কেনিয়ার ক্রিকেট বোর্ড বিলুপ্তই হয়ে গেল। একসময় পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানো ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সে তুলনায় কেনিয়া কখনোই বিশ্ব ক্রিকেটের পরাশক্তি ছিল না। তাই তাদের এই বিলোপে কান্না করার কিছু নেই। কিন্তু একটা শোক এই খবরে কোথাও না কোথাও লুকানো থাকে। পৃথিবীর সম্ভাবনাময় এক ক্রিকেট দলের পতন হতে হতে শূন্যতে এসে ঠেকতে দেখার শোক।
বাংলাদেশের আইসিসি ট্রফি জয়ের অধিনায়ক আকরাম খান এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, একটা কেনিয়া দল ছিল বলেই বাংলাদেশ দল আজকের বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পেরেছে। এটা খুব সত্যি কথা, কেনিয়া ছিল একসময় বাংলাদেশের সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বী দল। কখনো কখনো বাংলাদেশের চেয়েও ভালো দল বলে মনে হয়েছে এই কেনিয়াকে। সেই কেনিয়ার ক্রিকেট বোর্ড আজ বিলুপ্ত হয়ে গেল আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে কোনোরকম ছাপ রাখতে না পেরে।
অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ছিল। তবে সেই সাথে বড় ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছিল পারফরম্যান্স। একসময়ের কেনিয়ার সঙ্গী বাংলাদেশ যখন ওয়ানডে, টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে একটু একটু করে বড় দল হয়ে উঠছে, কেনিয়ার ভাগ্য দাড়িয়েছিল তখন আইসিসির ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগের দ্বিতীয় বিভাগে। সেখানেও টিকতে পারলো না দলটি। সর্বশেষ টুর্নামেন্টের ফলাফলে রেলিগেটেড হয়ে কেনিয়া নেমে গেছে ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগের তৃতীয় বিভাগে। আর এরপরই দেশটির ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে দেশের ক্রিকেট বোর্ড বিলুপ্ত করে দেবে।
এখন অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই কেনিয়ার ক্রিকেটারদের। অথচ আফ্রিকার এই দেশটির বলার মতো একটা অতীতই ছিল ক্রিকেটে।
আর দশটা আফ্রিকান দেশের মতো কেনিয়াতেও ক্রিকেট নিয়ে গিয়েছিল উপনিবেশ স্থাপনকারীরা। যতদূর যানা যায়, ১৮৯৯ সালে মোম্বাসায় এই সেটেলাররা প্রথম একটা ম্যাচ খেলেছিল। এরপর ১৯১০ সালে ‘অফিশিয়াল বনাম সেটেলার’ একটা তিন দিনের ম্যাচ শুরু হয়; এই ম্যাচ ১৯৬১ সাল অবধি নিয়মিত আয়োজন হতো। ১৯৫১ সালে কেনিয়ার একটি জাতীয় দল গঠিত হয় এবং তারা তানগানিকার (পরে তানজানিয়ায় একীভূত দেশ) বিপক্ষে একটি আর্ন্তজাতিক ম্যাচ খেলে। ১৯৫৩ সালে কেনিয়ান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়। এটা ছিল কেনিয়ার প্রথম সব বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত কোনো সংগঠন।
এ সময়ে কেনিয়াতে দক্ষিণ আফ্রিকা, এমসিসিসহ বিভিন্ন দল সফর করে। এককভাবে কেনিয়াই হয়তো আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট শুরু করতে পারতো। কিন্তু তারা ১৯৬৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো একটি দল গঠন করে। ইস্ট আফ্রিকা নামে এই দলে আরো ছিল তানজানিয়া ও উগান্ডা। এই দলটি আইসিসির সদস্যপদও লাভ করে। মূলত কেনিয়ার ক্রিকেটাররাই ছিলো এই দলের সিংহভাগ সদস্য।
এই ইস্ট আফ্রিকা দল ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপে অংশ নেয়। এখানে ১৪ জন খেলোয়াড়ের ৭ জনই ছিল কেনিয়ার ক্রিকেটার। এরপর ইস্ট আফ্রিকা ১৯৭৯ সালের আইসিসি ট্রফিতে অংশ নেয়। কিন্তু ফলাফল ভালো করতে পারেনি। যার ফলে ১৯৭৯ বিশ্বকাপে খেলা হয়নি তাদের। এ সময়ে কেনিয়ায় একটি ভিন্নমত তৈরী হতে থাকে। কেনিয়ার সংগঠকরা মনে করতে থাকে যে, আলাদা দল হিসেবে তারা ক্রিকেট খেললে ইস্ট আফ্রিকার চেয়ে ভালো ফলাফল করা সম্ভব। এই মতামতের জয় হিসেবে ১৯৮১ সালে তারা ইস্ট আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসে এবং আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ লাভ করে। যদিও এই ঘটনার কিছু রাজনৈতিক ইতিহাসও ছিল।
১৯৮২, ১৯৮৬ ও ১৯৯০ সালের আইসিসি ট্রফিতে কেনিয়া নিজের নামেই অংশ নেয়। তবে কোনোবারই বিশ্বকাপে পৌছাতে পারেনি। অবশেষে ১৯৯৪ সালে সেই বাঁধা টপকে গেল কেনিয়া। বাংলাদেশের জন্য মহা শোকের সেই আইসিসি ট্রফির আসর বসেছিল কেনিয়ার নাইরোবিতেই। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে ফাইনালে হেরে গেলেও টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেরা দল হিসেবে গেল তারা ১৯৯৬ বিশ্বকাপে।
বিশ্বকাপের আগে দারুণ প্রস্তুতি নিয়েছিল কেনিয়া। ভারতীয় ‘এ’ দলের বিপক্ষে এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকটি প্রাদেশিক দলের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে উপমহাদেশের বিশ্বকাপে খেলতে আসে এ দেশটি। আর এখানে এসে প্রথম অভিযানেই চমক দেখায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৭৩ রানে হারিয়ে শোরগোল ফেলে দেয় কেনিয়া।
স্টিভ টিকোলো, মরিস ওদুম্বে, আসিফ করিমদের কেনিয়া এরপর ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেয়ে যায় এবং বিশ্ব ক্রিকেটে এক নিয়মিত দলে পরিণত হয়। বেশ কিছু হাই প্রোফাইল টুর্নামেন্টে অংশ নেয় দলটি। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির ফাইনালে হেরে গেলেও ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয় তারা। এর মাঝে ১৯৯৮ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে ভারতকে ৬৯ রানে হারিয়ে শোরগোল ফেলে দেয় আবার। এই টুর্নামেন্টেই কেনিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশ নিজেদের প্রথম ওয়ানডে জয়ের স্বাদ পেয়েছিল।
এরপর ২০০১ সালে কেনিয়া আবার একটি ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে ভারতকে হারায়। তখন কেনিয়া ধীরে ধীরে আধুনিক ক্রিকেটে এক উঠতি পরাশক্তি বলে বিবেচিত হচ্ছিল। আর এর চূড়ান্ত প্রমাণ মেলে ২০০৩ বিশ্বকাপে এসে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপে কেনিয়ার সাফল্য আকাশ স্পর্শ করে ফেলে; তারা খেলে ফেলে সেমিফাইনাল!
প্রথম রাউন্ডে কেনিয়া কানাডার বিপক্ষে জয় পায়। এরপর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়াক ওভার পায়। কারণ নিউজিল্যান্ড নাইরোবিতে ম্যাচ খেলতে যেতে রাজী ছিল না। এরপর শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের বিপক্ষে বড় দুই জয় দিয়ে জায়গা নিশ্চিত করে ফেলে দ্বিতীয় রাউন্ডে। সেখানে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক জয়ই তাদের তুলে দেয় সেমিফাইনালে। নিউজিল্যান্ড ও জিম্বাবুয়েকে টপকে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালিস্ট হয়ে যায় কেনিয়া।
২০০৩ সাল অবধি কেনিয়ার স্বর্ণযুগ ছিল বললে কম বলা হবে না। এই সময় অবধি যদি শুধু বাংলাদেশের বিপক্ষে তাদের পারফরম্যান্স দেখেন, তাহলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল অবধি বাংলাদেশের বিপক্ষে ৭টি ম্যাচ খেলে ৬টিতেই জিতেছিল কেনিয়া। এর মধ্যে তারা বড় দল হিসেবে ভারতকে দুইবার; শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়েকে একবার করে ম্যাচ হারায়।
এর পর থেকেই শুরু হয় কেনিয়ার পতন। সে সময় কেনিয়ার বিপক্ষে কয়েকটি ব্যাপার কাজ করেছিল। কেনিয়ার কয়েকজন সিনিয়র খেলোয়াড় অবসরে চলে গেলেন। সেই সাথে অন্যতম সেরা পারফরমার মরিস ওদুম্বে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অপরাধে নিষিদ্ধ হলেন। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, টাকা পয়সার টানাপোড়েনে থাকা কেনিয়ার ক্রিকেটাররা একের পর এক ধর্মঘট শুরু করলেন। যার ফলে কেনিয়ার পারফরম্যান্সে অধোগতি পরিষ্কার টের পাওয়া গেল। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল অবধি তারা আর কোনো ম্যাচই জিততে পারেনি। এখানে আইসিসিরও কিছু নীতিগত সমস্যা ছিল। ওয়ানডে স্ট্যাটাস থেকে আর উত্তরণ না ঘটায় আইসিসির থেকে তারা বাজেটও কম পাচ্ছিল। আইসিসির নতুন নীতির ফলে সহযোগী দেশগুলোর জন্য বরাদ্দও কমে যায়। তার প্রভাবও পড়ে দেশটির ক্রিকেটে।
অন্যদিকে মাঠের পারফরম্যান্স খারাপ হওয়ায় কেনিয়ার ক্রিকেট হারাতে থাকে সব স্পন্সর। ২০০৫ সালে এসে এই অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য একটি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। কেনিয়ার ক্রিকেট নাম বদলে ফেলে। নানারকম পদক্ষেপ নেওয়া হতে থাকে। তার ফলে সাময়িক কিছু সাফল্য এলেও দীর্ঘস্থায়ীভাবে কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি।
২০১১ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেলেও এরপর ধীরে ধীরে আরো তলানির দিকে যেতে থাকে কেনিয়ার ক্রিকেট। ২০১৪ সালে এসে কেনিয়ার ক্রিকেটের প্রতীক হয়ে থাকা স্টিভ টিকোলো, টমাস ওদোয়ো, কলিন্স ওবুইয়া অবসর নেন। কয়েক হাজার করে রানের এই মালিকরা চলে যাওয়ার ধাক্কা আর সামলাতে পারেনি। শেষ অবধি তাদের পরিণতি এখন সেই বিলুপ্তি।
Featured Image: Zee News