১.
১৯৯২ এর ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনাল; প্রতিপক্ষ পাকিস্তান আর ইংল্যান্ড। দুইটি দলের মাঝে ফেভারিট বাছাই করতে গেলে প্রথমেই চোখ পড়ে অতীত ইতিহাসের দিকে। সেদিক থেকে ম্যাচ শুরুর আগে ইংল্যান্ড চোখ বন্ধ করে ফেভারিট ছিল। তখন পর্যন্ত মুখোমুখি লড়াইয়ে ৩০টি ম্যাচের মাঝে পাকিস্তানের জয় ছিল মাত্র ১০টিতে, আর ইংল্যান্ডের ১৯টি জয়ের পাশাপাশি একটি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছিল। তবে অতীত ইতিহাস অনেক সময়ই পালটে দেওয়া যায় সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স দিয়ে। সমস্যা হচ্ছে, সেটা বিবেচনা করলে পাকিস্তান আরও পিছিয়ে ছিল। লিগ পর্যায় থেকে পরের পর্বে ইংল্যান্ড ওঠে দ্বিতীয় হয়ে, অন্যদিকে পাকিস্তান চতুর্থ হয়ে ওঠে ভাগ্যের কিছুটা সহায়তা নিয়ে। গ্রুপ পর্যায়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটাতেই পাকিস্তান মাত্র ৭৪ রানে অল-আউট হয়ে যায়।
নিশ্চিত হারতে থাকা সেই ম্যাচটা বৃষ্টির জন্য পরিত্যক্ত হয়। এই পয়েন্টটাই পাকিস্তানকে পরের পর্বে পৌঁছাতে সাহায্য করে। এভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফাইনালে আসা দলের বিপক্ষে অতীত ইতিহাসে এগিয়ে থাকা ইংল্যান্ডের ফেভারিট থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল।
ম্যাচ শুরুর পর সেটার প্রতিফলনই যেন দেখা গেল। মাত্র ২৪ রানেই দুই উইকেট হারিয়ে পাকিস্তান আবারও অল্প রানে গুটিয়ে যাওয়ার আশংকায়। সেখান থেকে হাল ধরলেন অধিনায়ক ইমরান খান এবং পাকিস্তানের সেই আমলের ব্যাটিং নির্ভরতা জাভেদ মিঁয়াদাদ। দুজনে মিলে ১৩৯ রানের জুটি গড়লেও বল খরচ করে ফেলেছিলেন অনেক বেশি। সেই আমলে ফাইনাল ম্যাচে মোটামুটি ২৩০ বা ততোধিক স্কোর না হলে সেটাকে নিরাপদ বলা যায় না। রানের গতি অনুযায়ী স্কোর ২১৫-এর কাছাকাছি হবার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। ইমরান খান যখন আউট হলেন, তখন মাঠে নামার কথা নিয়মিত ব্যাটসম্যান সেলিম মালিক কিংবা ইজাজ আহমেদের একজনের। কিন্তু মাঠে নামলেন ওয়াসিম আকরাম নামের ২৫ বছরের এক তরুণ, যিনি কিনা তখন বোলার হিসেবেই মূলত পরিচিত। সেই বিশ্বকাপে আগের ৭টি ইনিংসে তার সংগ্রহ মাত্র ২৯ রান। কিন্তু মাঠে নেমেই তিনি যেন ব্যাটসম্যান হয়ে গেলেন, ঝড়ো গতিতে মাত্র ১৯ বলে ৩৩ রানের একটা ক্যামিও খেললেন, যাতে চারটি বাউন্ডারি ছিল। তার এই রানের সুবাদেই পাকিস্তান করলো ২৪৯ রানের একটা চ্যালেঞ্জিং স্কোর।
তবে শক্তিশালী ইংল্যান্ডের সেই রান তাড়া করার সামর্থ্য বেশ ভালোভাবেই ছিল। পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল শুরুতেই কিছু উইকেট ফেলে ইংল্যান্ডকে চাপের মুখে ফেলা। সেই কাজের শুরুটা করতে আবারও এগিয়ে আসলেন সেই তরুণই। ব্যক্তিগত রানের খাতা খোলার আগেই যখন ইংল্যান্ডের ওপেনার ইয়ান বোথামকে আউট করলেন, তখন ইংল্যান্ডের সংগ্রহ মাত্র ৬ রান। শুরুর চাপটা সামলাতে না পেরে মাত্র ৬৯ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ড যখন মোটামুটি বিপদে, তাদের প্রয়োজন ছিল একটা জুটি গড়ে তোলা। সেই কাজটা করলেন নিল ফেয়ারব্রাদার আর অ্যালান ল্যাম্ব, ৭২ রানের একটা জুটি গড়ে প্রাথমিক বিপর্যয় সামলে ধীরে ধীরে জয়ের দিকে এগোচ্ছিলো ইংল্যান্ড। ম্যাচে ফেরত আসার জন্য পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল জুটিটা ভাঙা। সেই কাজের জন্য অধিনায়ক আবারও সেই ওয়াসিমকেই বোলিংয়ে নিয়ে আসলেন।
অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিলেন ওয়াসিম। ল্যাম্বকে বোল্ড করলেন অফ কাটারে, এরপর ক্রিস লুইসকে আবারও বোল্ড করলেন বিশাল এক ইনসুইংয়ে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জোড়া ডেলিভারি যে নেই, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এই ধাক্কা আর ইংল্যান্ড সামলাতে পারেনি, শেষ পর্যন্ত ২২৭ রানে অল আউট হয়ে ২২ রানের হার মেনে নেয় ইংল্যান্ড।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তান ঐ একবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ওয়াসিম আকরাম সেই ফাইনালের ম্যান অফ দ্য ম্যাচ, আর ১৮ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি।
পাকিস্তানের একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ের মূল কৃতিত্ব ইমরান খানের অধিনায়কত্বের ঘরে গেলেও ইমরানের সেই যুদ্ধের অন্যতম সেনানী যে ওয়াসিম আকরাম ছিলেন সেটা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়। বিশ্বক্রিকেট এবং পাকিস্তান ক্রিকেটে অবদান রাখা সেই ওয়াসিম আকরামের কিছু গল্পই আজ আমরা শুনবো।
২.
ওয়াসিম আকরামের জন্ম পাকিস্তানের একটা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে। উনার বাবা একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন, তারই ইচ্ছায় ওয়াসিমকে লাহোরের একটা স্কুলে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হয়। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, ছোটবেলায় ওয়াসিমের আগ্রহ ছিল টেবিল টেনিসে। দশ বছর বয়স থেকেই তিনি তার দাদার সাথে থাকতেন, যিনি একজন প্রচণ্ড ক্রিকেটপ্রেমী ছিলেন। দাদার আগ্রহে তার নিজেরও ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। আস্তে আস্তে স্থানীয় ক্লাবে খেলা শুরু করেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ক্লাবের একাদশেও শুরুতে তিনি সুযোগ পেতেন না।
পরবর্তীতে লাহোরে আয়োজিত একটা ক্রিকেট ক্যাম্পে বোলিংয়ের অডিশন দিতে যান ওয়াসিম। প্রথম দুই দিন বোলিং করার সুযোগই পাননি, কিন্তু তৃতীয় দিনে বোলিং করে চোখে পড়েন নির্বাচক হাবিব আহসানের, যিনি কিনা পাকিস্তানের পক্ষে ১২টি টেস্টও খেলেছিলেন। পাকিস্তানের তৎকালীন অধিনায়ক জাভেদ মিঁয়াদাদও প্র্যাকটিসে বোলিং দেখে ওয়াসিমকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে রাজি হয়ে যান।
নিউজিল্যান্ড সফরের পাকিস্তান দলেই তার জায়গা হয়ে যায়। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্টে মাত্র দু’টি উইকেট পান, দলও হারে ইনিংস ব্যবধানে। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টেই দুই ইনিংসে ৫টি করে উইকেট পান। সবচেয়ে কম বয়সী বোলার হিসেবে এক ম্যাচে দশ উইকেট পাওয়ার রেকর্ড করেন, যা কিনা পরবর্তীতে ভাঙতে সক্ষম হন বাংলাদেশী বোলার এনামুল হক জুনিয়র।
এখান থেকেই ওয়াসিম সবার নজর কাড়েন এবং পাকিস্তান দলের নিয়মিত অংশ হয়ে যান। কিছুদিন পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডেতে ৫ উইকেট পান, যা ছিল তার ক্যারিয়ারের মাত্র ৩য় ওয়ানডে ম্যাচ।
৩.
টেস্ট আর ওয়ানডে দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা ঘরানার ক্রিকেট। দুই ফরম্যাটেই সফলতা পেয়েছেন এমন খেলোয়াড় খুব কম না হলেও খুব অল্প খেলোয়াড়ই আছেন, যারা দুই ফরম্যাটেই সফলতার সাথে দীর্ঘদিন ক্যারিয়ার চালিয়ে যেতে পেরেছেন। ক্রিকেট ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, দুই ফরম্যাটেই ন্যূনতম ৪০০ উইকেট পেয়েছেন এরকম বোলারের সংখ্যা মাত্র ২ জন; মুত্তিয়া মুরালিধরন এবং ওয়াসিম আকরাম। এর মাঝে ওয়াসিম আকরামই একমাত্র ফাস্ট বোলার। একজন স্পিনারের তুলনায় একজন ফাস্ট বোলারের ইনজুরি-প্রবণতা বেশি থাকায় ক্যারিয়ার দৈর্ঘ্য কমে যাবার যে আশংকা থাকে, সেটা কে না জানেন! অথচ একজন ফাস্ট বোলার হিসেবে ১৮ বছর ১১০ দিনের ওয়ানডে ক্যারিয়ার যে কোন বিচারেই বিস্ময় জাগাতে বাধ্য।
ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশিদিন খেলা চালিয়ে যাওয়া ক্রিকেটারদের তালিকায় প্রথম ২০ জনের মাঝে ১৪ জনই নিখাদ ব্যাটসম্যান, ২ জন অলরাউন্ডার এবং ৪ জন বোলার। এই চারজন বোলারের মাঝে ওয়াসিম আকরাম বাদে বাকি তিনজনই স্পিনার।
ফাস্ট বোলারদের মূল অস্ত্রই হচ্ছে তাদের গতি। গতির সাথে সুইং, বাউন্স, ইয়র্কার – এসবের সংযোজন তাদেরকে আরও বেশি বৈচিত্র্যময় করে তোলে। তবে একটা সমস্যা হচ্ছে, ক্যারিয়ারের একটা পর্যায়ে গিয়ে স্বাভাবিক কারণেই গতির সাথে কিছুটা হলেও আপোষ করতে হয় তাদের। তখন গতির বদলে ভ্যারিয়েশনটাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
এই বৈচিত্র্যের জন্যেই ওয়াসিম আকরাম বাকি বোলারদের চেয়ে অনেকখানি আলাদা। ‘চাইলে ছয়টা বল ছয়রকম করতে পারেন’ – ওয়াসিম সম্পর্কে এমন একটা মিথ সবসময়ই প্রচলিত ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৮ বছর পার করলেও গতির সাথে খুব বেশী আপোষ তাকে কখনোই করতে হয় নি। বরং এরই সাথে স্লোয়ার কিংবা সুইংয়ের অন্তর্ভুক্তি তার কার্যকারিতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। পুরনো বলে রিভার্স সুইং করার এক আশ্চর্য ক্ষমতাও ছিল তার। এই ক্ষমতার কারণেই স্লগ ওভারের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বোলারও ছিলেন ওয়াসিম।
৪.
বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ছিলেন তিনি। ৩৮ ম্যাচে ৫৫ উইকেটের এই রেকর্ড পরবর্তীতে ভাঙ্গেন আরেক গ্রেট গ্লেন ম্যাকগ্রা। রেকর্ড ভাঙ্গার পর ওয়াসিম সম্পর্কে গ্লেন ম্যাকগ্রার বক্তব্য ছিল,
‘আমার কাছে ওয়াসিম আকরাম হচ্ছেন সর্বকালের সেরা বোলারদের একজন। একজন বাঁহাতি, যিনি কিনা দুই দিকেই সুইং করাতে পারতেন। নতুন এবং পুরনো বল দুটো দিয়েই তিনি বিপদজনক ছিলেন’।
১৯৯২ বিশ্বকাপের কথা তো আগেই বলা হলো। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল মিস করেন ইনজুরির জন্য, মনোবল হারিয়ে পাকিস্তানও হেরে যায় সেই ম্যাচে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপেও তিনি ১৫টি উইকেট পান এবং পাকিস্তান ফাইনালে যায়। ২০০৩ বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচের ৫ ইনিংসে ১২ টি উইকেট পেলেও পাকিস্তান দল গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। এই বিশ্বকাপের পরই পাকিস্তান দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করে এবং অনেক সিনিয়র ক্রিকেটারদের সাথে সাথে ওয়াসিম আকরামও দল থেকে বাদ পড়েন।
টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ওয়াসিম আকরাম ১৯৯৩ সালে ‘উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটার’ নির্বাচিত হন। এছাড়া উইজডেন দ্বারা নির্বাচিত গত শতাব্দীর সেরা ওয়ানডে বোলার হিসেবেও নির্বাচিত হন ওয়াসিম।
৫.
হ্যাটট্রিক করাটা যে কোন একজন বোলারেরই অতি আকাঙ্ক্ষিত। টেস্ট ক্রিকেটে এই পর্যন্ত ৪৩টি হ্যাটট্রিক হয়েছে, ওয়ানডে ক্রিকেটে হয়েছে ৪৪ টি। আর ওয়াসিম আকরাম হচ্ছেন একমাত্র বোলার, যার টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই দু’টি করে হ্যাটট্রিক রয়েছে। এর মাঝে ওয়ানডের দু’টো হ্যাটট্রিক সরাসরি বোল্ড করার মাধ্যমে।
এছাড়া ওয়াসিম আকরাম সেই ছয়জন ক্রিকেটারের একজন, যিনি কিনা এক ওভারে চারটি উইকেট শিকার করেছেন। ভাগ্যের সহায় না থাকায় হ্যাটট্রিকটা পাননি; দুই উইকেট পাওয়ার পর তৃতীয় বলে ক্যাচ ড্রপ হয়, পরের দুই বলে আবার দুই উইকেট পান।
প্রথম বোলার হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে ৫০০ উইকেট লাভ করেন ওয়াসিম আকরাম। পরবর্তীতে মুরালিধরন তার রেকর্ড ভাঙলেও আর কোনো ফাস্ট বোলার এই রেকর্ডের কাছাকাছিও এখনো যেতে পারেননি, অদূর ভবিষ্যতে সে সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
৬.
ব্যাট হাতেও লোয়ার অর্ডারে যথেষ্ট কার্যকরী ছিলেন। টেস্টে তিনটি সেঞ্চুরি রয়েছে, যার মধ্যে একটি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করেছিলেন তিনি। এছাড়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২৫৭ রানের একটা ইনিংস খেলেন, যা কিনা আট নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। এছাড়া সেই ইনিংসেই ১২টি ছক্কা মেরেছেন, যা কিনা এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারার রেকর্ড। পাকিস্তানি অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডও এটাই।
এছাড়া ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রায়ই লোয়ার অর্ডারে নেমে ছোটখাটো ক্যামিও খেলে পাকিস্তানকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জয় এনে দিয়েছেন। ১৯৮৯ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত নেহেরু কাপের ফাইনালে ওয়াসিম যখন মাঠে নামলেন, তখন শেষ দুই বলে প্রয়োজন ছিল ৬ রান। ওয়াসিম আকরাম প্রথম বলেই ছক্কা মেরে পাকিস্তানকে এনে দেন ঐতিহাসিক জয়।
ইমরান খান প্রায়ই আক্ষেপ করে বলতেন যে, ওয়াসিম যদি ব্যাটিং নিয়ে সিরিয়াস হতেন তাহলে একজন গ্রেট অলরাউন্ডারে পরিণত হতে পারতেন। তবে ওয়ানডে ক্রিকেটে ৬টি ফিফটির সাহায্যে ৩৭১৭ রান, কিংবা টেস্ট ক্রিকেটে ৩টি সেঞ্চুরি আর ৭টি ফিফটির সাহায্যে ২৮৯৮ রান কিন্তু তার ব্যাটিং-সামর্থ্যের ইঙ্গিতই দেয়।
৭.
ওয়াসিম আকরাম বোলার হিসেবে কেমন ছিলেন?
বলা হয়ে থাকে যে সেরা খেলোয়াড়েরা সাধারণত সেরাদের বিপক্ষেই নিজেকে তুলে ধরে। ওয়াসিম আকরামের সময়কালের সেরা ব্যাটসম্যান ধরা হয় মূলত দু’জনকে, শচীন টেন্ডুলকার আর ব্রায়ান লারা। এই বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানের পারফরম্যান্স কিন্তু তার বিপক্ষে মোটেও সেই মানের নয়। ওয়াসিম খেলেছেন এমন ২৪টি ওয়ানডে ম্যাচে শচীন করেছেন ৫৭২ রান, গড় ২৭.২৩, স্ট্রাইক রেট ৬৫.৫৯। অন্যদিকে ওয়াসিমবিহীন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৪৩টি ইনিংসে রান করেছেন ১৯৫৪, গড় ৪৬.৪২, স্ট্রাইক রেট ৯৮.০৯।
ওয়াসিম খেলেছেন এমন ৩৩টি ওয়ানডে ম্যাচে লারা করেছেন ৭৯৬ রান, গড় ২৮.৪২, স্ট্রাইক রেট ৫১.২২। অন্যদিকে ওয়াসিম-বিহীন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৫টি ইনিংসে রান করেছেন ৯৭৫, গড় ৭৫, স্ট্রাইক রেট ১৪১.৫০।
অনেক গ্রেট খেলোয়াড়ই ওয়াসিম আকরামকে সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে পাকিস্তানী বোলার শোয়েব আখতারের মন্তব্যটাই হয়তো উনার সত্যিকারের সামর্থ্যটা ফুটিয়ে তোলে।
‘ওয়াসিম আকরাম চাইলেই আমার মতো ১০০ জন বোলার তার জুতোর ধুলো থেকে তুলে আনতে পারে। এটাই তার ক্লাস।’
রবি শাস্ত্রীর ভাষায়,
‘হি ওয়াজ ক্যাপটেন’স ডেলাইট। লারা, টেন্ডুলকার, শেন ওয়ার্ন ছিল, ছিল স্টিভ ওয়াহও। তবুও নব্বইয়ের দশকে সেরা ক্রিকেটার ওয়াসিম আকরাম – এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।’
৮.
খেলা ছাড়ার পর ওয়াসিম কিছুদিন ধারাভাষ্যকারের কাজ করেছেন ইএসপিএন স্টার স্পোর্টস এবং অ্যারাই ডিজিটালের পক্ষ থেকে। ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়াতে অনুষ্ঠিত মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপ, ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি এবং ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ধারাভাষ্যকার হিসেবে তিনি কাজ করেছেন।
২০১০ সালে ওয়াসিম আকরাম আইপিএলে ‘কলকাতা নাইট রাইডার্স’-এর বোলিং কোচ হিসেবে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে পিএসএলে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে ‘ইসলামাবাদ ইউনাইটেড’-এর ডিরেক্টর এবং বোলিং কোচের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি ‘মুলতান সুলতানস’ এর ডিরেক্টর এবং বোলিং কোচ হিসেবে নিযুক্ত আছেন।
সারা জীবন ব্যাটসম্যানদেরকে বিভ্রান্ত করতে সিদ্ধহস্ত এই বোলার এখন পরবর্তী জেনারেশনকে প্রস্তুত করার কাজেই মন দিয়েছেন। তার হাত ধরে যদি আরেকজন ওয়াসিম আকরাম ক্রিকেট বিশ্বে আসেন, তাহলে সেটা ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্যে আনন্দেরই হবে বৈকি।
Featured Image source: Phil Walter/EMPICS via Getty Images