বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে অনিয়ম, ক্ষমতার ব্যবহার, প্রভাব খাটানো, ম্যাচ পাতানো নতুন ঘটনা নয়। বিভিন্ন সময়েই ক্রিকেট বোর্ডের প্রভাবশালীরা নিজেদের ক্লাবের জন্য অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন। তবে অতীতে এসব ঘটনা একটা টুর্নামেন্টের হয়তো কয়েকটি ম্যাচে ঘটতো। কিন্তু নাজমুল হাসান পাপনের নেতৃত্বাধীন বর্তমান বোর্ড বিসিবির পরিচালনায় আসার পর ঘরোয়া ক্রিকেটের লিগগুলোতে অনিয়মই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে!
নির্বাচনে জিততে চাই পক্ষে ভোট, ভোট দেন কাউন্সিলররা। আর নিজেদের পক্ষে কাউন্সিলরশিপ পেতে বেশি বেশি ক্লাব নিজেদের করায়ত্তে আনার মিশনে নামেন বিসিবির প্রভাবশালী পরিচালকরা। নিজের ক্লাবকে পয়েন্ট টেবিলে সবার উপরে আনতে অফিসিয়ালদের ব্যবহারের পদ্ধতিতে চলে যান তারা। তারপরই থেকেই দূষিত হতে থাকে ঘরোয়া ক্রিকেটের লিগগুলো। ক্লাব পাড়ায়, ক্রিকেটাঙ্গনে জনশ্রুতি আছে, বিসিবি পরিচালক ইসমাইল হায়দার মল্লিকের হাত ধরেই নাকি এসব অনৈতিক কান্ডের শুরু।
এখন তার নাম ব্যবহার করেও অনেক কর্মকর্তা অবৈধ উপায়ের সুযোগ নিচ্ছেন। সঠিক স্পিরিটে ক্রিকেট চর্চার ধারক ক্লাবগুলো গত কয়েক বছরে স্পষ্ট বার্তা পেয়েছে যে, লিগে ফেয়ার ক্রিকেট খেলার সুযোগ নেই। সামগ্রিক পরিবেশ যখন নষ্ট, তখন ভালো কিছু টিকে থাকাও কঠিন। এখন অনিয়ম যেন লিগের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে ফেলেছে, বিশেষ করে সিসিডিএমের অধীন প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিভাগ লিগগুলোতে। এখন অনেক ক্লাব নিজেদের প্রয়োজনেই অপর ক্লাবের সঙ্গে সমঝোতা করছে, পাতানো ম্যাচ খেলছে। সেটি ওপেন সিক্রেট।
সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে সেসব চিত্র। ম্যাচ পক্ষে আনতে অফিসিয়াল তথা আম্পায়ারদের ব্যবহারের প্রক্রিয়াটা মহামারি আকার ধারণ করেছে। ২০১৮-১৯ মৌসুমে নাকি আম্পায়ারও কেনা যাচ্ছিলো ৫-১০ হাজার টাকায়! গত দুই বছর ধরে নিচের স্তরের লিগগুলোতে আম্পায়ারদের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও শিরোনাম হয়েছিলো। তারপরও টনক নড়েনি বিসিবি’র, কারণ সর্ষের মাঝেই ছিল ভূত। এসব অনৈতিক কর্মকান্ডের নাটের গুরু যে বিসিবির কর্তারাই!
ঘরোয়া ক্রিকেটে সার্বিকভাবে এমন অসুস্থ পরিবেশের সূদুরপ্রসারী প্রভাবটা গত ২২ ডিসেম্বর রাতে টের পেয়েছে গোটা বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মঞ্চে উন্মোচিত হয়েছে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের নগ্ন, জঘন্য, ঘুণে ধরা রূপটা।
শেষ কয়েক মৌসুমে নির্দিষ্ট ক্লাবকে সুবিধা পাইয়ে দেয়ার অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক ম্যাচ করতে হয়েছে আম্পায়ারদের। তখন ভুল, অনৈতিক সিদ্ধান্ত ক্রমাগত দেন তারা। বলা চলে, হয়তো অজান্তেই একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে আম্পায়ারদের। যার একটা মহড়া বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ তৃতীয় ও শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও দেখা গেল।
বাংলাদেশের আম্পায়ার তানভীর আহমেদ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলার ওশান থমাসকে দুই বার ‘নো বল’ ডাকলেন। অথচ কোনোবারই নো বল ছিল না, পা দাগের ভেতরই ছিল। বিতর্কিত আম্পায়ারিংয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি শিকেয় তুললেন তানভীর আহমেদ। একবার ভুল হলে সেটি গ্রহণযোগ্য হয়, কিন্তু একই ওভারে দুইবার একই ধরনের ভুল অমার্জনীয়। তখন আম্পায়ারের সহজাত শিক্ষার অংশ হিসেবেই সেটি ধরা হয়। ঘরোয়া ক্রিকেটে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট পালনে ‘সিদ্ধহস্ত’ তানভীর সেদিন এমন কিছুই করে ফেলেছিলেন আন্তর্জাতিক মঞ্চেও।
এমনকি কার্লোস ব্র্যাথওয়েটের প্রতিবাদের পর ঘাবড়ে গিয়ে নো বলের সিদ্ধান্তও থার্ড আম্পায়ারের কাছে পাঠাতে চেয়েছিলেন তানভীর। একজন অন-ফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে তার এটুকু জানা ছিল না যে, নো বলের সিদ্ধান্ত থার্ড আম্পায়ারের কাছে পাঠানো যায় না। আউট হলে নো বল চেক করা যায়। এখানেই স্পষ্ট, কতটা অযোগ্যতাসহ বিসিবির কর্তাদের মদদে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা পড়েছিলো তানভীরের।
যে কেলেঙ্কারি হয়েছিলো সেদিন
বাংলাদেশের ইনিংসের চতুর্থ ওভারের ঘটনা। ওশান থমাসের করা ওভারটির পঞ্চম বলটিতে নো ডাকেন আম্পায়ার তানভীর। টিভি রিপ্লেতে স্পষ্ট দেখা যায়, থমাসের সামনের পা দাগের যথেষ্টই পেছনে ছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ব্রেথওয়েট গিয়ে প্রতিবাদও জানান কিছুটা। সেই নো বল থেকে পাওয়া ফ্রি হিটে পরের বলে ছক্কা মারেন লিটন। পরের বলটি থমাস করেন ওয়াইড। শেষ বলে উড়িয়ে মারতে গিয়ে মিড অফে ক্যাচ দেন লিটন। কিন্তু ততক্ষণে আবারও নো বল ডেকে বসেন আম্পায়ার। এবারও টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, আম্পায়ার তানভীরের সিদ্ধান্ত ছিল মস্ত বড় ভুল!
এ যাত্রা ক্যারিবিয়ানদের প্রতিবাদ ছিল সুতীব্র। ব্রেথওয়েট উত্তেজিত হয়ে কথা বলেছেন আম্পায়ারদের সাথে। উইকেটের পাশে গোটা দল জড়ো হয়ে গিয়েছিলো, সেখানে উত্তেজিত ছিলেন বেশিরভাগ ক্রিকেটার। এমনকি রিভিউও চেয়েছিলেন তারা।
তারপর দৃশ্যপটে আসেন রিজার্ভ আম্পায়ার শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ। সীমানার বাইরে কথা বলেন ব্র্যাথওয়েটের সঙ্গে। নেমে আসেন ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রো। কথা চলতে থাকে। মাঠের দুই আম্পায়ার তানভীর আহমেদ ও মাসুদুর রহমানের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেন রিজার্ভ আম্পায়ার। ড্রেসিংরুম থেকে বের হয়ে আসেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও।
এক পর্যায়ে আবার সতীর্থদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলেন ব্র্যাথওয়েট। ফিল্ডাররা যার যার পজিশনে ফিরে যায়, শুরু হয় খেলা। এ সময় অফিসিয়াল হিসেবেই খেলা বন্ধ ছিল ৮ মিনিট, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যা বিরল দৃশ্য।
বাংলাদেশি আম্পায়ারদের ভুলের আরও নজির
সিরিজের দ্বিতীয় টি-২০ ম্যাচেও বাংলাদেশের আরেক আম্পায়ার গাজী সোহেল প্রশ্নবিদ্ধ সব সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। ওই ম্যাচে ২১ রানে থাকা অবস্থায় সাকিবের ব্যাটে লেগে বল গিয়েছিলো উইকেটরক্ষকের হাতে। শাই হোপও বুঝতে পারেননি, বোঝেননি গাজী সোহেলও। অথচ টিভি রিপ্লেতে স্নিকোমিটারে দেখা গেছে বল ব্যাটে লেগেছিলো।
বল ইনসাইড এজ হওয়ার পরও শিমরন হেটমায়ারের বিরুদ্ধে মিরাজের লেগ বিফোর উইকেটের আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন গাজী সোহেল, পরে রিভিউ নিয়ে বেঁচে গেছেন হেটমায়ার। তার আগে প্রথম ওভারেই আবু হায়দারের বলে ইনসাইড এজ থাকার পরও এভিন লুইসকে লেগ বিফোর উইকেটের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন তিনি, সেটিও রিভিউতে পরিবর্তন হয়ে যায়। ওই সিদ্ধান্তের পর যারপরনাই বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন লুইস।
এছাড়া সিলেটে ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচে ফিল্ডিংয়ের একটা সময় বাংলাদেশ দল অনসাইডে ছয়জন ফিল্ডার রেখেছিলো। আবার ওই বলেই আউট হয়েছিলেন রভম্যান পাওয়েল। সেদিন একাদশে না থাকলেও অতিরিক্ত ফিল্ডার হিসেবে মাঠে এসে প্রতিবাদ করেছিলেন ব্র্যাথওয়েট। কিন্তু সেটি আম্পায়ারের চোখে পড়েনি। আর সিদ্ধান্ত দিয়ে দেওয়ায় আর পরিবর্তন করা হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে ব্র্যাথওয়েটের বোমা
বিতর্কিত আম্পায়ারিংয়ের পরও খেলা চালিয়ে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ম্যাচও জিতেছে ৫০ রানে। পরে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যেন সংবাদ সম্মেলনে উগরে দিয়েছিলেন উইন্ডিজ টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক ব্র্যাথওয়েট। ঘটনার সবিস্তার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে এক নাগাড়ে চার মিনিট উত্তর দিয়েছিলেন। সেখানেই স্পষ্ট, দুর্বল আম্পায়ারিংয়ে কতটা ফুঁসেছিলো ক্যারিবিয়ানরা। তার মতে, শুধু শেষ টি-টোয়েন্টি নয়, সিরিজজুড়েই অনেক সিদ্ধান্ত তাদের বিপক্ষে গিয়েছিলো।
ব্র্যাথওয়েট বলেছিলেন,
‘দ্বিতীয় ম্যাচের পরই আমি ম্যাচ রেফারির কাছে গিয়েছিলাম। ওয়ানডে সিরিজের সময় সৌভাগ্যবশত আমি এখানে ছিলাম। বলতেই হবে, ফিফটি-ফিফটি সিদ্ধান্তগুলো একটিও আমাদের পক্ষে আসছিলো না। এ রকম প্রতিটি সিদ্ধান্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে গেছে।’
‘আমি কখনো কোনোমতেই কারও বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনতে চাই না। তারাও পেশাদার। আমি মনে করি না, তারা পক্ষপাতিত্ব করতে বা প্রতারণা করতে মাঠে নামে। আমি তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনিনি। কিন্তু নিজের বক্তব্য আমি ম্যাচ রেফারির কাছে স্পষ্ট করেছি যে, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজে প্রতিটি ফিফটি-ফিফটি সিদ্ধান্ত আমাদের বিপক্ষে গেছে। আমরা অবশ্যই ভালো ক্রিকেট খেলতে পারিনি, লাল বল হোক বা সাদা। তবে আমি দেখেছি যে, যতবার আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলেছি, এই সিদ্ধান্তগুলো আমাদের বাধাগ্রস্ত করেছে।’
ব্র্যাথওয়েটের এই বক্তব্য নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য লজ্জার বিষয়। বারবারই পরোক্ষভাবে প্রতারণার কথা তুলে এনেছিলেন ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক। তিনি বলেছিলেন,
‘আবারও, আমি বলছি না, ম্যাচ অফিসিয়ালরা প্রতারণা করেছে। কারণ আমি মনে করি তারা পেশাদার। কিন্তু যা দেখেছি, সেটি নিয়ে বলতে পারি আমি। প্রাপ্যটা আমরা না পেলে, অধিনায়ক হিসেবে তা আমি বলবোই। ম্যাচ রেফারিকে জানাবোই।’
মাঠে থেকেই লড়তে চেয়েছিলেন ব্র্যাথওয়েট। দলকে তাই বুঝিয়ে আবার খেলায় ফিরিয়েছেন। বলেছেন,
‘শক্ত কিছু করার পরে ব্যাপারটির সমাধান হয়েছে। আমরা এত পরিশ্রম করেছি যে মাঠ ছেড়ে চলে আসতে পারি না বা ম্যাচ ও সিরিজ ওদের হাতে তুলে দিয়ে আসতে পারি না। সিদ্ধান্ত ছিল মাঠে থাকা, লড়াই করে শেষ পর্যন্ত দেখা।’
‘তবে সে সময় আমি ম্যাচ রেফারির কাছে ৫ মিনিট সময় চেয়েছিলাম যেন ছেলেদের শান্ত করতে পারি, বিতর্ক ভুলে মাঠে মনোযোগ ফেরাতে পারি। যা হয়েছে, তা ভুলে পরের ১৬ ওভার শেষ করতে পারি। ধন্যবাদ জানাতে হবে, সময়টা আমাদের দেওয়া হয়েছে। আমি সুযোগ পেয়েছি সতীর্থদের সঙ্গে কথা বলার। ব্যাপারটি ছিল আমরা বনাম বাকি সবাই। একসঙ্গে বৃত্তে দাঁড়িয়ে একমাত্র আমিই কথা বলেছি। তারপর সবাই সাড়া দিয়েছে, সবাই বলেছে এই ম্যাচ আমাদের জিততেই হবে। এরপর দেখেছেন, ম্যাচে কি হয়েছে।’
মাঠে এমন প্রতিবাদ, আচরণের কারণে অনেক সময় খেলোয়াড়দের পেতে হয় শাস্তি, বিশেষ করে আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কিছু করলে। কিন্তু ব্র্যাথওয়েটের সেদিন এমন কিছু নিয়ে দুর্ভাবনা ছিল না। বলেছিলেন,
‘শাস্তি তো আসবে-যাবে। কিন্তু কোনো কিছুর জন্য না দাঁড়ালে, সবকিছুই ভেঙে পড়বে। এটির কারণে শাস্তি হলে আমি হাসি মুখে মেনে নেব। সতীর্থদের পাশে দাঁড়ানো জরুরি ছিল এবং অধিনায়ক হিসেবে সেটি আমারই দায়িত্ব। আজ (২২ ডিসেম্বর) যেমন করেছি, ভবিষ্যতেও করবো। আমি জানি না, ম্যাচ রেফারি কি করবেন। তবে যেমনটি বলেছি, আমার সতীর্থ, দেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মানুষের জন্য আজকেও যেমন দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো।’