১৯৭৬ সালের ক্যারিবিয়ান সফর শেষে ভারতীয় দল যখন বোম্বের সান্তাক্রুজ বিমানবন্দরে এসে নামে, তখন তাদের স্বাগত জানানোর জন্য খুব বেশি ভক্ত-সমর্থকদের ভিড় দেখা গেল না। তবে এটা নিশ্চিত করে বলে দেয়া যায়, তারা এখানে থাকলেও খুব সহজে ক্রিকেটারদের চিনতে পারতেন না। গজ-ব্যান্ডেজে মোড়ানো একেকজনকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে তারা ক্রিকেট খেলে ফিরেছে।
প্লাস্টার নেমে এসেছে গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথের কনুই থেকে আঙুল পর্যন্ত, ব্রিজেশ প্যাটেলের ঠোঁটে সেলাই। অধিনায়ক বিষেণ সিং বেদী আর তার স্পিন বোলিং সঙ্গী ভগবত চন্দ্রশেখরের আঙুলেও ব্যান্ডেজ। তারা কি খেলতে গিয়ে মারামারি করে ফিরেছে?
সফরের ফলাফলের দিকে তাকানো যাক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ২-১ এ হেরে ফিরেছে ভারত। তবে সেসময়কার বিবেচনায় এটা বেশ ভালো অর্জন ছিল। সিরিজের ৩য় টেস্টে ভারত মাত্র ৪ উইকেট হারিয়ে ৪০৬ তাড়া করে ম্যাচ জেতে। দুর্দান্ত ফর্ম আর আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে থাকা অবস্থায় স্যাবাইনা পার্কে ৪র্থ টেস্ট খেলতে নামে ভারত।
ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ যথেষ্ট তেতে ছিল। আগের সিরিজেই অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজিত হয়েছিল ৫-১ ব্যবধানে। এবারও সিরিজ খোয়ানোর সমূহ সম্ভাবনা। তাই ক্লাইভ লয়েড কোনো সুযোগ নিলেন না। লেলিয়ে দিলেন তার ফাস্ট বোলারদের।
মাইকেল হোল্ডিং আর ওয়েইন ড্যানিয়েল ছিলেন মোটামুটি সুপার ফাস্ট ক্যাটাগরির। বার্নার্ড জুলিয়েন, ভ্যানবার্ন হোল্ডাররাও গতিতে খুব পিছিয়ে নন। উইকেটে অতিরিক্ত বাউন্স আছে। টসেও জিতলেন ক্যারিবীয় দলপতি লয়েড। চিরাচরিত নিয়ম না মেনে নিলেন ফিল্ডিং।
উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাস্কার আর অংশুমান গায়েকোয়াড় প্রথম সেশনটা নিরাপদে কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু পরের সেশনেই দেখা গেল এক ভিন্ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। শুরুটা করলেন হোল্ডিং। গায়েকোয়াড়কে এক ওভারে মারলেন তিনটা বাউন্সার। এরপর এক ওভারে গাভাস্কারকে মারলেন চার বাউন্সার ও এক বিমার। দর্শকরা প্রচুর হাততালি দিচ্ছিল। তবে এই তান্ডবের মাঝেও দৃঢ়তার সাথে ব্যাট করে যাচ্ছিলেন গাভাস্কার-গায়েকোয়াড়।
সুনীল গাভাস্কার তার আত্মজীবনী ‘Sunny Days’ এ এই টেস্ট ম্যাচটিকে নিয়ে একটি অধ্যায় লিখেছেন, যার নাম দিয়েছেন ‘Barbarism in Kingston’। ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই পাঁজর বরাবর বোলিংয়ের ভয়ানক পরিকল্পনার পূর্ণ সমর্থনে ছিল স্যাবাইনা পার্কের দর্শকেরা। গাভাস্কার লিখেছেন, “To call the crowd a ‘crowd’ in Jamaica is a misnomer. It should be called a ‘mob’ “.
গাভাস্কারের ৩ ঘন্টা ৪০ মিনিটের লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটান হোল্ডিং, তার ইয়র্কারে ব্যক্তিগত ৬৬ রানে আউট হয়ে ফিরে যান তিনি। অপরদিকে, গায়েকোয়াড় সারাদিন লড়াই করেন প্রতিকূল পরিবেশে ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে। রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে ক্রমাগত বাউন্সার-বিমারের বিরুদ্ধে লড়াই করে শরীরে আঘাতে চিহ্ন নিয়ে ৫৮ রানে অপরাজিত থাকেন গায়েকোয়াড়। আলোকস্বল্পতায় প্রথম দিনের খেলা শেষে ভারতের রান ছিল ১ উইকেটে ১৭৮।
২য় দিনের শুরুতে নতুন বল নিলেন লয়েড। হোল্ডিং গতি আর বাউন্সের ঝড় তোলা শুরু করলেন। পঞ্চম বল করলেন মোহিন্দর অমরনাথের মাথা বরাবর। অমরনাথ মাথা বাঁচাতে কোনোমতে ব্যাট সামনে নিয়ে আসেন। মাথা বাঁচাতে পারলেও উইকেট বাঁচাতে পারেননি, ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগে ধরা পড়েছিলেন।
নতুন ব্যাটসম্যান বিশ্বনাথকে বাউন্সার মেরে স্বাগত জানালেন হোল্ডিং। এই বলটাকে টনি কোজিয়ার বলেছিলেন, “The wickedest bouncer of the series“। হোল্ডিং ইতিমধ্যে ভারতীয়দের রক্ত ঝরিয়েছেন এবং আরো রক্ত ঝরানোর জন্য তৈরি ছিলেন। কিছুক্ষণ পরেই হোল্ডিংয়ের শরীর তাক করা বল বিশ্বনাথের গ্লাভসে লেগে ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগ ফিল্ডারের হাতে চলে যায়। কিন্তু বলের গতি এত বেশি ছিল যে বিশ্বনাথের আঙুল ভেঙে যায়।
গায়েকোয়াড়ের আঙুলেও তিনবার বল লাগে। কয়েকবার একদম মুখের পাশ দিয়ে বল উড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত ৮১ রানের মাথায় আর রক্ষা পেলেন না। একটা বাউন্সারে ডাক করতে গিয়ে তার বাম কানে আঘাতপ্রাপ্ত হন গায়েকোয়াড়। এক ইঞ্চি এদিক-সেদিক হলেই যমে-মানুষে টানাটানি চলত। আর খেলবেন কী, দুদিন কাটিয়ে আসলেন হাসপাতালে।
এবার পালা ব্রিজেশ প্যাটেলের। ভ্যানবার্ন হোল্ডারের বল সোজা গিয়ে আঘাত করল তার মুখে। গলগল করে রক্ত পড়ছিল মুখ দিয়ে, মুখ হা করে মাঠ ছাড়েন রক্তাক্ত ব্রিজেশ প্যাটেল।
ড্রেসিংরুমে ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছিল। অধিনায়ক বিষেণ সিং বেদী ঠিক করলেন, তিনি আর ভগবত চন্দ্রশেখর ব্যাটিংয়ে নামবেন না। তারা চোটে পড়লে বোলিংটা করবে কে!
বেদী ৬ উইকেটে ৩০৬ রান নিয়ে ইনিংস ঘোষণা করলেন। যে তিনজন আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাদের আর ম্যাচে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা নেই। এর মাঝে ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিল ৮৪ রানের লিড।
ভারতের হয়ে সফরে যাওয়া ১৭ জন সদস্যের সবাইকেই কোনো না কোনো সময় মাঠে নামতে হয়েছিল। আবার বদলি ফিল্ডার হিসেবে নামা সুরিন্দর অমরনাথকে হাসপাতালে দৌঁড়াতে হলো অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশনের জন্য।
২য় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে ৩য় ওভারেই হোল্ডিং ফেরান গাভাস্কারকে। দিলীপ ভেংসরকারকে নিয়ে প্রতি-আক্রমণের চেষ্টা চালিয়েছেন মহিন্দর অমরনাথ। ২য় ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হন ভেংসরকার। তিন ব্যাটসম্যান কম, তাই জীবনের প্রথমবার চার নাম্বারে ব্যাটিংয়ে নামেন মদন লাল। আর কখনোই এই পজিশনে নামতে হয়নি তাকে। হোল্ডিংয়ের তোপের মুখে টিকতে না পেরে যখন আউট হন, তখন স্কোর ৯৭/৩।
ভারত আর কিছু যোগ করতে পারেনি স্কোরবোর্ডে, পর পর ফিরে যান অমরনাথ ও শ্রীনিবাস ভেংকটরাঘবন। ফিল্ডিংয়ের সময় আঙুলের চোটে পড়া বেদী ও চন্দ্রশেখর আর ব্যাটিংয়ে নামেননি। ফলে পাঁচ ব্যাটসম্যান ‘অ্যাবসেন্ট হার্ট’ হওয়ায় ৯৭ রানেই শেষ হয় ভারতের ইনিংস।
১৩ রানের লক্ষ্য কোনো উইকেট না হারিয়েই পেরিয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এবার ভারত অধিনায়ক বেদী আর মাঠেই নামেননি। টনি কোজিয়ার লিখেছিলেন, “Bedi’s action was plain and simple. The Indians had had enough and were calling in quits.“
এসবের থোড়াই কেয়ার করল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তারা তাদের পেস ব্যাটারি পেয়ে গিয়েছিল। একের পর এক তাদের ফাস্ট বোলাররা রাজত্ব করেছে পুরো দুই দশক জুড়ে।