প্রিমিয়ার লিগে ২০২০-২১ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন হওয়া সত্ত্বেও পেপ গার্দিওলা তার ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিকে আরো শক্তিশালী করার জন্য কিছু সাইনিং করান, যাতে তারা এই মৌসুমেও প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা ধরে রাখতে পারেন এবং একইসাথে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার সুযোগ পান। গার্দিওলার অধীনে সিটিজেনরা তাদের ভিন্নতর অ্যাটাকিং প্লেয়িং স্টাইলের জন্য পরিচিত, যা হাতেগোনা কয়েকটি ক্লাব ছাড়া বেশিরভাগ প্রতিপক্ষের উপর তাদের সম্পূর্ণ আধিপত্য বিস্তারে সাহায্য করেছে। তবে গত মৌসুমটা সিটিজেনদের জন্য কিছুটা আলাদাই ছিল বলা যেতে পারে। শুরুটা আশানুরূপ হয়নি, একেবারে মৌসুমের মাঝপথে এসে তারা রাইট ট্র্যাকে ফেরে এবং রক্ষণভাগে উন্নতি করার দরুন নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে পেছনে ফেলে গত ৪ বছরে তাদের তৃতীয় লিগ শিরোপা নিজেদের শোকেসে তোলে।
লিগ শিরোপা জিতলেও গত মৌসুমটা গোল করার দিক থেকে গত ৪ মৌসুমের মধ্যে সবচেয়ে বাজে মৌসুম ছিল। সিটিজেনদের কিংবদন্তি স্ট্রাইকার সার্জিও আগুয়েরোর বিদায় তাদের অ্যাটাকের ভবিষ্যৎ আরো অনিশ্চিত করে তোলে। আগুয়েরোর রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে হ্যারি কেইন আসার কথা থাকলেও স্পার্স তাকে না ছাড়ায় গার্দিওলা এবারও একজন ন্যাচারাল স্ট্রাইকারবিহীন একাদশ খেলাতে বাধ্য হবেন। তবে স্ট্রাইকার কেনা না হলেও ফাইনাল থার্ডে চান্স ক্রিয়েশন বাড়াতে তিনি এবার ইংলিশ ফুটবলে রেকর্ড ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডে অ্যাস্টন ভিলা থেকে জ্যাক গ্রিলিশকে তার দলে ভিড়িয়েছেন। গ্রিলিশ তার সৃজনশীলতা ও টেকনিক্যাল স্কিলের সাহায্যে গোলবারের সামনে প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে ভূমিকা রাখবেন।
সিটির চেকলিস্ট
পূর্বেই বলা হয়েছে, গত চার মৌসুমের মধ্যে গোলস্কোরিংয়ের দিক থেকে গত মৌসুম তাদের সবচেয়ে বাজে কেটেছে। ২০১৭-১৮ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে তারা রেকর্ড সর্বোচ্চ ১০৬ গোল করেছিল। সেই তুলনায় গত মৌসুমে করা ৮৩ গোল নগণ্যই বলা চলে। তবে এটা শুধু শট অ্যাক্যুরেসি কমে আসার ফল নয়। সমান দায়ী গোলের সামনে আগের মতো সুযোগ তৈরির ক্ষমতা হারানো। ২০২০-২১ মৌসুমে প্রতি ৯০ মিনিটে সিটিজেনরা ১৫.০৫টি করে শট নেয়, যা গত পাঁচ মৌসুমের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২০-২১ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে সর্বোচ্চ গোল করলেও তাদের অ্যাটাকিং পারফরম্যান্স আপ টু দ্য মার্ক ছিল না।
তাদের প্রয়োজন ছিল এমন একজনের যে কি না একাধারে ফাইনাল থার্ডে পাসিং অপশন বাড়াবে, ফাঁকা জায়গার সদ্ব্যবহার করবে এবং একইসাথে সরাসরি আক্রমণও তৈরিতে সহায়তা করবে। রাহিম স্টার্লিং ও ফিল ফোডেন ওয়াইড এরিয়া থেকে থ্রেট যোগালেও অতিরিক্ত একজন ক্রিয়েটিভ ফুটবলারের অভাব ছিল যে ফ্রন্টলাইনে থ্রু-বল ও ফরোয়ার্ড পাস দেবে এবং প্রতিপক্ষকে তাদের পজিশন থেকে ড্র্যাগ করবে।
ক্রিয়েটিভিটি বাদে সিটির আরো একজনের দরকার ছিল যে স্টেপ-আপ করে চান্সগুলোকে গোলে কনভার্ট করবে, বল হোল্ড করার ক্ষমতা রাখবে, যার দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা খুবই ভালো, এবং যে ডিফেন্ডারদের ড্রিবল করে শট নেওয়ার সক্ষমতা রাখে। এছাড়াও পজিশনালি ফ্লেক্সিবল, আক্রমণভাগের অন্যান্যদের সাথে কম্বিনেশন তৈরি করতে পারে, এমন একজন লাগতো তাদের।
গার্দিওলার দলের ফুটবলারদের উইথ দ্য বলে ভালো হওয়ার সাথে সাথে অফ দ্য বলেও যথেষ্ট ভালো হতে হয়, কারণ তিনি এমন ফুটবলারদের পছন্দ করেন যারা স্পেসের সদ্ব্যবহার করতে জানে ও যাদের পজিশনাল সেন্স ভালো।
গত মৌসুমে তার দলে ভালো পাসিং স্ট্রাকচার ও রক্ষণ ভাঙতে সক্ষম এবং ফাইনাল থার্ডে অতিরিক্ত অপশন যোগানোয় দক্ষ একজনের অনুপস্থিতি বারবারই টের পাওয়া গেছে। কোচের স্টাইলের সাথে মানিয়ে নিতে নতুন সাইনিংকে শুধু বল প্রোগ্রেশনেই ভালো যথেষ্ট নয়, গোলের সামনে থ্রেট ক্রিয়েট করতেও সমান দক্ষ হতে হতো।
গ্রিলিশেই সমাধান?
গ্রিলিশ যে পজিশনেই খেলুন না কেন, তিনি অফ দ্য বলে সবসময়ই মুভ করতে থাকেন এবং ফাঁকা স্পেসে বল রিসিভের চেষ্টায় থাকেন। সমানভাবে প্রতিপক্ষকে নিজের দিকে টেনে রাখা, প্রেশার রিলিজ ও চান্স ক্রিয়েশনে ভালো। তার ড্রিবলিং অ্যাবিলিটি ও চেঞ্জ অফ পেসের কারণে বল প্রোগ্রেশনেও অসাধারণ এবং বল দখলে ভূমিকা রাখতেও সক্ষম। তার পজিশনাল সেন্স ও ক্রিয়েটিভিটির জন্য তিনি মোটামুটি তিনটি রোলে খেলে অভ্যস্ত – নাম্বার এইট, নাম্বার টেন ও লেফট উইংগার।
গ্রিলিশ আক্রমণভাগের গতি মুহূর্তের মধ্যেই বদলে দিতে সক্ষম। পজিশনিং এবং ফাইনাল থার্ডে অপশন যোগানোতেও তিনি দক্ষ। ম্যাচ চলাকালীন সাধারণত হাফ স্পেসগুলোয় থাকলেও সেন্ট্রালি মুভ করে নাম্বার টেন পজিশনেও যান। এভাবেই বিটুইন দ্য লাইন ও ফ্রন্টলাইনের মধ্যকার যোগাযোগও দারুণভাবে প্রভাবায়িত করেন। অ্যাডভান্সড এরিয়ায় বল ডেলিভারি ও বল প্রোগ্রেশনে তার মুভমেন্ট মূখ্য ভূমিকা রাখে।
সিটির আক্রমণভাগ সবসময়ই অবিরতভাবে অবস্থান পরিবর্তন করতে থাকে। তাই গ্রিলিশের জন্য মুভ করা ও তার সতীর্থদের বুদ্ধিদীপ্ত পাস দেওয়াও অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। তার লিংকআপ প্লে ভালো হওয়ায় এগিয়ে আসা ফুলব্যাকদের সাথে জুটি গড়ে করে ওয়াইড এরিয়াগুলো দিয়ে বল এগিয়ে নিতে পারেন, তারপর তার নিয়ন্ত্রণ ও বল দখলে রাখার সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সুযোগ তৈরি করেন।
তার প্রোগ্রেসিভ রানগুলো প্রতিপক্ষের ডিফেন্সের প্রথম দুই লাইন ব্যর্থ করে বক্সের কিনারায় বল পাঠাতে সাহায্য করবে। গ্রিলিশকে আটকাতে তৈরি হওয়া ডিফেন্সের মাঝের গ্যাপ কাজে লাগিয়ে কিংবা অন্যান্য ফরোয়ার্ডদের সাথে সেন্ট্রালি ওয়ান-টাচ খেলে কম্বিনেশন তৈরি করে সুযোগ তৈরি করবেন। তার ড্রিবলিং সামর্থ্য তাকে একজন ভালো বল ক্যারিয়ার বানিয়েছে, আবার পজেশন রিটেইনের ক্ষেত্রেও দক্ষ বানিয়েছে।
তার মুভমেন্ট মাঠে সতীর্থদের প্রভাব কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। ইন বিহাইন্ডে তার উপস্থিতি ও অফ দ্য বল মুভমেন্ট বল রিলিজ ও পজেশন রিটেইন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তার দারুণ সব পাস ছাড়াও লো ব্লকে খেলা দলগুলোর বিপক্ষে ভালো পাসিং আউটলেট হিসেবে কাজ করতে পারেন।
প্রতিপক্ষদের ড্র্যাগ করে জায়গা তৈরি করে নিতে বিশেষ পারদর্শী গ্রিলিশ। সিটির জন্য এটা খুবই ভালো হবে, কারণ তাদের সেই স্পেস এক্সপ্লয়েট করে গোলের সুযোগ তৈরি করার মতো মানের খেলোয়াড় রয়েছে। অ্যাস্টন ভিলার মতো ক্লাবে খেলা সত্ত্বেও তার গোল কন্ট্রিবিউশন দারুণ ছিল, যা থেকে আশা করা যায় সিটিতে তার গোল কন্ট্রিবিউশন আরো বেশি হবে; কেননা, সিটিজেনদের হয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি মানসম্পন্ন খেলোয়াড়দেরকে পাশে পাবেন তিনি। স্টার্লিং-ফোডেনদের সাথে খেলার পূর্ব অভিজ্ঞতাও সিটিতে তার মানিয়ে নেওয়া অনেক সহজ করে দেবে।
ডি ব্রুইনার সাথে তার পার্টনারশিপজুটি সিটির সৃজনশীলতাকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। দু’জনের পাসিং রেঞ্জই অসাধারণ, দু’জনেই কী-পাস দেওয়ায় দক্ষ। দু’জনে একে অন্যের মুভমেন্টকে পূর্ণতা দান করতে পারলে সিটি তাই দারুণ কিছু প্রত্যাশা করতেই পারে। উপরন্তু, গ্রিলিশের ক্রসিং অ্যাবিলিটিও যথেষ্ট ভালো, যার ফলে প্রতিপক্ষের বক্সে ওভারলোড করে সিটির খেলোয়াড়েরা গোলের সুযোগ আরো বেশি পাবেন।
২৫ বছর বয়সী গ্রিলিশের প্লেয়িং স্টাইলের আরেকটি পজিটিভ দিক হচ্ছে, তিনি অনেক বেশি ফাউলের শিকার হন – যা সিটিজেনদের সেট পিস সুবিধা বাড়িয়ে দেবে কয়েকগুণ। গত মৌসুমেও প্রিমিয়ার লিগে সবচেয়ে বেশি ফাউলের শিকার হয়েছেন তিনিই।
ভিলাতে গ্রিলিশের প্রভাব ছিল অসাধারণ। গত মৌসুমে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ভিলাকে লিগে ১১তম অবস্থানে শেষ করানো গ্রিলিশ ৬ গোলের পাশাপাশি ১০ অ্যাসিস্টও করেছিলেন। অ্যাস্টন ভিলার ট্যাকটিক্স ও তার পাশে কেমন সতীর্থ পেয়েছেন, এসব বিষয় মাথায় রাখলে বলাই বাহুল্য, সিটিতে সাফল্য পাওয়াটা তার জন্য নেহায়েতই সময়ের ব্যাপার হওয়ার কথা।
পরিসংখ্যান যা বলে
যদিও গ্রিলিশ গোল করার চেয়ে করাতেই বেশি পছন্দ করেন, তবু গোলবারের সামনে তিনি বিশাল এক হুমকি। গত মৌসুমে প্রতি ৯০ মিনিটে তার নেওয়া ১.৯৪টি শট অন্তত তা-ই বলে। তার শট ও গোলের বেশিরভাগই এসেছে পেনাল্টি এরিয়ার ভেতর থেকে, আরো পরিষ্কারভাবে বললে লেফট হাফস্পেস থেকে। সিটিজেনদের এত ভালো পাসারদের পাশে পেয়ে এই সংখ্যাটি যে আরো বাড়বে, তা অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
প্রতি ৯০ মিনিটে তার করা ২.৯টি শট অ্যাসিস্ট সতীর্থদের জন্য তার অবিরত চান্স ক্রিয়েট করাকেই নির্দেশ করে। সাধারণ শর্ট পাস হোক কিংবা থ্রু বলের মাধ্যমে হোক, গ্রিলিশ সবসময়ই তার সতীর্থদের খুঁজে ফেরেন মাঠে।
তার ড্রিবলিং সামর্থ্য তাকে বল এবং চাপ দুটোই ধরে রাখতে সাহায্য করে। প্রতি ৯০ মিনিটে ৮.০৮ ড্রিবল অ্যাটেম্পট ও ৭০.৮% সাকসেস রেট নিয়ে প্রিমিয়ার লিগে গত মৌসুমে তিনি ছিলেন সেরা ড্রিবলারদের একজন। প্রায়ই ডিপে নেমে বল খুঁজে নিয়ে পরবর্তীতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পছন্দ করেন তিনি। প্রতি ৯০ মিনিটে তার ৫.৭২টি প্রোগ্রেসিভ রান গার্দিওলার গতিশীল স্টাইল অফ প্লে’র সাথে নিখুঁতভাবেই যায়। ম্যাচপ্রতি তার ক্রসসংখ্যা ২.১৭টি, যা প্রমাণ করে একইসাথে সেন্ট্রালি ও আউট ওয়াইডে ভালো করতেও সক্ষম তিনি। গত মৌসুমে ম্যাচপ্রতি তার ৪.১২টি করে ফাউলের শিকার হওয়াও প্রমাণ করে, ফাইনাল থার্ডে দলের জন্য তিনি হবেন দারুণ এক অস্ত্র।
গ্রিলিশ অ্যাস্টন ভিলায় ছিলেন যেন একজন ‘মিসফিট’; যার খেলার মান বরাবরই ভিলার সামগ্রিক খেলার মানের তুলনায় বেশ উঁচু পর্যায়েই থাকত। গার্দিওলা ভালোভাবেই জানেন, কীভাবে একজনের থেকে তার সেরাটা বের করা যায়। তাই গ্রিলিশের ক্ষেত্রেও যে এর ব্যতিক্রম হবে না, এবং তিনি যে এবার কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফুটতে পারবেন, এই আশাতেই নিশ্চয়ই বুক বাঁধবে সিটিজেনরা!