পি সারা ওভালে নিজেদের শততম টেস্টে ৪ উইকেটের ব্যবধানে শ্রীলঙ্কাকে হারানোর পর বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বেশ উজ্জীবিত ছিলো। আর তার আগে তো ওডি’আইতে নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ ইতিমধ্যে ক্রিকেট বিশ্বকে জানিয়েই দিয়েছে বাংলাদেশ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইংল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে টেস্ট ক্রিকেটেও নিজেদের সামর্থ্যর প্রমাণ দিচ্ছে বাংলাদেশ। এরই মাঝে দুই দলের মধ্যেকার টেস্ট সিরিজ অমীমাংসিতভাবে সমাপ্ত হওয়ার পর, গতকাল রনগিরি ডাম্বুলা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওডি’আই ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।
ডাম্বুলায় টসে জিতে শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক শুরুতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিতে দুইবার ভাবেননি। এই মাঠে রান তাড়া করে ম্যাচ জেতার পূর্ব পরিসংখ্যান এবং দিবারাত্রি ম্যাচে রাতের বেলায় শিশিরের কারণে বোলারদের অসুবিধার কথা ভেবে শুরুতে ফিল্ডিং নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই সৌম্য সরকারের উইকেট হারায় বাংলাদেশ। ইনিংসের ৪.৪ ওভারের সময় লাকমালের বল ক্রস ব্যাটে খেলতে গিয়ে চান্দিমালের সহজ ক্যাচে পরিণত হয়ে সাজঘরে ফেরেন সৌম্য সরকার। কিন্তু অন্যপ্রান্তে তামিম ইকবাল শুরু থেকেই ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। ম্যাচের প্রথম ওভারেই লেগ সাইডে ঠেলে দিয়ে ২ রান সংগ্রহ করার মধ্য দিয়ে প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দশ হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন তিনি।
পি সারা ওভালে ম্যাচ জয়ী ইনিংস খেলে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে থাকা তামিমকে সঙ্গ দিতে ক্রিজে আসেন সাব্বির রহমান। এই দুইজন প্রাথমিক বিপর্যয় সামাল দিয়ে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে মাত্র ১০১ বলে ৯০ রান যোগ করে। সাব্বির রহমান শুরুতে দেখেশুনে খেলে সময় বাড়ার সাথেসাথে শ্রীলঙ্কান বোলারদের উপর চড়াও হন। গুনারত্নের বলে থারাঙ্গার অসাধারণ ক্যাচে আউট হওয়ার আগে খেলেন ৫৬ বলে ৫৪ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। ১০টি চারের মারে তার এই ইনিংস সাজিয়েছেন।
সাব্বির রহমান আউট হওয়ার মাত্র ১ রানের মাথায় সান্দাকানের হাতে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে আউট হয়ে ফিরেন বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। বাংলাদেশের স্কোরকার্ড তখন ১ উইকেটে ১১৯ রান থেকে ৩ উইকেটে ১২০ রানে পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায় ক্রিজে আসেন অভিজ্ঞ সাকিব আল হাসান, অন্যপ্রান্তে তামিম ইকবাল তখনো ঠাণ্ডা মেজাজে ব্যাট করছিলেন। সাকিব এবং তামিম ওডি’আইতে খুব সচরাচর জুটি গড়ার সুযোগ পান না। ইতিপূর্বে একসাথে বড় কোনো জুটি গড়তে পারেনি তারা। কিন্তু আজকে ঠিকই দলের প্রয়োজনে দুইজনেই ঠাণ্ডা মাথায় বেশি সময় ধরে ক্রিজে টিকে থাকার দিকে মনোনিবেশ করে। কোনোপ্রকার ঝুঁকি না নিয়ে দুইজনেই প্রান্ত বদল করে খেলতে থাকে। সাকিব আল হাসান নিজের ৩৩তম অর্ধশতক পূর্ণ করার পথে মাত্র ১টি চার মারেন। শেষপর্যন্ত সাকিব আল হাসান ৭১ বলে ৭২ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলার পর দ্রুত রান তোলার তাগিদে ৪৬ তম ওভারে লাকমালের বলে আউট হয়ে সাজঘরে ফিরেন সাকিব আল হাসান।
ততক্ষণে সাকিব এবং তামিম চতুর্থ উইকেট জুটিতে ১৪৪ রান যোগ করে। বাংলাদেশের হয়ে ওডি’আইতে চতুর্থ উইকেট জুটিতে এটি চতুর্থ সেরা এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সর্বোচ্চ রানের জুটি এটিই। ওডি’আইতে এর আগে মাত্র একবারই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা জুটি শত রান তুলতে পেরেছিল। ১৩ বছর আগে মানজারুল ইসলাম রানা এবং মোহাম্মদ আশরাফুল ৫ম উইকেটে ঠিক ১০০ রান যোগ করেছিলেন। সাকিব ফিরে যাওয়ার পর দ্রুতই তামিম ইকবালও ফিরে যান। কিন্তু এর আগে খেলেন অসাধারণ ইনিংস। ১২৭ বলে নিজের ৮ম ওডি’আই শতক পূর্ণ করার পর দলীয় ২৮৯ রানের মাথায় ৫ম ব্যাটসম্যান হিসাবে সাজঘরে ফিরে যান তামিম ইকবাল। আউট হওয়ার আগে ১৪২ বলে ১৫টি এবং ১টি ছয়ের মারে ১২৭ রান করেন। যা ওডি’আইতে বাংলাদেশের হয়ে যৌথভাবে ৬ষ্ঠ সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। ওডি’আইতে বাংলাদেশের হয়ে ব্যক্তিগত ৮টি সর্বোচ্চ ইনিংসের মধ্যে তামিমের দখলে ৫টি।
বাংলাদেশের ইনিংসের শেষদিকে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ৯ বলে ২৪* এবং রিয়াদ ৭ বলে ১৩* রান করলে দলীয় সংগ্রহ দাঁড়ায় ৫ উইকেটে ৩২৪ রান। শততম টেস্টে অভিষেক হওয়া সৈকতের ব্যাটিং দেখে বুঝা মুশকিল ছিল কিছুদিন আগেই তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ হয়েছে। ৫ উইকেটে ৩২৪ রান ওডি’আইতে বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ দলীয় ইনিংস। বাংলাদেশের এমন ব্যাটিং পারফরমেন্স দেখার পর উপুল থারাঙ্গা আফসোস করতেই পারেন। কারণ শ্রীলঙ্কার মাটিতে এর আগে কখনো ৩০০+ রান তাড়া করে কেউ জিততে পারেনি। সর্বোচ্চ ২৮৯ রান তাড়া করে জিতেছিল শ্রীলঙ্কা, ২০০৯ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে।
শ্রীলঙ্কার লক্ষ্য আরো দুর্গম করে তোলেন বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। স্বাগতিকদের ইনিংসের প্রথম ওভারেই ওপেনার গুনাথিলাকে খালি হাতে সাজঘরে ফেরত পাঠান তিনি। নিজের প্রথম দুই ওভার থেকে কোনো দেয়নি মাশরাফি বিন মর্তুজা। অপরপ্রান্ত থেকে অভিষিক্ত মেহেদি হাসান মিরাজও নতুন বলে ভালো টার্ন আদায় করে নিচ্ছিলেন। নিজের করা তৃতীয় ওভারের শেষ বলে কুশাল মেন্ডিসকে আউট করে প্রথম ওডি’আই উইকেটের স্বাদ নেন মিরাজ।
এরপর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে শ্রীলঙ্কা। তাসকিনের বলে থারাঙ্গা, সাকিবের বলে গুনারত্নে সাজঘরে ফিরলে ৮৭ রানেই ৪ উইকেট খুইয়ে বসে শ্রীলঙ্কা। ইনিংসের মাঝপথে চান্দিমাল, গুনারত্নে এবং শ্রীওয়ার্ধনেকে নিয়ে ছোটো দুটি জুটি গড়ে নিজের অর্ধশতক পূর্ণ করে ৫৯ রান করলেও ম্যাচে ফিরতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। শেষদিকে পাথিরানার ৩১ রান এবং স্মার্ট প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ থিসারা পেরেরার ৩৫ বলে ৫৫ রানের ইনিংসের সুবাদে হারের ব্যবধান কমায় শ্রীলঙ্কা। মুস্তাফিজুর রহমান ৩ উইকেট এবং মিরাজ ও মাশরাফি দুই উইকেট তুলে নিয়ে শ্রীলঙ্কাকে ২৯ বল বাকি থাকতে ২৩৪ রানে অল আউট করে দেয়।
ওডি’আই ক্রিকেটে ৩৯ বারের দেখায় ৫ম জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ, এর আগের ৪বার বাংলাদেশের টার্গেটে ব্যাট করে ম্যাচ জিতেছিল। এই প্রথম আগে ব্যাট করে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। পুরো ম্যাচ জুড়েই সাকিব, তামিমরা দাপট দেখিয়েছে। সাঙ্গাকারাদের পরবর্তী সময়ে শ্রীলঙ্কা দল ম্যাচের কোনো মুহূর্তেই জয়ের আশা জাগিয়ে তুলতে পারেনি। তামিম ইকবাল নিজের ৮ম ওডি’আই শতক করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে নেন। ওডি’আইতে এটি তামিমের ১১তম ম্যাচ সেরার পুরস্কার। ডাম্বুলায় ৯০ রানের জয়ের মধ্য দিয়ে ৩ ম্যাচ সিরিজে ১-০ তে এগিয়ে গেলো বাংলাদেশ। সিরিজের দ্বিতীয় ওডি’আই ম্যাচ ২৮-শে মার্চ অনুষ্ঠিত হবে একই ভেন্যুতে।