লেগ স্পিন, ক্রিকেট দুনিয়ার এক দুর্লভ শিল্প।
কিছুদিন আগেই (৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯) লেগ স্পিনের মহীরূহ আব্দুল কাদির না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। পাকিস্তানের এই কিংবদন্তির বোলিং জাদুই লেগ স্পিনার হওয়ার সাহস যুগিয়েছে বহু তরুণকে।
গত কয়েক বছর ধরে একজন লেগ স্পিনারই হন্যে হয়ে খুঁজছে বাংলাদেশ। লেগ স্পিনারের অভাবজনিত হাহাকার শোনা গেছে ক্রিকেটকর্তাদের মুখে। বিভিন্ন সময়ে জেনুইন লেগ স্পিনার ভেবে কয়েকজনকে দেশের ক্রিকেটের অবলম্বন করার চেষ্টাও করা হয়েছিল। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সফলতা পাওয়া যায়নি।
এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে সত্যিকারের লেগ স্পিনার হওয়ার অমিত প্রতিভা না থাকা, খেলোয়াড়দের নিজেদের বখে যাওয়া এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে তাদেরকে অপাংক্তেয় বানিয়ে রাখা। কঠিন শোনালেও এটা বাস্তবতা যে, লেগ স্পিনাররা বরাবরই বাংলাদেশে অনেক অযত্নে-অবহেলায় লালিত হন।
বাংলাদেশের প্রথম লেগ স্পিনার ওয়াহিদুল হক গনি ওয়ানডে খেলেছিলেন মাত্র একটি। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচটি খেলেছিলেন তিনি। এখন বিসিবির সিনিয়র স্পিন কোচ হিসেবে কাজ করছেন তিনি। তার একাডেমি থেকেই বের হয়েছেন মোহাম্মদ আশরাফুল, শাহরিয়ার নাফীসের মতো প্রতিভাধর ক্রিকেটাররা।
নেটে বোলিং করে জাতীয় দলে এসেছিলেন লেগ স্পিনার জুবায়ের হোসেন লিখন। সাবেক কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের পছন্দে দলে ঠাঁই পান এই তরুণ। তার শুরুটাও ছিল আশা জাগানিয়া। পড়তি ফর্মের চেয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, মনোযোগী না হওয়া, ফিটনেস ঘাটতি ডুবিয়েছে তার ক্যারিয়ার। ঘরোয়া ক্রিকেটে সাইড বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতে হারিয়ে যাওয়ার দুয়ারে এখন লিখন। পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য, এখন আবার নেট বোলারই হয়ে গেছেন লিখন। দৃশ্যত ৬ টেস্ট, ৩ ওয়ানডে ও একমাত্র টি-টোয়েন্টিতে স্থবির হয়ে গেছে তার ক্যারিয়ার।
মূলত ব্যাটসম্যান হলেও টুকটাক লেগ স্পিন করতেন তানভীর হায়দার। নেটে দেখে তাকেও মনে ধরে যায় হাথুরুসিংহের। ২০১৬ সালের শেষ দিকে নিউ জিল্যান্ড সফরে দুই ওয়ানডেতেই তানভীর হায়দারকে নিয়ে ঘোর কেটে যায় এই লঙ্কান কোচের।
তারপর থেকে নতুন কারো অপেক্ষায় প্রহর গুণছিল বাংলাদেশ। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে রিশাদ হোসেন, মিনহাজুল আবেদীন আফ্রিদি নামে দু’জন স্বীকৃত লেগ স্পিনার আছেন। কিন্তু তারা এখনও প্রস্তুত নন বড় মঞ্চের জন্য।
হুট করেই ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজের মাঝপথে আলোর মঞ্চে হাজির আমিনুল ইসলাম বিপ্লব। পরম আকাঙ্ক্ষিত লেগ স্পিনার কোটায় বাংলাদেশ দলে ডাক পান এই তরুণ। পাকিস্তানের সাবেক লেগ স্পিনার আব্দুল কাদিরের প্রয়াণের মাসেই বাংলাদেশ জাতীয় দল পেল এক তরুণ লেগ স্পিনার। কিন্তু মজার বিষয়, তানভীর হায়দারের মতো বিপ্লবও পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ দলের হয়ে ২০১৫ সালের অক্টোবরে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের (সিবিএ) বিপক্ষে চার ম্যাচে (তিন দিনের ম্যাচ) দু’টি সেঞ্চুরি করেছিলেন বিপ্লব। বয়সভিত্তিক পর্যায়ের অন্য দলগুলোতেও তিনি স্বীকৃত ব্যাটসম্যান হিসেবেই খেলেছেন।
শুধু কি দলে ডাক পাওয়া? চট্টগ্রামে গত ১৮ সেপ্টেম্বর জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টিতে অভিষেকও হয়ে যায় বিপ্লবের। অপেক্ষাকৃত খর্বশক্তির জিম্বাবুয়ের ব্যাটিং লাইনের সামনে খুব একটা পরীক্ষায় পড়তে হয়নি তাকে। ৪ ওভারে ১৮ রান দিয়ে ২ উইকেট পাওয়ায় তার অভিষেকটাও মন্দ হয়নি।
আবার এই পারফরম্যান্সের কারণেই বিপ্লবের লেগ স্পিনে আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন অনেকে। লেগ স্পিনারের অভাবটা ঘুচিয়ে আনতে এই তরুণকে গড়ে তোলার পক্ষেও কথা বলেছেন ক্রিকেট বিশ্লেষকরা। অভিষেকের পর অবশ্য ম্যাচ খেলা হয়নি এই তরুণের। ইনজুরির কারণে পরের ম্যাচে খেলতে পারেননি। আর ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল তো বৃষ্টিতেই পণ্ড হয়েছে। ম্যাচটা হলেও সেখানে খেলার সম্ভাবনা ছিল না লেগ স্পিনার বিপ্লবের।
ব্যাটসম্যান থেকে লেগ স্পিনার: বিপ্লবের রূপান্তর
ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে উঠার শুরু থেকেই বোলিংটা করতেন বিপ্লব। তবে সেটা নিয়মিত ছিল না। ২০১৮ সালে যুব বিশ্বকাপের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে মোহামেডানের হয়ে খেলেছিলেন তিনি। মোহামেডানের কোচ তখন সোহেল ইসলাম (ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশ দলের ভারপ্রাপ্ত স্পিন কোচ, তাইজুল ইসলাম-মেহেদী হাসান মিরাজের গুরু)। মোহামেডানের তাঁবুতে সোহেল ইসলামের সঙ্গে নিজের বোলিং নিয়ে কাজ করেছিলেন বিপ্লব।
শিষ্য সম্পর্কে সোহেল ইসলাম বলেছেন,
‘আসলে বিশ্বকাপের সময় মোহামেডানে ওর বোলিং নিয়ে আমি কিছু কাজ করেছি। ওর মূল শক্তি হচ্ছে স্টক বল ও অ্যাকুরেসি।’
কিন্তু তার ক্যারিয়ারের গতিপথে নতুন রঙ লেগেছে চলতি বছর হাই পারফরম্যান্স (এইচপি) ক্যাম্প শুরু হওয়ার পর। ক্যাম্পে বিপ্লবের লেগ স্পিন নজর কাড়ে কোচ সাইমন হেলমটের। সেই থেকেই বিপ্লবের লেগ স্পিনটা স্বীকৃতি পায়। এইচপি ক্যাম্পে অভিজ্ঞ কোচ ওয়াহিদুল হক গনিও কাজ করেছেন বিপ্লবের বোলিং নিয়ে। পরে হেলমটের সুপারিশেই ত্রিদেশীয় সিরিজের বাংলাদেশ দলে ডাক পড়ে তার। এবং বলা বাহুল্য, শুধু লেগ স্পিনটা পারেন বলেই ১৯ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার কোনো পারফরম্যান্সের বালাই ছাড়াই বাংলাদেশ দলে সুযোগ পেলেন।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের র্যাডিসন ব্লু হোটেলে লেগ স্পিনার হিসেবে নিজের যাত্রা শুরুর গল্পটা শুনিয়েছেন বিপ্লব। তিনি বলেছেন,
‘আসলে আমি ক্যারিয়ারের শুরু থেকে বোলিং করতাম। মাঝে অনেকদিন গ্যাপ গেছে বোলিংয়ে। কাঁধের ইনজুরির কারণে বোলিং করতে পারতাম না। ইনজুরিটা প্রিমিয়ার লিগের সময় হয়েছিল। কাঁধের ইনজুরি থেকে সেরে ওঠার পর কোচ সাইমন হেলমট আমার বোলিং নিয়ে কাজ শুরু করে। ওয়াহিদুল গনি স্যারের সঙ্গে কাজ করেছি। এর আগে সোহেল স্যারের সঙ্গে কাজ করেছি, কীভাবে বোলিংয়ে উন্নতি করা যায়। ওয়াহিদ স্যার ও সোহেল স্যারের কাছে যেগুলো ভালো হয়েছিল, সেগুলোই পরবর্তীতে চেষ্টা করে গেছি।’
অগ্রজদের পরিণতি জানা আছে বিপ্লবের
সাগরিকায় ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে অভিষেকের আনন্দের সঙ্গে ইনজুরির দুর্ভাগ্যও সঙ্গী হয়েছিল বিপ্লবের। নিজের করা বলে জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক হ্যামিল্টন মাসাকাদজার মারা তীব্র গতির শট ঠেকাতে গিয়ে বাঁ হাতের তালুতে আঘাত পান এই তরুণ। পরে হোটেলে ফিরে রাতে ব্যান্ডেজ করা হয় তার হাতে। সেলাই পড়েছিল তিনটি।
হাতে ব্যান্ডেজ নিয়েই ১৯ সেপ্টেম্বর সংবাদ মাধ্যমের সামনে এসেছিলেন বিপ্লব। কয়েক মিনিটের আলাপে বেশ মানসিক দৃঢ়তাও ফুটে উঠেছে তার কথায়।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে লেগ স্পিনারের পরিণতি অজানা নয় ১৯ বছরের এই তরুণেরও। লিখন, তানভীর হায়দাররা ছিটকে পড়েছেন জাতীয় দল থেকে। স্বীকৃত লেগ স্পিনার লিখন এখন আলোর মঞ্চ থেকে অনেক দূরে। ব্যাটসম্যান হয়েও লেগ স্পিনের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে আসা তানবির হায়দার এখন আর নির্বাচকদের নজরে নেই।
বিপ্লব মনে করেন, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণটা জরুরী। অগ্রজদের পরিণতি দেখে নিজেকে প্রতিটি পদক্ষেপে নিয়ন্ত্রণ করতে চান, এবং উন্নতি করতে চান বোলিংয়ে। শরীয়তপুরের ছেলে বিপ্লব বলেছেন,
‘আমি ফিল করি, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অনেক বড় জিনিস। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি দেখেছি, আগে কারা কে কী করেছে। চেষ্টা থাকবে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ডে-বাই-ডে উন্নতি করার চেষ্টা করব। ম্যাচ-বাই-ম্যাচ ভালো করার চেষ্টা করব।’
***
জাতীয় দলে খেলতে পারা নিশ্চয়ই স্বপ্নপূরণ?
এটা আসলে সবার একটা স্বপ্ন যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট খেলবে। আমার খুব ভালো লাগছিল যে আমি খেলছি। ছোটবেলা থেকে যাদের খেলা দেখে আসছি, তাদের সঙ্গে একসঙ্গে খেলতে পারা গর্ববোধ করা, এই আর কি।
আপনি মূলত ব্যাটসম্যান। বোলার হিসেবে অভিষেকটা ভেবেছিলেন কখনো?
সত্যি বলতে, এত বড় আশা করিনি। ‘এ’ দল থেকে নির্বাচকরা আমাকে সিলেক্ট করেছে। তারপর থেকে আল্লাহর রহমতে হয়ে গেছে।
দলে ডাক পাওয়ার খবর কীভাবে পেয়েছিলেন?
দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি’র (ত্রিদেশীয় সিরিজ) পর সোহেল স্যার আমাকে ফোন দিয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুই কি কিছু জানিস?’ আমি বলি, ‘না, আমি জানি না।‘ উনি বলল, ‘আচ্ছা ওয়েট কর, একটা ভালো নিউজ পাবি।‘ সাব্বির ভাই (সাব্বির খান, ক্রিকেট অপারেশন্স বিভাগের ম্যানেজার) আমাকে ফোন দিয়ে জানায় যে, অভিনন্দন, তোমাকে জাতীয় দলে ডাকা হয়েছে। রাতে তখন ঘুমাতে পারিনি। প্রথমবারের মতো তো!
***
লেগ স্পিনার হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার ইমরান তাহির ও অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম জাম্পাকে অনুসরণ করেন বিপ্লব। লেগ স্পিনের সব অস্ত্রের ব্যবহারের প্রদর্শনীটা এখনও করেননি এই তরুণ। বিপ্লব কত দূর যেতে পারবেন, তা হয়তো সময়ই বলে দিবে। তবে তার সামনে পড়ে আছে ‘বন্ধুর’ পথ, এটুকু নিশ্চিত।
বিপ্লবের বোলিংয়ে অনেক উন্নতি আবশ্যক। প্রতিনিয়ত শেখার, উন্নতি করার চেষ্টা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের ক্রিকেটে তারকাখ্যাতি পেতে সময় লাগবে না তার। উল্টো পিঠে, লক্ষ্য থেকে কক্ষচ্যুত হলে বিপ্লবের জন্যও অপেক্ষা করছে অগ্রজদের পরিণতি। অবশ্য তার ব্যাটসম্যান সত্ত্বাকে অসম্মান করার সুযোগ নেই। তবে লেগ স্পিনের নেশায় বুদঁ বিপ্লবের ব্যাটিংটা আগের অবস্থানে থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। সে প্রশ্নের উত্তরটা বরং সময়ের হাতেই তোলা থাক!