একটা সময় অবধি বাংলাদেশের সফলতম অধিনায়ক ছিলেন হাবিবুল বাশার। তার রেকর্ড মাশরাফি-সাকিবরা টপকে গেছেন; কিন্তু বাংলাদেশের যুগসন্ধিক্ষণের নায়ক হিসেবে এখনো অম্লান বাশার। ছোট দল থেকে ‘জায়ান্ট কিলার’ হয়ে ওঠা বাংলাদেশ দলের নেতা ছিলেন তিনি। এখনো আছেন ক্রিকেটের সাথেই। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের নির্বাচক কমিটির সদস্য তিনি।
খেলোয়াড় ও নির্বাচক হিসেবে তার অভিজ্ঞতা, সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে রোর বাংলার সাথে কথা বলেছেন হাবিবুল বাশার।
খেলোয়াড়ি জীবনের সাথে নির্বাচক জীবনের পার্থক্য কতটা?
পুরোপুরি ভিন্ন। তবে একটা মিল হলো, যখন ক্যাপ্টেন ছিলাম, তখনো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকতে হতো। এখনো থাকতে হয়। এটুকুই। কিন্তু পার্থক্যটা অনেক বেশি। তখন অনেক বেশি সক্রিয় জীবন যাপন করতাম। এখন অনেকটাই বসে বসে কাজ করতে হয়। তখন অনেক কিছুই আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন অনেকটা পর্দার পেছনে বসে কাজ করতে হয়। এখানে সবকিছু আমার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। নিয়ন্ত্রণ বলতে, আমি এখন একটা ছেলেকে নির্বাচন করলাম, কিন্তু সে পারফর্ম করবে কি না, এটা আমার ওপর আর নির্ভর করে না। সে যদি কিছু করতে পারে, মনে হয় সফল হয়েছি। নইলে মনে হয় ব্যর্থ হলাম। যখন খেলায় ছিলাম, তখন অন্তত আমার পারফরম্যান্সটা আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল।
যখন অধিনায়ক ছিলেন, ব্যর্থতার মতো সাফল্যেও আপনাকে মনে করা হতো। সংবাদ সম্মেলনে আসতেন। এখন কি সেই জীবনটা মিস করেন? মনে হয় যে, কিছু একটা পাচ্ছি না?
আসলে খেলোয়াড়ি জীবনের মতো তো কিছুই না। খেলোয়াড়ি জীবনের সাথে কোনো কিছুর তুলনা চলে না। ওই জীবনে অনেক প্রাপ্তি থাকে, অনেক দায়িত্ব থাকে। ওখানে উপভোগ করার ব্যাপার থাকে। খেলাটা তো স্রেফ আমার আবেগ ছিল না; ওটা আমার ভালোবাসাও ছিল। আপনি যেটা বললেন, এটা নির্বাচক হওয়ার সময় জেনেই তো হয়েছি। আমরা যাকে নির্বাচন করবো, সবসময় সে ভালো করবে না; এটাই স্বাভাবিক। আর তেমন ক্ষেত্রে সমালোচনা হবে। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে একটু হতাশ লাগে। তারপরও আমার কাছে যেটা মনে হয়, আমি খুব সৌভাগ্যবান যে, ক্রিকেটের সাথে থাকতে পারছি। ক্রিকেট ছাড়া জীবনে আর কিছু তো শিখিনি। ফলে এখানে থাকতে পারাটাই একটা বড় তৃপ্তি।
নির্বাচক হিসেবে একটু বলুন, জাতীয় দলে এই যে তরুণরা ব্যর্থ হচ্ছে, তারা সেই অর্থে সিনিয়রদের পাশে দাঁড়াতে পারছে না; এটা কি নির্বাচকদের ব্যর্থতা নয়?
আমি এটাকে নির্বাচক কমিটির ব্যর্থতা বলবো না। কারণ, যাদের এই সময়ে পারফর্ম করার কথা ছিল, তারা এসে এখন পারফর্ম করতে পারছে না। ফলে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এদের অভিষেক কিন্তু হয়েছে তিন-চার বছর আগে। ফলে এরা নতুন নয়। এরা শুরুতে পারফর্ম করেছেও। তাই এদের এখনকার ব্যর্থতাটাকে নির্বাচক কমিটির ব্যর্থতা ঠিক বলা যাবে না। তবে আমি ইতিবাচক কথা বলতে চাই। আমাদের পাইপলাইনে এখন অনেক খেলোয়াড়। আমি খুবই আশাবাদী। সম্প্রতি ‘এ’ দলেও অনেককে দেখে আসলাম। আমরা খুব দ্রুত পরিস্থিতির পরিবর্তন দেখতে পাবো।
আপনার খেলোয়াড়ি জীবনে আসা যাক। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে সন্তুষ্ট?
না, সন্তুষ্ট বলা যাবে না। আরো ভালো হওয়া উচিত ছিল।
আরো বেশি রান হওয়া উচিত ছিল?
হ্যাঁ, আরো বেশি রান হওয়া উচিত ছিল, আরো বড় ইনিংস খেলা উচিত ছিল। কিছু কিছু অসমাপ্ত ইনিংস অবসর সময়ে আমি মাঝে মাঝে মনে মনে খেলি। এটা আমার বড় একটা অবসর বিনোদন। তখন বুঝতে পারি যে, এরকম না খেলে ওরকম খেললে ইনিংসটা আরো বড় হতে পারতো। এই অতৃপ্তি তো থাকবে। তারপরও যখন আবার চিন্তা করি যে, যে সময়টা আমরা পার করেছি, যে সময়ে খেলেছি; খুব একটা খারাপ মনে হয় করিনি। নাকি? সেই তৃপ্তি তো আছেই।
অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশের একটা যুগ বদলের সময় দায়িত্বে ছিলেন আপনি। এটা আপনাকে গর্বিত করে?
অবশ্যই। এটা একটা গর্বের ব্যাপার যে, বাংলাদেশের একটা যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে ছিলাম আমি। অনেক খেলোয়াড়কে, যারা এখনকার দলের মূল খেলোয়াড়, তাদের আসতে দেখেছি। এরা আরেকটু আগে এলে মনে হয় আমার দলটা আরেকটু ভালো করতো (হাসি)। সাকিব, তামিম, মুশফিকদের শুরু হয়েছে আমার ওই সময়টায়। আমি এভাবে ভাবি, যে সময় শুরু করেছিলাম, আর যে সময় শেষ করেছি; এই সময়ে যে উন্নতিটা হয়েছে তা অবশ্যই তৃপ্তিদায়ক।
অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই সময়ের পাওয়া সেসব জয়ের কথা মনে পড়ে?
অবশ্যই। মনে না পড়লেও সমস্যা নেই। কেউ না কেউ মনে করিয়ে দেয়। এর মধ্যে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে লম্বা সময় পর আমরা প্রথম যে ম্যাচটা জিতলাম জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, ওটা খুব জরুরি ছিল। সেই ম্যাচের পর থেকে কিন্তু আমরা জিততে শুরু করলাম। এর আগে ব্যাপারটা ছিল এরকম- ভালো খেলে হেরে গেলেও সমস্যা নেই। কিন্তু সেই সময় থেকে আমাদের মধ্যে এই চিন্তাটা এলো যে, শুধু ভালো খেললেই চলবে না, ভালো খেলার উদ্দেশ্য হচ্ছে জেতা। ভালো খেলে হেরে যাওয়াটা যে গর্বের বিষয় নয়, সেটা বুঝতে পারছিলাম।
কেমন ছিল সেই জয়গুলোর অনুভূতি?
প্রথম প্রথম তো অনেক বড় ব্যাপার ছিল। আমরা সেই সময় জিতলেই হেডলাইন হয়ে যেত। অস্ট্রেলিয়ার সাথে জেতার পর মনে আছে, মিনিট পাঁচেক ধরে স্রেফ চিৎকার করেছিলাম। কিন্তু ২০০৬ সালের দিকে এসে আমাদের উপলব্ধিটা হলো যে, এখন আমাদের এ ধরনের জয় নিয়মিত পাওয়া উচিত। আমরা ভালো করছি, ঠিক আছে। তখন বড় দলগুলো কিন্তু আসলেই অনেক বড় দল ছিল। সেই অস্ট্রেলিয়া, সেই দক্ষিণ আফ্রিকা, সেই ভারত, সেই পাকিস্তান, এমনকি শ্রীলঙ্কাও; এখনকার যার যার দলের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। ফলে এদের বিপক্ষে জিততে পারাটা তো বড় ব্যাপার ছিলই। কিন্তু আমরা ভাবছিলাম, জয়টা এতো অনিয়মিত হলে চলবে না।
বিভিন্ন সময় অধিনায়কত্ব নিয়ে মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকদের সাথে কথা হয়েছে। তারা সবাই আপনাকে দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক বলে মনে করেন। আপনি নিজে নিজের অধিনায়কত্বটা কীভাবে দেখেন?
নিজের পারফরম্যান্স, ক্যাপ্টেন্সি এগুলো নিজে মূল্যায়ন করা খুব মুশকিল। আমি খুশি যে, এই প্রজন্মের ক্রিকেটাররা অধিনায়ক হিসেবে আমাকে মনে রেখেছে। এটা আমার ক্রিকেট জীবনের সবচেয়ে বড় পুরষ্কার বলতে পারেন। অনেক বড় তৃপ্তি। আসলে একটা মানুষ যখন খেলা ছাড়ে, আর কোনো কিছুই তো তার সঙ্গে যায় না। সে চায়, এরকম কোনো একভাবে তাকে যেন মনে রাখা হয়। সবাই এটাই চায়। আমি খুব খুশি যে, আমাকে কিছু একটা হিসেবে মনে রাখা হয়েছে।
অধিনায়ক হিসেবে আপনার শক্তিটা কী ছিল?
ক্যাপ্টেন হিসেবে আমি আমার দলের শক্তিমত্তা আর দুর্বলতা, এই দুটো জিনিস জানতাম বলে মনে হয়। আর একটা ব্যাপার, আমি দলে কখনো কাউকে আলাদা করে দেখিনি। অবশ্যই সবার কিছু পছন্দ-অপছন্দ থাকে। কিন্তু আমার চেষ্টা ছিলো, সেই পছন্দ বা অপছন্দ যেন আমার অধিনায়কত্বে প্রভাব না ফেলে। এমনও উদাহরণ আছে যে, আমি জানি কেউ একজন আছে, যে আমাকে পছন্দ করে না বা আমার অধীনে খেলতে চায় না। কিন্তু দলের প্রয়োজন যেহেতু, সে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হলে আমি তাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। আমার জন্য দলটাই প্রথম ব্যাপার ছিল। আমার মনে হয়, এটা আমাকে খুব সাহায্য করেছিল। আমি মনে করি, শেষ অবধি সবাই আমাকে বুঝতে পেরেছিল।
২০০৭ বিশ্বকাপটা আপনার জন্য বিচিত্র একটা অভিজ্ঞতা ছিল। দল ইতিহাস গড়া পারফরম্যান্স করলো, আপনি ব্যাট হাতে ভালো করতে পারলেন না। ফলে ক্যারিয়ারটাও আর বেশি লম্বা হলো না। এ নিয়ে আফসোস আছে?
অনেক আফসোস আছে। দেখুন, ব্যক্তিগতভাবে আমার ক্যারিয়ার আরো লম্বা না হওয়ার একটা বড় কারণ ছিল ২০০৭ বিশ্বকাপের আগে আমরা ১৪ মাস টেস্ট ক্রিকেট খেলিনি। যেটা একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে আমার জন্য খারাপ ছিল। আবার ওয়ানডের কথা যদি বলেন, ২০০৬-০৭ সালে কিন্তু আমি বিশ্বকাপের আগে অবধি ভালো ব্যাটিং করেছিলাম। কিন্তু ওই টুর্নামেন্টটায় আমি ভালো করতে পারিনি। টিম অসাধারণ খেলছিল। এমন হয়েছে যে, ওয়েস্ট ইন্ডিজে বসে আমি বিদেশি পত্রিকায় বলছি দলের সাফল্যের রহস্য এবং দেশি পত্রিকায় বলতে হচ্ছে আমার ব্যর্থতার কারণ।
আসলে আপনার ভেতরে সমস্যাটা কী হচ্ছিল সেই সময়?
আমার দিক থেকে যেটা সমস্যা ছিল, আমি সেই সময় যা যা হচ্ছিল, তা খুব বেশি ভেতরে নিয়ে ফেলেছিলাম। মেনে নিতে পারছিলাম না। অধিনায়কত্ব চলে গেল, সমালোচনা হচ্ছিল। এগুলো মেনে নেওয়া উচিত ছিল। আসলে একজন খেলোয়াড় হিসেবে এটার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। আমি আগে এরকম পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছি। খারাপ খেললে সমালোচনা হবে, অধিনায়কত্ব চলে যাবে, এগুলো খেলারই অংশ। আমি সেই সময় সেটা মেনে নিতে পারিনি।
তার মানে সেই সময়টায় মানিয়ে নেওয়া উচিত ছিল বলছেন?
অবশ্যই। সেটাই হওয়া উচিত ছিল। সারা জীবন তো অনেক ফাইট করেছি। আমার আর কোনো গুণ না থাক, আমি লড়াই করতে পারতাম। সেটাই সে সময় আর পারিনি। আমার ভেতরে ভেতরে এত প্রতিক্রিয়া হয়েছিল যে, তার প্রভাব ব্যাটিংয়ে পড়েছিল। ফলে সবকিছু মিলিয়ে আর লম্বা হলো না ক্যারিয়ারটা।
আইসিএলে যাওয়াটা কি একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল?
তখন তো আসলে আমার ক্যারিয়ার শেষ। তখন আমি বসেই আছি। প্র্যাকটিস করতাম, টিমে থাকতাম না। আমাকে একরকম বলেই দেওয়া হয়েছিল যে, আমার আর তেমন সুযোগ নেই। আমি যদি সেই সময় একটা টেস্টও খেলতে পারতাম, তাহলে আইসিএলে যেতাম না। তখন অবসর নিয়ে অনেকেই আইসিএলে যাচ্ছে।
হাবিবুল বাশারকে কীভাবে মানুষ মনে রাখবে? আপনি কী আশা করেন?
মানুষ মনে রাখবে কি না, সেটা তো আমি নিশ্চিত করতে পারি না। তবে আমি চাই, বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলেছিলাম, আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছিলাম; এভাবে মানুষ মনে রাখুক। জাতীয় দলের একজন সাধারণ খেলোয়াড় হিসেবে মানুষের মনে থাকতে পারলেই আমি খুশি।
ফিচার ছবি- AFP