তাহলে শেষ থেকেই শুরু হোক।
সাল ২০০৬; বিশ্বের বুকে আবার ফিরেছে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ – ফুটবল বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ডের ‘সুইডিশ’ কোচ সভেন গোরান এরিকসন ‘থিও ওয়ালকট’ নামের এক সতেরো বছর বয়সী কিশোরকে বিশ্বকাপ-স্কোয়াডে সংযুক্ত করে হইচই ফেলে দিয়েছেন। ১৯৫৮—সুইডেন বিশ্বকাপে যেমন ‘বিস্ময় বালক’ রুপে পেলের আবির্ভাব, এই কিশোরও তেমন হবেন; এরিকসন মনে করেন তেমনটা। অতএব আর্সেনালের বেঞ্চ থেকে বিশ্বকাপগামী বিমানে থিও।
এদিকে মুশকিলে পড়লেন আপনি। কীভাবে যেন খবর রটে গেছে, থিও ওয়ালকট আপনার ভাইপো হন, আপনি তার কাকা। থিও’র বাবা ছিলেন ক্যারিবিয়ান বংশোদ্ভূত, তাই লোকজনের পক্ষে হিসেব মেলানো সহজ। দুইয়ে দুইয়ে চার। মঞ্চে এসে আপনাকে বলতেই হলো, এ কে-রে বাবা! একে তো আমি চিনি না। ভাইপো তো নয়-ই, আপনার সঙ্গে পারতপক্ষে কোনো রক্তের সম্পর্কও নেই তার।
তার মাস খানেক পরই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। তখন আপনার বয়স ৮০। বন্ধু স্যার এভারটন উইকসের অশ্রুজল ও আশীষ সঙ্গে নিয়ে আরেক বন্ধু স্যার ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেলের পাশে সমাধিস্থ হলেন আপনি — স্যার ক্লাইড ওয়ালকট।
১.
মাত্র ষোল বছর বয়সে বার্বাডোসের হয়ে প্রথম শ্রেণির অভিষেক ত্রিনিদাদের বিপক্ষে। না, লোকের মুখে রটে যাওয়া ভাইপো ‘থিও ওয়ালকট’-এর মতো ‘বিস্ময়বালক’ হয়ে শোরগোল তুলতে পারেননি; দুই ইনিংস মিলিয়ে আট ও শূন্য করেছিলেন। শোরগোল তুলেছিলেন বছরকয়েক বাদে, সেই ত্রিনিদাদের বিপক্ষে। প্রিয় বন্ধু ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেলের সঙ্গে জুটি বেঁধে ৪র্থ উইকেটে জমা দিয়েছিলেন সেই সময়ের বিশ্বরেকর্ড ৫৭৪ রান! ওয়ারেল করেছিলেন ২৫৫, আর আপনি ৩১৪।
লম্বা, একহারা গড়ন। সুস্বাস্থ্যবান শক্তপোক্ত পেশিবহুল শরীর, ছয় ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতা। তাই শটে যেমন শক্তির প্রাবল্য থাকত, তেমনি দাপট ও প্রতিপত্তি। ড্রাইভ তো নয়, যেন ছ’আউন্সের একটি অগ্নিগোলক শাঁ শাঁ করে বাউন্ডারি অভিমুখে ছুটে যায়। অনুপম অফ ড্রাইভ, চোখ ধাঁধানো স্কয়ার কাট, পুল-হুকেও সুনিপুণ সক্ষমতা — ফলে উইন্ডিজ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ হিসেবে বিবেচিত হতে বেগ পেতে হয়নি মোটেও।
আপনার ব্যাটিং সক্ষমতা সম্পর্কে স্যার অ্যালেক বেডসার খুব সম্ভবত সবচেয়ে ভালো বলেছেন:
“I would rate Clyde as the hardest hitter of the three Ws. He drove with more strength off the back-foot than some crack batsmen were able to do off the front foot, an asset which led him to go back and force the ball away more than most and to assault the over-pitched half-volley with particular savagery.”
আপনার ব্যাটিংয়ে পেশিশক্তির সঙ্গে শিল্প-সৌন্দর্য্য মিলেমিশে এক চমৎকার সমন্বয়ে প্রকাশ পেত। কভার বা নাক বরাবর সোজা যখন দুরন্ত গতিতে ব্যাট চালাতেন, ব্যাট ও বলের তড়িৎ সংঘর্ষে যে শব্দ মুহূর্তকাল বাতাসে ভেসে বেড়াতো, তা অনেকটা যেন বজ্রপাতের আওয়াজ। গুড়ুম গুড়ুম শব্দে পৃথিবীকে যেন জানিয়ে দেয়া শক্তির সক্ষমতা। যেন ক্ষণকাল চারপাশ অবাক ও আতঙ্কে রাখা।
সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার টেড ডেক্সটার, যিনি নিজেও আক্রমণাত্মক ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আপনার সম্পর্কে তারও একটি উক্তি এখানে সংযুক্ত করে দিতে চাই,
“Raw power was his trademark,”
২.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে ক্রিকেট ফেরার সময়ে ইংল্যান্ড ক্যারিবিয়ানে অতিথি হয়ে যখন এসেছিল, সেই অতিথি আপ্যায়নের একজন হিসেবে স্কোয়াডে যুক্ত হন। আপনার সঙ্গে আশৈশব দুই বন্ধু ওয়ারেল ও উইকসও ছিলেন। ওয়ারেল প্রথম টেস্টে সুযোগ না পেলেও, দ্বিতীয় টেস্টে তিনজনই খেললেন একসঙ্গে— তিন-চার-পাঁচ নম্বরে; সেদিন থেকে পরবর্তী একদশকের জন্য উইন্ডিজ ক্রিকেটের মিডল অর্ডার নিয়ে দুশ্চিন্তা ফুরিয়ে গেল। অবশ্য দুশ্চিন্তা তো ফুরালো সেই সময়, যখন আঠারো মাসের ব্যবধানে তিন-তিনটি রত্ন সেইন্ট মাইকেলের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে জন্ম নিল। সে যাকগে, চর্বিত চর্বণ। কতবার যে এইসব কথা উচ্চারিত হয়েছে, লেখা হয়েছে! আপনাদের তিনজন বা যেকোনো একজন নিয়ে আলোচনা শুরু হলেই এইসব কথা আসবেই। এমনকি ধাই-মা পর্যন্ত নাকি একজনই ছিলেন তিনজনেরই!
দলে আপনার অন্তর্ভুক্তি অবশ্য কেবল ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিল না। মূলত উইকেটকিপার, যিনি ব্যাটিংয়েও দারুণ পারদর্শী। কলেজে ক্রিকেট খেলার সময়ে ব্যাটে ধরেছিল রান-খরা, ওদিকে একজন কিপারেরও প্রয়োজন দলে, ফলে নিজেকে আপনি উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান পরিচয়ে রূপান্তরিত করেন; যা উইন্ডিজ ক্রিকেট দলের অন্তুর্ভুক্তিতেও কাজে দিয়েছিল।
শুরুটা জঘন্য হলেও ঐ উইকেটকিপিং দিয়ে দলে জায়গা ধরে রাখেন ঠিকই। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চার টেস্টে ২২ গড়ে ১৩৩ রান। একটাও পঞ্চাশ নেই। উইকেটকিপার হিসেবে খারাপ না, তবে যিনি ৫৭৪ রানের জুটির অংশীদার (এবং তাতে জুড়ে দেন ৩১৪), তার জন্য বেমানান তো বটেই; ব্যাটসম্যানশিপেরও যথাযথ প্রতিফলন নয়।
ভারত সফরে কিঞ্চিৎ প্রতিফলন দেখা গেল, যেখানে এভারটন উইকস টানা পাঁচ সেঞ্চুরির (প্রথম সেঞ্চুরিটি অবশ্য ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, জ্যামাইকার কিংস্টনে, স্যাবাইনা পার্কে।) পর থেমেছিলেন নব্বইতে। সেখানে আপনারও থাকে দুটো সেঞ্চুরির সঙ্গে ৬৪ গড়ে ৪৫২ রান।
তারপর এলো বিলেত সফর। ১৯৫০-এর সেই বিখ্যাত ইংলিশ গ্রীষ্ম।
৩.
তখনও অনেক ক্যারিবিয়ান দ্বীপের ভাগ্যবিধাতা ইংরেজ সরকার। ব্রিটিশ রাজের অধীন কোনো অঞ্চল সেই রাজাদের দেশে গিয়ে রাজার সবচেয়ে অভিজাত উঠোনে রাজাকেই চোখ রাঙিয়ে দেয়া, পরাজয় উপহার দেয়া! প্রজা হয়ে রাজাকে শাসানো? শাসিতের দল শাসকের ভূমিকায়? যেন বামন হয়ে আকাশের চাঁদ ধরতে চাওয়া নয়, চাঁদটাকেই মাটিতে নামিয়ে আনা!
এই অসম্ভব কান্ডের কান্ডারীদের একজন ছিলেন আপনি। দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ১৬৮-তে স্বাগতিকদের প্রতিরোধের শেষ সম্ভাবনাটুকুও মুছে দিতে রাখলেন জোরালো ভূমিকা। লর্ডসের বনেদিয়ানাকে স্তব্ধ করে দিয়ে কালো মানুষদের উচ্ছ্বল উৎসবের সঙ্গে লেখা হলো বিখ্যাত গান:
উইথ দৌজ টু লিটল পালস অব মাইন
রামাধিন এন্ড ভ্যালেন্টাইন
সেই গানের একটা অংশে আপনাকেও দেয়া হলো যোগ্য মর্যাদা। একটা অংশে বলা হলো,
“But Gomez broke him down,
While Walcott licked them around;
He was not out for one-hundred and sixty-eight,
Leaving Yardley to contemplate.”
ক্যালিপসো সংগীতের কিংবদন্তী লর্ড কিচেনার তিন বন্ধুকে ঘিরেই গেয়েছিলেন চারটি লাইন,
Walcott, Weekes and Worrell held up their name
With wonder shots throughout the game
But England was beaten clean out of time
With the spin bowling of Ramadhin and Valentine.
ওয়ালকট-উইকস-ওয়ারেল যেন একইসূত্রে গাঁথা। একজন ছাড়া অন্যজন বুঝি ঠিকঠাক পূর্ণতা পায় না। এই যেমন অন্য দু’জন (ওয়ারেল ও উইকস) সম্পর্কে লেখার পর এক নগণ্য কলমচির কলম তাড়া করে আপনাকে!
৪.
উইন্ডিজ ক্রিকেট ধীরে ধীরে চারাগাছ হতে মহীরূহ হওয়ার পথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একটা সিরিজেও নেই পরাজয়। অস্ট্রেলিয়া সফরটাকে তখন অনেকে বলছিলেন অঘোষিত টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। উইন্ডিজ ক্রিকেটের সত্যিকার পরীক্ষাকেন্দ্র। এই পালায় উতরে গেলে বাকি বিশ্বের নমস্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত। কিন্তু চূড়ান্তভাবে পর্যদুস্ত হলো উইন্ডিজ, আপনিও পার করলেন ক্যারিয়ারের এক জঘন্যতম সময়। রে লিন্ডওয়াল ও কিথ মিলার আপনাকে ভড়কে দিল পুরোপুরি। গতি, বাউন্স, শর্ট বলের আক্রমণ – কিছুরই জবাব জানা নেই। উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব থেকেও পেলেন অব্যাহতি। আপনি বুঝে গেলেন, দলে টিকে থাকতে হলে উইকেটের পেছন সামলালেই হবে না আর, উইকেটের সামনেই সাহসের সাথে লড়ে দেখাতে হবে।
নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি দিয়ে জানিয়ে দিলেন, চ্যালেঞ্জটা নিয়েছেন আপনি। ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষেও আপনার ব্যাট সদা হাস্যময়। ইংলিশদের বিপক্ষেও তেমনি দাপট। এই সময়ে ব্যাটিংয়ে ছয় থেকে পাঁচ-চারে উঠে আসলেন। চার নাম্বারেই খেললেন ক্যারিয়ারসেরা ২২০ রানের ইনিংস। ২৫ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে কাঁপছে দল; ফিরে গেছেন ইনফর্ম ওয়ারেল, ঘরের মাঠ ব্রিজটাউনে। গ্যালারিতে উশখুশ করছে বার্বাডোজের ক্রিকেটপাগল জনতা। সেই ভীষণ প্রয়োজনের মুহূর্তে একপ্রান্ত আগলে প্রায় সাড়ে ছ’ঘন্টায় বিনির্মাণ করলেন আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উঁচু অট্টালিকা। দলের ৩৮৩ সংগ্রহে আপনার একারই যোগান প্রায় ষাট শতাংশ। অ্যালেক্স ব্যানিস্টার লিখেছিলেন,
“He knew Hutton had to set an attacking field which left gaps in front of the wicket and he accepted the challenge with a counter-attack,… How well he succeeded is history.”
সেই সিরিজে ৩ সেঞ্চুরি ও ৩ ফিফটিতে প্রায় সাতশ’ রান। কে জানতো, পরের সিরিজে অপেক্ষা করছে তার চেয়েও বড় কিছু? আরো অবিশ্বাস্য ব্যাটসম্যানশীপ?
৫.
অস্ট্রেলিয়ার সেবারের দলে কে ছিল না? বোলিংয়ে সব বড় বড় নাম। লিন্ডওয়াল, মিলার, বেনো, আর্চার, জনস্টন, জনসন। সবাইকে স্রেফ কচুকাটা করলেন। আপনি যেন বুনো ষাঁড় বা যেন উন্মত্ত কোনো নেকড়ে, যাকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে একপাল ভেড়ার মাঝে। ছিঁড়েখুড়ে খেলেন সবক’টাকে। ৫ টেস্টে ৫ সেঞ্চুরিতে ৮২৭ রান, যেখানে রয়েছে দুই টেস্টে দুইবার উভয় ইনিংসে সেঞ্চুরি!
অস্ট্রেলিয়ার সেই বীভৎস ও ভুলে যাওয়ার মতো দুঃসহ সিরিজের পর ঘরের মাঠে ১৯৫২-৫৩ থেকে ১৯৫৪-৫৫ পর্যন্ত পরপর তিন সিরিজে, ভারত-ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রায় ৮২ গড়ে ১৯৮২ রান, সঙ্গে দশটি সেঞ্চুরি। সেই যে গ্লাভস ছেড়ে ব্যাটিংয়েই নিজের যোগ্যতা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ ছিল, ব্যাটিংয়েই মনোযোগের আকাঙ্ক্ষা ছিল, তাতে সম্পূর্ণ সফল। স্লিপ ফিল্ডার হিসেবেও বিশ্বস্ততার প্রমাণ রেখেছিলেন পরে।
রিচি বেনো মুগ্ধতা ও সসম্ভ্রম শ্রদ্ধায় আপনার সম্পর্কে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন,
“আমি ওয়ালকটের চেয়ে পাওয়ারফুল হিটার এ যাবৎকালে দেখিনি। সম্ভবই না। যখন সে (ওয়ালকট) থিতু হয়ে যেত বা ফ্লো পেত, তখন তাকে বল করার জায়গা খুঁজে পাওয়াই অসম্ভব হয়ে পড়ত। আপনি যেখানেই বল করুন, সে আপনাকে তাড়া করবেই।”
ক্রিকেটের ইতিহাসে রিচি বেনো একজন কিংবদন্তী নন শুধু, তার চেয়েও বিশেষ কিছু। তাই বেনোর মন্তব্য বা লেখাও বিশেষ কিছু হিসেবেই বিবেচিত। তিনি যেমন যদু মধু নন, ঠিক তেমনি যেমন-তেমন কথাও তিনি বলবেন না। আপনার সম্পর্কে তাই বেনোর আরো একটি মন্তব্য উল্লেখ করতে চাই,
“He sometimes took the bat forward in a semi-circle through mid-off before bringing it down with a full face to meet the ball.”
বলা হয়, ল্যাঙ্কাশায়ার কিংবদন্তী ব্রায়ান স্ট্যাথাম (ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের একটি বোলিং প্রান্তের নাম যার নামানুসারে – ব্রায়ান স্ট্যাথাম এন্ড)-এর বলে একবার আপনি স্ট্রেইট ড্রাইভ করেছিলেন। তা স্যাবাইনা পার্কের সাইডস্ক্রিনের কংক্রিটের দেয়ালে লেগে আবার ফিরে আসে বোলিং মার্কে! এতটাই জোর ছিল শটটায়! সত্যি নাকি?
৬.
ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেল ছিলেন হালকা-পাতলা গড়নের, স্টাইল ও আভিজাত্যের প্রতীক। তার ব্যাটিংয়ে একটা বনেদিয়ানা, একটা নমনীয়তা টের পাওয়া যেত। স্যার উইকস ছিলেন বামনাকার, ব্যাটিংয়ে একদম গোছানো কিন্তু জাঁকালো একজন। তার স্কয়ারকাট ছিল বুলেটগতির। রিচি বেনো একবার বলেছিলেন,
‘He set out to hammer bowlers.’
কিন্তু আপনার ব্যাটিংয়ের পুরোটাই পেশিশক্তির সঙ্গে শৈল্পিকতার অনন্য সমন্বয়। দানবীয় একজন যেন মানবীয় সুন্দরতম গুণের সম্মিলনে প্রস্ফুটিত। সাবেক ইংলিশ অলরাউন্ডার ট্রেভর বেইলি ইংল্যান্ডের ১৯৫৩-৫৪ ক্যারিবিয়ান সফরটায় ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আপনি তো তাকেও ছেড়ে কথা কননি। সেই তিনি লিখেছিলেন,
“Weekes was a small, neat, compact back-foot player, while Worrell was the most artistic and stylish. But of all three I found bowling to Clyde on a good wicket the most difficult and unremunerative. He had the ability to hit good-length deliveries with astonishing ferocity using a straight bat off both front and back foot.”
জন উডকক প্রবল বিস্ময় নিয়ে বলেছিলেন,
‘উপরওয়ালাই জানেন, এই আধুনিক কালের গদা-সদৃশ ব্যাট যদি সে (ওয়ালকট) পেত, কি যে করত তাহলে!’
৭.
বছরখানেকের ব্যবধানে আশ্চর্যভাবে হারিয়ে ফেলেন ম্যাজিকটা। যে মানুষ ব্যাটিংয়ে নামলেই সেঞ্চুরি হাঁকাতেন, শেষ ১২ টেস্টে যার ১০টাই সেঞ্চুরি, শেষ ছয় টেস্টে ছয়টা; সেই তার ব্যাটে অদ্ভুত বিষণ্ণতা। যেন হঠাৎ জাদুর কাঠি হারিয়ে ফেলেছেন, অথবা কাঠিটা রেখে এসেছেন ক্যারিবিয়ানে।
তাই ইংল্যান্ড সফরে আপনার ব্যাটে রানের বান ডাকে না। তাছাড়া বছর আটেক পরের বিলেতি গ্রীষ্মে অনেক পরিবর্তন দেখতে পান। পিচগুলো কেমন যেন হয়ে গেছে, নেই আগের মতো। চোট-টোট মিলিয়ে আপনার অবস্থা সঙ্গীন। একদমই ভালো যায় না সফরটা। আপনার ব্যর্থতা তো ছিলই, আপনার দুই বন্ধুও সেভাবে আলো ছড়াতে পারেননি। তাই উইন্ডিজও ‘উইজডেন’ ট্রফিটা রেখে আসতে বাধ্য হয় ইংল্যান্ডে। অবশ্য গ্রীষ্মের পরের ভাগে কাউন্টি ক্রিকেটে ঠিকই আলো ছড়ান। সেই মৌসুমে পঞ্চম-সর্বোচ্চ রান থাকে আপনার।
পাকিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাঠে আবারও হেসে ওঠে ব্যাট। তরুণ গ্যারফিল্ড সোবার্স যখন লেন হাটনকে (৩৬৪) ছাড়িয়ে এক-পা এগিয়ে ৩৬৫তে পৌঁছান, তার সঙ্গে অপর প্রান্তে থাকেন আপনি। ৮৮ রানে অপরাজিত তখন। বুঝতে পারেন, আগামীর ক্যারিবিয়ান মিডল অর্ডার নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
ঘরের মাঠে আতিথ্য দেন ইংল্যান্ডকে। সেভাবে ব্যাট হাসে না, বোঝা যায় মানসিকভাবে খুব একটা ভালো নেই আপনি। সব ছেড়ে সেবারই ‘বিদায়’ বলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।
একযুগের ক্যারিয়ারে ৪৪ টেস্টে ৫৬.৬৮ গড়ে ৩,৭৯৮ রান, ১৫টি সেঞ্চুরি, এবং ৪৮টি ডিসমিসাল। উইকস বছর দুয়েক আগেই ছেড়ে দিয়েছেন, আপনিও নেই; তখন ডব্লিউ-ত্রয়ীর আর একজনই খেলছেন — ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেল। যদি জানতেন বন্ধুর অধিনায়কত্বে খেলার সুযোগ হবে, তাহলে কি ছাড়তেন তখন? যদি জানতেন আপনার বন্ধু পৃথিবীর বুকে অসম্ভব ও অসাধারণ এক ক্রিকেট-সময় উপহার দেবেন, তাহলে কি বিদায় বলতেন মাত্র চৌত্রিশেই?
৮.
আপনার অবসরের কারণ বলা হয়েছিল ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটকর্তাদের বৈষম্য। যোগ্যতা ও সক্ষমতা সত্ত্বেও তারা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারদের সেভাবে মূল্যয়ন করতেন না, যেমনটা করা উচিৎ। শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটাররা অধিনায়কত্বের অনুপযুক্ত হলেও নেতৃত্বে বহাল থাকছেন, আর এদিকে একে একে যোগ্যতর মানুষজন ছেড়ে যাচ্ছে আঙিনা। প্রথমে উইকস, পরে আপনি।
কিন্তু পরে আপনি যখন নিজেই পরিষ্কার করলেন কারণটা, তখন বোঝা গেল এটাও একটা রটনা বা লোকমুখে অনুমান। ঠিক যেমন ‘থিও ওয়ালকট’ হয়ে যান আপনার ভাইপো!
আপনি জানিয়েছিলেন, আসলে অর্থনৈতিক কারণই ছিল মূখ্য। তখন উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড আপনাকে জবরদস্তি খেলাতে চেয়েছিল, তাও আবার বিনামূল্যে। পেটে যদি ভাত না জোটে, তখন নীতিবোধ, দায়িত্বজ্ঞান বা দেশের প্রতি কর্তব্যবোধ নেহায়েৎ বাহুল্য ও পরিহাসযোগ্য। বিনা পারিশ্রমিকে খেলার চেয়ে সম্মানীসমেত গায়ানার কোচ হওয়ার প্রস্তাব লুফে নেওয়াই আপনার জন্য সময়োচিত ও সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। তারপর আরো কত কী করলেন জীবনে!
কোচ-নির্বাচক-প্রশাসক। আরো কত রূপে আবির্ভূত হলেন আপনি। প্রিয় বন্ধু ওয়ারেল দুরারোগ্য ব্যধিতে ভুগে আচমকা ছেড়ে গেলে তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে রেখে যাওয়া দায়িত্ব পালন করলেন, হলেন ম্যানেজার। ছিলেন আইসিসির চেয়ারম্যানও, প্রথম কৃষাঙ্গ ও অ-ব্রিটিশ ব্যক্তি হিসেবে। সে বছরই, অর্থাৎ ১৯৯৩ সালে আপনাকে নাইটহুড সম্মাননায় ভূষিত করা হয় ক্রিকেটে অবদানের কারণে। অথচ আপনি বলতেন,
“ক্রিকেট আমাকে অনেক দিয়েছে, কিন্তু ক্রিকেটকে আমি কিছুই দিতে পারিনি!”
আহা, বিনয়ের কী অসাধারণ স্বরূপ!
সুপ্রিয়,
ক্রিকেটের ব্যাপারে আপনার অনুভূতি ও মমতা কেমন ছিল, তা বোঝা যায় ম্যাচ-গড়াপেটায় ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ক্ষেত্রে। যে কেউ অভিযুক্ত প্রমাণিত হবে, সুন্দরতম এই খেলাটির সঙ্গে প্রতারণা করবে, কলুষতার আমদানি করবে এই সবুজ নন্দনে – তার জন্য আজীবন নিষেধাজ্ঞা; এই ছিল আপনার নীতি। কোনো ধরনের সহানুভূতি নেই সেক্ষেত্রে।
৮০ বছরের যে সময়টুকু থেকে ক্রিকেটকে আঁকড়ে ধরেছেন, সেই যে বাবা-চাচা-ভাইদের সঙ্গে ক্রিকেটে বুঁদ হয়েছিলেন, পরিবারে ক্রিকেট-আবহ থেকে হাতে তুলে নিয়েছিলেন ব্যাট, সেই থেকে ক্রিকেট কেবল খেলামাত্র নয় আপনার কাছে, শৈল্পিকতা ও স্বচ্ছতা উপস্থাপনার মঞ্চ। সুন্দরতম ফুলের সুন্দরতম বিকাশের উর্বর ক্ষেত্র। ত্যাগ-সাধনা, সততা-শৃঙ্খলা, নিষ্ঠা-অধ্যাবসায় মিলেমিশে যেখানে একজন মানুষ হয়ে উঠে ভালো থেকে আরো ভালো, শুদ্ধ থেকে আরো শুদ্ধ। সেই শুদ্ধতার উদ্যানে নোংরা ছড়ালে তাকে আপনার ভালো লাগবে কেন?
***
ক্রিকেট আর আগের মতো নেই। যে ক্রিকেট আপনি দেখে গেছেন বা রেখে গেছেন, তেমন অবস্থা নেই একদমই। এখানে ক্রিকেট নিয়ে নানান কদর্য-ক্রিয়া ও ছল-প্রতিক্রিয়া নির্লজ্জ গৌরবময় হয়ে চলমান। ক্রিকেট ভাঙিয়ে খাওয়ার অসুস্থ ও বিকৃত প্রতিযোগিতাও চলে। আপনার বন্ধু স্যার এভারটন উইকস দেখেছেন কিছুটা, কিন্তু তিনি সেসবের বদলে কেবল ক্রিকেট উপভোগের কথাই বলতেন। ফুলবাগানের পাশেই নর্দমার স্তুপ, উইকসের কথা হচ্ছে আমি নর্দমা দেখব কেন, ফুলবাগানের সৌন্দর্য ও সুঘ্রাণে বিমোহিত হই! আসলে যাদের মনে কেবলই ক্রিকেটানন্দ, তারা হয়তো এইরকমই, অত কিছু বুঝতে বা ভাবতে চান না।
থাকগে সেসব কলুষতাময় আলোচনা। এই মঞ্চে আপনার কীর্তি ও গুণপনার কথাই হোক, ওসব আলোচনা তোলা থাক অন্য কোনো মঞ্চের জন্য।
শেষের আগে একটাই কামনা, শুধুমাত্র ব্যাটিং-সক্ষমতা ও অবিশ্বাস্য ব্যাটসম্যানশিপের কীর্তিমান হয়ে নয়, ক্রিকেটের চিরন্তন কিংবদন্তির একজন হয়েই নয়, আপনারা ক্রিকেট-দর্শক মাঝে বেঁচে থাকুন ক্রিকেটের প্রতি নিবেদন ও আন্তরিকতার প্রতীক হয়েও। যে বা যারা আপনাকে পড়বে, মুগ্ধ হবে আপনার ব্যাটিংয়ে, তারা মুগ্ধ হোক আপনার অকৃত্রিম নিবেদনেও। ক্রিকেট মাঠে ব্যাটিংয়ের সুদক্ষ কুশীলব, সুনিপুণ কারিগর কত কতই দেখা যায়! আপনার মতো হতে পারে, আপনার চেয়ে ভালো বা কম ভালোও হতে পারে।
কিন্তু আমরা চাই, ক্রিকেট মাঠে ফিরুক আপনার মতো ক্রিকেটপ্রাণ ঐকান্তিক ক্রিকেট-পুরুষোত্তম।
পরিশিষ্ট
আসলে আপনার কাছে এই পত্রের কোনো মানে নেই। আপ্লুত কন্ঠে অনেকে বলেন, ওপার হতে যদি দেখেন, উঁকি দিয়ে যদি পড়েন! আমার মনে হয় না তেমন কোনো সম্ভাবনা আছে। আপনি নশ্বর জীবনের পাঠ চুকিয়েছেন সেই কবে, এই পত্র আপনি পড়বেন, সে আশা বালখিল্য দুরাশা বৈ কিছু নয়।
তবু লিখতে বসা কেন? জেনে-বুঝে তবে মাঝে মাঝে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ার ‘তামাশা’ কেন?
আপনি নশ্বর, আপনি নেই, কিন্তু কীর্তি তো রয়ে গেছে। কীর্তি তো অবিনশ্বর। সেই কীর্তির প্রতি এক তুচ্ছ অভাজন যদি ভিন্ন আঙ্গিকে সম্মান জানাতে চায়, তাহলে অপরাধ হয় না নিশ্চয়? তাছাড়া আপনার আবাল্য দুই বন্ধুর প্রতি সবিশেষ সম্মাননা জানানোর কিঞ্চিৎ সুযোগ ও সৌভাগ্য অধমের হয়েছে।
স্যার এভারটন উইকস— উত্তম পুরুষে, স্যার ফ্র্যাঙ্ক ওয়ারেল— প্রথম পুরুষে, আর আপনাকে সম্মাননা জানানোর আঙ্গিক – মধ্যম পুরুষ। আপনার কীর্তির যে বিস্তৃতি, আপনার মহানত্বের যে ব্যাপ্তি, আশা রাখা যায়, এইক্ষেত্রেও এই অভাজন কিছুটা ভাগ্যের সহায়তা পেয়ে পাঠকের কৃপাদৃষ্টি লাভ করবে।
ইতি,
এক তুচ্ছ লেখক।