‘যদি কাউকে নিকটবর্তী কোনো স্থানে যেতে হয়, তাহলে প্রায় প্রত্যেকেই চাইবেন ছয় লেনের রাস্তা দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব যাওয়া যায়। সবাই এটা চাইবেন, একমাত্র রিকেলমে ছাড়া। তিনি পছন্দ করবেন পাহাড়ঘেরা রাস্তাকে। হয়তো তার এই যাত্রায় ছয় ঘন্টা সময় লাগবে। কিন্তু তিনি নিজেকে অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ করতে পারবেন।’
রিকেলমে সম্পর্কে এই কথাগুলো বলেছিলেন আর্জেন্টিনার ‘৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম নায়ক হোর্হে ভালদানো। হ্যাঁ, রিকেলমে। হুয়ান রোমান রিকেলমে, সুন্দর ফুটবলের এক অসামান্য কারিগর। মেসিতে বুঁদ হয়ে থাকা আর্জেন্টাইন ফুটবল ভক্তরা হয়তো ভুলেই গেছেন এই রিকেলমে’র কথা। ম্যারাডোনা পরবর্তী যুগে আর্জেন্টিনাকে যে কয়েকজন ফুটবলার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছেন তাদের মধ্যে এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার অন্যতম। হয়তো তিনি সেই স্বপ্ন পূরণও করতে পারতেন যদি ২০০৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে হোসে পেকারম্যান ৭২ মিনিটে তুলে না নিতেন। তিনি মাঠ ছাড়ার পরই ঘুরে দাঁড়ায় স্বাগতিক জার্মানি। হেরে যায় আর্জেন্টিনা। সমাপ্তি ঘটে রিকেলমে’র বিশ্বকাপ জয়ের। যদিও ২০১০ বিশ্বকাপ খেলতে পারতেন। তার দেওয়ার সামর্থ্য ছিল। কিন্তু ম্যারাডোনা তার প্রিয় ১০ নম্বর জার্সি কেড়ে নেওয়ার পর আর জাতীয় দলে ফেরেননি। অভিমানেই বিদায় জানিয়েছেন জাতীয় দলকে। আর্জেন্টিনার আজ মেসি থাকলেও রিকেলমে’র অভাব এখনো বোধ করেন ফুটবল ভক্তরা।
১৯৭৮ সালের ২৫ জুন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয় করে আর্জেন্টিনা। আর এর ঠিক একদিন আগে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স এইরেসের শহরতলী সান ফার্নান্দোতে জন্মগ্রহণ করেন হুয়ান রোমান রিকেলমে। তখন কে জানতো এই ছেলেটাও একদিন দেশের জার্সিতে বিশ্ব মাতাবেন। রিকেলমে’র বেড়ে উঠা একেবারেই সহজ ছিলনা। জন্ম নিয়েছিলেন এক দরিদ্র পরিবারের ১১তম সন্তান হিসেবে। তিনি যেখানে বেড়ে উঠেছেন সেখানকার নিত্যদিনের ঘটনা ছিল মারামারি আর দাঙ্গাহাঙ্গামা। রিকেলমে’র বাবা হোর্হে রিকেলমে নিজেও একটি দাঙ্গাবাজ গ্রুপের নেতা ছিলেন। ছোটবেলায় ফুটবল খেলে বাবার জুয়ার টাকার ব্যবস্থা করতেন রিকেলমে। নিজে খুবই শান্ত ও ভদ্র হলেও তাকে বাধ্য হয়ে এই কাজ করতে হতো। কিন্তু একসময় তার এই কাজই সাফল্যের সন্ধান দেয়।
ক্লাব ক্যারিয়ার
ছোটবেলায় রিকেলমে তার নিজ শহর সান ফার্নান্দোর বিভিন্ন ক্লাবে খেলেছেন। এরপর তিনি আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স ক্লাবের জুনিয়র দলে খেলার জন্য ট্রায়াল দেন। অল্প বয়সেই তার পায়ের জাদুর দেখা মেলে। যার জন্য প্রথম ট্রায়ালেই আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স দলে সুযোগ পান। সেখানে তিনি সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতেন। আর্জিটিনোসে থাকাকালীন রিকেলমে’র উপর নজর পড়ে আর্জেন্টিনার শীর্ষ দুই ক্লাব বোকা জুনিয়র্স ও রিভারপ্লেটের। তাকে দলে ভেড়ানোর জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় দুই ক্লাব। অর্থের দিক থেকে এগিয়ে ছিল রিভার প্লেট। কিন্তু বোকা ছিল রিকেলমে’র স্বপ্নের ক্লাব। তাই বিপুল অর্থকে ছুড়ে ফেলে ১৯৯৫ সালে ৮ লাখ ডলার ট্রান্সফার ফিতে বোকা জুনিয়র্সে যোগ দেন তিনি। এক মৌসুম জুনিয়র দলে খেলার পর ১৯৯৫ সালের ১০ নভেম্বর মূল দলের হয়ে আর্জেন্টিনার প্রিমেরা ডিভিশনে অভিষেক হয়। আর অভিষেকের দুই সপ্তাহের মাথায় স্কোরশিটে নাম লেখান রিকেলমে।
রিকেলমে’র ফুটবল প্রতিভা ছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত। তাই সাফল্য পেতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। মাঝমাঠ ও আক্রমণভাগে তার সৃষ্টিশীল ফুটবল নৈপুণ্যের হাত ধরে ছয়টি শিরোপা ঘরে তোলে বোকা জুনিয়র্স। এর মধ্যে ২০০০ ও ২০০১ সালের কোপা লিবার্তোদোরেসও ছিল, যাকে লাতিন আমেরিকার চ্যাম্পিয়নস লিগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ক্লাবের এই সাফল্য বোকার ভক্তদের কাছে বাস্তবিক ছিল, কিন্তু তারা রিকেলমে’র প্রতিভাকে অনুধাবন করতে পারেননি। তার মুভমেন্ট, বলের উপর নিয়ন্ত্রণও নিখুঁত পাস ক্লাব কর্মকর্তাদের মুগ্ধ করতো। কিন্তু ভক্তরা মাতামাতি করতেন শুধুমাত্র গোলদাতাকে নিয়ে। বোকায় থাকাকালীন রিকেলমে’র কাছে গোল করা ছিল গৌণ। বরং গোলের রাস্তা তৈরির বিষয়টি ছিল মুখ্য। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন ছিল। বিশ্বজুড়ে স্ট্রাইকার তথা গোলদাতাদেরই মূল্য বেশি। কারণ ম্যাচশেষে পরিসংখ্যানই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সেই পরিসংখ্যানের বলে তার অনেক সতীর্থ ইউরোপে পাড়ি জমান। কিন্তু রিকেলমে থেকে যান বোকাতে।
গোলের সুযোগ সৃষ্টি করেও রিকেলমে যখন ভক্তদের কাছে থেকে আশানুরূপ সাড়া পাননি, তখন তিনি অভিমান করেন। তবে একেবারে দমে যাননি। বরং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সেনাপতির হবেন। তাই চেষ্টা করতেন তার মাঠের সবকিছু নিজের দুই পা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার। একদিন রিকেলমে তার সেই অভিমান থেকেই বিশ্বকে জয়ের পথে হাঁটতে শুরু করেন। নিজের নামকে ছড়িয়ে দেন লাতিন থেকে ইউরোপ-আমেরিকায়। বোকা জুনিয়র্সে ছয় বছর কাটালেও গোলের পরিসংখ্যান তার মাহাত্ম্যের কথা বলে না। ১৯৯৬ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত সোনালী নীল জার্সিতে ১৯৪টি ম্যাচ খেলে মাত্র ৪৪টি গোল করেছেন তিনি। তবে এই গোলগুলোর মধ্যে কোনোটি ছিল তার দুর্দান্ত ড্রিবল থেকে করা, আবার কোনোটি ছিল দূরপাল্লার জোরালো শট কিংবা ফ্রি কিক থেকে। তার কোনো কোনো গোলের সৌন্দর্য হাজারো দর্শককে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। গোলের সংখ্যাটা মাত্র ৪৪ হলেও সুবাস ছড়িয়েছেন প্রায় সব ম্যাচেই।
সোনালী নীল জার্সিতে রিকেলমে’র ছড়ানো ফুটবল সুবাস ইউরোপে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগেনি। খুব অল্প দিনের তাকে দলে ভেড়ানোর জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে ইউরোপিয়ান জায়ান্টরা। আর সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফুটবল থেকে মাফিয়া জগত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। রিকেলমে’র প্রতি দীর্ঘদিন ধরে নজর রেখেছিল বার্সেলোনা। কিন্তু তারা যে দামে কিনতে চেয়েছিল বোকা জুনিয়র্স সেই দামে বিক্রি করতে ইচ্ছুক ছিল না। ঠিক সেই সময় রহস্যজনকভাবে তার ভাই ক্রিস্টিয়ান রিকেলমে’কে অপহরণ করে স্থানীয় এক মাফিয়া চক্র। এই বিষয়ে খুব বেশি জানা যায়নি। কিন্তু এই ঘটনার পরপর ২০০২ সালে মাত্র ৯ মিলিয়ন পাউন্ডে বার্সায় যোগ দেন রিকেলমে। ধারণা করা হয় যে, রিকেলমে’র ভাই অপহরণের পেছনে বার্সার হাত ছিল। তিনি নিজেও এই ঘটনাকে বোকা জুনিয়র্স ছাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
রিকেলমে’র ইউরোপ যাত্রা খুব বেশি সুখকর হয়নি। বার্সা তাদের ক্লাব ইতিহাসে অনেক খেলোয়াড়কে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে দলে ভিড়িয়েছে। কিন্তু দলে টানার পর খুব বেশি মূল্যায়ন করেনি। রিকেলমে’র ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই ঘটেছে। বার্সায় যোগ দেওয়ার সাথে সাথে ব্লুগানার ভক্তদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে রিকেলমে’র স্কিলের প্রশংসা করে খবর ছাপানো হয়। কারো কারো মতে রিকেলমে মাঠে শুধু দেখা যায়। কিন্তু তার ফুটবল কৌশল দুর্বোধ্য। ইউরোপের প্রায় সকই ফুটবল বোদ্ধা রিকেলমে’র প্রতিভা দেখেছিলেন। কিন্তু বার্সার সেই সময়ের কোচ লুইস ফন গালের কাছে এটা ছিল একটা ‘রাজনৈতিক দলবদল’। এই কারণে তিনি দলে রিকেলমে’র জন্য জায়গা বরাদ্দ রাখেননি। ফলে বার্সা ছাড়া তার জন্য জরুরী ছিল। আর এক্ষেত্রে আশার আলো ছিল গ্রীষ্মের দলবদল।
এদিকে বার্সায় সুবিধা করতে না পারায় নিজ দেশ আর্জেন্টিনায় তাকে নিয়ে সমালোচনা তুঙ্গে উঠে। অনেকে তার খেলার ধরন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এমনকি তার ফুটবল ক্যারিয়ার খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে বলেও ভবিষ্যদ্বাণী করে বসেন। রিকেলমে তখন পরিস্থিতির শিকার হলেও এত দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার মতো ছিলেন না। তবে তার ক্যারিয়ারে বার্সা-অধ্যায় খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। কাতালান জায়ান্টরা ব্রাজিলিয়ান তারকা রোনালদিনহোকে দলে ভেড়ায়। ফলে রিকেলমে ন্যু-ক্যাম্পে চূড়ান্তভাবে ব্রাত্য হয়ে পড়েন। সেই সময় আলোর দিশারী হয়ে দেখা দেন বেনিতো ফ্লোরো। তিনি ছিলেন ভিলারিয়ালের তৎকালীন কোচ। দলের জন্য তিনি একজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার খুঁজছিলেন, যাকে তিনি স্বাধীনতা দেবেন এবং সুযোগ দেবেন বিশ্বকে নিজের প্রতিভার দেখানোর। রিকেলমে’র জন্য এমন একজন কোচেরই প্রয়োজন ছিল।
রোনালদিনহোকে কেনার পর বার্সার বেশ কয়েকজন বিদেশী খেলোয়াড়কে দল ছাড়ার সুযোগ দেন। ২০০৩-০৪ মৌসুমে রিকেলমে’কে ধারে ভিলারিয়ালে পাঠায় বার্সা। রিকেলমে তার ক্লাব ক্যারিয়ারে সেরা সময় কাটিয়েছেন ভিলারিয়াল ও বোকা জুনিয়র্সে। ভিলারিয়াল তখন স্প্যানিশ ফুটবলে ছোট দল। ১৯৯৮ সালে তারা প্রথমবারের মতো লা লিগা খেলার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু এই ছোট দলকেই চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে যান রিকেলমে ও ডিয়েগো ফোরলান। ভিলারিয়ালে আসার পর দুইজন মানুষের সংস্পর্শে রিকেলমে’র ক্যারিয়ার বদলে যায়। একজন ছিলেন কোচ ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনি, অপরজন এই ফোরলান।
উরুগুইয়ান তারকা এক সাক্ষাৎকারে ভিলারিয়ালে যোগ দেওয়ার কারণ হিসেবে রিকেলমে’র কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন,
‘ওর সাথে (রিকেলমে) সেখানে আমি ২০০৫ সালে যোগ দেই। ভিলারিয়ালকে বেছে নেওয়ার পেছনে রিকেলমে অন্যতম কারণ ছিল। আমরা একসাথে আক্রমণভাগে খেলেছি। আমি তখনো ওর সম্পর্কে ভালোভাবে জানতাম না। প্রথম দিন ওর সাথে হাত মেলাই এবং রাতে আমরা একসাথে খাবার খাই। তখন সে আমার প্রিয় খাবার সম্পর্কে জানতে চাইলে আমি মিলানেসার (মাংস ও পাউরুটি দিয়ে তৈরি এক ধরনের খাবার) কথা বলি। এরপর যখন তার সাথে দেখা করতে যাই, তখন দেখি আমার জন্য মিলানেসা ও ম্যাশ পটেটো তৈরি। এর আগে আমার ভাই ছাড়া আর কেউ আমার জন্য এটা করেনি। ওর ভেতরে প্রবেশ করা খুবই কঠিন। তবে কেউ একবার প্রবেশ করতে পারলে, একজন সত্যিকারের বন্ধু পাবে।’
ফোরলান ও রিকেলমে দুজনই লাতিন আমেরিকা থেকে উঠে এসেছেন। এবং তাদের দুজনেরই পূর্ববর্তী ক্লাবে তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু ভিলারিয়ালে তারা দুজনই নিজেদের প্রতিভার শতভাগ প্রদর্শন করতে সক্ষম হন। এর পেছনে বড় কারণ ছিলেন পেলেগ্রিনি। কারণ তিনি ফোরলান ও রিকেলমে’কে খুব ভালোভাবেই চিনতেন। ২০০৪-০৫ মৌসুমে রিকেলমে ইউরোপে তার ক্যারিয়ারসেরা পারফরম্যান্স করেন। লা লিগায় ৩৫ ম্যাচে ১৫ গোল করে ‘মোস্ট আর্টিস্টিক প্লেয়ার’ পুরস্কার পান। সেই মৌসুমে ভিলারিয়াল তাদের ইতিহাস সেরা পারফরম্যান্স করে তৃতীয় স্থান অর্জন করে। ফলে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করে নেয়। চ্যাম্পিয়নস লিগেও তাদের সাফল্য অক্ষুণ্ণ থাকে। প্রথমবারেই তারা সেমিফাইনালে জায়গা করে নেয় ভিলারিয়াল। কিন্তু সেমিতে আর্সেনালের বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করেন রিকেলমে। তবে এরপরও ক্লাব সমর্থকরা তার পক্ষে থেকেছেন। ভিলারিয়ালে কোচ ম্যানুয়েল পেলেগ্রেনির অধীনে রিকেলমে নিজেকে বিশ্বের সেরা প্লেমেকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
২০০৭ সালে ক্লাব কর্তৃপক্ষের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন রিকেলমে। যার ফলে ইউরোপ ছেড়ে আবারো আর্জেন্টিনায় ফিরে যান। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে প্রথমে তিনি ধারে বোকা জুনিয়র্সে যান। পরবর্তী গ্রীষ্মে তার সাথে চুক্তি পাকাপোক্ত করে আর্জেন্টাইন জায়ান্ট। বোকায় নিজের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করেন রিকেলমে। ২০০৭ সালে থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত টানা ৭ বছর সোনালী নীল জার্সিতে খেলেন। অর্জন করেন অনেক শিরোপা। অবসর নেওয়ার ১৭ জুলাই ২০১৪ সালে নিজের শৈশবের ক্লাব আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সে যোগ রিকেলমে। মাত্র ছয় মাস কাটিয়ে তিনি ফুটবলকে বিদায় জানান।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার
জাতীয় দলে প্রবেশের পর থেকেই রিকেলমেকে ম্যারাডোনার সাথে তুলনা করা হতো। কিন্তু তারা দু’জনই ছিল ভিন্ন। রিকেলমে মাঠের মধ্যে শূন্য থেকে সোনা ফলিয়েছেন। তাকে ম্যারাডোনার সাথে তুলনা করা হলেও তিনি এসব গায়ে মাখেননি। কারণ রিকেলমে চেয়েছেন নিজের নামে পরিচিত থেকে। কারো বিশেষণে নয়। রিকেলমে সর্বপ্রথম আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব-২০ দলে খেলেন। সেখানে ভালো খেলার করার পর জাতীয় দলে ডাক পান। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচ কলম্বিয়ার বিপক্ষে তিনি প্রথমবারের মতো মাঠে নামেন। ম্যাচের শেষ মিনিটে তিনি মাঠে নামেন। এবং ম্যাচটি ১-১ গোলে ড্র হয়। ১৯৯৯ সালের কোপা আমেরিকা ছিল রিকেলমে’র প্রথম বড় কোনো টুর্নামেন্ট। কিন্তু তিনি এই টুর্নামেন্টে বলার মতো কিছুই করতে পারেননি। এরপর আর্জেন্টিনার হয়ে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করেন। এবং এই টুর্নামেন্টে লিবিয়ার বিপক্ষে দেশের হয়ে প্রথম গোল করেন। এর পরপরই আসে ২০০২ বিশ্বকাপ। কিন্তু নিজের ভাই ক্রিস্টিয়ান অপহরণের পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন রিকেলমে। ফলে ২০০২ বিশ্বকাপে তাকে দর্শক হিসেবে থাকতে হয়।
২০০৬ সালে রিকেলমে তার ক্যারিয়ারের প্রথম ও শেষ বিশ্বকাপ খেলেন। হোসে পেকারম্যানের অধীনে সেই বিশ্বকাপে আগের আসরের চেয়ে ভালো পারফরম্যান্স করে। গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল নেদারল্যান্ড, সার্বিয়া অ্যান্ড মন্টিনেগ্রো এবং আইভরি কোস্ট। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে আইভরি কোস্টকে ২-১ গোলে হারায় পেকারম্যানের শিষ্যরা। দু’টি গোলের উৎসে ছিলেন রিকেলমে। পরের ম্যাচে সার্বিয়া অ্যান্ড মন্টিনেগ্রোকে ৬-০ গোলে বিধ্বস্ত করে শেষ ষোলো নিশ্চিত করে। গ্রুপপর্বে অপর ম্যাচে গোলশূন্য ড্র করে আলবেসেলেস্তেরা। দ্বিতীয় রাউন্ডে ম্যাচের শুরুতেই মেক্সিকোর বিপক্ষে পিছিয়ে পড়ে আর্জেন্টিনা। সেদিন ছিল তার জন্মদিন। নিজের জন্মদিনকে রিকেলমে নিজেই রাঙান। তার দুর্দান্ত এক কর্নার থেকে গোল পরিশোধ করেন হার্নান ক্রেসপো। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। পরবর্তীতে ৯৮ মিনিটে ম্যাক্সি রদ্রিগেজের গোলে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে আর্জেন্টিনা।
কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল স্বাগতিক জার্মানি। ম্যাচের ৪৯ মিনিটের মাথায় রিকেলমে’র নেওয়া কর্নার থেকে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন আয়ালা। রিকেলমে’র দুর্দান্ত ফুটবলশৈলীর কারণে মাঝমাঠে সুবিধা করতে পারছিল না জার্মানি। কিন্তু ম্যাচের ৭২ মিনিটের মাথায় সবাইকে অবাক করে দিয়ে কোচ হোসে পেকারম্যান তাকে তুলে ক্যাম্বিয়াসোকে নামান। রিকেলমে’র অনুপস্থিতিতে মাঝমাঠের দখল নেয় জার্মানরা। এর সুফল তারা মাত্র ৮ মিনিটের মধ্যেই তুলে নেয়। মিরোস্লাভ ক্লোসার গোলে সমতা আনেন জার্মানি। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে সমতা থাকায় ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে ৪-২ গোলে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। পরবর্তীতে আর্জেন্টিনার হারার জন্য পেকারম্যানের ভুল সিদ্ধান্তকে দায়ী করা হয়।
পরের বছর আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকায় মাঠে নামেন রিকেলমে। এই টুর্নামেন্টের গ্রুপপর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে কলম্বিয়ার মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। সেই ম্যাচে রিকেলমে জোড়া করে করেন। গ্রুপ পর্বের সবগুলো ম্যাচ জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নেয় আর্জেন্টিনা। কোয়ার্টার ফাইনালে পেরুর বিপক্ষে আবারো জোড়া গোল করেন। সেমিফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল মেক্সিকো। এই ম্যাচে রিকেলমে নিজে এক গোল করার পাশাপাশি গ্যাব্রিয়েল হেইঞ্জকে দিয়ে এক গোল করার। ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল। তাদের কাছে ৩-০ গোলে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় আর্জেন্টিনা। পাঁচ গোল করে টুর্নামেন্ট সেরা হন রিকেলমে। এরপর তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে বেইজিং অলিম্পিকে খেলেছেন। অবশেষে এই টুর্নামেন্টে সাফল্য পায় তার দল। ফাইনালে নাইজেরিয়াকে হারিয়ে স্বর্ণপদক জয় করে আর্জেন্টিনা।
২০১০ বিশ্বকাপে বাছাইপর্ব পার করতে বেশ বেগ পেতে হয় আর্জেন্টিনাকে। বেশ কয়েকজন কোচেরও পরিবর্তন ঘটে। সবশেষে আর্জেন্টিনার ডাগআউটে আসেন কিংবদন্তি ম্যারাডোনা। কিন্তু তার সাথে রিকেলমে’র প্রচুর মতপার্থক্য ছিল। সেই কারণে তিনি ম্যারাডোনার অধীনে খেলতে রাজি ছিলেন না। এর পেছনে বড় কারণ ছিল ম্যারাডোনার অতিরিক্ত মেসি ভক্তি। রিকেলমে’র ১০ নম্বর জার্সি মেসিকে দিতে চেয়েছিলেন ম্যারাডোনা। তখন থেকেই মতবিরোধ শুরু হয়।
কারণ ১০ নম্বর জার্সি কেড়ে নেওয়া ছিল রিকেলমে’র কাছে বড় এক অপমান। যার ফলে ২০০৯ সালে মার্চে তিনি জাতীয় দল থেকে অবসরগ্রহণ করেন। যদিও ম্যারাডোনা তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু রিকেলমে তার মান ভেঙে ফেরেননি। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের স্কোয়াডে জায়গা হারান হাভিয়ের জানেত্তি ও ক্যাম্বিয়াসোও। এই আসরেও কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। এবার তারা ৪-০ গোলের বড় ব্যবধানে হারে। অবসরের আগে রিকেলমে জাতীয় দলের হয়ে ৫১টি ম্যাচ খেলে ১৭টি গোল করেছেন।
আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় বলার পর আরো ছয় বছর ক্লাব ফুটবল মাতান রিকেলমে। অবশেষে ২০১৫ সালের ২৫ জুন আনুষ্ঠানিক ফুটবলকে বিদায় বলেন এই আর্জেন্টাইন ফুটবল কিংবদন্তি। অবসর নেওয়ার আগে চারবার আর্জেন্টিনার প্রিমেরা ডিভিশন, তিনবার কোপা লিবার্তোদোরেস ও একবার ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জিতেছেন। এছাড়া আর্জেন্টিনার হয়ে ফিফা অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ও অলিম্পিকের স্বর্ণপদক জিতেছেন। রিকেলমে’র ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। তবে ইয়েসিকা তোসকানিনি নামের এক মডেলের সাথে তার সম্পর্ক ছিল বলে বেশ কয়েকবার গুঞ্জন রটে। তাদের মধ্যে ২০০৮ সাল থেকে প্রেম ছিল বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু ২০১৫ সালে তোসকানিনি অপর একজনকে বিয়ে করে সংসার করছেন। এরপর রিকেলমে আর কোনো সম্পর্কে জড়িয়েছেন কি না, সেই সম্পর্কে কোনো কিছুই জানা যায়নি।