অষ্টবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত টেনিসকে দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সে হিসেবে বর্তমানে ওপেন টেনিসের যুগে ভক্তরা উপভোগ করছেন টেনিস ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ তারকাদের কীর্তি। এই কারণে পেশাদার টেনিস প্রতিযোগিতায় বেড়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং তারকার ছড়াছড়ি। কিন্তু এত শত প্রতিযোগিতার ভীড়ে ৬ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতার এক স্প্যানিশ পকেটে পুরে নিয়েছেন ওপেন টেনিসের উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন ও রেকর্ড। কিংবদন্তি রজার ফেদেরার, সাথে নোভাক জোকোভিচ, অ্যান্ডি মারে, দেল পোর্ত্রোর মতো তারকাদের সময়ে বাঁ হাতে টেনিস র্যাকেট নিয়ে জয় করেছেন হার্ড কোর্ট, গ্রাস কোর্ট। তবে এই তারকা সব থেকে বেশি সফলতা অর্জন করেছেন ক্লে কোর্টে। একক কোনো সার্ফেসে তার থেকে বেশি সংখ্যক গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতেননি টেনিস ইতিহাসের কোনো তারকা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে টেনিস ইতিহাসে তিনিই ক্লে কোর্টের রাজা।
খুব ঘটা করেই টেনিসে তার আগমন ঘটেছিল। চাচা সাবেক টেনিস তারকা হওয়ার সুবাদে টেনিসের খুঁটিনাটি শিখতে প্রশিক্ষক ভাড়া করতে হয়নি তাকে। চাচার সহায়তায় মাত্র ১৫ বছর বয়সেই প্রতিযোগিতামূলক টেনিসে পা রাখতে সক্ষম হন তিনি। আর সেই থেকে শুরু, যা বর্তমানে ৩৩ বছর বয়সেও তিনি অব্যাহত রেখেছেন শীর্ষ পর্যায়ে। ‘দ্য স্প্যানিশ বুল’-খ্যাত এই তারকা ১৮ বছরের পেশাদার টেনিস ক্যারিয়ারে এখন অবধি জিতেছেন ৮৩টি শিরোপা। পুরুষ এককের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গ্র্যান্ড স্ল্যাম (১৮টি) জয়ের রেকর্ডটিও তার নামের পাশে। এছাড়াও ৩৫টি মাস্টার্স শিরোপার পাশাপাশি স্পেনের হয়ে বেইজিং অলিম্পিকে স্বর্ণপদকও জিতেছেন তিনি। নিজের ক্যারিয়ারকে যেমনভাবে তুলেছেন শীর্ষ পর্যায়ে, তেমনই নিজের দেশের পতাকাকেও তুলে ধরেছেন সারা বিশ্বের মাঝে। যার কারণে স্পেনের ছেলে-বুড়ো সবার নিকট দেশটির ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছেন তিনি।
বলছিলাম রাফায়েল নাদাল প্যারেরার কথা। ওপেন টেনিসের যুগে যার বাঁ হাতের জাদুতে রচিত হয়েছে নতুন নতুন রেকর্ড ও ইতিহাস। হাঁটুর ইনজুরি নিয়েও শীর্ষ পর্যায়ে লড়াই করে যাওয়া নাদাল ক্লে কোর্টকে নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছেন, সেই সাথে টেনিস ভক্তদের উপহার দিয়েছেন কয়েক ডজন রোমাঞ্চকর ম্যাচ। তার শরীর একজন সত্যিকারের যোদ্ধার মতো, আর তার মাঝে উপস্থিত ‘হার না মানা মানসিকতা’ যেন একজন প্রকৃত যোদ্ধার প্রতিরূপ। টেনিসের দীর্ঘ প্রতিযোগিতার ভীড়ে যে সকল প্রতিভাবান হাল ছেড়ে দেন, তাদের জন্য রাফায়েল নাদাল সর্বোত্তম আদর্শ। আর যারা ব্যক্তিজীবনে নিজেকে দুর্বল ভেবে আগেই পরাজয় বরণ করেন, তাদের জন্যও তিনি উদাহরণ। ওপেন টেনিসের যুগে যার এত শত অর্জন তাকে নিয়ে আমরা কতটুকুই জানি? চলুন, জানা যাক কিংবদন্তি রাফায়েল নাদালের শৈশব, কৈশোর, টেনিস ক্যারিয়ার ও ব্যক্তিগত জীবনের অজানা বিষয়গুলো।
শৈশব
রাফায়েল নাদাল আর দশজন কিংবদন্তির মতো দরিদ্র পরিবারে জন্মাননি। স্পেনের ম্যানাকোরে সেবাস্তিয়ান নাদাল ও আনা মারিয়া প্যারেরা দম্পতির ঘরে ১৯৮৬ সালের ৩ জুন জন্মগ্রহণ করেন তিনি। নাদালের বাবা একজন সফল ব্যবসায়ী, তার একমাত্র ছোট বোনের নাম মারিয়া ইসাবেল নাদাল। ছোটবেলায় নাদালের বেশিরভাগ সময় কেটেছে তার দুই চাচার সঙ্গে, কারণ তারা দুজনেই পেশাদার ক্রীড়াবিদ ছিলেন। মিগুয়েল অ্যাঞ্জেল নাদাল ছিলেন একজন ফুটবলার এবং টনি নাদাল ছিলেন প্রতিষ্ঠিত একজন পেশাদার টেনিস খেলোয়াড়।
মূলত চাচা টনি নাদালের হাত ধরে মাত্র ৩ বছর বয়সেই টেনিস র্যাকেট হাতে নেন রাফা। ডানহাতি হওয়ার পরও টনি তাকে বাঁহাতে টেনিস খেলায় পারদর্শী করে তোলেন। অন্যদিকে, মিগুয়েল নাদালের কাছ থেকে নাদাল ফুটবলের প্রশিক্ষণও নিতেন। যার ফলে খুব অল্প বয়সে ফুটবল এবং টেনিস দুটোকেই রপ্ত করেন রাফা। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি টেনিসকে বেছে নিয়েছিলেন নিজের ভবিষ্যৎ হিসেবে।
রাফায়েল নাদাল ছোটবেলায় টেনিস প্রশিক্ষণের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন ক্লে কার্টে, যার প্রভাব তার পেশাদার টেনিস ক্যারিয়ারে খুব ভালোভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৯৪ সালে ১২ জন প্রতিযোগীর একটি টেনিস টুর্নামেন্টে অংশ নেন রাফা। সেখানে শিরোপা জেতায় স্থানীয়রা তার প্রশংসা করেন। অতঃপর ১২ বছর বয়সে নাদাল বয়সভিত্তিক টেনিস টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ শুরু করেন এবং শিরোপা জেতেন।
তবে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে বেশিদিন ঘাম ঝরাতে হয়নি তাকে। টনি নাদালের সহযোগিতায় এবং নিজের কঠোর পরিশ্রমের কল্যাণে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই পেশাদার টেনিসে নাম লেখান রাফা।
টেনিস ক্যারিয়ার
২০০২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পেশাদার টেনিসে অভিষেক হয় নাদালের। রেমন দেলগাদোর বিপক্ষে সেই ম্যাচটি জিতে রেকর্ডবুকে নতুন করে নাম লেখান তিনি। টেনিস ইতিহাসের নবম খেলোয়াড় হিসেবে ১৬ বছর বয়সের পূর্বে পেশাদার টেনিস ম্যাচ জেতার রেকর্ড গড়েন নাদাল। আর সেখানেই ক্ষান্ত হননি তিনি। সে সময় টেনিস র্যাংকিংয়ের শীর্ষ তারকাদের বিপক্ষে অসাধারণ সব পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে নিজের আগমনকে জোরালোভাবে জানান দিয়েছিলেন তিনি। তখন টেনিসবিশ্বের সেরা প্রতিভাবান ভাবা হতো এই নাদালকেই। পেশাদার টেনিসে অভিষেকের এক বছর পরই নাদাল মায়ামি মাস্টার্সে রজার ফেদেরারকে পরাজিত করে টেনিসবিশ্বে ঝড় তোলেন। শুধু তা-ই নয়, ঐ টুর্নামেন্টের তৃতীয় রাউন্ড পর্যন্ত নাদালই সর্বকনিষ্ঠ প্রতিযোগী হিসেবে টিকে ছিলেন।
সে সময় ডেভিস কাপেও চমক দেখান রাফা। পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে ফাইনালে কোয়ালিফাই করেন তিনি। অতঃপর ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত ফাইনালে অ্যান্ডি রডিককে ৩-২ ব্যবধানে পরাজিত করে স্পেনকে শিরোপা উপহার দেন তিনি। এতে করে প্রথমবারের মতো স্প্যানিশদের প্রশংসায় সিক্ত হয়েছিলেন নাদাল। তখন নাদাল ক্লে কোর্টে টানা ২৪ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ডও গড়েন। এত কম বয়সে ক্লে কোর্টে এর আগে কেউ কখনো একটানা এত সংখ্যক ম্যাচে অপরাজিত থাকতে পারেনি।
নাদাল তার ক্যারিয়ারের প্রথম পর্যায়ের সেরা সময় পার করেন ২০০৫ সালে। ঐ বছর প্রথমবারের মতো তিনি গ্র্যান্ড স্ল্যামের শিরোপা জেতেন। ক্লে কোর্টের ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইনালে আর্জেন্টাইন তারকা মারিয়ানো পুয়েত্রাকে পরাজিত করেন তিনি। একই বছর নাদাল বার্সেলোনা ওপেন, রোম ওপেনের মতো মাস্টার্স শিরোপাও জেতেন। যার ফলে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো টেনিস র্যাংকিংয়ে তিন নম্বরে উঠে আসেন তিনি।
২০০৬ সালে নাদাল একজন পরিপক্ব তারকা হিসেবে বছর শুরু করেন। সেবার তিনি দুবাই ডিউটি ফ্রি মেন্স ওপেন, মন্টে কার্লো মাস্টার্স, বিএনএল ইতালিয়ার মতো জনপ্রিয় প্রতিযোগিতার শিরোপা জেতেন। বিএনএল ইতালিয়ার ফাইনালে তিনি আবারও রজার ফেদেরারের মুখোমুখি হন এবং তাকে পরাজিত করেন। একই বছর টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইনালে কোয়ালিফাই করেন নাদাল। আর ফাইনালে আবারও রজার ফেদেরারের মুখোমুখি হন তিনি। সেবারের ফাইনাল ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে গড়িয়েছিল। যদিও টাইব্রেকারে নাদালের হার না মানার এক দৃঢ় প্রচেষ্টার কাছে পরাজিত হন ‘ফেডেক্স’। ঐ জয়ের মধ্য দিয়ে ওপেন টেনিসের যুগে গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালে প্রথমবারের মতো ফেদেরারকে পরাজিত করার অভূতপূর্ব এক রেকর্ড গড়েন নাদাল।
সফল দু’টি বছর পার করার পর ২০০৭ সালটি নাদালের তেমন ভালো কাটেনি। একের পর এক ম্যাচে পরাজিত হন তিনি। যদিও এত এত পরাজয়ের মাঝেও দুবাই টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ, ইন্ডিয়ান ওয়েলস ওপেন, বিএনএল ইতালিয়ার মতো টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতেন। যদিও সেবার নাদাল হামবুর্গ মাস্টার্স সিরিজে ফেদেরারের বিপক্ষে পরাজিত হন। কিন্তু ফ্রেঞ্চ ওপেনে ফেদেরারকে পরাজিত করে ঠিকই প্রতিশোধ নিয়ে নেন নাদাল।
২০০৮ সালে অবশ্য নাদাল একাধিক টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলেছিলেন। সেবার চেন্নাই ওপেন ও অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে পৌঁছেও শিরোপা জিততে পারেননি তিনি। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে তিনি ফ্রেঞ্চ তারকা উইলফ্রেড সোঙ্গার কাছে পরাজিত হন। একই বছর নাদাল টেনিসের সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ ‘উইম্বলডন’ ফাইনালেও কোয়ালিফাই করেন। বৃষ্টিবিঘ্নিত গ্রাস কোর্টের ফাইনাল ম্যাচটিতে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জেতেন তিনি। আর প্রথমবারের মতো উইম্বেলডন জিতে টেনিস ইতিহাসের তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে একই বছর ফ্রেঞ্চ ওপেন ও উইম্বলডন জেতার রেকর্ড গড়েন। নাদালের পূর্বে একই বছর এই দু’টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছিলেন শুধুমাত্র কিংবদন্তি রড লেভার এবং বিয়ন বোর্গ। সেবার দু’টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের পাশাপাশি অলিম্পিকে স্বর্ণপদকও জেতেন নাদাল।
রাফায়েল নাদাল তার ক্যারিয়ারের প্রথম ও একমাত্র অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের শিরোপা জেতেন ২০০৯ সালে। সেবার রজার ফেদেরারকে পরাজিত করে প্রথম স্প্যানিশ হিসেবে শিরোপাটি জেতেন তিনি। সেই সাথে চতুর্থ টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে ওপেন টেনিসের যুগে প্রচলিত তিন রকম কোর্টে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের রেকর্ড গড়েন। ঐ বছর অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের পাশাপাশি ডেভিস কাপ এবং একাধিক মাস্টার্স ওপেনের শিরোপা জিতলেও নিজের প্রিয় ক্লে কোর্টের শিরোপাটি জিততে পারেননি তিনি। তবে নাদাল তার ক্যারিয়ারের সব থেকে বড় প্রতিবন্ধকতার শিকার হন ২০০৯ সালেই। রোটারডামে অনুষ্ঠিত একটি টুর্নামেন্টে হাঁটুর ইনজুরিতে পড়েন নাদাল, আর সেই ইনজুরি আজ অবধি বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
২০১০ সালে ইনজুরি থেকে ফিরে বেশিদিন কোর্টে থাকতে পারেননি নাদাল, আবারও গুরুতর ইনজুরিতে পড়েন। এতে করে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন থেকে তার নাম বাতিল করা হয়। তবে ঐ বছর ইনজুরি থেকে ফিরে চমক দেখিয়েছিলেন নাদাল, জেতেন ফ্রেঞ্চ ওপেন এবং উইম্বলডনসহ একাধিক মাস্টার্স ওপেনের শিরোপা। ইনজুরি নিয়ে বছর শুরু করলেও বছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে নিজের পারফরম্যান্সের কল্যাণে টেনিস র্যাংকিংয়ের এক নম্বর জায়গাটি দখল করে নেন নাদাল। অতঃপর ‘বছরের শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম’-খ্যাত ইউএস ওপেনও জেতেন তিনি। ফাইনালে নোভাক জোকোভিচকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে এক বছরে ৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম ঘরে তোলেন রাফা।
নাদাল ২০১১ সালে ডেভিস কাপসহ একাধিক মাস্টার্স ওপেন এবং একমাত্র গ্র্যান্ড স্ল্যাম হিসেবে ফ্রেঞ্চ ওপেনের শিরোপা জেতেন। এতে করে টেনিস র্যাংকিংয়ের দুই নম্বরে চলে যায় তার অবস্থান। পরের বছর টানা অষ্টমবারের মতো মন্টে কার্লো রোলেক্স মাস্টার্সের শিরোপা জেতার রেকর্ড গড়েন রাফা। সেই সাথে ফ্রেঞ্চ ওপেনেও অব্যাহত ছিল তার আধিপত্য।
২০১২ সালে অবশ্য হাঁটুর পুরনো চোটের কারণে তার ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়ে। ঐ বছর প্রথমবারের মতো উইম্বলডনের ফাইনালে পরাজিত হওয়ার পাশাপাশি একাধিক প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল তাকে। শুধু তা-ই নয়, টেনিস র্যাংকিংয়ে অবস্থান গিয়ে ঠেকে চার-এ। সেবারের ইনজুরির পর একটানা কয়েক বছর ব্যর্থতার আগলে বাঁধা পড়েন নাদাল।
২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল অবধি নাদাল উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে পরাজিত হয়েছিলেন, যার মধ্যে কাতার ওপেন এবং উইম্বলডন ছিল উল্লেখযোগ্য। ২০১৫ সালের শুরুতে হাঁটুর ইনজুরির কারণে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনেও পরাজিত হয়েছিলেন এই তারকা। বলতে গেলে কয়েক বছর ঘন ঘন ইনজুরিতে পড়ে তার ক্যারিয়ারে তখন হুমকির মুখে। তার পরিবার এবং ডাক্তাররা তাকে টেনিস ছেড়ে দেয়ার নির্দেশনা দেন। শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না নাদালের টেনিস ক্যারিয়ার নিয়ে গুঞ্জন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রিকায় টেনিস থেকে তার বিদায়ের সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল বড় বড় হেডলাইনে।
দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৬ সালে পুরোপুরি নতুন রূপে টেনিস কোর্টে ফিরেছিলেন নাদাল, যদিও র্যাংকিংয়ে অভাবনীয়ভাবে পিছিয়ে গিয়েছেন ততদিনে। রিও অলিম্পিকের দ্বৈত রাউন্ডে জিতে স্পেনকে স্বর্ণপদক জিতিয়ে নিজের প্রত্যাবর্তনকে টেনিস বিশ্বের কাছে জোরালোভাবে তুলে ধরেন নাদাল। পরের বছর ফ্রেঞ্চ ওপেন এবং ইউএস ওপেন জিতে নেন তিনি, র্যাংকিংয়েও উঠে আসেন দ্বিতীয় অবস্থানে। ২০১৭ সালে চাচা টনি নাদালকে নিজের কোচের পদ থেকে ছুটি দেন নাদাল। ২০০৫ সাল থেকে শুরু হওয়া সেই অধ্যায়ের ইতি টেনে চাচাকে অবসরে পাঠান তিনি।
গত দুই বছরে রাফায়েল নাদাল তার ব্যক্তিগত সেরা ফর্মে ফিরেছেন। যদিও পূর্বের মতোই ইনজুরির কারণে পরাজিতও হয়েছেন একাধিক গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালে। এই দুই বছরে নাদালের অর্জন নেহায়েত কম নয়। গত বছর ফ্রেঞ্চ ওপেনে ১১তম বারের মতো শিরোপা জিতে একক গ্র্যান্ড স্ল্যাম টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চসংখ্যক শিরোপা জেতার রেকর্ডে ভাগ বসান তিনি। আর এই বছর ১২তম বারের মতো ফ্রেঞ্চ ওপেনের শিরোপা জিতে রেকর্ডটি নিজের করে নেন নাদাল।
সর্বশেষ কয়েক বছরের পরিসংখ্যান হয়তো নাদালকে অনেকটাই ধীরগতিসম্পন্ন প্রমাণ করে। কিন্তু তিনি যে একেবারেই থেমে গিয়েছেন, সেটি অবশ্য বলার সুযোগ একেবারেই নেই। হাঁটুর ইনজুরি তাকে হার্ড কোর্ট ও ঘাসের কোর্টে বারবার ব্যর্থ প্রমাণ করেছে। কিন্তু পরাজিত হওয়ার ম্যাচগুলোর শেষ সেটের শেষ গেম বল পর্যন্ত লড়াই করতে দেখা গিয়েছে তাকে। আর ক্লে কোর্টে তো নিজের একক আধিপত্য কায়েম করেই রেখেছেন নাদাল। ফ্রেঞ্চ ওপেনে তার গড়া রেকর্ডগুলো ভাঙতে কত বছর অবধি অপেক্ষা করতে হবে নতুন প্রজন্মের টেনিস তারকাদের, ইয়ত্তা নেই। হয়তো কখনো কেউ ছুঁতেও পারবে না তার রেকর্ডগুলো।
ফেদেরার, জোকোভিচ, অ্যান্ডি মারের মতো শীর্ষ তারকারা বাকি দুই কোর্টে তার বিরুদ্ধে শেষ গেম বল পর্যন্ত লড়াই করে জেতার কীর্তি গড়লেও ক্লে কোর্টে তার বিপক্ষে অন্যদের অর্জন একেবারেই শূন্য বলা যায়। কারণ, ক্লে কোর্টের রাজা হওয়ার দীর্ঘ পথে মারাত্মক ইনজুরির মতো প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেছেন তিনি। আর ক্লে কোর্ট তো যেন তার জন্যেই সৃষ্টি। ৩৪ বছর বয়সী নাদাল ধীর গতিতে এগোলেও রজার ফেদেরারের গড়া সর্বোচ্চ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের রেকর্ডটি নিজের করে নেয়ার পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ ওপেনে গড়া রেকর্ডটি আরো দীর্ঘায়িত করতে পারবেন বলে আশা করাই যায়।
ব্যক্তিগত জীবন
একজন ক্রীড়াবিদ থেকেও ব্যক্তিজীবনে নাদাল খুবই বিখ্যাত। তিনি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে যেমন সফল, তেমনই একজন সমাজসেবী হিসেবেও বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। ২০০৭ সালে রাফায়েল নাদাল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি তার সেবামূলক কার্যক্রম শুরু করেন। তার সংস্থাটি মূলত সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করে। নাদাল তার ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ ও অনন্তপুরে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অনন্তপুর শিক্ষা প্রকল্প এবং অনন্তপুর স্পোর্টস ভিলেজে বড় অঙ্কের অর্থ যোগান দিয়েছিলো রাফায়েল নাদাল ফাউন্ডেশন। যদিও পরবর্তীতে তিনি তার নিজের শহরের শিশু-কিশোরদের নিয়ে স্থায়ীভাবে কাজ শুরু করেন।
জলবায়ুর পরিবর্তনে বিশ্বাবাসীকে সচেতন করার একটি কার্যক্রমেও অংশ নিয়েছিলেন নাদাল। তিনি তার ফাউন্ডেশন থেকে অর্থের যোগান দিয়ে কয়েকটি দেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পরিচালনা করেন। স্বয়ং থাইল্যান্ডের রাজাকে নিয়ে তিনি এই কার্যক্রমটি সফল করেছিলেন। বর্তমান সময়ে অবশ্য টেনিস ছাড়াও গলফ, ফুটবল ও ব্যবসায়ে যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন নাদাল।
নাদালের আয়ের সিংহভাগ অংশ আসে টেনিসের প্রাইজমানি থেকে। তিনি টেনিস ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ আয়কারী খেলোয়াড়। এছাড়াও তার বাণিজ্যিক টেনিস একাডেমি, হসপিটাল এবং মোনাকোতে রিসোর্ট ব্যবসা রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে নাদাল স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের একজন কট্টর ভক্ত। ভবিষ্যতে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্নও দেখেন। ধারণা করা হয়, পরোক্ষভাবে রিয়াল মাদ্রিদের ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন তিনি।
ঘনিষ্ঠ সূত্রমতে, নাদাল এখন অবধি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি। তবে ২০০৫ সাল থেকেই তার বান্ধবী জিসকা পেরেলোর সঙ্গে বসবাস করছেন তিনি, যদিও তাদের কোনো সন্তান নেই। এই ব্যাপারে একাধিকবার প্রশ্নের সম্মুখীন হলেও বরাবরই এড়িয়ে গেছেন নাদাল। তিনি তার ক্যারিয়ারে যে তিনজন নারীর অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন তারা হলেন, তার মা, বোন এবং বান্ধবী। তাই বলা যায়, নাদাল তার পরিবারের সঙ্গে খুব ভালোভাবেই মেশেন।