বাংলাদেশের জন্য রোটেশন পলিসি ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

আজ থেকে এক যুগ আগের তুলনায় বর্তমান ক্রিকেটে ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেছে। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে, এই ফরম্যাটের একটা আলাদা বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ায় আইসিসি আয়োজিত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের প্রচলন ঘটায় ক্রিকেটারদের এখন আর দম ফেলার ফুসরতটাও নেই। এই ব্যস্তময় সূচীতে ক্রিকেটারদের ফিট রাখার জন্য তাদের নিয়মিত বিশ্রাম দেওয়াটাও জরুরী।

দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের দীর্ঘ সময়ের জন্য ফিট রাখার জন্য প্রয়োজন ও সুযোগ বুঝে নিয়ম করে বিশ্রামে পাঠানোর ব্যাপারটাই ‘রোটেশন পলিসি’ নামে পরিচিত। বর্তমান বিশ্বের জায়ান্ট দলগুলোর অধিকাংশই এই ‘রোটেশন পলিসি’ অনুসরণ করে থাকে। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় ভারতের কথা। নিদাহাস ট্রফি ও এশিয়া কাপের ফাইনালে আমরা যে ভারতের কাছে হারলাম, তার একটিতেও কিন্তু তাদের নিয়মিত অধিনায়ক বিরাট কোহলি ছিলেন না। অতিরিক্ত খেলার ধকলে যাতে কোহলি ইনজুরড না হন, সে কারণেই তাকে এই দুই সিরিজে বিশ্রাম দিয়েছিল ভারত। একইভাবে, দলের সেরা পেসার জাসপ্রিত বুমরাহকেও বিভিন্ন সময়ে বিশ্রাম দিয়েছে দলটি। 

রোটেশন পলিসির সুফলে এই দু’জন ইনজুরি ছাড়া দীর্ঘদিন খেলতে পারছেন; Image Source: Reuters

অস্ট্রেলিয়া তো এই রোটেশন পলিসির সবচেয়ে বড় অনুসারী। ক্ষণিক সাফল্যের মোহ কিছুটা বিসর্জন দিয়ে হলেও তারা তাদের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের বিশ্রামে পাঠায়। ইনজুরিপ্রবণ মিচেল স্টার্ক এবারের বিশ্বকাপ পুরোটা খেলতে পেরেছেন, আর এর মূল কারণ এই রোটেশন পলিসি। অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের ফিট রাখা ছাড়াও রোটেশন পলিসির আরেকটা বড় সুবিধা হচ্ছে, পাইপলাইনের নতুন খেলোয়াড়দের বাজিয়ে দেখা যায়, ফলে দলের ভিতটাও মজবুত হয়।

সম্প্রতি এই ব্যাপারেই কথা বলেছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। তার মতে, বিসিবি যদি এই রোটেশন পলিসি অনুসরণ করে, তবে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আরো অনেক প্রতিভা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে। তিনি বলেন,

‘দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের বিশ্রামে পাঠালে আপনি পাইপলাইনে থাকা খেলোয়াড়দের যাচাই করার একটা সুযোগ পাবেন। এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব বড় পরিসরে পরিকল্পনা করা উচিত, তাহলে ভবিষ্যতে ভালো ফল আসবে।’

বিশ্বকাপে দারুণ সময় পার করেছেন এই অলরাউন্ডার; Image Source: Getty Images

উদাহরণ হিসেবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কথা উল্লেখ করে বলেন,

‘সাম্প্রতিক সময়ের পরিসংখ্যানে চোখ বুলালেই দেখতে পাবেন যে, ভারতের খেলোয়াড়েরা সবচেয়ে কম ইনজুরিতে পড়েছে। আর এমনটা হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই রোটেশন পলিসি। এই নীতির ফলে অনেক নতুন খেলোয়াড় দলে নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ পেয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্রামশেষে যখন তারা দলে এসেছেন, তখন তারা অনেক বেশি সতেজ ও প্রাণবন্ত ছিলেন।’

আর ঠিক এসব দিক ভেবেই বিশ্বকাপে দারুণ পারফর্ম করার পর শ্রীলঙ্কা সফরে না গিয়ে কিছুদিন বিশ্রামে থাকার আবেদন জানিয়েছিলেন সাকিব, বিসিবিও সেই আবেদন মঞ্জুর করেছিল। কোনো খেলোয়াড় যদি সম্পূর্ণ ফিট না হন, তবে সেই খেলোয়াড় নিজে এসেই টিম ম্যানেজমেন্টকে সেই ব্যাপারে জানাবেন, এমনটাই আশা করেন এই অলরাউন্ডার। কোচিং স্টাফ, ফিজিও ও প্রশিক্ষকদেরও ইনজুরিসংক্রান্ত ব্যাপারে যথাযথ ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানান তিনি।

সাকিবের বলা কথাগুলো যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এবারের বিশ্বকাপ। পুরো আসরজুড়ে অধিনায়ক মাশরাফি মর্তুজা, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম, মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন, মোসাদ্দেক হোসেন, মুস্তাফিজুর রহমানের ছোটখাটো ইনজুরির ফলে বেশ ভোগান্তির স্বীকার হয়েছিল টাইগাররা। এই ইনজুরি সমস্যার কারণে খেলোয়াড়েরা খুব বেশি ম্যাচ হয়তো মিস করেননি, কিন্তু তাদের পারফরম্যান্সে একটা বড় নেতিবাচক প্রভাব কিন্তু ঠিকই ছিল। 

বিশ্বকাপজুড়েই আনফিট লেগেছে মাশরাফিকে; Image Source: AFP 

বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সবচেয়ে বাজে বোলিংয়ের রেকর্ড এখন মাশরাফির। অথচ কিছুদিন আগেও ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’-এর পারফরম্যান্স ছিল বেশ সন্তুষ্টিজনক। হুট করে পারফরম্যান্স ছকে এমন অবনতির মূল কারণ ঘাঁটলে সবার আগে এই ফিটনেস সমস্যাটাই চলে আসবে। বিশ্বকাপে যারা মাশরাফিকে একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করেছেন, তাদের সবারই এই পেসারের আনফিট থাকার ব্যাপারটা নজরে এসেছে। শুধু বোলিং নয়, ফিল্ডিংয়ের সময়েও তাকে কিছুটা অস্বস্তিতে থাকতে দেখা গেছে।

একই কথা প্রযোজ্য হবে দলের আরেক সিনিয়র খেলোয়াড় মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের জন্যেও। গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড় এই বিশ্বকাপে ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দুটো বাদ দিলে বাকি সব ম্যাচেই তার পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক। তিনি যে পুরোপুরি ফিট ছিলেন না, এটা তো নতুন করে আর বলার কিছু নেই। কাঁধের ইনজুরির কারণে পুরো আসরে একটা বলও করতে পারেননি। 

ফিটনেসের অভাবে নিজের সেরা ছন্দ হারিয়ে ফেলেছেন রিয়াদ; Image Source: UNB

পুরোপুরি ফিট না হওয়া সত্ত্বেও খেলা চালিয়ে যাওয়াটাকে অনেকেই দেশপ্রেম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করছিল, কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই কতটা বাজেভাবে বুমেরাং হয়ে ফিরতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল এবারের বিশ্বকাপ। আনফিট হয়ে যারা বিশ্বকাপ খেলতে গেছে, তাদের কারো পারফরম্যান্সই আশানুরূপ ছিল না। অন্যদিকে, বিশ্বকাপ শুরুর আগে ফিটনেস নিয়ে বিশেষ কাজ করেছিলেন সাকিব আল হাসান, অতিরিক্ত পরিশ্রম করে ওজনও কমিয়েছিলেন তিনি। আর এই পরিশ্রমের ফলটা হাতেনাতেই পেয়েছেন সাকিব, পুরো আসরজুড়ে তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স সেটার পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়।

সাকিবের দৃষ্টান্ত দেখে হলেও বাংলাদেশের বাকি খেলোয়াড়দের ফিটনেস নিয়ে আরো যত্নবান হওয়া উচিত। তাছাড়া শরীর ঠিক রাখার জন্য কতটুকু বিশ্রাম প্রয়োজন, সেটা নিয়েও ভাবতে হবে। বছরে বাংলাদেশ যে কয়টা দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলে, তার মধ্যে অনেকগুলোতেই অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলের সাথে খেলা হয়। কিন্তু সেসব সিরিজেও দলের তারকা খেলোয়াড়দের বিশ্রাম দেওয়ার কথা বিসিবি ভাবে না, র‍্যাংকিংয়ের পয়েন্ট কমে যাওয়ার দোহাই দিয়ে পারলে প্রতিটি সিরিজেই পূর্ণশক্তির দল নামিয়ে দেয় বিসিবি। 

ওজন কমাতে বিশ্বকাপের আগে কঠোর পরিশ্রম করেছেন সাকিব; Image Source: The Daily Star

সদ্যসমাপ্ত শ্রীলঙ্কা সিরিজের কথাই ধরা যাক। বিশ্বকাপে বাজে সময় কাটানো রিয়াদ ও তামিমকে এই সিরিজে খেলতে না পাঠিয়ে বিশ্রামে পাঠানোটাই হতো বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু বিসিবি সেটা না করে দু’জনকেই শ্রীলঙ্কা পাঠিয়ে দিলেন। তাতে লাভটা কী হলো? তিন ম্যাচেই খারাপ করায় তাদের সময়টা আরো কঠিন হয়ে গেছে।

মাঝেমধ্যে খেলা থেকে কিছুটা বিরতি নেওয়াটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে সাকিব বলেন,

‘একজন খেলোয়াড়ের পক্ষে তো সবসময় খেলা সম্ভব নয়, তাদেরও বিশ্রামের প্রয়োজন রয়েছে। এই ব্যাপারে কোচিং স্টাফ ও খেলোয়াড় – দুই পক্ষের মাঝেই একটা ভালো বোঝাপড়া থাকা দরকার। সেটা না হলে এই বিশ্রাম নেওয়া নিয়ে বিভ্রান্তিকর সংবাদ ছড়িয়ে উল্টো বিতর্ক ছড়িয়ে পারতে পারে।’

দীর্ঘমেয়াদে সাফল্য পাওয়ার জন্য রোটেশন পলিসি নিয়ে একটা সুন্দর পরিকল্পনা সাজাবে বিসিবি, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে সাকিব বলেন,

‘আগামী তিন-চার বছরের জন্য বিসিবি নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। ইতঃমধ্যে দুইজন কোচকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে বিসিবি নিশ্চয়ই তাদের কৌশল ঠিক করবে। যদি আমরা সবাই মিলে একসাথে কাজ করতে পারি, তবে গত চার বছরের ধারা অব্যাহত রেখে আমরা ক্রিকেটকে আরো এগিয়ে নিতে পারবো।

২০২৩ বিশ্বকাপে যদি বাংলাদেশ বড় কিছু করতে চায়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। রোটেশন পলিসি ছাড়াও পাইপলাইন থেকে নতুন প্রতিভা কীভাবে খুঁজে আনা যায়, সেই ব্যাপারেও নজর দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না সাজিয়ে প্রতি দ্বিপাক্ষিক সিরিজের আগে দায়সারা প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলে বড় কিছুর স্বপ্ন দেখাটাই বৃথা।

This article is in Bangla language. It's about the importance of rotation policy for Bangladesh. For references please check the hyperlinks inside the article.

Featured Image: Getty Images

Related Articles

Exit mobile version