আধুনিক ফুটবলে একটি ক্লাবে ক্লাবটির স্পোর্টিং ডিরেক্টর ক্লাবের ভাগ্য নির্ধারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে থাকেন। তেমনি একজন স্পোর্টিং ডিরেক্টর হচ্ছেন এডু গ্যাসপার। আর্সেনালের সাবেক এই খেলোয়াড় এখন ক্লাবের স্পোর্টিং ডিরেক্টর। একটু বেশি আশা নিয়েই তাকে এই পদে নিয়োগ দেয় আর্সেনাল। কিন্তু তাদের আশার কতটুকু প্রতিদান দিতে পেরেছেন তিনি?
২০২২-২৩ মৌসুমে খুব অল্পের জন্য লিগ শিরোপা হাতছাড়া হয় আর্সেনালের। খুব কাছে এসেও এভাবে যে ভরাডুবি হবে, সে শঙ্কা ছিল অনেকেরই। কিন্তু এভাবে পুরো মৌসুম টেবিলের শীর্ষে থেকে একদম শেষে এসে শীর্ষস্থান হারানো খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়। তবে তারা যাদের কাছে শীর্ষস্থান হারিয়েছে, সেই ম্যানচেস্টার সিটি কিন্তু শিরোপার অন্যতম দাবিদারই ছিল। অনেকক্ষেত্রে তারা আর্সেনালের থেকে এগিয়ে কয়েকগুন। স্কোয়াড ডেপথ বলুন কিংবা অভিজ্ঞতা, সিটির ধারেকাছেও ছিল না আর্সেনাল। আর যেখানে আর্সেনালের প্রথম একাদশের খেলোয়াড়দের বেশিরভাগই উঠতি তারকা, সেখানে ম্যানচেস্টার সিটিতে সবাই প্রতিষ্ঠিত তারকা।
আর্সেনাল জিতবে না, যারা এই কথাটি বলে আসছিলেন মৌসুমের শুরু থেকেই তাদের একটি বড় যুক্তি ছিল আর্সেনালের স্কোয়াড ডেপথ। কোন একজন প্লেয়ার ইনজুরি বা অন্য কোনো কারণে খেলতে না পারলে তার ব্যাকআপ দিয়ে তারা সেভাবে সাপোর্ট পাবে না। হলোও তাই, এক সালিবার ইনজুরির জন্য গোটা দলটাই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ল। এই মৌসুমের আগের মৌসুমে ঠিক একইভাবে টমাস পার্টের ইনজুরির জন্য একদম মৌসুমের শেষে এসে খেই হারিয়ে অল্পের জন্য চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জায়গা পায়নি আর্সেনাল।
এই আর্সেনাল কিন্তু দুই বছর আগেও এমন ছিল না। বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত আর্সেনাল ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করে গত মৌসুম থেকে। কৃতিত্ব অবশ্যই কোচ মিকেল আর্তেতার। তার সাথে আরেকটি নাম আসবে। তিনি এডু গ্যাসপার, আর্সেনাল ক্লাব ইতিহাসের প্রথম টেকনিক্যাল ডাইরেক্টর, পরবর্তীতে যিনি হন স্পোর্টিং ডিরেক্টর।
এডু ছিলেন আর্সেনালের ইনভিন্সিবল দলটির একজন। খেলোয়াড়ি জীবন শেষে ব্রাজিলের ক্লাব করিন্থিয়ানসের ফুটবল ডিরেক্টরের দায়িত্ব পান। ২০১৪ বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন ইরানের সহকারী কোচ। সেখান থেকে ২০১৯ সালে যোগ দেন আর্সেনালে। আর্সেনালে তিনি যে দায়িত্বে আছেন, তাতে কি তিনি সফল? এই মৌসুমে আর্সেনাল যে তীরে এসে তরী ডুবাল, তাতে কি তিনি কোনোভাবে দায়ী?
এডু যখন আর্সেনাল ক্লাবে আসেন তখন আর্সেনাল ওয়েঙ্গারের যুগ শেষে উনাই এমেরির যুগে নতুনভাবে গড়ে উঠছিল। প্রথম মৌসুমে অল্পের জন্য টপ ফোর মিস করা উনাই এমেরি পরের মৌসুমে হারিয়ে ফেলেন দলের নিয়ন্ত্রণ। ফলে দলের পারফরম্যান্স খারাপ হওয়ায় বিদায় নিতে হয় তাকে। তার জায়গায় কিছুদিন দলের দায়িত্ব নেন আরেক আর্সেনাল লিজেন্ড ফ্রেডি লিয়্যাঙ্গবার্গ। কিন্তু আর্সেনাল খুঁজছিল একটি স্থায়ী সমাধান। সেই লক্ষ্যেই তারা ম্যানচেস্টার সিটি থেকে নিয়ে আসে তাদের সহকারি কোচ মিকেল আর্তেতাকে। এরপর থেকে নতুন আর্সেনাল গঠনে একসাথে কাজ শুরু করেন আর্তেতা ও এডু।
এডুর এই মেয়াদকালে সাফল্য-ব্যর্থতা সবই ছিল। তবে এক্ষেত্রে তার ব্যর্থতার পাল্লাই বেশি ভারী হবে।
টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ও স্পোর্টিং ডিরেক্টর রোলে বেশ কিছু দায়িত্ব বর্তায়। এদের মধ্যে নতুন খেলোয়াড় দলে ভেড়ানো, পরিকল্পনায় না থাকা খেলোয়াড়দের অন্য ক্লাবে বিক্রি করে দেয়া, স্কোয়াড ডেভেলপমেন্টে নজর রাখা, খেলোয়াড়দের চুক্তি নিয়ে আলাপ আলোচনা করা, ক্লাবকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা এবং ক্লাবের সব ডিপার্টমেন্টের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করা।
ক্লাবের প্লেয়ার স্কাউটিংয়ে স্পোর্টিং ডিরেক্টরের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। ক্লাবের জন্য সম্ভাব্য সঠিক খেলোয়াড় ঠিক করায় সাহায্য করবেন স্কাউটদের, এরপর কোচকে সাথে নিয়ে ডিসিশন নেবেন যে আদৌ এই খেলোয়াড়কে দলে প্রয়োজন রয়েছে কি না। এরপর বলা যায় তিনি স্কোয়াডের গ্রোথে কোন কোন জায়গায় সমস্যা সে অনুযায়ী কোচকে সাজেশন দেবেন। আর তিনি শুধু খেলোয়াড়দের না, কোচিং স্টাফ থেকে শুরু করে মাঠের সবার চুক্তি, বেতন, বোনাস ঠিক করবেন।
এখন প্রশ্ন হলো এডু গ্যাসপার এগুলোর কোনটায় সফল এবং কোনটায় ব্যর্থ?
স্পোর্টিং ডিরেক্টর ও টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের একদম প্রাথমিক একটি দায়িত্ব হল সফল্ভাবে ক্লাবের ট্রান্সফারগুলো পরিচালনা করা। এডুর সময়ে আর্সেনাল এই ট্রান্সফারের ব্যাপারে যথেষ্ট ভুগেছে। তার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ও সাইনিং ক্লাবের জন্য মোটেও ভালো ব্যাপার ছিল না। মাঝে তো এমন হয়েছে এক কিয়া জোরাবচিয়ানের কাছ থেকেই তিনজন ক্লায়েন্ট ডেভিড লুইজ, উইলিয়ান, আর সেড্রিক সোরেসকে দলে ভেড়ায়। এর মধ্যে এক ডেভিড লুইজ ২০২০ সালের এফএ কাপ জয়ে সামান্য কিছু অবদান রাখলেও বাকিরা অনেকটা দলের জন্য বোঝা হয়েই ছিলেন। আর ডেভিড লুইজের করা মাঠের ভুলগুলো ছিল বলার বাইরে একদম। অর্থনৈতিকভাবে আর্সেনাল এখন মোটামুটি স্বচ্ছল একটা ক্লাব। আমেরিকান মালিক স্ট্যান ক্রোয়েংকে এমিরেটস স্টেডিয়ামের কিস্তির টাকাগুলো পুরোপুরি শোধের পর ক্লাবের স্কোয়াডের পেছনে ইদানিং ভালোই টাকা ঢালছেন। সেই হিসেবে খেলোয়াড় কিনতে কখনোই টাকার সমস্যা থাকার কথা না। কিন্তু এর মধ্যেও আর্সেনাল বেশ কিছু ট্রান্সফার মিস করে ফেলেছে। এখানে আপনি দায়ী করতে পারেন এডুর দূরদর্শিতার অভাবকে।
এরপর আমরা আসি আর্সেনালের খেলোয়াড়দের বেতন কাঠামো ও চুক্তির ব্যাপারে। হ্যাঁ, সম্প্রতি অবশ্যই আর্সেনাল এসবে লাগাম টেনে ধরেছে। কিন্তু এর আগে আর্সেনালের উলটাপালটা বেতন কাঠামো আর ক্যারিয়ারের অন্তে থাকা খেলোয়াড়দের লম্বা সময়ের চুক্তি দিয়ে বিপদে পড়েছিল। এডুর এইসব ব্যাপারে নেগোসিয়েশনের ক্ষমতা তুলনামূলক কমই ছিল। এইসবের জন্য আর্সেনালের ফ্লেক্সিবিলিটি অনেকটাই কমছিল ট্রান্সফার মার্কেটে। তবে বলতেই হয় যে এই কাঠামো ঠিক করা আর অফ দ্য ফিল্ডে ক্লাবের লক্ষ্য নিয়ে এডু ভালই কাজ করেছেন। অন্তত এখন যারা ক্লাবে খেলেন তারা ক্লাবের দর্শন নিয়ে জানে, ক্লাবের খেলার ধরন কী, তা-ও তাদের সামনে পরিস্কার এবং ক্লাব যে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে তাতেও খেলোয়াড়েরা খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। এইদিকে এডুকে ক্রেডিট দিতেই হয়। আর্তেতা যে একটি প্রজেক্ট নিয়ে এগোচ্ছেন, তাতে এডুর অনেকখানি অবদান রয়েছে।
যদি বলি এডু আসলে ব্যর্থ কোথায় তবে বলতে হবে সেটা ট্রান্সফার মার্কেটে। ইউথ প্লেয়ারদের জন্য লোনের ব্যবস্থা করা, সিস্টেমের সাথে যায় এমন খেলোয়াড় নিয়ে আসা, ক্লাবের পরিকল্পনায় না থাকা কিংবা আশানুরূপ পারফর্ম্যান্স না দেখানো খেলোয়াড়দের মোটামুটি একটি দামে বিক্রি করা এসব ব্যাপারে এডু আসলেই ব্যর্থ ছিলেন।
ইউরোপের ফুটবল একাডেমিগুলোর মধ্যে আর্সেনালের একাডেমি খুবই প্রসিদ্ধ। বর্তমানে ফার্স্ট টিমে খেলা বুকায়ো সাকা, এমিল স্মিথ রো, রিস নেলসন, এডি এনকেতিয়াহ সবাই এই হেইল এন্ড থেকেই উঠে এসেছেন। কিন্তু আর্সেনাল ইদানিং নতুন উঠে আসা খেলোয়াড়দের ঠিকমত গেমটাইম দিতে পারছে না। গেম টাইম দিতে না পারলে ক্লাব অন্য ক্লাবে তাদের লোনে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। কিন্তু এখন অনেক খেলোয়াড়কেই ক্লাব ঠিকঠাক জায়গায় লোনেই পাঠাতে পারছে না। একাডেমিতে থাকা মারসেলো ফ্লোরেস আর্সেনালের মূল দলে সুযোগ পাওয়ার আগে সুযোগ পেয়েছিলেন মেক্সিকোর জাতীয় দলে। কিন্তু এরপর লোনে গিয়েও তেমন গেমটাইম পাওয়া হয়নি তার। ফলে মেক্সিকোর বিশ্বকাপ মিশনের কোনো প্ল্যানেই তিনি ছিলেন না নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকায়। এভাবে আরো কয়েকজন খেলোয়াড় রয়েছেন যাদের লোনে সঠিক ক্লাবে পাঠানো হয় নি। তাদের মধ্যে ছিলেন মিগুয়েল আজিজ, চার্লি প্যাতিনো, ওমার রেকিকের মতো কিছু উদীয়মান তরুণ। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধায় ভুগে গত মৌসুমে আর্সেনাল একাডেমি থেকে চেলসিতে পাড়ি জমান ওমারি হাচিনসন। সম্প্রতি প্রিমিয়ার লিগে খেলা সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় ইথান নোয়ানেরিও আর্সেনালে স্কলারশিপ চুক্তিতে স্বাক্ষর করা নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন। পরে যদিও তিনি আর্সেনালেই থেকে যান। ক্লাব যদি এসব উদীয়মান খেলোয়াড়দের সঠিক গেমটাইম না দিয়ে বৃদ্ধির সুযোগ না দেয়, তবে এখান থেকে সাকার মতো বিশ্বমানের খেলোয়াড় বের হওয়া বন্ধই হয়ে যেতে পারে। ক্লাবে কিন্তু এই দায়িত্বগুলো সমন্বয় করার কাজ এডু গ্যাসপারেরই।
আর্সেনালের একাডেমি নিয়ে কিছু শঙ্কা জেগেছে ইতোমধ্যেই। গত মৌসুমে জ্যাক উইলশেয়ার অনূর্ধ্ব-১৮ দলের কোচ হিসেবে ক্লাবে ফেরেন। প্রথম মৌসুমেই তারা অনূর্ধ্ব-১৮ এফএ কাপের ফাইনাল খেলে। কিন্তু এই দলের অধিকাংশ খেলোয়াড় ছিলেন অনূর্ধ্ব-২১ দলের। বয়স কম হলেও তারা তাদের পারফর্ম্যান্সের জন্য প্রমোশন পেয়ে খেলতেন অনূর্ধ্ব-২১ দলে। সব বয়সের পারফরমারদের যে একটা অভাব রয়েছে একাডেমিতে তার প্রমাণ চোখের সামনে ছিল। তবে এখানে একাডেমির হেড কোচ পেয়র মার্টেস্যাকারের একটি দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু ক্লাবের বাইরে যা করা লাগবে তা তো এডুকেই করতে হবে।
এবার আমরা আসি হাই-প্রোফাইল সাইনিংয়ের ব্যাপারে। গত ২ বছরে আর্সেনালের হাত থেকে ছুটে যায় অনেক খেলোয়াড়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বলা যায় মিখাইলো মুদরিচ, রাফিনহা, ডুসান ভ্লাহোভিচ, হোয়াও ফেলিক্স, হোসেম অউয়ার, ডগলাস লুইজ, লিসান্দ্রো মার্টিনেজ, ব্রুনো গিমারেজ। মুদরিচের ডিলটায় চেলসির বাগড়া দিলেও এডু ক্লাব, খেলোয়াড় বা এজেন্ট কাউকেই ঠিকমতো কনভিন্স করতে পারেননি। ফেলিক্স তো চেলসির ভালো অফার দেখেই আর্সেনালের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ভ্লাহোভিচ আর্সেনালকে ব্যাবহার করেন জুভেন্তাসের ট্রান্সফারটি তাড়াতাড়ি করার জন্য। রাফিনহার প্রথম পছন্দ ছিল বার্সেলোনা, মার্টিনেজ এরিক টেন হ্যাগের ডাককেই প্রাধান্য দেন। এইসব ক্ষেত্রে এডুর ভূমিকা আসলেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। ঠিকমতো ব্যাকআপ আর স্কোয়াড ডেপথ না থাকায় ২০২২ সালের বিশ্বকাপের পর বেশ কয়েকবার খেই হারায় আর্সেনাল। আর ব্রুনো বা লুইজ ডিলে এডু তার ব্রাজিলীয় সম্পর্কগুলো এখানে ঠিকমতো ব্যবহারই করতে পারেননি।
ডিফেন্সে আর্সেনাল ভুগছিল বেশ কবছর ধরেই, গত মৌসুমে লিগ শিরোপা, আগের মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার সুযোগ তারা হারায় তাদের রক্ষণভাগের ব্যর্থতার জন্য। স্কোয়াডে ভারসাম্য ছিল না কোনো। প্রথম একাদশের কেউ না থাকলেই মাঠে ভেঙে পড়ত পুরো দলের কাঠামো। এই মৌসুমে কেনা ডেক্লান রাইসকে আর ১ মৌসুম আগে আনতে পারলে কিছুটা সাহায্য অবশ্যই হত।
এরপর এই সময়েই আর্সেনালের বেশ কিছু কিনে আনা খেলোয়াড় দলে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তাদের রেকর্ড সাইনিং নিকোলাস পেপে। তবে শোনা যায় পেপের এই ট্রান্সফারে আর্সেনালের সাবেক হেড অফ ফুটবল রাউল সানলেহি কিছু দুর্নীতি করেছিলেন। পেপেকে বাদ দিলেও এই লিস্টে আরো যোগ হবে পাবলো মারি, সেড্রিক সোরেস, উইলিয়ান, রুনার অ্যালেক্স রুনারসন।
এবার আসি এডু তার চরম ব্যর্থতা দেখাচ্ছে কোথায় সেখানে। গত ৫ বছরে ট্রান্সফার মার্কেটে আর্সেনালের নেট স্পেন্ড ছিল -৫৯৫.৪৩ মিলিয়ন পাউন্ড। অর্থাৎ গত ৫ বছরে তারা খেলোয়াড় বিক্রি করে যা আয় করেছে, তার চেয়ে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন পাউন্ড বেশি তারা খরচ করেছে খেলোয়াড় বিক্রিতে। প্রিমিয়ার লিগের ২০টি দলের মধ্যে যেটি সর্বোচ্চ। এমন চলতে থাকলে যেকোনো সময়ই উয়েফা এফএফপিতে ট্রান্সফার ব্যান খেতে পারে।
গত দুই বছরে ৪টি ট্রান্সফার উইন্ডোতে আর্সেনাল সবচেয়ে বেশি খেলোয়াড়কে ক্লাব ছাড়া করেছে বিক্রি করে নয়, চুক্তি বাতিল করে। খেলোয়াড় ছেড়ে দিয়ে টাকা পাওয়ার জায়গায় উল্টো খেলোয়াড়দের টাকা দিতে হয়েছে এই চুক্তি বাতিল করায়। এভাবে তারা তাদের ক্লাব থেকে অপ্রয়োজনীয় খেলোয়াড়দের ছেড়েছে। এই তালিকাও আরো বিশাল। একদম ফ্রি’তে আর্সেনাল ছেড়ে অন্য ক্লাবে গিয়েছেন পিয়ের এমেরিক অবামেয়াং, উইলিয়ান, মেসুত ওজিল, হেক্টর বেয়েরিন, শকদ্রান মুস্তাফি, সিয়েড কোলাসিন্যাচ, ডেভিড লুইজ, এইন্সলে মেইটল্যান্ড-নাইলস, আলেক্সান্ডার লাকাজেত, কালাম চ্যাম্বার্স, সক্রেটিস পাপাস্টাথোপোলাস, হেনরিখ মিখিতারিয়ান, স্টিফেন লিটস্টাইনার, অ্যারন রামজি, ড্যানি ওয়েলবেকে। আর বাকিদের মধ্যে পাবলো মারি ৪.৯ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে মনজায়, দুইবছর লোনে ঘুরা মাতেও গুয়েন্দৌজি ১১ মিলিয়নে মার্শেইয়ে, লুকাস তরেইরা ৬ মিলিয়ন ইউরোয় গ্যালাতাসারায়ে, বার্নড লেনো ৩.৬ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ফুলহ্যামে, মাভ্রোপানোস ৩.২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে স্টুটগার্টে চলে যান। অউবামেয়াংয়ের সাথে মাত্র ১ বছর আগে আর্সেনাল ৩ বছরের একটি বড় এমাউন্টের চুক্তি করে। দেড় বছরেই তা বাতিল করে আর্সেনাল। উইলিয়ান কোনো টাকা নেননি চুক্তি বাতিলের সময়, তিনিও আর্সেনালে আসেন লম্বা চুক্তিতে।
দেখা যাচ্ছে আর্সেনাল ঠিকমতো এসব ব্যাপার পরিচালনা করতে পারেনি। খেলোয়াড় ক্লাব ছাড়ার সময় টাকা তো আসেই না, উল্টো খেলোয়াড়দেরকেই টাকা দিয়ে বিদায় করতে হয়। আর খেলোয়াড় বিক্রির সময়েও ৫ মিলিয়ন ইউরো পাওয়াও কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে যায়। এতেই বোঝা যায়, আর্সেনাল ও এডু গ্যাসপার ক্লাবগুলোর সাথে আলোচনার ব্যাপারে কতটা পিছিয়ে আছে। এমনকি সম্প্রতি ক্লাবের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় না থাকা সাবেক রেকর্ড সাইনিং নিকোলাস পেপের চুক্তিও বাতিল করে দিতে চাচ্ছে। এমন হয়ে ৭২ মিলিয়ন ইউরো হতে আর্সেনালের হাতে ফেরত আসে একেবারে শূন্য। ইউরোপের কোনো ক্লাবই এইভাবে একদম নামমাত্র দামে খেলোয়াড় ছাড়ে না। এমনকি তাদের নগর প্রতিদ্বন্দ্বী চেলসিও তাদের একদম ফ্লপ যাওয়া খেলোয়াড়গুলোকে বিক্রি করে কিছু হলেও কামিয়ে নিচ্ছে। এমনকি সুপার ফ্লপ যাওয়া কাই হ্যাভার্টজকে তারা আর্সেনালের কাছেই বিক্রি করেছে ৬৫ মিলিয়ন ইউরোতে। এডুর থেকে ট্রান্সফার মার্কেটে বড় খেলোয়াড় তারাই।
তবে আশার কথা হচ্ছে এডু চেষ্টা করছেন নিজের এই দুর্নাম ঘুচাতে, বলতে গেলে এই মৌসুমে একদম কোমর বেঁধে নেমেছেন। এই গ্রীষ্মে আর্সেনাল ইতোমধ্যে খরচ করেছে ২৩১ মিলিয়ন ইউরো, যা দিয়ে তারা কিনেছে ডেক্লান রাইস, কাই হ্যাভার্টজ ও জুরিয়েন টিম্বারকে। টমাস পার্টেকে কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছে জুভেন্টাস ও সৌদি প্রো লিগের দুটি দল। এডু এখনো আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন পার্টের জন্য একটি ভাল দাম পাওয়ার আশায়। একই আশা তাদের তরুণ স্ট্রাইকার ফোলারিন বালোগুনের ট্রান্সফার থেকেও। ওয়েস্ট হ্যাম ও ইন্টার মিলানের কাছে ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড দাবি করেছে তারা। দ্বিতীয় গোলরক্ষক ম্যাট টার্নারকে তারা নটিংহ্যাম ফরেস্টের কাছে বিক্রি করেছে ৭+৩ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে।
নিজের এই মেয়াদকালে আর্সেনালের স্পোর্টিং ডিরেক্টর হিসেবে এডু গ্যাসপার বেশ কিছু ভুল করেছেন। এই ভুলগুলোই প্রশ্ন তুলেছে তার সক্ষমতা নিয়ে। রেকর্ড ট্রান্সফার, বিশাল নেগেটিভ নেট ট্রান্সফার, পরিস্কার দিক নির্দেশনার অভাব, ট্রান্সফার, চুক্তি ও বেতন নিয়ে অব্যবস্থাপনা, যুব উন্নয়নে অপর্যাপ্ত অগ্রগতি সম্মিলিতভাবে একটি ক্লাবের ফুটবল পরিচালনার চিত্র ফুটিয়ে তোলে যা আধুনিক ফুটবলের সব চাহিদা পূরণ করতে এখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু ব্যর্থ ট্রান্সফার, প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়া হাই প্রোফাইল সাইনিং, রক্ষণভাগের দুর্বলতাগুলো এখনো অমীমাংসিতই রয়ে গিয়েছে। এডুর নেতৃত্বে যেখানে এসব ব্যাপার যত দ্রুত সমাধান করার কথা উল্টো আর্সেনাল এভাবে স্কোয়াডের ভারসাম্য হারিয়ে নিজেদেরকে কৌশলগতভাবে ফ্লেক্সিবল করতে পারছে না। ট্রান্সফার মার্কেটে এভাবে প্ল্যান-এ’তে থাকা খেলোয়াড়দের সাইন করাতে না পারা ও ট্রান্সফার মার্কেটে পাওয়া সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পারায় দলটি দেশীয় কিংবা ইউরোপিয় প্রতিযোগিতা কোথাও সুবিধা করতে পারছে না।
একজন সফল ক্রীড়া পরিচালক বোর্ড, কোচিং স্টাফ ও খেলোয়াড়দের মধ্যে লিংক হিসেবে কাজ করবেন এবং সকলের সম্মিলিত সহযোগিতায় ক্লাবকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। দুঃখজনক হলো আর্সেনাল দলটিতে এখন এমন একতাবদ্ধ মনোভাব থাকলেও তারা পিছিয়ে রয়েছেন তাদের সক্ষমতার দিক থেকে। বিচ্ছিন্ন একটি দলকে এক সূত্রে গাঁথার ক্রেডিট আর্তেতার সাথে এডু অবশই পাবেন।
আধুনিক ফুটবল অত্যন্ত জটিল। দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি, দক্ষ স্কাউটিং, ও বিচক্ষণতার সাথে আলোচনার ক্ষমতা একটি ক্লাবের বিকাশের জন্য খুবই প্রয়োজন। যদিও এই চ্যালেঞ্জগুলো খুবই কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। ম্যানচেস্টার সিটি, চেলসি, রিয়াল মাদ্রিদসহ অনেক ক্লাবই এসব করে দেখিয়েছে। আর্সেনালের জন্যও এটি সম্ভব হবে, তারা যদি তাদের দলকে সঠিক দিকে পরিচালনা করে। আর এসবে অন্যতম একটি গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে এডু গ্যাসপারকে, কারণ ক্লাবের সবার সাথে যোগসূত্র তো তিনিই।
ফুটবল বিশ্বে সফলতা ও অল্পের জন্য ব্যর্থ হওয়ার মধ্যে ব্যবধান খুবই অল্প। কিন্তু ব্যর্থ তো ব্যর্থই, তার আবার রকমফের কীসের? ফুটবলের অন্যতম অভিজাত একটি ক্লাব আর্সেনাল। তারা তাদের এই আভিজাত্যকে পুনরুদ্ধার করতে চাইলে অবশ্যই কিছু ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর সাথে জড়িত এডু গ্যাসপারের ভবিষ্যৎও। আর্সেনালকেই ঠিক করতে হবে যে তারা তাদের ভবিষ্যৎ যাত্রা এডুকে সাথে নিয়েই করবে না এডুকে ছাড়াই করবে। ঘড়ির কাটায় প্রতি মুহূর্তেই অল্প অল্প করে সময় চলে যাচ্ছে। তাই যা করার সময় থাকতেই করতে হবে, তা আর্সেনালই করুক কিংবা এডু গ্যাসপার।