আফ্রিকা। তার রেখে যাওয়া শূন্যস্থান মিস করবে প্রোটিয়ারা। সর্বোপরি, সাদা বল হাতে এক যুগান্তকারী লেগ স্পিনারকে মিস করবে পুরো ক্রিকেট বিশ্ব।