আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন অনেক ক্রিকেটার আছেন, যারা অসাধারণ পারফরমেন্স দিয়ে তাদের অভিষেক ম্যাচ স্মরণীয় করে রেখেছেন। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক আশা জাগিয়েও নিজেদের ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করতে পারেননি। আবার অনেকেই নিজেদের প্রতিভার সদ্ব্যবহার করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার পেসার অ্যালান ডোনাল্ড তার অভিষেক ওডিআইতে মাত্র ৮.৪ ওভার বল করে পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন। এখানেই থেমে থাকেননি ডোনাল্ড। ‘সাদা বিদ্যুৎ’ নামে পরিচিত অ্যালান ডোনাল্ড তার পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই ব্যাটসম্যানদের কোণঠাসা করে উইকেট শিকার করে নিয়েছিলেন। অভিষেক ওডিআইতে শতক হাঁকানো ডেসমন্ড হেইন্স, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, মার্টিন গাপটিলরা এক ম্যাচে বাজিমাত করে থেমে থাকেননি। তাদের মতো বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার আছেন যারা ‘উঠন্তি মুলো, পত্তনেই চেনা যায়’ প্রবাদটি সত্য প্রমাণিত করেছেন। ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’ এই প্রবাদটিও বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার প্রমাণ করেছেন। অভিষেক ম্যাচে দুর্দান্ত পারফরমেন্স দেবার পরেও নিজেদের ক্যারিয়ার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এরকম পাঁচজন ক্রিকেটারকে নিয়েই আজকের লেখা।
১. নরেন্দ্র হিরওয়ানি (ভারত)
বিশ্বসেরা লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নের তখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভাব ঘটেনি। সেইসময়ে হারাতে বসা লেগ স্পিন শিল্পকে পুনর্জীবিত করেন নরেন্দ্র হিরওয়ানি। মাত্র ২০ বছর বয়সে তৎকালীন অপরাজেয় দল।ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে হিরওয়ানির। ১৯৮৮ সালের ১১ই জানুয়ারি চেন্নাইয়ে সিরিজের চতুর্থ টেস্টে মুখোমুখি হয় ভারত এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জয়লাভ করে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় টেস্টে ভারত ড্র করতে সক্ষম হয়। সিরিজ বাঁচানোর লড়াইয়ে চতুর্থ টেস্টে মাঠে নামে ভারত। ডেসমন্ড হেইন্স, রিচার্ডসন, এবং ভিভ রিচার্ডসদের নিজের লেগস্পিন, গুগলি এবং ফ্লাইটেড ডেলিভারিতে নাস্তানাবুদ করেন নরেন্দ্র হিরওয়ানি।
হিরওয়ানি প্রথম ইনিংসে ৬১ রানে আট উইকেট এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৫ রানে আট উইকেট শিকার করেন। ম্যাচে ১৩৬ রানে ১৬ উইকেট শিকার করেন তিনি। অভিষেক টেস্টে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারের রেকর্ড এখন পর্যন্ত তার দখলে। প্রথম ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানরা হিরওয়ানির লেগ স্পিনে পরাস্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ডাউন দ্য উইকেটে এসে আক্রমণাত্মকভাবে খেলার চেষ্টা করেন। এই পরিকল্পনাতেও ব্যর্থ হয় তারা। যার ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পাঁচজন ব্যাটসম্যান স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে পড়েন। অভিষেক টেস্টে ১৬ উইকেট শিকারের পর, পরবর্তী তিন টেস্টে শিকার করেন ২০ উইকেট। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম বছরে মাত্র চার টেস্টে ৩৬ উইকেট শিকার করেন তিনি। চারটি টেস্টই ছিলো ঘরের মাটিতে। ঘরের মাটিতে নিজের পছন্দমতো স্পিন সহায়ক উইকেট পেয়ে নরেন্দ্র হিরওয়ানি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউ জিল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের মাটিতে খেলতে গিয়ে নিজের ছন্দ হারিয়ে ফেলেন তিনি। বিদেশের মাটিতে নয় টেস্টে মাত্র ২১ উইকেট শিকার করেন তিনি। বিদেশের মাটিতে ব্যর্থতার পর প্রায় পাঁচ বছর দলের বাইরে ছিলেন হিরওয়ানি। ১৯৯৫ সালে আবারও জাতীয় দলে সুযোগ পেলেও কাজে লাগাতে পারেননি তিনি। ভারতীয় ক্রিকেট দলে অনিল কুম্বলের আবির্ভাব ঘটলে নরেন্দ্র হিরওয়ানির ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে। তিনি ১৭ টেস্টে ৬৬ উইকেট শিকার করেছিলেন।
২. বব ম্যাসি (অস্ট্রেলিয়া)
১৯৭২ সালের ২২শে জুন আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে বব ম্যাসির। তার অভিষেকের আগে টানা এগারো ম্যাচে জয় শূন্য ছিলো অস্ট্রেলিয়া। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ জয় পেয়েছিল ১৯৬৮ সালে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল অজিদের। এমতাবস্থায় হঠাৎ করেই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে দলে ডাক পান ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বব ম্যাসি। বব ম্যাসি সম্পর্কে ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের কোনও ধারণাই ছিলো না। তার নামটাও হয়তো ম্যাচ শুরু হওয়ার পর জেনেছে ইংলিশরা। লর্ডসে গতির পাশাপাশি সুইং করিয়ে ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করতে থাকেন। ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ৮৪ রানে আট উইকেট এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৩ রানে আট উইকেট শিকার করে এগারো ম্যাচের অপেক্ষার পর অস্ট্রেলিয়াকে জয় এনে দেন তিনি।
লর্ডসে নিজের অভিষেক টেস্টে ১৩৭ রানে ১৬ উইকেট শিকার করে বিশ্বরেকর্ড গড়েন তিনি। ১৫ বছর পর নিজের অভিষেক টেস্টে তারচেয়ে এক রান কম খরচ করে ১৬ উইকেট শিকার করে তার রেকর্ড ভাঙেন নরেন্দ্র হিরওয়ানি। তবে এখন পর্যন্ত এক ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড বব ম্যাসির দখলে। নরেন্দ্র হিরওয়ানির মতো বব ম্যাসির ক্যারিয়ারও দীর্ঘাদিন টেকেনি। মাত্র ছয় মাসেই তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়। অভিষেক টেস্টে দুর্দান্ত পারফরমেন্স দেবার পর পাঁচটি টেস্ট খেলেন তিনি। ঐ পাঁচ ম্যাচে তিনি ১৫ উইকেট শিকার করেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের শেষ ম্যাচ খেলার পর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটেও তাকে বেশিদিন দেখা যায়নি। পরবর্তীতে রেডিওতে ধারাভাষ্যকার হিসাবে কাজ করেন তিনি।
৩. জ্যাসন ক্রেজা (অস্ট্রেলিয়া)
শেন ওয়ার্নের অবসরের পর একজন স্পেশালিষ্ট স্পিনারের খোঁজে ছিলো অস্ট্রেলিয়া। নিউ সাউথ ওয়েলসের অফস্পিনার ২০০৮ সালে সেই অভাব দূর করতে অস্ট্রেলিয়া দলে ডাক পান। ভারতের মাটিতে চার ম্যাচের টেস্ট সিরিজের স্কোয়াডে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু প্রস্তুতি ম্যাচে ৩১ ওভার বল করে ১৯৯ রান করার দরুন প্রথম তিন টেস্টে একাদশে জায়গা পাননি তিনি। ৬ই নভেম্বর ২০০৮ সালে নাগপুরে সিরিজের চতুর্থ টেস্টে আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে জ্যাসন ক্রেজার। ক্রেজা শচীন, সৌরভ, লক্ষণ, গাঙ্গুলী, ধোনি এবং শেহওয়াগদের মতো ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে নিজের অভিষেক টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন। বিশ্ব ক্রিকেটে ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা সবচেয়ে বেশি দক্ষতার সাথে স্পিন বল খেলে। তাদের বিপক্ষে শক্ত মনোবলের সাথে বোলিং করেছিলেন তিনি।
ব্যাটসম্যানদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন শট খেলার জন্য। এতে করে ব্যাটসম্যানরা যেমন রান করেছিলো, তেমনি ভুল শট খেলে নিজেদের উইকেট দিয়ে আসছিলো। জ্যাসন ক্রেজা প্রথম ইনিংসে ২১৫ রান খরচায় আট উইকেট এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ১৪৩ রানের বিনিময়ে চার উইকেট শিকার করেন। বব ম্যাসির পর অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অভিষেক টেস্টে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারের রেকর্ড ক্রেজার দখলে। জ্যাসন ক্রেজা ম্যাচে ৩৫৮ রানের বিনিময়ে ১২ উইকেট শিকার করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতেন। এই ম্যাচের পর মাত্র একটি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন ক্রেজা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুই ইনিংসে ২০৪ রানের বিনিময়ে এক উইকেট শিকার করেছিলেন। ব্যাট হাতে দুই ইনিংসে ৩০ এবং ৩২ রানের ইনিংসে খেলেছিলেন তিনি। এরপর ২০১১ সালে এশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে পুনরায় দলে ডাক পেলেও দলে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করতে পারেননি জ্যাসন ক্রেজা।
৪. ফাওয়াদ আলম (পাকিস্তান)
পাকিস্তানের বাঁহাতি স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান ফাওয়াদ আলমের টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ২০০৮ সালের ১২ই জুলাই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলোম্বো টেস্টের মধ্য দিয়ে। কলোম্বো টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে মাত্র ৯০ রান করেই গুটিয়ে যায় পাকিস্তান। ফাওয়াদ আলম করেন ১৬ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে ফাওয়াদ আলমের ব্যাটে চড়ে ম্যাচে ভালোভাবেই ফিরে পাকিস্তান। একপর্যায়ে পাকিস্তানের রান সংখ্যা ছিলো এক উইকেটে ২৮৫ রান। সেখান থেকে মাত্র ৩২০ রানে সবকটি উইকেট হারায় তারা। ফাওয়াদ আলম নিজের অভিষেক টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ২৫৯ বলে ১৫টি চার এবং একটি ছয়ের সাহায্য ১৬৮ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেন। পাকিস্তানের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে দেশের বাইরে অভিষেক টেস্টে শতক হাঁকান তিনি। পাকিস্তান সাত উইকেটে পরাজিত হলেও ফাওয়াদ আলম তার শতকের জন্য নুয়ান কুলাসেকারার সাথে যৌথভাবে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতেন।
অভিষেক টেস্টে অসাধারণ পারফরমেন্স দেবার পর মাত্র দু’টি টেস্ট খেলার পরেই দল থেকে বাদ পড়ে যান ফাওয়াদ আলম। ঠিক কোন কারণে তাকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিলো সেটার সঠিক ব্যাখ্যা কেউই দিতে পারেনি। টেস্ট দলে না থাকলেও ওডিআইতে আসা-যাওয়ার মধ্যে আছেন। ২০১৫ সালে নিজের শেষ ওডিআই খেলা ফাওয়াদ এই ফরম্যাটে ৪০.২৫ ব্যাটিং গড়ে ৯৬৬ রান করেছেন।
৫. খালিদ ইবাদুল্লাহ (পাকিস্তান)
পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান খালিদ ‘বিল্লি’ ইবাদুল্লাহ ইংলিশ কাউন্টিতে ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে নিয়মিত খেলতেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো পারফরমেন্সের সুবাদে করাচিতে ১৯৬৪ সালের ২৪ই অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ইবাদুল্লাহর। আরেক অভিষিক্ত ব্যাটসম্যান আব্দুল কাদিরের সাথে ইনিংসের গোড়াপত্তন করতে নেমে ২৪৯ রানের জুটি গড়েন। দুই অভিষিক্ত ব্যাটসম্যানদের মধ্যে উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে সর্বোচ্চ রানের বিশ্বরেকর্ড এটি।
আব্দুল কাদির ৯৫ রান করে রান আউট হয়ে গেলেও খালিদ ইবাদুল্লাহ পাকিস্তানের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে অভিষেক টেস্টে শতক হাঁকিয়ে ১৬৬ রান করে সাজঘরে ফেরেন। এই ম্যাচের পর আর মাত্র তিনটি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন ইবাদুল্লাহ। ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেন তিনি। ঐ সিরিজে দুই টেস্টে মাত্র ৪৭ রান করার পর আর জাতীয় দলে ডাক পাননি ইবাদুল্লাহ। ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এরপর নিউ জিল্যান্ডের কোচ হিসাবেও খালিদ ইবাদুল্লাহকে দেখা যায়।
অভিষেক টেস্টে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করা দুই বোলার নরেন্দ্র হিরওয়ানি, বব ম্যাসি। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অভিষেক টেস্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি জ্যাসন ক্রেজা এবং পাকিস্তানের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে অভিষেক টেস্টে শতক হাঁকানো খালিদ ইবাদুল্লাহ এবং অভিষেক টেস্টে বিদেশের মাটিতে প্রথম পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান হিসাবে শতক হাঁকানো ফাওয়াদ আলম কেউই নিজেদের সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করতে পারেননি।