ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় স্প্যানিশ ফুটবলের খুব ভালো নামডাক রয়েছে একটি দিকে। তা হচ্ছে মুড়ি-মুড়কির মতো মিডফিল্ডার তৈরিতে। অন্যান্য এলাকার চাইতে শুধু এই স্প্যানিশ উপদ্বীপ থেকে অধিক মানসম্পন্ন মিডফিল্ডাররা বের হন। এবং তাদের এই কৃতিত্ব আরো দারুণভাবে ফুটে উঠেছিল ২০১০ বিশ্বকাপের সময়। ২০১০ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় বাছাইয়ে উরুগুয়ের ডিয়েগো ফোরলান ছিলেন সবার চেয়ে এগিয়ে। তার এই পদক নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিল না। তবে সেখানে যদি ফোরলান না পেয়ে জাভি বা ইনিয়েস্তাও পেতেন, সেখানে এই নিয়ে কোনো তর্ক করাও যেত না। কারণ ফোরলান যেমন দাবিদার ছিলেন, তার চেয়ে খুব কম দাবিদার এই দুইজন ছিলেন না।
তবে এই দুইজনের বাইরেও আলোচনা উঠে আসবেন আরো একজন, যার কারণে জাভির করা ফ্লিকগুলো অ্যাসিস্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, যিনি কি না স্পেনের ৮০% গোল একাই করেছিলেন ফাইনালের পথে, যিনি তৎকালীন বিশ্বের তৃতীয় সেরা ফুটবলারেরও দাবিদার ছিলেন। হয়তো তিনি অমরত্ব পাননি ইনিয়েস্তার মতো, ইনিয়েস্তা যেমন স্পেনের বিশ্বজয়ী মুহূর্তের পোস্টারে অমর হয়ে রয়েছেন। এমনকি ইনিয়েস্তার এই গোলটির সময় তিনি মাঠেই ছিলেন না। তবুও স্প্যানিশদের এই বিজয়ে তার কৃতিত্ব থাকবে অবশ্যই বাকি সবার উপরে। কারণ তিনি একা যদি স্পেনের আক্রমণভাগকে সেমিফাইনাল পর্যন্ত না টেনে আনতেন, তবে আমরা এখনো স্পেনের মনোগ্রামের উপর সোনালী তারকাটির দেখা পেতাম না।
২০১০ বিশ্বকাপের মেডেল তার জন্য ছিল ক্যারিয়ারের সবচেয়ে মূল্যবান অর্জন। এই অর্জনের পথ তার জন্য মোটেও সহজ ছিল না। এক দশক পূর্বে ট্রান্সফার মার্কেটের অবস্থা কেমন ছিল তা একটু ভেবে দেখুন। সেই অবস্থায় বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র ২৩ দিন পূর্বে ৫০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তাকে দলে ভেড়ায় বার্সেলোনা। তাদের বিশ্বকাপ অভিযানের শুরুতে সবাই তাদের খেলার ধরন সম্পর্কে জানত। এই একই দলটিই তো ২০০৮ সালের ইউরো জিতে এল। তাদের বল পায়ে রেখে খেলে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি রীতিমতো ফুটবল বিশ্বে একটি নতুন চ্যালেঞ্জের সূচনা জাগায়। তবুও এই দলটিকে প্রথম ম্যাচেই স্তব্ধ করে দেয় সুইজারল্যান্ড। ১-০ গোলে স্পেনকে হারিয়ে দেয় তারা।
টুর্নামেন্ট শুরুর পূর্বে স্পেনের এই খেলার ধরন অনেক প্রশংসিত ছিল। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের সাথে এই খেলায় খেলোয়াড়রা ছিলেন একদম ঘুমন্ত ফর্মে। প্রথম ম্যাচে প্রচুর সুযোগ মিস করে ফেলে ভিয়া। প্রাইস ট্যাগের ভার যে নিতে পারছিলেন না, তা ছিল স্পষ্টই। একজন ৫০ মিলিয়নের স্ট্রাইকারের কাছ থেকে মানুষ যা আশা করে, ভিয়া প্রথম খেলায় তা থেকে ছিলেন যোজন যোজন দূরে। ভিয়া কিন্তু স্পেনের দলে এসেছিলেন রাউল গঞ্জালেসের জায়গায় ৭ নাম্বার জার্সি নিয়ে। এহেন খেলার পর এই সংযুক্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠে।
এই সিদ্ধান্তটি এসেছিল স্পেনের ২০০৮ ইউরোজয়ী কোচ লুইস আরাগোনাসের কাছ থেকে। তিনি প্রথম রাউলকে বাদ দিয়ে স্প্যানিশ উপদ্বীপে বিতর্কের আগুনের সূত্রপাত ঘটান। কিন্তু তার পরিকল্পনা ছিল সুদূরপ্রসারী। তিনিই দলটিকে পুরোপুরি টিকিটাকা বা ছোট পাসে খেলায় নিয়ে আসেন। তার পরিকল্পনায় ছিল স্পেনের এমন মিডফিল্ডার প্রোডাকশনকে কাজে লাগানো।
পরের খেলায় ভিয়া ফিরে যান নিজের অতীতে। কাজে লাগান অতীত থেকে পাওয়া শিক্ষাকে। ভিয়া পুরোপুরি ‘নাম্বার নাইন’-এর মতো খেলতে পারবেন না। তার খেলার ধরনই একটু বামে নিচে থেকে উপরে উঠে আসা। সুইজারল্যান্ডের সাথে ভুল করলেও এবার হন্ডুরাসের সাথে কোচ এই ভুল করলেন না। তিনি ভিয়াকে একটু বাম থেকে উঠে আসার লাইসেন্স দিলেন। ফলাফল আসতে মোটেও দেরি হয়নি।
এই ম্যাচের ভিয়ার থেকে আমরা কী কী পেয়েছিলাম? পায়ে বল নিয়ে আলতো টোকায় এবার ভিয়া নিজেই বল নিয়ে উপরে উঠতে শুরু করেন। নিজের দুর্দান্ত ড্রিবলিং দিয়ে দুই-তিন টোকায় পরাস্ত করতেন ডিফেন্ডারকে। দুই ডিফেন্ডারের মাঝে দিয়ে বল নিয়ে দিতেন টান। ডিফেন্ডার দুইজন শুধু নিজেদের মধ্যে একটা ধাক্কা খেতেন। এবং বক্সে হঠাৎ করেই নিজের বলের গতি পরিবর্তন করতেন। হুটহাট থেমে গিয়ে ডিফেন্ডারদের বোকা বানানোর চেষ্টা করতেন। বক্সের ভেতরে একটু বামে থেকে চেষ্টা করতেন বলকে বাঁকিয়ে জালে পাঠাতে। আগের মৌসুমে ভ্যালেন্সিয়ায় আমরা এই ভিয়াকেই দেখেছিলাম। কিন্তু সুইসদের সাথে দেখা যায়নি। আবার হন্ডুরাসের সাথে ফিরে আসেন এভাবে। আবার কোচ এ-ও বুঝছিলেন যে ভিয়া আর তোরেসকে একসাথে খেলানো সম্ভব নয়।
হন্ডুরাসের সাথে প্রথম গোলটা ছিল একদম উপরের বর্ণনার মতো। বক্সের বাইরে বামপ্রান্ত থেকে বল নিয়ে দুই ডিফেন্ডারের মাঝখান দিয়ে ভেতরে ঢুকে আরেক ডিফেন্ডারকে ডজ দিয়ে শট করে বলকে পাঠান একদম হন্ডুরাসের জালের উপরের কোণায়। স্পেনের জন্য এই গোলটি ছিল যতটা নয় আনন্দের, তার চেয়ে বেশি হাঁফ ছেড়ে বাঁচার। তাদের উদযাপনেও সেটাই বোঝা যায়। ক্যাসিয়াস নিজের ট্রেডমার্ক সেলিব্রেশন হিসেবে বারে হাত ছোঁয়ান। ভিয়ার এই গোলে তার উপর থেকে কত বড় একটি ভার যে নেমে গিয়েছিল, তা তার মুখের অভিব্যক্তিই বলে দিয়েছিল।
স্পেন ও ভিয়ার দ্বিতীয় গোলটি আসে দ্বিতীয়ার্ধে। ভিয়া বল ছাড়াই এবার বাম পাশ থেকে মাঝে চলে আসেন, হন্ডুরাসের বক্সের বাইরে। বক্সের ভেতর তার সামনে তখন স্পেনের আরো দুই খেলোয়াড়। ডান পাশ থেকে আসা একটি ক্রস বক্সের বাইরে ভিয়ার পায়ে আসে। সেখান থেকেই তিনি গোলে শট নেন। বল গিয়ে লাগে ডিফেন্ডারের গায়ে। গোলরক্ষক বলের প্রারম্ভিক গতিপথে ঝাঁপ দিলেও বল ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে গতিপথ পরিবর্তন করে গোলরক্ষকের পাশ দিয়ে জালে চলে যায়। শুধু একটি ব্যর্থ চেষ্টা ছাড়া তিনি আর কিছুই করতে পারেননি। এই গোলেই আসলে স্পেন আনন্দের উদযাপন করে। মাঠে ফেরে চিরচেনা লাল জার্সিধারীদের সত্যিকারের রূপ।
অবশেষে স্পেন ওই বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম জয়ের দেখা পায়। সেই সাথে ডেভিড ভিয়াও বুঝিয়ে দেন, কেন তিনি তখন স্পেনের সেরা ফিনিশার, কেন ফার্নান্দো তোরেসকে বেঞ্চে রেখে কোচ তাকে খেলাচ্ছেন। আগের মৌসুমে ২১ গোল করা ভিয়ার থেকে স্পেন যে সর্বোচ্চটাই পাবে, তারও একটি আভাস দিয়ে দেন।
পরের খেলাটি ছিল মার্সেলো বিয়েলসার চিলির সাথে। পরের পর্বে যাওয়ার জন্য এটি জিততেই হতো স্পেনের। চিলি তখন আস্তে আস্তে নিজেদের জানান দিচ্ছিল ফুটবল বিশ্বে। প্রস্তুতি ম্যাচে আর্জেন্টিনার কাছে উড়ে গেলেও দলকে পথে ফিরিয়ে এনেছিলেন বিয়েলসা। স্পেনের সাথে ২-১ গোলে লড়াই করে হারে চিলি। তাদের হাই-প্রেসিংয়ে স্পেন কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল অনেকবার। কিন্তু তাদের এই কৌশল ভেস্তে যায় যখন তোরেসের পা থেকে একটি বল ক্লিয়ার করতে ক্লদিও ব্রাভো বক্সের বাইরে চলে আসেন। খুব একটা ভালো ক্লিয়ার করতে পারেননি। বল স্লাইড করে সরিয়ে দিলেও বল চলে যায় একটু পেছনে, প্রায় মধ্যমাঠের কাছাকাছি দাঁড়ানো ভিয়ার পায়ে। সেখান থেকেই ফাঁকা পোস্টে বাম পায়ে দুর্দান্ত এক শটে গোল করে স্পেনকে এগিয়ে নেন তিনি।
খেলায় ফিরতে মরিয়া চিলি তাদের প্রেসিং চালিয়ে যায়। কিন্তু তাদের পা থেকে বল নিয়ে নেয় স্পেন। ছোট ছোট পাসে উঠে এসে স্পেনের চারজন খেলোয়াড় বক্সের আশেপাশে চলে আসে। সেখানে পাস যায় বক্সের বামে থাকা ডেভিড ভিয়ার কাছে। আলতো করে তা তিনি বাড়িয়ে দেন তার একটু ডানে, বক্সের মধ্যে ডি জোনে ইনিয়েস্তা বরাবর। সেখান থেকে ইনিয়েস্তার সুন্দর একটি মাটি কামড়ানো শট ব্রাভোর পাশ দিয়ে চলে যায় চিলির জালে। এরপর চিলিও গোল পায় একটি। রড্রিগো মিলার তাদের খেলায় ফেরার আশা জাগিয়েছিলেন। কিন্তু এবার স্পেন নিজেদের টিকিটাকায় বল আর নিজেদের কাছ ছাড়া করেনি। বাকি সময়টা এভাবে পার করে চিলির খেলোয়াড়দের হাই-প্রেসিং এড়িয়ে ৯০ মিনিটের খেলা শেষ করে।
একটা দল যখন ক্রমাগতই ন্যূনতম ব্যবধানে জিততে থাকে, তবে বুঝতে হবে যে তাদের কৌশলই এটি। স্পেন তাদের এই কৌশলকে খুব ভালোভাবে কার্যকর করে। তার এই বিশেষ খেলার ধরনে তারা বেশিক্ষণ বল নিজেদের কাছে রাখতে পারত। বারবার বল পাস দিয়ে প্রতিপক্ষকে বলের পেছনে দৌড়িয়ে ক্লান্ত করে দিত। এভাবে তাদের গোলের সুযোগ কমিয়ে নিজেদের অন্তত একটা গোলের সুযোগ তৈরি করত। স্পেন দলে তখন যারা ছিল, তাদের জন্য এই কৌশলটি ছিল একদম খাপে খাপ। এবং একটি নির্দিষ্ট ক্লাব থেকে আসা খেলোয়াড়ের সংখ্যা যখন বেশি হয়, তখন ঘুরে ফিরে অনুসরণ করতে হয় কিছুটা ঐ ক্লাবের কৌশলই। স্পেনের মিডফিল্ডের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না ঐ বিশ্বকাপে। তাদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ও পাসিং স্কিলে বল তাদের পায়েই থাকত সবসময়। এভাবে টুকটুক পাসে যা সুযোগ তৈরি হতো, সবই গেলানো হতো সামনে থাকা ডেভিড ভিয়াকে।
দ্বিতীয় পর্বে তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালকে। মাত্র একটি বড় পরীক্ষা দিয়ে আসা স্পেনকে পড়তে হয় আরো একটি বড় পরীক্ষার সামনে। যদিও বিশ্বমঞ্চে এটি স্বাভাবিক, কিন্তু তবুও তৎকালীন পর্তুগালের মুখোমুখি হতে চাইত না অনেকেই। বড় কারণ তো অবশ্যই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। এরপর রাউল মিরেলেসের দুর্দান্ত স্ট্যামিনা, যা তাকে সারাক্ষণ বলের আশেপাশেই রাখে। এরপর ডিফেন্সে পেপের মতো ডিফেন্ডার যিনি কি না একই সাথে ডিফেন্স সামলান, আবার ডিফেন্সে থাকা অন্যদের জন্য নির্দেশক হিসেবেও থাকেন। পর্তুগালের ৪ জনের ডিফেন্স লাইন সেদিন টিকিটাকাকে নিজেদের বক্সে থেকে যথেষ্ট দূরে রাখতে সাক্ষম হয়। পর্তুগাল ভালোভাবেই জানত যে তাদের একটি ভুলে যদি কোনোভাবে একবার স্পেন ঢুকতে পারে, তাতেই তারা খেলার ফলাফল বের করে নেবে। তারা এভাবে স্পেনের অনেক অ্যাটাকই ঠেকিয়ে দেয়। বাধ্য হয়ে স্পেন এদিন বক্সের বাইরে থেকেও শট নেয়া শুরু করে। ঘড়ির কাটা এভাবে একঘণ্টা অতিক্রম করে।
ক্রমাগত আক্রমণ চলাকালে এসময় একটি বল বক্সের মাথায় ইনিয়েস্তার কাছে আসে। তিনি হালকা করে সামনে জাভির দিকে ঠেলে দেন। জাভি এসময় গোলমুখের উল্টো হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা এখানে যে জাভির কথা বলছি, সে সময় তিনি ছিলেন ক্যারিয়ারের টপ ফর্মে। তার ৩৬০ ডিগ্রি ভিশন এবং সর্বদা সজাগ দৃষ্টি তাকে সমসাময়িক মিডফিল্ডারদের থেকে অনেক এগিয়ে রেখেছিল। ইনিয়েস্তার কাছ থেকে বল পাওয়া মাত্র তিনি কোনো দিকে না দেখে গোড়ালি দিয়ে বলকে হালকা ফ্লিক করে দেন। এই আলতো টোকাতেই বল পেয়ে যান বক্সে ঢুকতে থাকা ভিয়া। তার শট ফিরিয়ে দেন গোলরক্ষক, কিন্তু ফিরতি বল আবারও আসে ভিয়ার পায়ে। এবার ভিয়া শট নেন গোলমুখে। বলটি বারে লেগে গোলের ভেতরে ঢুকে যায়। গোলরক্ষক এদুয়ার্দো কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু তার সব চেষ্টা বিফল করে স্পেন ১-০ গোলে জিতে চলে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে। এখানেও নায়ক সেই ডেভিড ভিয়া।
এবার তাদের প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আমেরিকার দল প্যারাগুয়ে। তবে পঁচা শামুকে পা কাটার ইতিহাস স্পেনের জন্য নতুন নয়। সে সাথে প্যারাগুয়ে সেই বিশ্বকাপে তখন অব্দি ছিল দুর্দান্ত ফর্মে। কোয়ার্টার ফাইনালের পথে তারা করেছিল ৩ গোল এবং খেয়েছিল কেবল ১ গোল। এই দলের মুখোমুখি হয়ে স্পেন সাবধানী সূচনাই করে। তবে সাবধানী হলেও গোল পেয়ে যায় প্যারাগুয়ে। লাইন্সম্যানের ভুলে ওই গোলটি বাতিল না হলে হয়তো বা আমরা ইতিহাসকে অন্যভাবে পড়তাম। ওই গোল বাতিলের পর প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলশূন্য অবস্থায়। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই স্পেনের জন্য বিপদ ডেকে আনেন জেরার্ড পিকে। তিনি স্পেনের বক্সে টেনে ফেলে দেন কারদোজোকে। স্পেনকে বাঁচান ক্যাসিয়াস, কারদোজোর পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিয়ে। অল্প কিছু সময় পর স্পেনও পায় পেনাল্টি। জাবি আলোনসো গোল করলেও তা বাতিল হয়ে যায় স্পেনের এক খেলোয়াড় কিকের আগেই বক্সে ঢুকে পড়ার। আবার পেনাল্টি নেন আলোনসো, এবার বল ফিরিয়ে দেন প্যারাগুয়ের গোলরক্ষক। ফ্যাব্রেগাস এগিয়ে এসে গোলে শট গিতে গেলেও বলের নাগালে যেতে পারেননি। সবাই এবার ভেবে বসে, স্প্যানিশ রূপকথার সমাপ্তি বুঝি এখানেই।
কিন্তু রূপকথার স্ক্রিপ্ট তো লেখা হয়েছিল অন্যভাবে। যে স্ক্রিপ্টে নায়ক শুধু ডেভিড ভিয়া। নাহলে কেন অন্যরা এত অ্যাটেম্পট নেয়ার পরও গোল পায় না, অথচ তিনি পেয়ে যান?
শেষ দশ মিনিটের খেলা যখন চলছিল, তখন স্পেনের একটি আক্রমণ থেকে বল পান ডানে থাকা পেদ্রো। আক্রমণটি তৈরি করে দিয়েছিলেন আসলে ইনিয়েস্তা। তিনজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন প্যারাগুয়ের রক্ষণের ভেতরে। সেখান থেকে পাস দিয়েছিলেন পেদ্রোকে। তার শট গিয়ে লাগে পোস্টে। পোস্ট থেকে বল যায় অপর পাশে থাকা ডেভিড ভিয়ার পায়ে। তার শটও গিয়ে লাগে অপর পোস্টে। কিন্তু এবার আর বল ফিরে আসেনি, এবার আবার গিয়ে ধাক্কা খায় আরেক পোস্টে এবং ঢুকে যায় গোলে। এবং সেই সাথে আবারও ডেভিড ভিয়ার একমাত্র গোলে জয় পায় স্পেন। সেমিফাইনালে ওঠার জন্য স্পেন করে ৬টি গোল, এর মধ্যে ৫টিই ছিল ডেভিড ভিয়ার।
ফাইনালে উঠতে এবার তাদের সবচেয়ে বড় বাধা, জার্মানি। জার্মানির আক্রমণভাগ এই বিশ্বকাপে রীতিমতো সব দলের মনেই ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয় পর্বে ইংল্যান্ডকে ও কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ৪ গোল দেয়ার পর এটা স্বাভাবিক। তবে স্পেনের ডিফেন্স খুব ভালোভাবে ঠেকিয়ে দেয় জার্মানদের। কিন্তু অন্যদিকে প্রথমার্ধে জার্মানদের রক্ষণ ভেদ করতে না পেরে নতুন মতলব আঁটেন পুয়োল। জাভিকে নির্দেশনা দেন কী করতে হবে। জাভিও সেভাবে কর্নার নেন। সেখান থেকে গোল করেন ঝাঁকড়া চুলের এই পুয়োলই। সেদিন ভিয়ার কোনো ম্যাজিক আমাদের চোখে ধরা দেয়নি। ফাইনালেও অনেকটা এমন। গোলশূন্য থাকা অবস্থায় ১০৬ মিনিটে তাকে তুলে নেন কোচ ভিসেন্তে দেল বস্ক। ফলে ইনিয়েস্তার জয়সূচক গোলটি তিনি বেঞ্চে বসেই দেখেন। তবে তিনি যা করে গিয়েছেন, তাতে গোটা টুর্নামেন্টে তার পারফরম্যান্সের মাহাত্ম্য কিছুমাত্র কমবে না। কারণ পুয়োলের ঐ হেড কিংবা ইনিয়েস্তার এই শিরোপাসূচক গোল – কোনোটারই সুযোগ আসত না যদি না ভিয়া তাদের এতদূর টেনে আনতেন।
হাওয়ার্ড ওয়েবের বাঁশি বেজে উঠার সাথে সাথেই মাঠ ছেয়ে যায় নেভি ব্লু জার্সীধারীদের উৎযাপনে। ক্যাসিয়াস তার বিখ্যাত ক্রসবারে ছোঁয়া দিয়ে ধন্যবাদ জানান, বাকিরা মাঠে হাঁটুগেড়ে বসে পড়েন। ফাইনালটি ছিল কিন্তু ক্যাসিয়াসেরই, রোবেন শটকে ফিরিয়ে দিয়ে নিজের দলকে ধরে রেখেছিলেন খেলায়। টানা তিনটি ট্রফির পথে এটি ছিল তাদের দ্বিতীয়। প্রতিবারই তারা যে তাদের সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়, এই অপবাদ ঘুচে যায়। ক্যাপ্টেন ‘সেইন্ট’ ইকার যখন সোনালী ট্রফিটি উঁচিয়ে ধরেন, তাতেই থেমে যায় সকল সমালোচনা। সবাই ভুলে যায় সুইজারল্যান্ডের সাথে খেলায় কী ঘটেছিল।
টুর্নামেন্টে ডেভিড ভিয়ার গোলমেশিন থেমে গিয়েছিল সেমিফাইনালেই। কিন্তু এরপর স্পেনের হয়ে কাজে লেগেছিল তার স্কিল, তার বহুমুখী কর্মদক্ষতা। তার ফিনিশিং স্কিলের জন্য সবসময় তাকে রাখা হত কড়া নজরে। এতে কিছুটা হলেও অন্য খেলোয়াড়েরা ফাঁকা জায়গা পেয়েছিল খেলার জন্য। তিনি টুর্নামেন্ট শেষ করেন সিলভার বুটজয়ী হিসেবে। শুধু অ্যাসিস্টে পিছিয়ে থাকায় সমান সংখ্যক গোল করেও গোল্ডেন বুট হারান সত্য টিনেজ পার করে আসা টমাস মুলারের কাছে। কিন্তু স্পেনের এই দলে ব্যক্তিগত অর্জনকে খুব একটা বড় করে দেখা হয়নি। কারোর ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স নয়, স্পেনের এই সফলতার পেছনে ছিল তাদের একটি দল হয়্ খেলা। একটি ইউনিট, একটি গ্রুপ হিসেবেই তারা ছিলেন শক্তিশালী। তবে এই ইউনিটটিতে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি, ডেভিড ভিয়া অবশ্যই তাদের একজন। নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছিলেন ফুটবল বিশ্বে। হয়ে উঠেছিলেন একজন কিংবদন্তি।
ভিয়াকে স্পেনে কেমন সম্মাননা দেয়া হয় তার কৃতিত্বের জন্য? তেমন কিছুই না। তবে ট্রফি নিয়ে উদযাপনের সময়েই ভিয়াকে স্প্যানিশ দল কী হিসেবে দেখেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মাইক্রোফোন দেয়া ছিল পেপে রেইনার কাছে, তিনি ছিলেন মাইকে স্পেনের সেরা বিনোদনদাতা। তিনি একজন একজন খেলোয়াড়কে জার্সি নাম্বারের ক্রমে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। যখন এলো নাম্বার সিক্সের পালা, তিনি ইনিয়েস্তাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন শিরোপানির্ধারণী গোলদাতা হিসেবে। এরপর এলো ডেভিড ভিয়ার পালা। রেইনা কী বললেন?
“নাম্বার ৭, ডেভিড ভিয়া, স্পেনের গোলমেশিন।”
– পেপে রেইনা, সাবেক গোলরক্ষক, স্পেন জাতীয় দল