সময়ের সাথে সাথে ফুটবলে বাড়ছে পেশাদারিত্বের মাত্রা। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফুটবলে অর্থের ঝনাঝনি। এই অর্থের ক্ষমতায় আজ ম্যানচেস্টার সিটি ও পিএসজি একসময়ের সাধারণ অবস্থা থেকে পরিণত হয়েছে বিশাল মহীরুহে। একসময় ফুটবল ক্লাবগুলোর আয়ের উৎস ছিল শুধুমাত্র ম্যাচ থেকে প্রাপ্ত আয়। কিন্তু বর্তমানে টিভিস্বত্ব ও স্পন্সরশিপ থেকে ফুটবল ক্লাবগুলো আয় করছে কাড়ি কাড়ি টাকা। এসবের উপর ভিত্তি করেই বিখ্যাত মার্কিন ম্যাগাজিন ফোর্বস কিছুদিন আগে প্রকাশ করেছে ফুটবলের সবচেয়ে বেশি আয় করা বিশটি ফুটবল ক্লাবের তালিকা।
ফোর্বসের প্রকাশিত তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এই ২০টি ক্লাবের বর্তমান গড় মূল্য প্রায় ১.৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত বছরের থেকে ১৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই বিশটি ক্লাবের গড় আয় ৪২৮ মিলিয়ন ইউএস ডলার, যা পাঁচ বছর আগের গড় আয় থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে ৪০%।
বরাবরের মতো এই তালিকায় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দলগুলোর রাজত্ব বিদ্যমান। তবে প্রিমিয়ার লিগের পাশাপাশি ইতালির সিরি-আ, স্পেনের লা লিগা এবং জার্মানির বুন্দেসলিগার দলও রয়েছে। চলুন এক নজরে দেখে আসা যাক বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দামি ফুটবল ক্লাব কোনগুলো।
১০. টটেনহাম হটস্পার
তালিকার অন্য ৯ দলের সাফল্যের সাথে তুলনা করলে টটেনহাম হটস্পারের অবস্থা নিতান্তই হতদরিদ্র। শেষ শিরোপা (২০০৭-০৮ মৌসুমে লিগ কাপ) এসেছে প্রায় ১০ বছরেরও বেশি সময় হয়ে গেল। তা সত্ত্বেও প্রিমিয়ার লিগে বিগত মৌসুমগুলোতে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের সুবাদে স্পার্সরা টানা দ্বিতীয়বারের মতো সেরা ১০ ধনী ক্লাবের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। বর্তমানে টটেনহাম প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার খরচ করে তৈরি করছে তাদের নতুন স্টেডিয়াম, যা পরবর্তীতে তাদের আয় আরও বাড়িয়ে দিবে বলেই সবার বিশ্বাস।
বর্তমান মূল্য: ১.২৪ বিলিয়ন ডলার
আয়: ৩৮৭ মিলিয়ন ডলার
৯. জুভেন্টাস
তালিকার নবম অবস্থানে রয়েছে ইতালিয়ান জায়ান্ট জুভেন্টাস। একসময় বিশ্ব ফুটবলের ছড়ি ঘুরানো সিরি-আ এখন অনেকটাই নিষ্প্রভ। তবে সিরি-আ’র বর্তমান শোচনীয় অবস্থাতেও আলো ছড়িয়েছে জুভেন্টাস। জিতেছে টানা ৬ বার ইতালিয়ান সিরি-আ। একইসাথে বিগত চার মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগের মধ্যে দুটিতে তারা রানার্স-আপ হয়েছে। এই সুবাদে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের তুলনায় সিরি-আ’র টিভিস্বত্ব থেকে আয় অনেক কম হলেও তারা ফোর্বসের প্রকাশিত তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। বর্তমানে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর আগমনে তাদের আয় আরও বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বর্তমান মূল্য: ১.৪৭ বিলিয়ন ডলার
আয়: ৪৪২ মিলিয়ন ডলার
৮. লিভারপুল
ইয়ুর্গেন ক্লপের ছোঁয়ায় পাল্টে গিয়েছে লিভারপুল ক্লাবের অবস্থা। তার নেতৃত্বে লিভারপুল গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে অংশ নিয়েছে। নতুন টিভিসত্ত্ব চুক্তির কারণে দলটির আয় ২০১০ সালের সাথে তুলনা করলে বেড়েছে দ্বিগুণ। ডেলোয়েটের মতে, এরকম পারফর্ম করতে থাকলে দলটির বাণিজ্যিক আয় এবং ম্যাচ থেকে আয় বৃদ্ধি পাবে। ফলে আগামী বছরের তালিকায় দলটিকে আরো উপরের দিকে দেখা যাবে। গত শীতকালীন দল-বদলের বাজারে ফিলিপে কোতিনহোকে বার্সেলোনার কাছে ১৪২ মিলিয়ন পাউন্ড (২৪৪ মিলিয়ন ডলার) এর বিনিময়ে বিক্রয়ের সুবাদে লিভারপুলের আয় আরো বৃদ্ধি পাবে।
বর্তমান মূল্য: ১.৯৪ বিলিয়ন ডলার
আয়: ৪৬২ মিলিয়ন ডলার
৭. চেলসি
২০১৬-১৭ মৌসুমে ইতালিয়ান কোচ আন্তোনিও কন্তে চেলসিকে এনে দিয়েছিলেন প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা। ফলে চেলসির গত বছরের আয় মোটামুটি ভালো ছিল। তবে গত মৌসুমের হতাশাজনক পারফরম্যান্সের কারণে এই মৌসুমে চেলসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। তাই বড় সম্ভাবনা আছে এই তালিকা থেকে চেলসি ছিটকে পড়ার। এই দুর্দশার মুহূর্তে ক্লাবের আয় বাড়ানোর জন্য অবশ্য চেলসি এনার্জি ড্রিঙ্ক কোম্পানি কারাবাওয়ের সাথে নতুন স্পনসরশিপ চুক্তি করেছে, যাতে কোম্পানিটি চেলসিকে প্রতি মৌসুমে ৩০ মিলিয়ন পাউন্ড করে দিবে।
বর্তমান মূল্য: ২.০৬ বিলিয়ন ডলার
আয়: ৪৬৬ মিলিয়ন ডলার
৬. আর্সেনাল
বিশাল সময় ধরে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা অধরা থাকলেও ধারবাহিকভাবে চ্যাম্পিয়নস লিগে অংশগ্রহণের সুবাদে আর্সেনাল এই তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। তবে তাদেরই আরেক চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চেলসির মতোই এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। ফলে আগামী বছর এই তালিকায় আর্সেনাল নিচে নেমে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। প্রিমিয়ার লিগে আয়ের দিক দিয়ে ৩য় হলেও ফুটবলারদের বেতনের খরচের দিক দিয়ে তাদের অবস্থান ৫ম অবস্থানে। খেলোয়াড়দের পেছনে এত কম খরচ আর্সেনাল ফ্যানদের হতাশার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমান মূল্য: ২.২৪ বিলিয়ন ডলার
আয়: ৫৩১ মিলিয়ন ডলার
৫. ম্যানচেস্টার সিটি
বাণিজ্যিক আয় ও ম্যাচের দিন আয়ের বৃদ্ধির কারণে ম্যানচেস্টার সিটি টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফোর্বসের এই তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। একসময় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ছায়ায় থাকা এই দলটি তাদের মালিক শেখ মনসুরের টাকার সুবাদে অর্থের দিক দিয়ে দিন দিন আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। টিভিস্বত্ব থেকে দলটি ২০১৬-১৭ মৌসুমে আয় করেছিল ২৫৮ মিলিয়ন ডলার, যা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল। পেপ গার্দিওলার দলটি এবারের প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা ঘরে তোলায় আগামী বছরের তালিকায় দলটি আরো উপরের দিকে থাকবে সেটা আশা করা যায়।
বর্তমান মূল্য: ২.৪৭ বিলিয়ন ডলার
আয়: ৫৭৫ মিলিয়ন ডলার
৪. বায়ার্ন মিউনিখ
তালিকায় জার্মান লিগ বুন্দেসলিগার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আছে জার্মান জায়ান্ট বায়ার্ন মিউনিখ। বিশ্বের সব ফুটবল ক্লাবের মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি থেকে সবচেয়ে বেশি আয় করেছে বায়ার্ন মিউনিখ, যা ৩৭৪ মিলিয়ন ডলার। তা সত্ত্বেও তালিকার মাত্র ৪র্থ স্থানে রয়েছে তারা। বিদেশি বিনিয়োগের অভাব ছাড়াও বুন্দেসলিগার টিভিস্বত্ব থেকে নিম্ন আয়ের কারণেই বায়ার্ন মিউনিখ তালিকার সেরা তিনে স্থান করে নিতে পারেনি।
বর্তমান মূল্য: ৩.০৬ বিলিয়ন ডলার
আয়: ৬৪০ মিলিয়ন ডলার
৩. বার্সেলোনা
২০১৮ সালের এপ্রিলে বার্সেলোনা তাদের স্থানীয় সরকার থেকে বার্সেলোনার বিখ্যাত স্টেডিয়াম ক্যাম্প ন্যু-তে সৌন্দর্যবর্ধন ও আসন সংখ্যা বৃদ্ধির অনুমতি পায়। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২১ সালে নতুন রুপ পাবে স্প্যানিশ জায়ান্টদের ঘরের মাঠ। ফলে তাদের আয়ও অনেক বেড়ে যাবে। অন্যদিকে নাইকির সাথে নতুন চুক্তি হয়েছে বার্সেলোনার, যার ফলে প্রতিবছর নাইকি ক্লাবটিকে দেবে ১১৬ মিলিয়ন ডলার, যা যেকোনো ফুটবল ক্লাবের জন্য রেকর্ড। তবে সামনের বছরে বার্সেলোনা এই তালিকাতে আরো উপরে উঠতে পারবে কি না তা অনেক অংশেই নির্ভর করছে চ্যাম্পিয়নস লিগে তাদের পারফরম্যান্সের উপর। অবশ্য গত মৌসুমে লা লিগা এবং কোপা দেল রে জয়ের ফলে বার্সার আয় অনেক বৃদ্ধি পাবে।
বর্তমান মূল্য: ৪.০৬ বিলিয়ন ডলার
আয়: ৭০৬ মিলিয়ন ডলার
২. রিয়াল মাদ্রিদ
টানা ৩ বছর চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার অভাবনীয় রেকর্ড করেছে রিয়াল মাদ্রিদ। এরই সুবাদে রিয়ালের বাণিজ্যিক চুক্তি থেকে আয় বেড়েছে বিশাল পরিমাণে। এমনকি ২০০০ সাল থেকে চিন্তা করলে, রিয়াল মাদ্রিদের আয় প্রতি বছর গড়ে বেড়েছে প্রায় ১১%। আর তাই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনাকে টপকে তালিকার ২য় স্থানে জায়গা করে নিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। দুবাই এমিরেটসের সাথে নতুন চুক্তির ঘোষণা করেছে ১৩ বারের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ী এই দল। এই চুক্তি অনুসারে এমিরেটস রিয়ালকে প্রতি মৌসুমে দেবে ৮২ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২০-২১ মৌসুম পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
বর্তমান মূল্য: ৪.০৯ বিলিয়ন ডলার
আয়: ৭৩৫ মিলিয়ন ডলার
১. ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
ফুটবল যারা খুব একটা অনুসরণ করেন না, তাদের কাছে তালিকার প্রথম ক্লাবের নামটি বিস্ময় সৃষ্টি করার কথা। কিংবদন্তি ম্যানেজার স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের বিদায়ের পরে থেকেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নিজেকে হারিয়ে ফিরছে। তবে মাঠে অবস্থা যা-ই হোক না কেন, মাঠের বাইরে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছড়ি ঘোরাচ্ছে। আর এর পিছে বিশাল অবদান রেখেছেন ক্লাবের বোর্ডের বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট এড উডওয়ার্ড। দলবদলের বাজারে তিনি যতটা ব্যর্থ, বাণিজ্যিক ব্যাপারে তিনি ততটাই সফল। তার নেতৃত্বে রেড ডেভিলদের ২০১৬-১৭ মৌসুমে অপারেটিং আয় ছিল ২৫৪ মিলিয়ন ডলার, যা যেকোনো ফুটবল ক্লাবের তুলনায় প্রায় ৫০% বেশি। ইউনাইটেডের বাণিজ্যিক চুক্তি থেকে আয় ৩৫৪ মিলিয়ন ডলার, যা ইংলিশ ক্লাবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অ্যাডিডাসের সাথে ১০ বছর ব্যাপী ৭৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের চুক্তির কারণে ইউনাইটেডের আয়ের উৎসের শেষ নেই। একইসাথে দলটির আয় বৃদ্ধির অন্য একটি কারণ হচ্ছে উয়েফা ইউরোপা কাপের শিরোপা জয়।
বর্তমান মূল্য: ৪.১২ বিলিয়ন ডলার
আয়: ৭৩৭ মিলিয়ন ডলার
ফিচার ইমেজ: Manutd.com; Stathalon.com; Realmadrid.com