প্রিয় আকরাম খান,
বাংলাদেশের ক্রিকেটে আপনার অবদানকে নিঃশঙ্কচিত্তে স্বীকার করতেই হবে। ফিটনেস, খেলোয়াড়ি দক্ষতা, এসবে বর্তমান ক্রিকেটারদের চাইতে আপনি পিছিয়ে থাকতেই পারেন; কিন্তু তাতে আপনার অসাধারণত্ব কমে না একটুও। এখনকার মতো এত সুবিধা আপনি পাননি, ক্রিকেট খেলে জীবিকার নিশ্চয়তা আপনাদের সময় ছিল না, সামাজিক স্ট্যাটাসেও আপনারা পিছিয়েই ছিলেন। কেউ পেশা জিজ্ঞেস করলে বলতে দ্বিধাবোধ করতেন, ক্রিকেট খেলি। সেই আপনাদের সময় গড়ে দেওয়া ভিত্তির উপরই এখন দেশে বিপিএলের মতো কোটি টাকার আসর বসে, একজন খেলোয়াড় ৩৫ লাখ টাকা পারিশ্রমিকও ‘তুলনামূলকভাবে অপর্যাপ্ত’ ঠাওর হয়।
আপনারা ক্রিকেট খেলেছেন ভালোবাসা থেকে, জীবিকার জন্য অনেকেরই হয়তো বা অন্য কোনো পেশার উপর নির্ভর করতে হতো। তবু খেলার প্রতি আবেগের কমতি ছিল না। বড় দলের বিপক্ষে আপনাদের প্রজন্ম হতাশাজনক পারফরম্যান্স প্রদর্শন করতো। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে সেগুলোকে ‘লজ্জাজনক’ বলতে রাজি নই।
পেশাদার ক্রিকেটারদের সাথে অপেশাদারের খেলায় একপেশে দৃশ্যপটই যদি না হলো, পেশাদারিত্বের মূল্য তবে আর কোথায়! ধরুন, বাংলাদেশ ফিনল্যান্ডের সাথে ক্রিকেট খেলতে নামলো। ফিনল্যান্ডকে বাংলাদেশে ব্যাটসম্যানরা যদি উড়িয়েই না দেয়, বোলাররা ব্যাটিং অর্ডার গুড়িয়ে দিতেই না পারে, সেটা কিন্তু বাংলাদেশেরই ব্যর্থতা হবে। ফিনল্যান্ড নবীশ দল হিসেবে যতটুকু খেলতে পারে, সেটাই প্রাপ্তি। অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকার সাপেক্ষে একদা আমরাও ‘ফিনল্যান্ড’ই ছিলাম, সেই দলে খেলেছেন আপনারা; যতটুকু যা দেখিয়েছেন, ওটাই পর্যাপ্তের চাইতে বেশি।
তবে… কিছু কমও দিয়েছিলেন কি?
আপনার নামটা শুনলেই মনে আসে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা সেই ৬৮ রানের ইনিংস। আজ থেকে ২৩ বছর আগের ৪ এপ্রিল, ১৯৯৭ সালের। নেদারল্যান্ডের সাথে সেই ম্যাচ হারলেই আইসিসি ট্রফি থেকে বিদায় নিতে হতো; কে জানে, হয়তো এখনো আমাদের আইসিসি ট্রফিতে অংশ নিতে হতো। একটা ইনিংস পুরো জাতির ক্রিকেট সংস্কৃতিকে কীভাবে প্রভাবিত করে, ক্রিকেট ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত খুব বেশি পাওয়া যাবে না। টার্গেট শুরুতে ছিল ১৭২, বৃষ্টির কারণে ৩৩ ওভারে টার্গেট দাঁড়ায় ১৪১। সেই রান তুলতেই ১৫ রানে নেই ৪ উইকেট। অধিনায়ক বলেই হয়তো দায়িত্ব ছিল অনেক বেশি।
নেদারল্যান্ডের সাথে সেই ম্যাচে মিনহাজুল আবেদীন আর সাইফুল ইসলামের সাথে দুটি পঞ্চাশোর্ধ্ব পার্টনারশিপ গড়েছিলেন। ৩ উইকেটে বাংলাদেশ ম্যাচটি জিতে নেয়। বৃষ্টি বৃষ্টি আবহাওয়া ছিল, সুতরাং বৃষ্টি আসা পর্যন্ত ম্যাচটিকে টিকিয়ে রাখতে সময়ক্ষেপণের কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণে এই আচরণ গর্হিত, তবে সমর্থকদের প্রান্ত থেকে আপনার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ছিল। কেননা, আশার ভেলা যে আপনারাই ভাসিয়ে রাখেন!
আইসিসি ট্রফিতে বহুবার খেলতে হয়েছে, ‘৯৭ এর আসরের মতো এতটা কাছাকাছি যাওয়া হয়নি কোনো আসরেই। সেখানে একটি ম্যাচ জেতার জন্য যদি একটু ‘কূটবুদ্ধি’র আশ্রয় নিয়েই থাকেন, তাকে ‘অপরাধ’ না বলে ‘বীরত্ব’ বলাই সঙ্গত হবে। সেই ম্যাচে খেলেন ৯২ বলে ৬৮ রানের ইনিংস। চার মাত্র ৩টি, ছয় নেই। কেউ নিছক বিনোদনের জন্য এই ম্যাচ দেখলে হতাশ হবেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ইনিংসে সৌন্দর্য না থাকলেও এই ইনিংসই যে পরে ভবিষ্যৎ গড়ে দেবে, সেদিনের মাঠের দর্শক কি তা আদৌ ভাবতে পেরেছিলেন?
৩১ মে, ১৯৯৯। আইসিসি বিশ্বকাপের ২৯তম ম্যাচ। কে জানতো, সেদিন অপেক্ষা করছিল বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় অঘটন?
সদ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হামাগুড়ি দেওয়া এক দল হারিয়ে দেয় পরাক্রমশালী পাকিস্তানকে। পাকিস্তানকে হারানোর ম্যাচে সবাই খালেদ মাহমুদকে মনে রেখেছেন, কারণ সেদিন তার অলরাউন্ড নৈপুণ্য ছিল দেখার মতো। ব্যাটিংয়ে ২৭ রানের পাশাপাশি বোলিংয়ে নেন ৩ উইকেট, ইকোনমি মাত্র ৩.১০। একে একে ফেরান আফ্রিদি, ইনজামাম ও সেলিম মালিককে। পেয়েছিলেন ম্যাচসেরার পুরষ্কারও। কিন্তু ওয়ান-ডাউনে ব্যাটিং করতে নেমে আকরাম খান যে ৪২ রানের ঝকঝকে একটি ইনিংস খেলে দলের স্কোরকে সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, সে কথা হয়তো বা অনেকেই ভুলে গেছেন। অবশ্য সেদিনের ৬২ রানের জয়টা দেশে যে বিজয় উৎসব এনে দিয়েছিল, তার সুবাদে তিনি হয়তো তার অবদানের কথা মানুষ ভুলে গেলেও কষ্ট পাবেন না।
আকরাম খান যখন খেলতেন, তখন ফুটবলই বাংলাদেশের ১ নম্বর খেলা ছিল। সেই পরিস্থিতিতে ফুটবল বাদ দিয়ে ক্রিকেট খেলাকে বেছে নেওয়া যথেষ্ট সাহসের ব্যাপার। তাকে আদ্যোপ্যান্ত একজন সাহসী ক্রিকেটার মনে হয়েছে সবসময়ই। মনে পড়ে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে মাখায়া এনটিনি ক্রমাগত শর্ট বল করছিলেন, আকরাম খান ডাক না করে বাউন্ডারি মারছিলেন। পরের টেস্টে চেস্টগার্ড নিয়ে ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন, তবু এনটিনিকে ভয় পাননি।
তার ব্যাটিংয়ে টেকনিক্যাল ভুল ছিল প্রচুর, সমসাময়িককালে প্রায় সবারই একই দশা ছিল। তবু মনের জোরে তিনি খেলে গেছেন, তার সংগ্রামে তৈরি করা প্ল্যাটফর্মে এখন সৌম্য সরকার নির্বিঘ্নে প্রতিপক্ষ বোলারের বলে পেরিস্কোপ শট খেলেন, তামিম ইকবাল নির্ভয়ে ডাউন দ্য উইকেটে বেরিয়ে এসে বলকে গ্যালারিতে পাঠান। শারীরিক গড়নের কারণে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের কাছে বিদ্রুপ শুনতেন, তবু দমে না গিয়ে দেখাতেন, ক্রিকেট খেলায় মনের জোরটাই আসল।
অন্য সবার মতো ফর্ম হারিয়েছিলেন তিনিও, অধিনায়কত্ব থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। তবু বিশ্বাস না হারিয়ে খেলা চালিয়ে গিয়েছিলেন, জুনিয়র অধিনায়কের নেতৃত্বও মেনে নিয়েছিলেন হৃষ্টচিত্তে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চোখ ঝলসানো কোনো পারফরমেন্স তিনি দেখাতে পারেননি, সত্যি। কিন্তু এখন যারা ক্রিকেট খেলেন, তাদের সবারই আইডল ছিলেন তিনি, অথবা আমিনুল ইসলাম বুলবুলের মতো খেলোয়াড়েরাই। যতটা ভালবাসা-সম্মান তারা পেয়েছেন মানুষের, আজকের জনপ্রিয়তম ক্রিকেটারটিও তা পান কি না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ।
আকরাম খান ক্রিকেট ছাড়ার পরও প্রশাসক হিসেবে বোর্ডে রয়ে গেছেন। তামিম ইকবাল খারাপ খেললে শুরুর দিকে আকরাম খানকে জড়িয়ে নেপোটিজমের অভিযোগ তুলতো। এমন নিম্ন মানসিকতার মানুষের প্রতি করুণা হয় বৈকি। পরবর্তীতে তামিম সেই সমালোচনার উত্তর দিয়েছেন ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই দেশের শীর্ষ রান সংগ্রহকারী হয়ে। প্রমাণ করেছেন, প্রতিভা থাকলে পারিবারিক পরিচয় এমন কোনো ব্যাপারই নয়। নেপোটিজমের অভিযোগ যদি সত্যি হতো, নাফিস ইকবাল হয়তো তাহলে এখনও জাতীয় দলে খেলতেন।
প্রশাসকের কাজ অনেক কঠিন, সেখানে প্রিয়-অপ্রিয় অনেক কাজই করতে হয়। ক্রিকেটার হিসেবে যে জনপ্রিয়তা ছিল, আকরাম খান প্রশাসক হিসেবে তা ধরে রাখতে পারেননি; নানা কারণেই বিতর্কে জড়িয়েছেন। তবু তিনি ‘ক্রিকেটার’ আকরাম খান হিসেবে এখনও শ্রদ্ধার আসনে আসীন।
আজ থেকে ১৫-২০ বছর পর ছেলেরা যখন ব্যাট বল হাতে নেবে, তখন তারা জানবে, আকরাম খান নামের এক ক্রিকেটনায়ক একটিমাত্র ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে বিশ্বকাপে টেনে নিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশের ব্যাটসম্যানরা রানের ফোয়ারা ছোটালেও তার সেদিনের সেই ‘আনঅফিসিয়াল’ ম্যাচের ইনিংসটার পাশে সবকিছুই যেন ফিকে।
আর যা-ই হোক, সেদিন ৬৮ রানের ইনিংসটা না খেললে হয়তো ক্রিকেটে আমাদের হামাগুড়ি চলতেই থাকতো। একটা জাতি বিশ্বে পরিচিত হওয়ার এমন উৎস কি পেত বাংলাদেশ?
২৩ বছর পূর্ণ হয়ে ২০২০ এর ৪ এপ্রিল সন্নিকটে। আকরাম খান যে যাত্রার সূচনা করেছিলেন, সেই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূরত্ব পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। শিকড়কে ভুলে গেলে যেমন অন্যায় হয়, তার কীর্তিকে খর্ব করা বা অসম্মানের চোখে দেখাও সেরকমই অপরাধ। বাংলাদেশের ক্রিকেট তাকে অবশ্যই মনে রাখবে; ক্রিকেট-পরবর্তী জীবনে তার সাফল্য আসুক কিংবা না আসুক, ধ্রুব সত্য এটাই।