জাভি হার্নান্দেজের বিদায়ের সময় কাতালানদের চোখের পানি ধরে রাখতে গিয়ে বিষম খেতে হয়েছিলো। তখন কেউ কল্পনা করতে পেরেছিলো আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাবিহীন বার্সেলোনা? সময় থেমে থাকে না। ইনিয়েস্তা ও জাভিহীন বার্সেলোনার একটা সময় অবশ্যই আসতো। ৩ বছর আগে জাভি ন্যু ক্যাম্প ছেড়ে বিদায় নেবার সময়ই প্রমাণ হয়ে গিয়েছিলো যে, বেদনাদায়ক সেই সময় নিকটে। অবশেষে দীর্ঘ ২২ বছর পর আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা বিদায় নিলেন ন্যু ক্যাম্প থেকে। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা ও বার্সেলোনা, দীর্ঘ ২২ বছর ধরে যে দুটো নাম মিলেমিশে এক হয়ে ছিলো, আগামী মৌসুম থেকে বার্সেলোনার পাশাপাশি ইনিয়েস্তার সেই নামটি আর উচ্চারণ করা হবে না।
গত শুক্রবার ইনিয়েস্তার বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলো বার্সেলোনা। তাতে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং জাভি হার্নান্দেজ। জাভি নিজেও কেঁদেছেন, কাঁদিয়েছেন বাকি সবাইকে। শুধু জাভি বা কাতালানরা কেন? রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকেরা যার সম্মানে গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে যায়, যে খেলোয়াড়ের কোনো নিন্দুক হাতে-কলমে পাওয়া যায়নি, তার বিদায়ে পুরো ফুটবলবিশ্ব কেঁদে উঠবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
ইনিয়েস্তার উত্থান
স্থানীয় ক্লাবের সাফল্যের জন্য বার্সেলোনা স্কাউট টিমের নজরে ইনিয়েস্তা প্রথমেই পড়ে গিয়েছিলেন। লা মাসিয়াতে আরো পরিপক্ব হয়ে তার বয়স যখন ১৬, তখন তিনি বার্সেলোনা মূল দলের অনুশীলনে ডাক পান। বার্সেলোনার কোচ তখন লুইস ফন হাল। ফন হাল কোচ থাকাকালীন সময়ে ইনিয়েস্তার মূল দলে অভিষেক হয় মাত্র ১৮ বছর বয়সে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সে অভিষেক ম্যাচে পুরো ৯০ মিনিট খেলেছিলেন তিনি। সেই বছর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপপর্বের ম্যাচেও খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন ইনিয়েস্তা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচে নজর কেড়ে নেওয়ায় ইনিয়েস্তাকে ঐ বছরই স্প্যানিশ লা লিগাতে অভিষেক ঘটানো হয়।
বার্সেলোনার সাথে ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রেবল
এক মৌসুমে তিনটি ট্রফি জেতার ঘটনা সাধারণত বিরল, বিশেষ করে স্পেনে। আর এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ছয়টি শিরোপার ঘটনা খুঁজে পাওয়া রীতিমতো দুরুহ ব্যাপার। কিন্ত ইনিয়েস্তার দল তা করে দেখিয়েছিলো। পেপ গার্দিওলা যুগে বার্সেলোনা প্রথম ট্রেবল শিরোপার দেখা পায়। যদিও সেই মৌসুমে ইনিয়েস্তা অনেকটা সময় পার করেছিলেন ইনজুরির সাথে যুদ্ধ করে। তাই খেলতে পারেনি অধিকাংশ ম্যাচ। তবে ২০১৪-১৫ মৌসুমে লুইস এনরিকের আমলে ট্রেবল জয়ের পেছনে ইনিয়েস্তার বড় ধরনের ভূমিকা ছিলো।
জাভির অবসরের পর বার্সেলোনার আর্মব্যান্ড পরিধান করার দায়িত্ব পুরোদমে দেওয়া হয় ইনিয়েস্তারকে। তারপর থেকে বার্সেলোনাকে সবসময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন তিনি। ইনিয়েস্তা সে বছর কোপা দেল রে-তে অ্যটলেটিকো বিলবাও এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে দলের অধিনায়ক ছিলেন। দুটো ফাইনালেই আলো কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। বিশেষ করে জুভেন্টাসের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে নেইমার বা মেসি নয়, মধ্যমাঠে খেলা ইনিয়েস্তাই ছিলেন ভয়ঙ্কর রূপে। ২০১৫ সালে তার ক্যারিয়ারে যোগ হয়েছিলো নতুন একটি মাত্রা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নামকরণের পর দলের সদস্য জাভি ও মেসির সাথে ইনিয়েস্তা সর্বোচ্চ তিনবার স্পর্শ করেছেন এ শিরোপা।
বার্নাব্যুতে ঐতিহাসিক সম্মান
বার্সেলোনার জন্য শুধু রিয়াল মাদ্রিদ নয়, তাদের মাঠ যেমন বার্সেলোনার কাছে দুর্গ, তেমনই তাদের সমর্থকরা যেন সেই দুর্গের রক্ষক। সান্তিয়াগো বার্নাব্যু কখনোই বার্সেলোনার খেলোয়াড়দের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিলো না, ভবিষ্যতেও হবে না। কিন্ত এই সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে যখন রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থক বার্সেলোনার কোনো খেলোয়াড়কে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখায়, তখন তা হয়ে যায় ইতিহাসের বিরল এক ঘটনা।
বিরল এ সম্মান ১৩ বছর আগে পেয়েছিলেন রোনালদিনহো, তারও অনেক আগে ডিয়েগো মারাডোনা। ২০১৫ সালে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাও এ বিরল সম্মানের ভাগীদার হয়েছিলেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে মেসিহীন বার্সেলোনার হিরো হয়ে উঠেছিলেন ইনিয়েস্তা। নিজের করা এক গোল এবং নেইমারকে দিয়ে করানো আরেক গোলসহ ড্রিবলিং, লং পাস এবং সলো রানে নাচিয়ে ছেড়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদ রক্ষণকে। রিয়াল মাদ্রিদকে বিধ্বস্ত করার পর শেষ মুহূর্তে কোচ লুইস এনরিকে তুলে নিলেন ইনিয়েস্তাকে। মাঠ ছাড়ার পূর্বমুহূর্তে ইনিয়েস্তার জন্য দাঁড়িয়ে গেলো মাদ্রিদ সমর্থকভরা গ্যালারি। সম্মানজনক করতালির পাশাপাশি এটা পরিষ্কার ছিলো যে, বার্সেলোনার প্রতি বা বার্সেলোনার জার্সির প্রতি বিদ্বেষ থাকলেও আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার প্রতি তাদের ভালোবাসার কমতি নেই।
বার্সেলোনার হয়ে ৪০০ তম ম্যাচ খেলার মাইলফলক
সব ধরনের ফুটবল মিলিয়ে ৩৪ বছর বয়সী আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা ৭০০ এর বেশি ম্যাচ খেলেছেন। কিন্ত বার্সেলোনার হয়েও যে তার ৪০০ ম্যাচ খেলার মতো মাইলফলক রেকর্ড আছে। গত মৌসুমে লেগানেসে সাথে ২-১ ব্যবধানে জয়ের ম্যাচে ইনিয়েস্তা তার ৪০০ তম ম্যাচ খেলার সৌভাগ্য অর্জন করেন। বার্সেলোনা অধিনায়ক সেই মৌসুমেও ছিলেন বার্সেলোনার অন্যতম ভরসা হিসেবে। বার্সেলোনাকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে গেলেও জুভেন্টাসের কাছে হেরে ফাইনালে পৌঁছানো হয়নি কাতালানদের।
২০১৫ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল
আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা যেন যেকোনো ফাইনাল খেলতে একটু বেশিই পছন্দ করেন। স্পেনের সাথে ৩ বার ফাইনালের মঞ্চে গিয়েছেন এবং জিতে এনেছেন শিরোপা। বার্সেলোনার হয়েও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল খেলেছেন ৩টি। তিনটি ফাইনালই জিতেছিলো কাতালানরা।
২০০৯, ২০১১ ও ২০১৫ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ইনিয়েস্তা খেলেও কখনো গোল করেননি। কিন্ত প্রত্যেকবারই গোল করতে সহযোগিতা করেছেন, যা তৈরি করে দিয়েছে ম্যাচের ভাগ্য। ২০১৫ সালে জাভি হার্নান্দেজ বার্সেলোনা থেকে অবসর নেবার প্রক্রিয়া শুরু হলে ইনিয়েস্তাই নিয়মিত ক্যাপ্টেন হিসেবে মাঠে নামতে শুরু করেন। যতবার দলনেতা হয়ে মাঠে নেমেছেন, ততবার দর্শকেরা হতাশ হয়নি। ক্যাপ্টেন হিসেবে নেমে ২০১৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ম্যাচ শুরু হবার মাত্র ৪ মিনিটের মাথায় রাকিটিচকে দিয়ে করিয়েছিলেন প্রথম গোল।
নেইমারের দেওয়া পাওয়া পাস থেকে বল তৈরি করে রাকিটিচকে দেবার প্রক্রিয়া কোনোভাবেই থামাতে পারেনি জুভেন্টাস রক্ষণ। পুরো ৯০ মিনিট চোখ ধাধাঁনো পাস, গোলের সুযোগ তৈরি ও সলো রানে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিলেন জুভেন্টাসকে। ফাইনাল ম্যাচে দুর্দান্ত পারফর্মেন্সের ফলে তিনি সেবার হয়েছিলেন ম্যান অফ দ্য ম্যাচ। ইনিয়েস্তাই ফুটবল ইতিহাসে একমাত্র খেলোয়াড় যিনি ইউরো, বিশ্বকাপ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল ম্যাচে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বার্সেলোনার হয়ে শেষ ঘরোয়া লিগ
চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৭-১৮ মৌসুম ছিলো বার্সেলোনার হয়ে ইনিয়েস্তার শেষ স্প্যানিশ লিগ। নিজের শেষ লিগও তিনি রাঙিয়ে রাখলেন দারুনভাবে। স্প্যানিশ লা লিগাতে এবার বার্সেলোনার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিলো। পুরো মৌসুমে বার্সেলোনা ছিলো টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত। ৩৪ বছর বয়সেও আর্নেস্তো ভালভার্দের ভরসা ছিলো ইনিয়েস্তার উপরে। যে কারণে অধিকাংশ ম্যাচেই শুরু থেকে মাঠে ছিলেন তিনি। যদিও বয়সের কারণে এবং ডেনিস সুয়ারেজ, পাওলিনহো ও কৌতিনহোকে সুযোগ করে দিতে প্রায় ম্যাচে ৬০ মিনিট পর বার্সেলোনা কোচ তুলে নিতেন ইনিয়েস্তাকে। এ মৌসুমে বিদায় না দিলে আসন্ন মৌসুমেও হয়ত বার্সেলোনা বিশ্বাস রাখতো ইনিয়েস্তার উপর।
বার্সেলোনার হয়ে শেষ ফাইনাল
এ মৌসুমের কোপা দের রে-তে সেভিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি ছিলো বার্সেলোনার হয়ে ইনিয়েস্তার শেষ ফাইনাল। এ ম্যাচের আগে তার সম্পর্কে হাজারো উড়ো খবর ভেসে বেড়ালেও বার্সেলোনা ছাড়ার পক্ষে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য তিনি তখনো দেননি। ওয়ান্দা মেট্রোপলিটনে সেই ম্যাচে বার্সেলোনা জিতেছিলো ৫-০ গোলে। ইনিয়েস্তা করেছিলেন ৪র্থ গোলটি। জয় নিশ্চিত চতুর্থ গোলের পর ইনিয়েস্তার উদযাপন, সাবস্টিটিউট হয়ে ম্যাচ ত্যাগের সময় তার মুখের অভিব্যক্তি ও ডাগআউটে অশ্রুজল চোখে বসে থাকা দেখে অনেকেই বিশ্বাস করে নিয়েছিলো বার্সেলোনায় আর তিনি থাকছেন না। কয়েকদিন পর আসলো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য, বার্সেলোনার হয়ে ৩২টি শিরোপা জেতা আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা পাড়ি জমাচ্ছেন নতুন এক অচেনা গন্তব্যে।
বার্সেলোনা ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ
নিজের শেষ ম্যাচটি খেলতে যখন ইনিয়েস্তা মাঠে নামছেন, তার অনেক আগেই বার্সেলোনার সমর্থকে ভর্তি পুরো গ্যালারি। শেষবারের মতো সবাই উপভোগ করতে চায় তাদের সবথেকে বিশ্বস্ত সৈনিককে। শেষ ম্যাচ খেলার আবেগে আক্রান্ত না হয়ে, পুরো ম্যাচে একজন পুরোদস্তুর পেশাদার ফুটবলার হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করলেন ইনিয়েস্তা।
কোনো গোল করেননি, করেননি কোনো অ্যাসিস্টও। কিন্ত শেষ ম্যাচেও সেই পুরনো ইনিয়েস্তার দেখা আবারো মিলল। হয়তো সবার মনে কথা বুঝতে পেরেই কোচ ৮০ মিনিট পর্যন্ত মাঠে রাখলেন ইনিয়েস্তাকে। দ্বিতীয়ার্ধে মেসিকে নামিয়ে শেষবারের মতো মেসি ও ইনিয়েস্তার রসায়নকে দেখার সুযোগটাও করে দিলেন। ৮০ মিনিটে আসলো সমাপ্তির সময়। আর্মব্যান্ড খুলে মেসির হাতে পরিয়ে দিয়ে যখন শেষ বিদায় নিলেন, ৮০ মিনিট ধরে পুষে রাখা বেদনা যেন তার হৃদয়ে আঘাত করেছে তখন। সবই ঠিকমতো ঘটলো, ইনিয়েস্তাও চেয়েছিলেন এমন একটি সম্মানজনক বিদায়। কিন্ত আক্ষেপ একটি সবার মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে। ইনিয়েস্তা কি আরেকটি মৌসুম থেকে যেতে পারতেন না?
রিয়াল সোসিয়াদাদের বিপক্ষে ম্যাচে কয়েক ঘন্টা আগে ইনিয়েস্তা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমার শেষ ম্যাচ আমার সমর্থকদের সামনে, অনেক আবেগ স্পর্শ করলেও গর্ববোধ হচ্ছে এমন একটা সময়ের জন্য। সবসময় বার্সেলোনা।” বার্সেলোনার সাথে ইনিয়েস্তার আজীবন চুক্তি করা আছে। তার জন্য বার্সেলোনার দরজা সবসময় খোলা। তাই বিষণ্ন একটি বিদায়ের মুহূর্ত পার করেও ইনিয়েস্তা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে গেলেন, চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়।