কারো কারো মতে তিনি বর্তমান সময়ের সেরা ফুটবলার। আবার কেউ কেউ তো তাকে সর্বকালের সেরাদের তালিকায়ও প্রথম স্থানটি দিতে চায়। তবে মেসি আসলেই বর্তমান সময়ের কিংবা সবসময়ের সেরা কি না, সে বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক অব্যাহত থাকলেও একটি কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আজকে মেসি নিজেকে যে অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তা রাতারাতি সম্ভব হয়নি। এজন্য তাকে লম্বা একটা সময় পাড়ি দিতে হয়েছে। এবং সেই সময়ে তিনি ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে অসংখ্য অবিস্মরণীয় মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছেন।
কিন্তু এখন যদি জিজ্ঞেস করা হয়, মেসির খেলোয়াড়ি জীবনের সেরা মুহূর্ত কোনটি? যদি তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ বা কোনো মেজর আন্তর্জাতিক ট্রফি জিততেন, তবে সেটিকেই কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই তার খেলোয়াড়ি জীবনের সেরা মুহূর্ত হিসেবে আখ্যা দেয়া যেত। কিন্তু এখনো যেহেতু মেসি সেই জাদুময় মুহূর্তের দেখা পাননি, তাই তার এ যাবৎকালের সেরা মুহূর্ত নির্ধারণে আমাদেরকে একটু যেন বিড়ম্বনাতেই পড়তে হয়। তবে মেসিই করে দিয়েছেন সেই সমস্যার সমাধান। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, খেলার মাঠে তার সেরা ১৪টি মুহূর্ত কোনগুলো।
চলুন, আর দেরি না করে স্বয়ং মেসির ভাষ্যেই জেনে নিই সেই মুহূর্তগুলোর সম্পর্কে।
এস্পানিওল ০-১ বার্সেলোনা
লা লিগা, ১৬ অক্টোবর, ২০০৪
২০০৪ সালের সেই ম্যাচে ডেকোর বদলি খেলোয়াড় হিসেবে আমি মাঠে নেমেছিলাম স্থানীয় প্রতিদ্বন্দ্বী এস্পানিওলের বিপক্ষে। অবশ্যই আমি কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত ছিলাম, কারণ সেটি যে ছিল আমার অভিষেক ম্যাচ। আমার জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল সেটি, কেননা বহুদিন ধরেই আমি খুবই মরিয়াভাবে এই মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম, এবং সম্ভবত এক পর্যায়ে আমি অধৈর্য্যও হয়ে পড়েছিলাম।
কোচ ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড এবং অন্যান্য খেলোয়াড়দের সাথে কাজ করার সুবাদে ইতিমধ্যেই আমি বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলাম। বেশ অনেকদিন ধরেই আমি দলের স্টাফ ও সতীর্থদের সাথে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসছিলাম। এই ব্যাপারটি আমাকে অনেক সাহায্য করেছিল ক্লাবের মূল দলে থিতু হওয়ার ক্ষেত্রে। এটি ছিল আমার জন্য খুবই বিশেষ একটি দিন। এটি ছিল এমন একটি স্বপ্ন, যা আমি দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছিলাম; এবং অবশেষে সেটি সত্যি হতে চলেছিল। যদিও এখন যখন পেছন ফিরে তাকাই, সেই দিনটিকে মনে হয় যেন অনেক কাল আগের কথা।
বার্সেলোনা ৭-১ বেয়ার লেভারকুসেন
চ্যাম্পিয়নস লিগ, শেষ ১৬, ৭ মার্চ, ২০১২
কী অসাধারণ একটি রাত ছিল সেটি! আমি নিশ্চিত নই যে কোনোদিন আমি আমার গোলগুলোকে র্যাংক করতে, কিংবা একটিকে অন্যটির চেয়ে এগিয়ে রাখতে পারব কি না। সত্যিই আমার মনে হয় না, কোনো একটি গোল অন্য একটি গোলের চেয়ে সুন্দর ছিল।
পাঁচটি গোল পেয়ে আমি খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলাম। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমার দল হেসেখেলে জয় তুলে নিয়েছিল। ওই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারিনি যে, আমিই চ্যাম্পিয়নস লিগের এক ম্যাচে পাঁচ গোল করা প্রথম খেলোয়াড়। আমি শুধু ভাবছিলাম, দল হিসেবে আমরা খুবই ভালো খেলেছি, এবং সেজন্য আমি অনেক খুশিও ছিলাম। কারণ দিনশেষে এটি তো একটি দলীয় খেলা, আর দলের বাকিদের সাহায্য ছাড়া আমি একা কিছুই করতে পারতাম না।
নাইজেরিয়া ০-১ আর্জেন্টিনা
অলিম্পিক, ফাইনাল, ২৩ আগস্ট, ২০০৮
সার্জিও আগুয়েরোর সাথে দীর্ঘদিন ধরে আমার দারুণ বন্ধুত্ব। যখন আমাদের বয়স অনেক কম ছিল, আমরা প্রচুর সময় একসাথে কাটাতাম। বিশেষত আমরা দুজনেই যখন জাতীয় দলের হয়ে ছিলাম, এবং একসাথে ফিফা (ভিডিও গেমস) খেলতাম। সত্যি কথা বলতে, বেইজিং সফরটি ছিল আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতিগুলোর একটি।
অলিম্পিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু এজন্যই নয় যে, আপনি আপনার দেশের হয়ে একটি পদক জয়ের সুযোগ পাবেন। বরং এজন্যও যে, আপনি এমন অসাধারণ একটি বৈশ্বিক আয়োজনের অংশ হতে পারবেন, এবং অলিম্পিক ভিলেজে একই সাথে থাকার সুযোগ পাবেন আরো অসংখ্য রকম খেলার অ্যাথলেটদের সাথে।
এটি আমাদের জন্য ছিল অসাধারণ, পরিপূর্ণ একটি টুর্নামেন্ট। হ্যাঁ, আমরা সেমিফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে ৩-০ ব্যবধানে জিতি। সেই ব্রাজিল দলটিও ছিল অসম্ভব ভালো, এবং তারা ছিলও দারুণ ফর্মে। তাছাড়া আমরা নেদারল্যান্ডস ও নাইজেরিয়ার বাধাও পার হয়ে এসেছিলাম। দুইটি ম্যাচই ছিল অনেক কঠিন, এবং আমাদেরকে আমাদের সেরাটা দিয়েই ম্যাচ দুইটি জিততে হয়েছিল। আর সেজন্য আমরা অনেক আত্মবিশ্বাসীও হয়ে উঠেছিলাম যে, স্বর্ণপদক আমরাই জিতব। আমাদের দলটির দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন, এবং আমাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে কী দারুণ একতা ছিল। একদম শুরু থেকেই আমরা বিশ্বাস করে আসছিলাম যে, আমরা বেইজিংয়ে জিততে পারব, এবং শেষমেশ আমরা তা করতে সক্ষম হই।
বার্সেলোনা ৫-১ সেভিয়া
লা লিগা, ২২ নভেম্বর, ২০১৪
লা লিগার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার অনুভূতিটা অসাধারণ। কারণ এই লিগটিতে ইতিহাসের এত এত কিংবদন্তি খেলোয়াড় খেলেছেন, এবং তারা কত অর্জনও করেছেন। তাই আমার জন্যও এটি বিশাল একটি অর্জন।
আগে থেকে আমি এটির জন্য কোনো বিশেষ উদযাপনের পরিকল্পনা করে রাখিনি। এবং আমি কখনও ভাবিওনি যে, গোল করার পর কী হবে। মাঠের খেলার মতোই, উদযাপনেও যা যা করেছিলাম, তা একদম প্রাকৃতিকভাবেই এসেছিল।
আর্জেন্টিনা ২-১ বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা
বিশ্বকাপ, গ্রুপপর্ব, ১৫ জুন, ২০১৪
বিশ্বকাপে দ্বিতীয় গোল পাওয়ার জন্য আমাকে আট বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম টুর্নামেন্টটা যেন আমাদের জন্য অনেক ভালো হয়, এবং বসনিয়ার সাথে জয় দিয়েই শুরু করেছিলাম আমরা। আর আমি করেছিলাম আমার দলের দ্বিতীয় গোলটি।
সবকিছুই খুব দ্রুত হয়ে গিয়েছিল। প্রায় মাঝমাঠের কাছাকাছি থেকে আমি বল নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছিলাম, এবং চেয়েছিলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিপক্ষের পেনাল্টি এরিয়ায় ঢুকে পড়তে। গঞ্জালো হিগুয়াইনের সাথে আমি একটা ওয়ান-টু খেলেছিলাম, আর তারপর বক্সের প্রান্ত থেকে শট নিয়েছিলাম। ভাগ্যক্রমে গোলটি পেয়ে গিয়েছিলাম।
বাছাইপর্বেও আমরা দারুণ খেলেছিলাম, এবং কয়েকটি ম্যাচ হাতে রেখেই ব্রাজিলের টিকিট পেয়ে গিয়েছিলাম। আর মূল টুর্নামেন্টের ফাইনাল পর্যন্ত উঠে আমরা নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণও দিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমরা হয়তো ওই টুর্নামেন্টটি জিততে পারিনি, কিন্তু আমাদের পক্ষে যা যা সম্ভব, তার সবই আমরা করেছিলাম।
বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার প্রতিটি মানুষের জন্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এবং একদিন যদি আমি জাতীয় দলের হয়ে এটি জিততে পারি, তা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো একটি ব্যাপারই হবে।
বার্সেলোনা ৩-০ বায়ার্ন মিউনিখ
চ্যাম্পিয়নস লিগ, সেমিফাইনাল, ৬ মে, ২০১৫
আমি যখন বোয়াটেংয়ের দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম, একটি কথাই আমার মাথায় ঘুরছিল। আর তা হলো, যে করেই হোক তাকে পাশ কাটাতে হবে এবং গোলের যত কাছাকাছি সম্ভব যেতে হবে। অন্য আর সব ম্যাচের মতোই ছিল বিষয়টি; আমার পায়ে বল এসেছিল, কিন্তু আমার ঠিক সামনেই ছিল প্রতিপক্ষের একজন খেলোয়াড়।
এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি ম্যাচে গোল করতে পেরে আমি খুবই আনন্দ পেয়েছিলাম। কারণ এই গোলটিই আমার দলকে নিয়ে গিয়েছিল আরো একটি চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুহুর্মুহু প্রশংসাবাণী আসার আগ পর্যন্ত আমি পুরোপুরি অনুধাবনও করতে পারিনি যে, ঠিক কতটা ভালো আমি খেলেছি। আমি অনেকগুলো মন্তব্য পড়েছিলাম, এবং বেশ কিছু ভিডিও দেখেছিলাম।
লুইস এনরিকে অসম্ভব মেধাবী একজন কোচ, এবং তার কারণেই আমরা এমন জটিল একটি ম্যাচ জিততে পেরেছিলাম। ওই ম্যাচের জন্য আমরা সত্যিই দারুণভাবে প্রস্তুত ছিলাম, এবং আমরা আমাদের সকলের সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু ঢেলে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরও আমরা সকলে অনেক প্রশান্ত ছিলাম, নিজেদের মাথা ঠান্ডা রেখেছিলাম।
বার্সেলোনা ২-০ আলবাসিতি
লা লিগা, ১ মে, ২০০৫
বার্সার হয়ে আমার প্রথম গোল! আমি তখনো এমন একটি পর্যায়ে ছিলাম, যখন ক্যাম্প ন্যুতে খেলা ও প্রথম দলের অসাধারণ সব খেলোয়াড়ের সাথে ড্রেসিংরুম ভাগ করতে পারাটাই অনেক বেশি উপভোগ করছিলাম। গোল করার বিষয়টি আসলেই আমার মাথায় ছিল না। কিন্তু আমি এটুকু জানতাম যে, যদি আমার পক্ষে স্কোর করার সুযোগ আসে, আমি ভয় পাব না।
সবকিছুই যেন আলোর গতিতে হয়ে গিয়েছিল। রোনালদিনহো ফ্লিক করে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের উপর দিয়ে বলটি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, আর আমি কেবল আলতো ছোঁয়ায় সেটিকে কিপারের মাথার উপর দিয়ে জালে জড়িয়েছিলাম। সেটি ছিল আমার জন্য খুবই সুন্দর একটি মুহূর্ত। বিশেষ করে আমার সতীর্থরা যখন ছুটে এসেছিলেন আমার সাথে উদযাপন করতে।
বার্সেলোনা ৩-৩ রিয়াল মাদ্রিদ
লা লিগা, ১০ মার্চ, ২০০৭
রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে তিনটি গোল পাওয়া চমৎকার একটি অনুভূতি। এটি এমন একটি ম্যাচ, যা পুরো বিশ্বই দেখে। এবং সেবারই প্রথম এমন একটি ম্যাচে আমি সেরকম কিছু অর্জন করেছিলাম। হ্যাটট্রিক করতে তো সবসময়ই দারুণ লাগে, আর ক্লাসিকোতে সেটা করতে পারলে তো গোটা বিষয়টাই আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে যায়।
বার্সেলোনা ৫-২ গেতাফে
কোপা দেল রে, সেমিফাইনাল, ১৮ এপ্রিল, ২০০৭
যখন আমি মাঠে নামি, আমি কখনো ম্যাচের পরিণতি নিয়ে ভাবি না। কী হতে পারে কিংবা কী না হতে পারে, এসব বিষয় আমার মাথায় থাকে না। আমি মনে করি, ফুটবলে সবকিছুকে নিজের মতো করেই ঘটতে দেয়া উচিৎ।
গেতাফের বিপক্ষে এই গোলটির ক্ষেত্রে, আমি মাঝমাঠের কাছাকাছি থেকে বলটি নিজের পায়ে নিয়েছিলাম, এবং রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের মাঝে অনেক ফাঁকা জায়গা পেয়ে গিয়েছিলাম। যখন বল আমার দখলে এসেছিল, তখনো কিন্তু আমি গোল করার কথা ভাবিনি। আমি কেবল চাইছিলাম, পেনাল্টি এরিয়ার দিকে এগোনোর সময় এমন ফাঁকা জায়গা যেন আরো খুঁজে পাই। আসলেই আমি সেরকম ফাঁকা জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলাম। তারপরও গোলে শট নেয়ার আগ পর্যন্ত আমি গোল করার কথা ভাবিনি।
আমি সবসময়ই আমার গোলকে পরিমাপ করে এসেছি সেটির গুরুত্ব অনুযায়ী, সেটির সৌন্দর্য্য দেখে নয়। এই গোলটি অবশ্যই খুব ভালো ছিল, কিন্তু আমি আরো অসংখ্য গোল করেছি যেগুলো আমার দলের জন্য আরো বেশি গুরুত্ববহ ছিল।
আর্জেন্টিনা ৬-০ সার্বিয়া অ্যান্ড মন্টিনেগ্রো
বিশ্বকাপ, গ্রুপ পর্ব, ১৬ জুন, ২০০৬
যদিও এটি ছিল বিশ্বকাপে আমার প্রথম ম্যাচ, তবে এর আগে জাতীয় দলের জার্সিতে আমি কিছু প্রীতি ম্যাচ খেলেছিলাম। তাই আমি আলাদা কোনো চাপ অনুভব করছিলাম না। আমি একটুও ভীত ছিলাম না। আমি কেবল উত্তেজিত ছিলাম মাঠে নামতে এবং বিশ্বকাপে খেলার অনুভূতিটা উপভোগ করতে।
দিনটি তার তাৎপর্যের কারণেই দারুণ সুন্দর হয়ে উঠেছিল। এটি ছিল বিশ্বকাপ, এবং সেদিন টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় ম্যাচ। আমি আইভরি কোস্টের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচটিতে বেঞ্চে বসে ছিলাম, যদিও ম্যাচটি আমরা জিতেছিলাম। আর সার্বিয়া অ্যান্ড মন্টিনেগ্রোর বিপক্ষে ম্যাচের শেষ ১৫ মিনিটে আমি মাঠে নেমেছিলাম, এবং আমার দলের পক্ষে ষষ্ঠ গোলটি করেছিলাম। দুর্দান্ত!
জুভেন্টাস ১-৩ বার্সেলোনা
চ্যাম্পিয়নস লিগ, ফাইনাল, ৬ জুন, ২০১৫
চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি উঁচিয়ে ধরার অনুভূতিটা দারুণ। চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা সবসময়ই আনন্দ ও উল্লাসের একটি মুহূর্ত। কিন্তু তারপরও ওই মুহূর্তগুলোতে আপনার পক্ষে পুরোপুরি বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না যে, মাত্রই আপনি কী অসাধারণ একটি অর্জন করেছেন। এমনকি বার্লিনেও আমরা তখনো বুঝে উঠতে পারিনি, আমরা মাত্রই ঠিক কী করেছি। ট্রেবল জয়ের গুরুত্ব তখনো আমাদের মাথায় আসেনি।
এই জয়ের বিশেষত্ব আরো বেশি এ কারণে যে, সেরা দলগুলোর বিপক্ষে জেতা সবসময়ই খুব কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। এই টুর্নামেন্টটিও খুবই কঠিন। আপনি হয়তো বরাবরই দুর্দান্ত খেলে আসছেন, কিন্তু একটি ম্যাচে একটু খারাপ খেললেন, আর তাতেই আপনি চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বাদ!
রিয়াল মাদ্রিদ ২-৬ বার্সেলোনা
লা লিগা, ২ মে, ২০০৯
এই রাতটি ছিল খুবই মহিমান্বিত, কারণ যেভাবে আমরা সে রাতে বার্নাব্যুতে জিতেছিলাম। আমি সেদিন একটি নতুন পজিশনে খেলেছিলাম – ফলস নাইন। পেপ গার্দিওলা কেবল ওই ম্যাচের জন্যই এই বিশেষ পরিকল্পনাটি নিয়ে এসেছিলেন, যাতে ম্যাচে আমরা আরো বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারি।
ম্যাচের আগে এই বিষয়টি নিয়ে আমরা প্রচুর কথা বলেছিলাম। তাই ম্যাচে যখন সবকিছু ঠিকভাবে হলো, আমরা দুজনেই অনেক সন্তুষ্ট হয়েছিলাম। এই বড় ম্যাচগুলোতে ভাগ্য যে কারো দিকে হেলে পড়তে পারে। আমি এমন ম্যাচ খেলেছি, যেখানে আমরা রিয়ালের কাছ থেকে চারটি গোল হজম করেছি। আবার এমন ম্যাচও আমি খেলেছি যেখানে আমরা ছয় গোল করেছিল। এই ম্যাচটিতেও আমাদের পুরো দলের পারফরম্যান্স অনেক ভালো ছিল। আমি জানি না এটিই আমাদের সেরা ম্যাচ কি না, তবে নিশ্চিতভাবেই এটি এমন একটি ম্যাচ, যার কথা আমরা সবসময় মনে রাখব।
বার্সেলোনা ২-০ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
চ্যাম্পিয়নস লিগ, ফাইনাল, ২৭ মে, ২০০৯
আমার জন্য এই বিষয়টি কল্পনা করাও অনেক কঠিন ছিল যে আমি আমার মাথা দিয়ে গোল করব, যখন রিও ফার্দিনান্ড আমার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকবেন। কিন্তু ওই সময়টাতে আমার জন্য আসলে কোনো মার্কার ছিল না। বক্সের একদম মাঝামাঝি জায়গায় বলটি এসেছিল, এবং সেটিকে গ্রহণের জন্য আমি সঠিক জায়গাতেই অবস্থান করছিলাম।
জাভি ক্রস করার পর যখন বলটি আকাশে ভাসছিল, তখন থেকেই আমি ভাবছিলাম, গোলটি বুঝি হয়ে যেতে পারে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আসলে সেটিই হয়েছিল। গোলটি সবদিক থেকেই ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দলের জন্য যেমন, তেমনই ফাইনালের জন্যও যে এর মাধ্যমে ম্যাচটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল, এবং অবশ্যই আমার নিজের জন্যও। এখনো এটি আমার সবচেয়ে প্রিয় গোলগুলোর একটি।
২০০৬ সালের ফাইনাল ইনজুরির কারণে মিস করায়, এই ম্যাচটি কেবল খেলতে পারাই আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয় ছিল। আর সেখানে গোল পেয়ে যাওয়া তো পুরো সোনায় সোহাগা। এর মাধ্যমে দারুণ একটি মৌসুম সম্পন্ন হয়েছিল, যেখানে আমরা আক্ষরিক অর্থেই সবকিছু জিতেছিলাম।
রিয়াল মাদ্রিদ ২-৩ বার্সেলোনা
লা লিগা, ২৩ এপ্রিল, ২০১৭
এটি ছিল যথাযথ একটি রাত। এমন একটি রাত, যেখানে সবকিছুই ঠিকভাবে হয়েছিল, আমিও যা যা চেয়েছিলাম তার সবই পেয়েছিলাম। বার্নাব্যুতে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে দারুণ দুইটি গোল করেছিলাম আমি, যার মধ্যে শেষটি ছিল একদম শেষ মিনিটে, যার ফলে আমরা ম্যাচটি জিতেছিলাম। এবং তার উপর আরো একটি বিষয়ও ছিল যে, বার্সেলোনার হয়ে সেটি আমার ৫০০তম গোল!
এর বেশি কিছু আমার চাওয়ার ছিল না। ওই মুহূর্তে আমরা যদি গোলটি করতে না পারতাম, তাহলে হয়তো লিগ শিরোপাকে সেদিনই আমাদের বিদায় বলতে হতো। কিন্তু ওই গোলটির কারণে আমরা কেবল ম্যাচটিই জিতিনি, লিগ জয়ের লড়াইয়েও প্রবল বিক্রমে ফিরে এসেছিলাম। এই ম্যাচের জয়টি আমাদের প্রাপ্য ছিল, এবং ওই মুহূর্তটি সকল বার্সেলোনিস্তার জন্যই অনেক আবেগময় ছিল।
যখন আমি জর্দি আলবার পায়ে বল দেখেছিলাম, তখনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমাকে কোথায় থাকতে হবে। কারণ এমন মুভমেন্ট নিয়ে আমরা আগেও অনেক প্রাকটিস করেছি। আমরা একে অন্যকে খুব ভালো করে চিনতাম। তাছাড়া এমনটা আমরা ইতিপূর্বেও করেছিলাম। যখন জর্দি আলবা মাঠের শেষ এক-তৃতীয়াংশে পৌঁছাতো, আমি সবসময়ই পেনাল্টি এরিয়ার প্রান্ত ঘেঁষে ছুটে যেতাম। এবং সেদিনও ঠিক এমনটাই করেছিলাম আমি।
লুইস এনরিকে ম্যাচশেষে আমার অনেক প্রশংসা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি নাকি ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়। কিন্তু আমার এখানে বলা উচিৎ, তার উপস্থিতিই আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছিল লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য। পুরো দল হিসেবে আমাদের অবস্থা সত্যিই অনেক শোচনীয় ছিল। কিন্তু যখন তিনি ন্যু ক্যাম্পে আসলেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে তিনি কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমাদের মনোবল ফিরিয়ে এনেছিলেন, এবং একটি গ্রেট দল হওয়ার জন্য আমাদের যা যা প্রয়োজন ছিল তার সবই তিনি দিয়েছিলেন।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/