বাঁধা ভেঙ্গে এগোনোটা অনেক কঠিন ব্যাপার। সেই বাঁধা পেরিয়ে যদি মূল্যায়ন না মেলে, সেটা বোধ হয় আরও বেশি কষ্টের। তারপরও কষ্টে কেষ্ট মেলে যখন স্বপ্নের পথে একটু একটু করে এগিয়ে বাস্তবের হাতছানি পাওয়া যায়। বাংলাদেশের প্রথম নারী ক্রিকেট দল যখন গঠিত হয় তখন হয়তো এমন অবস্থা ছিলো। সেই শুরুর দিককার ক্রিকেটার ছিলেন জাহানারা আলম। খুলনা থেকে উঠে আসা এই মেয়েটি মোহাম্মদ রফিকের মতো খুব গরীব ঘর থেকে উঠে আসেননি। উঠে আসেননি মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো গল্পের চরিত্র থেকেও। এই জাহানারা আলমের ক্যারিয়ার ভারতীয় কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারের মতো যে সোনালী, সেটাও নয়। কিন্তু জানাহারাকে নিয়ে গল্প হয়। লাল-সবুজ জার্সিতে তার অবদান বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা জানেন। তাকে ভালোবাসে।
১০ বছর ধরে জাতীয় দলে ক্রিকেট খেলছেন জাহানারা আলম। নারী ক্রিকেট যখন এ দেশে ভ্রু কুঁচকানোর চোখে দেখতো, তখন থেকেই সেসব মেঘযুক্ত চোখ এড়িয়েই সংগ্রাম করেছেন জাহানারা। ফলটাও পাচ্ছেন হাতেনাতেই। এই পেসারের হাতে একাধিকবার উঠেছে জাতীয় দলের নেতৃত্ব।
১.
২০০৮ সালের কথা। ক’দিন পরই মাধ্যমিক (এসএসসি) পরীক্ষা। এমন সময়েই জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার সম্ভাবনা এলো জাহানারা আলমের সামনে। ব্যাপারটা অনেকটা উভয় সঙ্কটের মতো। একদিকে যেমন এসএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা, আরেকদিকে স্বপ্ন পূরণের পথ। জাহানারা কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না।
ভয়ে ভয়ে বাবার কাছে গিয়ে বললেন সব কথা। জাহানারার পথটা বদলে গেছে সেদিনই, যার কৃতিত্ব তার বাবাকে দিতেই হবে। জাহানারা বলেছিলেন, “কদিন পর পরীক্ষা। সামনে আবার বাংলাদেশ নারী দল শ্রীলঙ্কায় সফর করবে। ডাক পেলে কী করবো?“
উত্তরে তার বাবা বলেন, “পরীক্ষা তো পরেও দিতে পারবে। জাতীয় দলে যদি সুযোগ আসে তাহলে অবশ্যই খেলতে যাবে।“
সত্যিই ডাক পেয়েছিলেন জাহানারা। সত্যি সত্যি পরীক্ষা বাদ দিয়ে সফর করেছিলেন শ্রীলঙ্কায়। সেই থেকে এখনও খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০০৮ সালে অভিষেক। এখন দলের ‘অটোমেটিক চয়েজ’। তাদের হাতেই বাংলাদেশ ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেয়েছে। সেটার পর থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ৩৪ ওয়ানডে ও ৪০ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। লাল-সবুজ জার্সির এই পেস বোলার ওয়ানডেতে নিয়েছেন ২৯ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ২১ উইকেট।
লোয়ার অর্ডারে ব্যাটিংটাও খুব খারাপ হয় না তার। দলের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে চেষ্টা করেছেন যতটা পারা যায় সমর্থন দিতে। তার প্রমাণ তো মিলেছে ক’দিন আগেই। প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টির শিরোপা জিতলেন জাহানারারা। মালয়েশিয়ায় টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে জয়ের কাণ্ডারি ছিলেন পেসার হয়েও সেদিন ‘ব্যাটসম্যান’ হয়ে ওঠা জাহানারা। শেষ বলে প্রয়োজন ছিল ২ রানের। সেটা সফলভাবেই নিতে পেরেছেন তিনি।
যার ফলাফল, প্রথমবারের মতো কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে জায়গা পেয়েই শিরোপা জয়। এ নিয়ে জাহানারা আলম বলেছেন, “আমি এখনও ২০১৪ সালের সেই দুঃস্মৃতি ভুলতে পারিনি। আমরা এশিয়ান গেমসে পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের দরজা থেকে ফিরে এসেছিলাম। তাই এশিয়া কাপের ফাইনালে এই জায়গা থেকে কোনোভাবেই ফিরতে চাইনি। তাই ব্যাটিংটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। তাছাড়া আমি সবসময় লোয়ার অর্ডারেই ব্যাট করি। এই সময়টা প্রায়ই এরকম কঠিন থাকে। ঘরোয়া ক্রিকেটে এগুলো নিয়ে অনেক কাজ করেছি। তাই এখানেও পেরেছি।”
২.
যখন স্কুলে পড়েন তখন থেকেই খেলাধুলার শুরু জাহানারার। মজার ব্যাপার হলো, শুরুটা ছিল হ্যান্ডবল, ভলিবল দিয়ে। খুলনার এই মেয়েটি ক্রিকেটে আসেন যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়েন তখন থেকে। সেটাও বেশ নাটকীয়ভাবে। প্রথম নারী ক্রিকেট দল গড়বে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। চলছে স্কুলে স্কুলে ক্রিকেটারের খোঁজ। এভাবেই উঠে আসা জাহানারার।
যদিও ক্রিকেট খেলতেন না, তারপরও তার শারীরিক গড়নের কারণেই বোধহয় স্কুলের শিক্ষক তাকে ক্রিকেটে আনলেন। ব্যস, ক্রিকেট নিয়ে শুরু হয়ে গেলো জাহানারার যাত্রা। সেই যাত্রায় এখনও কোনো বিরতি আসেনি।
পেসার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও শুরুটা জাহানারা করেছিলেন ব্যাটসম্যান হিসেবে। তারপর বল হাতে নেওয়া। নির্বাচকদের নজরে পড়েছিলেন খুব দ্রুত।
বাবা-মা তথা পরিবার থেকে ক্রিকেটের ব্যাপারে পর্যাপ্ত উৎসাহ পেলেও প্রতিবেশি কিংবা বাইরের লোকজনের কারণে মুদ্রার ওপিঠ দেখতে সময় লাগেনি জাহানারার। অনেকে অনেক কটু কথা বলেছে। একটা মেয়ে কেন ক্রিকেট খেলবে, সেটা নিয়ে নাকি তার বাবা-মায়ের কাছেও অভিযোগ দিয়েছে। জাহানারা ভরসা রেখেছিলেন। সেসব কটু কথাকে প্রশংসা বাণীতে পরিণত করেছেন। সেসব অভিযোগকারীরাই এখন জাহানারাকে তাদের ‘গর্ব’ বলে মনে করে।
শুধু প্রতিবেশি নয়, ক্রিকেটেও খানিকটা গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে দেশসেরা এই নারী ক্রিকেটারকে। তার সময়ে যেহেতু নারীদের ক্রিকেট সেভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি, তাই অনুশীলন করতে হতো ছেলেদের সাথে। সেসব ছেলেই অনেক সময় হেয়-প্রতিপন্ন করেছে তাকে।
জাহানারার ভাষায়, “মেয়েদের সঙ্গে যখন খেলতাম, তখন তো কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু মাঝে মাঝে খুলনায় থাকতে ছেলেদের সাথে অনুশীলন করতে হতো। কারণ সবসময় মেয়েদের ক্রিকেট হতো না। তো অনুশীলন করতে গিয়ে অনেক সময় বিপাকে পড়তাম। অনেকে অনেক কথা বলতো মেয়ে হয়ে ক্রিকেট খেলছি দেখে।”
নারী হিসেবে তাকে পিছিয়ে পড়তে হবে, এমনটা কখনোই ভাবেননি জাহানারা। তার কাছে ক্রিকেট খেলতে পারাটাই মূল কথা। তাই এই ক্রিকেটের জন্যই সংগ্রাম করেছেন, করেও যাচ্ছেন।
৩.
ক্রিকেট নিয়ে হাজারো স্বপ্ন জাহানারার। হতে চান বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার চলতে চলতেই বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলকে দেখতে চান র্যাংকিংয়ের পাঁচ কিংবা ছয় নম্বরে। দেশের নারী ক্রিকেটের জন্যেও অনেক কিছু করতে চান। কাজ করতে চান ভবিষ্যতের নারী ক্রিকেটারদের জন্য। এখনও চেষ্টা করেন যতটা পারা যায় সাহায্য করতে। একবার বলেছিলেন, “অনেক মেয়ে আমাকে আইডল মানে। তাছাড়া যেকোনো মেয়ে আমার কাছে কোনো ব্যাপারে পরামর্শ চাইলে আমি চেষ্টা করি সর্বোচ্চটা দেওয়ার।”
ক্রিকেটারদের মধ্যে পছন্দের মানুষের কমতি নেই তার। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পছন্দ মাশরাফি বিন মুর্তজাকে। বাংলাদেশ পুরুষ জাতীয় দলের এই ওয়ানডে অধিনায়ককে ক্রিকেট ক্যারিয়ারের আদর্শ মানেন জাহানারা। এছাড়া ভালো লাগে মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে।
আন্তর্জাতিক নারী ক্রিকেট নিয়েও প্রয়োজনীয় পড়াশোনা করেন তিনি। পছন্দের ক্রিকেটারের তালিকায় রয়েছে ভারতের ঝুলন গোস্বামী, মিতালি রাজ, ইংল্যান্ডের সারা টেলরের মতো ক্রিকেটাররা।
জাতীয় দলের হয়ে একাধিকবার ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছেন। নারী দলের অনেক ‘প্রথম’ও এসেছে তার কাঁধে চড়ে। ক’দিন আগে দুই সতীর্থ খাদিজা-তুল-কুবরা ও ওয়ানডে অধিনায়ক রুমানা আহমেদের সঙ্গে জায়গা পেয়েছেন ‘ওমেন্স ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট’ একাদশে। ২০১৮ সালের জুলাইতে ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) সুপার লিগ দলের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের সিরিজে অংশ নেবেন জাহানারা।
আরেকটি ব্যাপার না বললেই নয়। সেই যে এসএসসি পরীক্ষা না দিয়েই ২০০৮ সালে জাতীয় দলের সফরে দেশ ছেড়েছিলেন, সেটার জন্য পড়াশোনা কিন্তু ভোলেননি! জাহানারা পরের বছরেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন খুলনারই একটি কলেজে। তারপর সেই কলেজেই থেকেই উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন।
ফিচার ইমেজ- ESPN Cricinfo