দুবাইয়ের স্পোর্টস সিটিতেই অনুশীলন, সেখানেই ছয় দলের সংবাদ সম্মেলন। এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, অথচ বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার চোখে নেই কোনো দুশ্চিন্তার ছাপ। পাশে বসা পাকিস্তান অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ আর ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মার সঙ্গে দিব্যি ঠাট্টা চালিয়ে যাচ্ছেন! মাশরাফি কী যেন বললেন, রোহিত-সরফরাজ তো হেসেই খুন! কিন্তু তিনজনের ওপাশে শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের চোখেমুখে স্পষ্ট উদ্বেগ। উদ্বোধনী ম্যাচে বাংলাদেশ দলের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে লঙ্কান শিবিরে যা ঘটছে তাতে দুশ্চিন্তা না করে উপায় কি! দুজন ইনজুরিতে, একজন থাকছেন না প্রথম দুই ম্যাচে; মোট তিনজন মূল ক্রিকেটার ছাড়া নামতে হচ্ছে বাংলাদেশের বিপক্ষে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ দলের অধিনায়কের মুখে হাসি ফুটতেই পারে। সেটা কেবল প্রতিপক্ষ দলের শক্তি কমছে- এমনটা ভেবে নয়, বরং সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালের ফিটনেস নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল; তা মিটে গেছে। অর্থাৎ সদ্য উইন্ডিজকে ২-১ এ ওয়ানডে সিরিজ হারানো লাল-সবুজ জার্সিধারীরা এশিয়া কাপের মাঠে নামছে পুরো শক্তি নিয়ে।
তবে মাঠের পারফরম্যান্স ছাড়াও বাংলাদেশের সামনে কিছু ব্যাপার সত্যিকারের দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রথমত, দুবাইয়ের গরম। বাংলাদেশ গ্রীষ্মপ্রধান দেশ হলেও, এই সেপ্টেম্বরে দুবাইয়ের গরম মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ-তামিম ইকবালদের জন্য বড় প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি, শেষ তিন আসরে এশিয়া কাপের ফাইনালে দুইবার জায়গা করেও যে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে; সেই দুঃস্মৃতি দলের মন থেকে সরানোর কথা নয়।
শেষটা হলো, প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা। এই মুহূর্তে ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ থাকলেও, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাশরাফিরা শেষবার ওয়ানডেতে লড়েছিলেন মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে। ত্রিদেশীয় সিরিজের সেই ফাইনাল ম্যাচে বাংলাদেশ শুধু হেরেছিল না, সাকিব ফিল্ডিং করতে গিয়ে হাতের বড় ইনজুরিতে পড়েছিলেন। সেই চোট এখনও ভোগাচ্ছে তাকে।
খালি চোখে
আজ বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটায় এশিয়া কাপ ২০১৮ আসরের উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা। দু’দলের সর্বশেষ স্মৃতি যদিও নিদাহাস ট্রফির টি-টোয়েন্টি ম্যাচে। সেখানে হেরেছিল স্বাগতিক লঙ্কানরা। চলতি বছরে দুই দলের লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত এগিয়ে আছে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে বাংলাদেশকে হারানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের ঘরের মাঠেই ফেব্রুয়ারিতে একটি টেস্ট ও দুটি টি-টোয়েন্টি জিতেছেন আকিলা ধনঞ্জয়া-কুশল পেরেরারা।
কিন্তু নিহাদাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার মাটিতেই লঙ্কানদের হারিয়েছে বাংলাদেশ। সেখান থেকে উইন্ডিজ সফরের সফলতা আরও তাতিয়ে দিয়েছে এই দলটিকে। পাঁচ জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার- মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এই মুহূর্তে দারুণ ফর্মে রয়েছেন। এছাড়া লিটন কুমার দাস উইন্ডিজের বিপক্ষে সর্বশেষ সিরিজে ফ্লোরিডায় হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছেন। মুস্তাফিজুর রহমান ও মেহেদী হাসান মিরাজ বল হাতে সাম্প্রতিক সময়ে ভালো করছেন। কেবল তরুণ ব্যাটসম্যানদের এগিয়ে আসার অপেক্ষা।
ওয়ানডেতে শ্রীলঙ্কা খানিকটা পিছিয়ে আছে এই সময়ে। ক’দিন আগেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তারা ঘরের মাঠে সিরিজ হেরেছে। তবে এশিয়া কাপের শুরুতেই বড় ধরনের ধাক্কা খাচ্ছে লঙ্কানরা। দলের ও অন্যতম ফর্মে থাকা স্পিনার আকিলা ধনঞ্জয়া প্রথম দুই ম্যাচে থাকছেন না, তার স্ত্রীর সন্তান প্রসবের কারণে। এছাড়া দিনেশ চান্দিমাল ও দানুশকা গুনাথিলাকা এরই মধ্যে ইনজুরির কারণে ছিটকে পড়েছেন।
শ্রীলঙ্কার পক্ষে থেকে এমন ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’ সুযোগ হয়তো খানিকটা হলেও এগিয়ে রাখবে বাংলাদেশকে। কিন্তু মিডল অর্ডারে অনিয়ন্ত্রিত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে না পারলে বিপদ বাড়বে বাংলাদেশের। দিলরুয়ান পেরেরার অফস্পিন ওই সময়ে ভোগাবে বাংলাদেশকে। যদিও দলের ওপেনার তামিম ইকবালের চোখে শ্রীলঙ্কান প্রতিপক্ষের চেয়ে ঘুরে-ফিরে সেই দুবাইয়ের গরমই বড় প্রতিপক্ষ মনে হচ্ছে।
যাদের উপর পাখির নজর
শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস এই মুহূর্তে ওয়ানডেতে ভালো অবস্থানে রয়েছেন। সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে অপরাজিত ৯৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন ম্যাথুস। দিনেশ চান্দিমালের অনুপস্থিতিতে এই মুহূর্তে অ্যাঞ্জেলোকে তাই কেবল নেতৃত্ব দিলেই চলবে না, প্রোটিয়াদের বিপক্ষে খেলা সেই ইনিংসের প্রতিফলন ঘটাতে হবে বাংলাদেশের বিপক্ষেও।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে তুরুপের তাস ওপেনার তামিম ইকবাল। এখন পর্যন্ত চলতি বছরে তামিমের গড় ৮৯.৮৩ রান। মোট এসেছে ৫৩৯ রান। এশিয়া কাপে হয়তো তাকে আরও বেশি করতে হতে পারে। কারণ এখনও ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ওপেনিং পার্টনারশিপে স্থিতিশীল জুটি খুঁজে পায়নি।
দলের খবর ও সম্ভাব্য মূল একাদশ
শ্রীলঙ্কা তাদের পেস আক্রমণের অন্যতম হাতিয়ার লাসিথ মালিঙ্গাকে এই ম্যাচে পাচ্ছে। অন্যদিকে আকিলা ধনঞ্জয়ার জায়গাতেই সুযোগ হচ্ছে অফস্পিনার দিলরুয়ান পেরেরার। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে তার সাফল্যের সুখস্মৃতি রয়েছে। দলে ফিরেছেন নিরোশান ডিকভেলা ও শিহান জয়সুরিয়া।
শ্রীলঙ্কা একাদশ
নিরোশান ডিকভেলা, উপল থারাঙ্গা, কুশল মেন্ডিস, কুশল পেরেরা, অ্যাঙ্গেলো ম্যাথুস (অধিনায়ক), ধনঞ্জয়া ডি সিলভা, থিসারা পেরেরা, দাশুন শানাকা, দিলরুয়ান পেরেরা, সুরঙ্গ লাকমাল, লাসিথ মালিঙ্গা।
শনিবারের ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে তামিমের সঙ্গে ওপেন করতে পারেন লিটন কুমার দাস। অন্যদিকে আরিফুল হক ও মোহাম্মদ মিঠুনরা সুযোগ পেতে পারেন সাব্বির রহমানের জায়গায়। এনামুল হকের সঙ্গে এশিয়া কাপের স্কোয়াড থেকে ছিটকে গেছেন সাব্বির।
বাংলাদেশ একাদশ
তামিম ইকবাল, লিটন কুমার দাস, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম (উইকেটরক্ষক), মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, মোহাম্মদ মিঠুন, মেহেদী হাসান মিরাজ, রুবেল হোসেন, মাশরাফি বিন মুর্তজা (অধিনায়ক) ও মুস্তাফিজুর রহমান।
উইকেট ও কন্ডিশন
পরিসংখ্যান বলছে, দুবাইয়ের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে গেল বছর পাঁচ ম্যাচের চারটিতেই জয় পেয়েছে আগে ফিল্ডিং করা দল। মাঠের তাপমাত্রা থাকবে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি। স্টেডিয়ামের কিউরেটর টম লুমসডেন জানিয়েছেন, ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ২৭০ রানের মতো হতে পারে। তবে স্বাভাবিকভাবে ২৬০ রান হয়।
উইকেটের স্বভাব সম্পর্কে তিনি জানান, সেপ্টেম্বরের এই উষ্ণ ও আদ্র আবহাওয়ায় দিনের বেলা গরম, রাতে আর্দ্রতার সঙ্গে থাকবে শিশির। সেক্ষেত্রে বিকেলের দিকে উইকেট কিছুটা পেস সহায়ক হবে। রাতের বেলা সুইংয়ে বাড়তি সুবিধা থাকতে পারে, সন্ধ্যায় সুবিধা পাবে স্পিনাররা।
পরিসংখ্যানের কথকতা
১৯৯৫ সালের ৮ এপ্রিলের পর এই প্রথম সংযুক্ত আরব আমিরাতে খেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই মুহূর্তে লঙ্কান কুশল পেরেরা ও থিসারা পেরেরা দলের ব্যাটিং ও বোলিংয়ে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। কুশল ২০১৮ সালের এখন পর্যন্ত ৩৮.৬২ গড়ে তুলেছেন ৩০৯ রান। অন্যদিকে থিসারা নিয়েছেন সর্বোচ্চ ১৮ উইকেট।
কে কী বলছেন?
প্রতিবার দুয়েকটি বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়া উচিত। আমার মনে হয় আমাদের কারোরই (বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা) নিদাহাস ট্রফির ঘটনা মাথায় নেই। সেই ইতিহাসকে সরিয়ে দুই দলই জানে সেপ্টেম্বর ১৫ তারিখের ম্যাচে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
– তামিম ইকবাল (ওপেনার, বাংলাদেশ)
আমাদের প্রস্তুতি অনেক ভালো হয়েছে। আমরা প্রতিযোগিতামূলক একটি সিরিজের অপেক্ষায় রয়েছি। আমার মনে হয় প্রতিটি দলই সেই অপেক্ষায় রয়েছে।
– অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস (অধিনায়ক, শ্রীলঙ্কা)
সামনের বছরে আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে। আমরা সবাই সেখানে অংশগ্রহণ করতে মুখিয়ে আছি। আমার মনে হয় এই মুহূর্তে এশিয়া কাপ সেই আসরের জন্য আমাদের সবার জন্য দারুণ একটা প্রস্তুতি হয়ে যাবে।
– মাশরাফি বিন মুর্তজা (অধিনায়ক, বাংলাদেশ)
ফিচার ইমেজ- DNA India