১.
চিটাউরি আর্মির আক্রমণে লণ্ডভণ্ড নিউ ইয়র্ক শহর। নিজ শহরকে বাঁচাতে বীরদর্পে লড়ছে ‘দ্য অ্যাভেঞ্জার্স’। শত্রুদের প্রতিহত করার চেষ্টা করছেন আয়রনম্যান, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, ব্ল্যাক উইডো, থর, আর হক-আই। ঘটনাক্রমে এরপরই হাজির হয় হাল্ক ওরফে ড. ব্রুস ব্যানার; রাগেই যার সমস্ত শক্তি। আয়রনম্যানের পেছন পেছন এগিয়ে আসছে ড্রাগনসদৃশ বিশালকায় এক জন্তু; তাকে থামাতে সবার ভরসা ‘দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক’।
‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা’-খ্যাত স্টিভ রজার্স তাকে মনে করিয়ে দেন, এখনই রাগান্বিত হওয়ার উপযুক্ত সময়। হাল্কের জবাব,
‘That’s my secret Cap. I am always angry.’
মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের (এমসিইউ) অ্যাভেঞ্জার্স: দ্য এজ অফ আল্ট্রন, সিনেমার এই মুহূর্তটা সিনেমাপ্রেমীদের মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে, সেটা বলাই বাহুল্য। পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, রোর বাংলার খেলাধুলা বিভাগের লেখায় সিনেমার গল্প কেন? সেটার উত্তর লেখার বাকি অংশতেই দেয়া যাক।
২.
ইয়ান বিশপের কাঁপা গলার কমেন্ট্রি খেলা দেখার মজাটাই কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। মাইক্রোফোনে তার ছড়িয়ে দেয়া দারুণ সব শব্দের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ক্রিকেট খেলাটা। ক্রিকেটকে বলা হয় গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। ক্রিকেটকে ঘিরে সকল আনন্দ, বেদনা, পাওয়া-না পাওয়া যেন ফুটে ওঠে বিশপের কণ্ঠের জাদুতে। কত ঘটন-অঘটন, হৃদয়ভাঙ্গার গল্প, রূপকথার উপ্যাখানের সাক্ষী হয়েছেন তিনি, সেই গল্প টিভিসেটের সামনে বসিয়ে শুনিয়েছেন আমাদের।
তেমনই এক ক্রিকেটীয় রূপকথার গল্প আমাদের শুনিয়েছেন বিশপ। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে নামিবিয়ার প্রতিপক্ষ ছিল আয়ারল্যান্ড। জয়ী দল পাবে সুপার টুয়েলভ রাউন্ডের টিকেট, সমীকরণই এমন। আফ্রিকা মহাদেশের নামিবিয়ার লক্ষ্য ছিল মাত্র ১২৬। শেষ দুই ওভারে জয়ের জন্য প্রয়োজন নয় রান। অধিনায়ক জেরহার্ড এরাসমাস প্রথম বলেই হাঁকালেন চার। পরের বলে সিংগেল নিয়ে স্ট্রাইকে পাঠালেন আগের ম্যাচের নায়ককে। সেই নায়ক আবারও নায়ক হলেন। ফুল লেংথের ওয়াইডিশ ডেলিভারিটাকে সজোরে স্লাইস করে বাউন্ডারি পার করে। চার মেরে ছুটেছেন সেই নায়ক, উদ্দাম উদযাপনে। অপর প্রান্তে অধিনায়ক এরাসমাস যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না, আবেগে টইটুম্বুর হয়ে। মুদ্রার অপর পিঠে আইরিশ অধিনায়ক অ্যান্ড্রু বালবার্নিও হতবাক। লম্বা শ্বাস ছেড়ে হতাশা বের করে দিতে চাইছিলেন। সেই এক চারেই কত দামি ইতিহাস রচিত হয়ে গেল। প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূলপর্বে জায়গা করে নেয়া। আইসিসির পূর্ণসদস্য দেশের বিপক্ষে জয়।
মাত্র ২.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার এক দেশ নামিবিয়া, যেখানে ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবল, রাগবি, ফিশিং-ই বেশি জনপ্রিয়। তবুও আছে নয়টা ক্রিকেট মাঠ, পাঁচটা ক্লাব আর ১৬ জন চুক্তিভূক্ত ক্রিকেটার। সীমিত সামর্থ্য, বুকভরা সাহস আর চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে নামিবিয়ার ক্রিকেটাররা লিখেছেন নিজেদের রূপকথা। সেই রূপকথার সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়টা লিখেছেন নিজভূমে পরবাসী হয়ে যাওয়া এক দুর্ভাগা রাজপুত্র; কপালের লিখন খণ্ডাতে না পেরে যিনি গিয়ে ভিড়েছেন নামিবিয়ার প্রান্তরে।
৩.
নামটা তার একটু গোলমেলে। ছয় ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটার নামের প্রথম অংশের উচ্চারণ সহজ হলেও শেষাংশেই যত গোলমাল। কেউ বলেন উইসে, কেউ ডাকেন উইসা, কেউ বা আবার ভিসে। ঝামেলাটা আরো বেড়ে যায় ধারাভাষ্যকারদের বিচিত্র বাচনভঙ্গির জন্য। শেষাংশ যেমনই হোক, প্রথমাংশের ডেভিড উচ্চারণে কারো সমস্যা হবার কথা নয়। হ্যাঁ, নামিবিয়ার ক্রিকেটকে রূপকথার রাজ্যে নিয়ে যাওয়া সেই সুপারহিরো ডেভিড ভিসার কথাই বলছি।
জন্মেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রান্সভাল প্রোভিন্সে। বেড়ে ওঠা উইটব্যাংক শহরে। নয় বছর বয়সে ক্রিকেটের হাতেখড়ি এক দক্ষিণ আফ্রিকার কোচের ক্রিকেট ক্লাবে। সেই ক্লাবে স্পিন দিয়েই ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে মন দিয়েছেন পেস বোলিংয়ে। শরীরটাও তখন বাড়ন্ত। ক্রিকেটের সাথে ডেভিডের চলছিল বেশ ভালোই। বাদ সাধলেন মা-বাবা। তারা চান ক্রিকেট নয়, পড়াশোনায় মন দিক ছেলে। তাদের ইচ্ছায় ডেভিডের নতুন ঠিকানা হয় ইউনিভার্সিটি অফ প্রিটোরিয়া। ইন্টার্নাল অডিটিং ডিগ্রীতে পড়ার পাশাপাশি ক্রিকেটটাও খেলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। প্রথম বর্ষে খেলেছেন নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় একাদশে।
সবচেয়ে বড় ব্রেক-থ্রু’টা এসেছিল ২০১২ সালে। সেবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টি-টোয়েন্টিতে সুযোগ পেয়েছিলেন টাইটান্সের একাদশে। সেই আসরের সেমিফাইনালে সিডনি সিক্সার্সের বিপক্ষে ২৮ বলে ৬১ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলেন তিনি, যার মধ্যে ছিল ছয়টি বিশাল ছক্কা। সেই ম্যাচটা টাইটান্স হারলেও আলাদা করে নজর কেড়েছিলেন ডেভিড ভিসে।
বাংলাদেশ যদি বাঁহাতি স্পিনারদের আঁতুড়ঘর হয়, তবে অলরাউন্ডারদের খনি বলতে হবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। ল্যান্স ক্লুজনার, জ্যাক ক্যালিস, শন পোলকদের মতো বড় বড় অলরাউন্ডাররা তো সেই দেশেরই সন্তান। বলা চলে, সেই লেগ্যাসি থেকেই ডেভিড ভিসা খেলেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। কিংবদন্তি জ্যাক ক্যালিস ইনজুরিতে পড়ায় ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কা সফরের দলে জায়গা করে নেন তিনি। সেই সফরেই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয়। মারকুটে ব্যাটিং আর ডানহাতি মিডিয়াম পেসের জন্য নির্বাচকরা তার মাঝে হয়তো আগামী দিনের ক্যালিসকেই দেখেছিলেন।
সে আর হলো কই? রইলেন নিজের ছায়া হয়েই। প্রোটিয়াদের হয়ে ছয় ওয়ানডেতে ১০২ রান ও নয় উইকেট। আর মোট টি-টোয়েন্টিতে ২০ ম্যাচে ৯২ রান, সাথে ২৪ উইকেট। অমন সাদামাটা পারফর্ম্যান্সে দলে আসা-যাওয়ার মধ্যেই ছিলেন। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও খেলেছেন তিন ম্যাচ, উইকেট পেয়েছেন মাত্র একটি।
খেলতে চেয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার হয়েই। ব্যাট-বল কথা না বলায়, জাতীয় দলের দরজাও একপ্রকার বন্ধই। সাথে যোগ হয়েছিল আফ্রিকান ক্রিকেটের কোটাপ্রথা। উপায়ান্তর না দেখে ২০১৭ সালে কোলপ্যাক চুক্তি নিয়ে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডের কাউন্টি সাসেক্সে। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলার স্বপ্নটার সলিল সমাধিও ওখানেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না খেললেও চষে বেড়িয়েছেন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে। আইপিএল, সিপিএল, বিপিএল, পিএসএস – সবখানেই ছিল তার সরব উপস্থিতি।
তবে সবচেয়ে বড় চমকটা এসেছে চলতি বছরের আগস্টে। নামিবিয়ার কোচ পিয়েরে ডি ব্রুইন জানান, এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তাদের হয়ে খেলবেন ডেভিড ভিসা। সেপ্টেম্বরে ঘোষিত স্কোয়াডেও নাম দেখা যায় তার। পরিশেষে পাঁচ অক্টোবর সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে নামিবিয়ার হয়ে অভিষিক্ত হন ভিসা। দ্বিতীয় জন্ম, দ্বিতীয়বারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। দুই দেশের হয়ে মাঠে নামার এক বিরল রেকর্ডও।
প্রশ্ন আসতেই পারে, জন্মসূত্রে দক্ষিণ আফ্রিকান হয়েও নামিবিয়ার হয়ে কীভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন? ভিসার বাবা জন্মেছেন নামিবিয়ায়। জন্মসূত্রে তিনি নামিবিয়ারও নাগরিক। পৈতৃকসুত্রে পাওয়া নাগরিকত্ব দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের পুর্নজন্ম দিয়েছেন ভিসা। ভিসার এই যাত্রায় তাকে সঙ্গ দিয়েছেন নামিবিয়ার হেডকোচ পিয়েরে ডি ব্রুইন ও সহকারী কোচ অ্যালবি মর্কেল। ভিসা নিজেই জানিয়েছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলার অনেক আগে থেকেই নামিবিয়া ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি। সেবার সাড়া না দিলেও এ বছর আর ফেরাননি তাদের।
৪.
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের এবারের আসরে এখন পর্যন্ত তিন ম্যাচ খেলেছেন ভিসা, যার মধ্যে দু’টিতেই হয়েছেন ম্যাচসেরা। তার অলরাউন্ডিং পারফর্ম্যান্সেই নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে আইসিসির ইভেন্টে প্রথম জয়ের স্বাদ পেয়েছে নামিবিয়া।
লক্ষ্য ছিল ১৬৫ রানের। অভিজ্ঞ ডাচদের কাছে খেই হারায় নামিবিয়া। ৫২ রানে তিন উইকেট পড়ে যায়। সেখান থেকে দলকে টেনে তোলেন ভিসা। পাঁচ ছক্কা আর চারটি চারে সাজান ৬৬* রানের ইনিংস, বল খরচ করেছেন মাত্র ৪০টি।
পরের ম্যাচেও তার ব্যাটে-বলে ছিল ধারাবাহিকতা। আয়ারল্যান্ডকে হারানোর সেই ম্যাচে চার নম্বরে নেমে অধিনায়ককে নিয়ে দলকে ভিড়িয়েছেন জয়ের বন্দরে। এক পর্যায়ে নামিবিয়াকে চেপে ধরেছিল আইরিশরা। সেই চাপ থেকে দলকে মুক্ত করেছেন ভিসা। মাত্র ১৪ বলে খেলেছেন ২৮ রানের দারুণ এক ক্যামিও। দুই ছক্কা আর এক চারে সাজানো সেই ইনিংস। এর আগে বল হাতে ২২ রানে নিয়েছেন দুই উইকেট।
ঠিক মার্ভেলের হাল্কের মতোই ভিসা যেন জানেন, কখন রেগে যেতে হবে, কখন ধারণ করতে হবে সংহারমুর্তি। সিনেমাতে দেখেছেন নিশ্চয়ই, হাল্ক যখন রেগে যায়, কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে ধ্বংসলীলা চালায়। ইতিহাস গড়া, রূপকথা লেখার এই টুর্নামেন্টে ভিসা যেন নামিবিয়ার ইনক্রেডিবল হাল্ক। হাল্কের মতো তিনিও তো বিশাল দেহের অধিকারী তিনি। যখনই দল বিপদের মুখে পড়েছে, সাহসের সাথে তখনই হাজির হচ্ছেন ব্যাট কিংবা বল হাতে।
মূলপর্বের বেশিরভাগ খেলা এখনো বাকি তাদের। সুপার টোয়েলভে নামিবিয়ার প্রতিপক্ষ ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ডের মতো বড় বড় সব নাম। বড় দেশগুলোর বিপক্ষে নামিবিয়া নিশ্চিতভাবেই তাকিয়ে থাকবে, ছয় ফুট পাঁচ ইঞ্চির বিশালদেহী ভিসার দিকে। হাল্কের মতো ভিসাও যে জানেন, কখন-কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে কোথায়। তবে শুরুটা তাদের হয়েছে দারুণ, স্কটল্যান্ডকে
নামিবিয়ার ক্রিকেট যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে। হাতের কড়েতে গুনে বলে দেয়া যায় তাদের ক্রিকেটের বয়স। তাদের ঐশ্বর্য্য নেই, নেই কাড়িকাড়ি রেকর্ডস, ক্রিকেট বোর্ডটাও হয়তো গুছিয়ে উঠছে ধীরেধীরে। তবে আছে বুকভরা আশা, সাহস, খেলাটার প্রতি নিবেদন। আর আছেন তাদের রূপকথার সবচেয়ে বড় নায়ক, নিজভূমে পরবাসী হয়ে যাওয়া সুপারহিরো- ডেভিড ভিসে ‘দ্য নামিবিয়ান হাল্ক’।