ফিরে আসা। ছোট্ট একটি কথা। কিন্তু এর যে অন্তর্নিহিত গুরুত্ব, তা আমরা কতটুকু বুঝি?
ধরুন কোনো এক দলের কোনো এক খেলোয়াডের কথা। বছরের পর বছর ধরে তিনি রয়েছেন দলের সাথে, সাক্ষী হয়েছেন দলের অনেক উত্থান-পতনের। আবার দলের উত্থান-পতনের সাথে সাথে উত্থান-পতন হয়েছে তার নিজের ক্যারিয়ারেও। ফর্ম হারিয়েছেন বেশ কয়েকবার, গোল মিসের মহরা দেখিয়ে দুয়ো পেয়েছেন নিজ দলের দর্শকদের কাছ থেকেই। দাবি উঠেছিল তাকে বিক্রি করে দেয়ারও। দলে তার থাকা না থাকা সমান এমনটাই ভাবা হচ্ছিল। এর মাঝে ক্যারিয়ারে আসল আরেকটি খারাপ সময়। বাদ পড়লেন জাতীয় দল থেকে, হারালেন অধিনায়কের বাহুবন্ধনীও। তাকে ছাড়া দল পেয়েছিল সর্বোচ্চ সাফল্য। কিন্তু তিনি কি দমে গিয়েছিলেন? নাহ, বরং ফিরে এসেছিলেন। তিনি করিম বেনজেমা।
বেনজেমার উত্থান হয় এক সোনালি সময়ে। ফ্রান্স সেসময় জেতে অনূর্ধ্ব-১৭ ইউরো। এই দলের তিন অপরিহার্য সদস্য ছিলেন সামির নাসরি, হাতেম বেন আরফা এবং করিম বেনজেমা। ফরাসি ফুটবলের পরবর্তী কাণ্ডারি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল তাদেরকেই। এরপর মাত্র ২২ বছর বয়সে তার ডাক আসে গত শতাব্দীর সেরা দল রিয়াল মাদ্রিদ থেকে। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ তখন মাদ্রিদে আরেক গ্যালাকটিকো তৈরির পরিকল্পনায় ব্যস্ত। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে রেকর্ড দামে কিনে এনেছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকেও। এভাবেই তাদের দল গোছানো হচ্ছিল। কিন্তু দলটি পুরোপুরি সাফল্যের মুখ দেখেনি সে সময়। কারণ, ঠিক একই সময়ে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনাও নিজেদের নতুনভাবে জানান দিচ্ছিল। ফুটবল তখন অপেক্ষায় ছিল বার্সেলোনায় আরেক গ্রেট লিওনেল মেসির উত্থানের। মেসির সেরাদের একজন হওয়ার পথে বাধা ছিল কেবল রোনালদো আর রিয়াল মাদ্রিদ। সে সময় রিয়াল মাদ্রিদকে বেশ ভালোরকমই নাকানিচুবানি খেতে হয়। তবে এর মাঝেই ২০১৩-১৪ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে নিজেদের ‘লা ডেসিমা’ পূর্ণ করে রিয়াল। অন্যদের পারফরম্যান্সের আড়ালে চলে যান করিম বেনজেমা। ততদিনে মাদ্রিদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘BBC’-ত্রয়ী, যার দুর্বলতা ভাবা হচ্ছিল কেবল এই বেনজেমাকেই।
গত এক দশক লা লিগার সব ব্যক্তিগত পুরস্কারে ভাগ বসাতেন হয় লিওনেল মেসি নয়তো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। কালেভদ্রে সুযোগ মিলত অন্যদের। এত বছর পর এবারই প্রথম তাদের ছাড়া লা লিগা হলো। এবার ভালো সুযোগ ছিল অন্যদের সামনে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন বেনজেমা; মৌসুম শেষে লা লিগায় তার গোলের সংখ্যা ২৭টি, সেই সাথে অন্যদের দিয়ে করিয়েছেন ১২টি। দুই ক্যাটাগরিতেই এবার তিনি রয়েছেন সবার শীর্ষে। লা লিগায় তার ব্যক্তিগত সেরা মৌসুমও ছিল এটি। এই শতাব্দীতে লিওনেল মেসি ছাড়া আর কারোরই লা লিগায় গোল-অ্যাসিস্ট দুই বিভাগেই শীর্ষে থাকার রেকর্ড নেই। এক যুগ ধরে বেনজেমা রয়েছেন রিয়ালের শিবিরে। কিন্তু কখনোই সেভাবে লাইমলাইটে আসতে পারেননি। হয় অন্যদের নৈপুণ্যের আড়ালে চলে গিয়েছিলেন, কিংবা নিজের ফর্মই হারিয়েছিলেন। কিন্তু এবার এই ৩৪ বছর বয়সী ফরাসী অসাধারণ নৈপুণ্যের প্রদর্শনী দিলেন, তাতে সবারই প্রশ্ন ছিল যে, “এই বেনজেমা এতদিন কোথায় ছিলেন!”
বার্নাব্যুর মতো মাঠে খেলার চাপ কম নয়। নিজেদের দর্শকদের প্রত্যাশা স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি থাকে। এর আগের মৌসুমগুলোয় হয়তো বা তিনি এই চাপ নিতে পারেননি। বা চাপ নিয়েছিলেন, কিন্তু তার অবদান অন্যদের আড়ালে চলে যায়। এখন ক্যারিয়ারের শেষের দিকে এসে নিজের এত বছরের অভিজ্ঞতা, সেই সাথে খালি মঞ্চ পেয়ে নিজের সব ঢেলে দিয়েছিলেন একসাথেই।
২০১৫ সালের ব্যালন ডি’অরের পর একটি দৃশ্য সবার চোখে লেগেছিল। তা হচ্ছে যখন ব্যক্তিগত পুরস্কার নিয়ে মাঠে দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণ করছিলেন রোনালদো, ক্রুস, রামোস ও হামেস রদ্রিগেজ। তাদের পেছনে তখন দাঁড়িয়ে হাসিমুখে তালি দিচ্ছিলেন বেনজেমা। সতীর্থের সাফল্যে এমন খুশি হতে পারেনই বা ক’জন?
২০১৭ রোনালদো মাদ্রিদ ছেড়ে তুরিনে পাড়ি জমানোর পর রিয়াল একজন ক্লিনিক্যাল ফিনিশারের অভাবে ভুগছিল। রোনালদোর রেখে যাওয়া ৭ নাম্বার জার্সি দেওয়া হয় মারিয়ানো দিয়াজকে। সেই মৌসুমে ৭ নাম্বার জার্সির একরকম অপমানই করে ছাড়েন তিনি। এরপর কাগজে-কলমে রোনালদোর পজিশনে খেলা ভিনিসিয়াসের ফিনিশিং ছিল একদম বাজে। তখন থেকেই দলের একমাত্র রক্ষাকর্তা বনে যান বেনজেমা।
এই ২০২১-২২ মৌসুমের বেনজেমার পা থেকে মোট গোল আসে ৪৪টি। ইউরোপীয় গোল্ডেন বুটের দৌড়ে তার উপরে আছেন কেবল ৩৫ গোল করা রবার্ট লেভানডফস্কি ও ২৮ গোল করা কিলিয়ান এমবাপে। সিরো ইমোবিলের গোল বেনজেমার সমানসংখ্যক, ২৭টি।
এখন বেনজেমা কি শুধুই একজন নাম্বার নাইন ফরোয়ার্ড, যার কাজ শুধুই গোল করা? একদমই তা নয়। আপনি যদি তাকে একজন কমপ্লিট ফুটবলার বলতে না-ও চান, একজন কমপ্লিট ফরোয়ার্ড বলতেই হবে। ডি-বক্সের মধ্যে তিনি শেয়ালের মতো ক্ষিপ্র হতে পারেন, দরকার পড়লে উইং থেকে বল সাপ্লাই করবেন, কিংবা পাসিং হাব হিসেবে খেলে বাকিদের জন্য ফাঁকা জায়গায় বল দেবেন, আবার মেকি দৌড় দিয়ে ডিফেন্ডারকে তার সাথে সরিয়ে নিয়ে অন্যদের জন্য ফাঁকা জায়গা তৈরি করে দেবেন, কিংবা বিশেষ প্রয়োজনে মিডফিল্ডে নেমে এসে মিডফিল্ডারদের সাহায্য করবেন। যখন থেকে আইকনিক ত্রয়ী ‘BBC’ তৈরি হয়, তখন থেকেই মাঠে তার ভূমিকা একই রয়েছে। এই ক’বছরে তার বয়স ছাড়া অন্য কিছুর পরিবর্তন হয়নি।
রিয়াল মাদ্রিদ তাদের দল গঠনের সময় কিছু নির্দিষ্ট কাঠামো অনুসরণ করে। গ্যালাকটিকো মডেলে তারা চায় তাদের আক্রমণভাগের ৩ জন ৩ মহাতারকা থাকুক। কিন্তু সবসময় মহাতারকাদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া পাওয়া যায় না। এই দিক দিয়ে ‘BBC’ যথেষ্ট ব্যতিক্রমী ছিল। সেখানে উইংয়ে খেলা রোনালদোর সমর্থনে সবসময় গিয়ে হাজির হতেন স্ট্রাইকার হিসেবে খেলা বেনজেমা, যেখানে অন্য যে কেউ থাকলে হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। এই ত্রয়ীর আমলেই মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতে চারবার, আর লা লিগা জেতে মাত্র একবার। এখানে আসলে নির্দিষ্ট করে কোনো খেলোয়াড়কে দোষারোপ করাটাও শোভন নয় বৈকি। কারণ সে সময়ের রিয়াল মাদ্রিদটাই ছিল এমন যে হুটহাট তারা খেই হারাত। ফলে লিগে তাদের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যেত না। কিন্তু ইউসিএলের মতো বড় মঞ্চে বড় প্রদর্শনীর জন্য তারা ছিল সবসময় প্রস্তুত।
তারকা-সমৃদ্ধ ত্রয়ী থেকে বের হয়ে গত তিন মৌসুম ধরে রিয়াল নির্ভরশীল ছিল বেনজেমার উপর। এই তিন বছরে দলকে বহু চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে। এর মাঝে একটি ট্রফিলেস মৌসুমও কেটেছে। কিন্তু অবশেষে অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়েছে তাদের। লা লিগার পাশাপাশি ইউসিএল জয়ে যে কারোর ভূমিকার চেয়ে এগিয়ে থাকবে বেনজেমার ভূমিকাটা।
একটা ছোট পরিসংখ্যান এখানে যোগ করি। এই মৌসুমে বেনজেমার প্রতি ৯০ মিনিটে গড়ে বলের টাচের সংখ্যা ৫৩টি, আর পাস প্রাপ্তির সংখ্যা ৪০টি। রিয়ালের ইতিহাসে যেকোনো মৌসুমে এটিই সর্বোচ্চ। BBC-ত্রয়ী যে মৌসুমে তৈরি হয়, সেই ২০১৩-১৪ মৌসুমে এই সংখ্যাটা ছিল ৩৮ ও ২৬। এই পরিসংখ্যান দেখিয়ে দেয় ২০১৪ সালে দলে বেনজেমার গুরুত্ব বর্তমানে সময়ের তুলনায় কত কম ছিল। তার কাজ তখন ছিল শুধু তার দুইপাশের উইঙ্গারদের জন্য জায়গা তৈরি করে দেয়া। এই কৌশলে বেল তার রকেটের মতো গতি দিয়ে রক্ষণভাগকে ছিঁড়েফুঁড়ে ভেতরে ঢুকে যেতেন, আর রোনালদোর কাজ ছিল শুধু গোল করা। মানে কফিনে শেষ পেরেকটা তিনিই মারতেন। তাহলে বেনজেমার মধ্যে এত পরিবর্তন কীভাবে?
বর্তমানে মাদ্রিদের আক্রমণের নিউক্লিয়াস হচ্ছেন বেনজেমা। সেই সাথে দলে এখন কার্লো আনচেলত্তির খুবই ফ্লেক্সিবল কৌশল। বেনজেমার মুখ থেকে শোনা যায় যে একজন নাম্বার নাইন হিসেবে যে তিনি শুধু বক্সেই থাকবেন, তা হতে পারে না। তাকে নিচে নেমে আসতে আসবে এবং দলের প্রয়োজনে যা করা দরকার তা করতেই হবে। প্লেমেকিংয়ের দিক দিয়ে ২০২১-২২ মৌসুমে তার থেকে এগিয়ে থাকবেন শুধু লিওনেল মেসি। তবে স্বাভাবিকের তুলনায় খারাপ একটি মৌসুম পার করা মেসির চাইতে তার গোল ঢের বেশি। সুযোগ তৈরি করে দেয়ার দিক দিয়ে বেনজেমা রয়েছেন মেসি ও দিমিত্রি পায়েটের পরই।
ইউরোপের প্রথম সারির প্রধান ৫টি লিগে এই মৌসুমের টপ স্কোরার একজন নাম্বার নাইন। তিনি রবার্ট লেভান্ডফস্কি। ৩৫টি গোল নিয়ে তার অবস্থান সবার উপরে। কিন্তু তার অ্যাসিস্টের সংখ্যা? সেটা বেনজেমার কিছু বিশেষ ম্যাচে অ্যাসিস্টের সংখ্যা থেকেও কম। আর ২৮ গোল নিয়ে ২য় থাকা এমবাপ্পের অ্যাসিস্ট বেনজেমার অর্ধেক। তো এখানেও আমরা বলতে পারছি যে বেনজেমা শুধু একজন নাম্বার নাইন নন, বরং আরো বেশি কিছু।
তবে ফুটবল একটি দলীয় খেলা। আপনি যত বড় মাপের খেলোয়াড় হন না কেন, যদি দলগত বোঝাপড়া ভাল না থাকে তবে আপনার একক নৈপুণ্যে দলকে কখনো জেতাতে পারবেন না। রোনালদোর চলে যাওয়া, বেলের দল থেকে বাদ পড়া, ইনজুরি আর জঘন্য অফ ফর্মের জন্য আজারের বাদ পড়া এইরকম কিছু ঘটনা ঘটায় দীর্ঘদিন একজন যোগ্য সঙ্গীর অভাবে ভুগছিলেন বেনজেমা। পেরেজ তার জন্য এনে দিয়েছিলেন টিনএজার ভিনিসিয়াস জুনিয়রকে। কিন্তু ভিনিসিয়াসের বাকি সব ঠিক থাকলেও ফিনিশিং ছিল অতি জঘন্য। তবে এই দুর্বলতাগুলো ঠিক করে ভিনিসিয়াস হয়ে উঠেছেন বেনজেমার যোগ্য সেকেন্ড-ইন-কমান্ড।
খুব বেশি না, মাত্র দেড় বছর আগেও এই বেনজেমা ইউসিএলের একটি খেলার হাফটাইমে ফারল্যান্ড মেন্ডিকে বলছিলেন ভিনিসিয়াসকে পাস না দিতে। কেন? কারণ ভিনিসিয়াস দলের পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে খেলছিলেন। দল যেভাবে পরিকল্পনা করে মাঠে নেমেছিল, তার প্রায় পুরো উল্টোটাই তখন করছিলেন তিনি। দলের চেয়ে নিজের পরিসংখ্যান বাড়ানোর দিকে তার নজর ছিল তখন এই ছোট বয়সেই। কিন্তু এতে না লাভ হতো তার, না লাভ হতো ক্লাবের। উলটো এই নিয়ে পুরো ফুটবল বিশ্বে শুরু হয় ব্যান্টারিং। সেই মুহূর্তে ভিনিসিয়াসের দরকার ছিল একজন ভাল মেন্টরের, যিনি তাকে ভালোভাবে গাইড করে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সৌভাগ্যের বিষয় যে ভিনিসিয়াস এমন একজন হিসেবে বেনজেমাকেই পেয়েছিলেন। একজন তরুন খেলোয়াড়ের মাথায় ঢুকে সেখানে সবকিছুকে ঠিকমতো সাজাতে যে এই ফরাসী ভালোই দক্ষ, তা এই ভিনিসিয়াসের ঘটনায় পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়। আর এই অবদানই ভিনিসিয়াসকে সাহায্য করেছে গ্যালাকটিকোর একজন হয়ে উঠতে। মাদ্রিদের দুইটি শিরোপা জয়ে এই দুইজনের মিলিত অবদান সবচেয়ে বেশি। তাদের এখানে যদি আলাদাভাবে বা একসাথেও হিসেবে ধরি, তবে তাদের দুইজন গত ২০২১-২২ মৌসুমে লা লিগার সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত হবেন। শুধুই কি লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগও নয় কি?
মৌসুমের শুরুতে মাদ্রিদের দলটি দেখে কিছুটা বিধ্বস্তই মনে হচ্ছিল। সম্ভাবনাময় অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ওডেগার্ডকে আর্সেনালের কাছে বিক্রি করে দেওয়ায় স্কোয়াড ডেপথ কমে যায় অনেকটাই। সেই সাথে অনেক বর্ষীয়ান খেলোয়াড়ের রিপ্লেসমেন্টও আনা সম্ভব হয়নি। আবার একই মৌসুমে ভারানে ও রামোস জুটিকে হারিয়ে শঙ্কা ছিল আক্রমণভাগে একটি বড় রকমের ভরাডুবির। অন্যদিকে, লা লিগার দুই শিরোপাপ্রত্যাশী বার্সেলোনা ও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের ঘরে আগুন লাগায় তারাও এই মৌসুমে বেশ বাজে খেলে মৌসুম শেষ করে। এমনকি গ্রুপপর্বে তৃতীয় হয়ে ইউরোপা লিগে অবনমন হয় বার্সেলোনার। সেখানেও ইউরোপা চ্যাম্পিয়ন হওয়া স্টুটগার্টের কাছে ঘরের মাঠ ক্যাম্প ন্যুতেই হয় চরম ভরাডুবি। তো লিগ জেতার জন্য রিয়ালের সামনে মাঠ প্রায় ফাঁকাই ছিল। তারা মৌসুমের শুরুতে এটিকে একটি ‘গুড’ মৌসুমে বানানোর চিন্তার ছিল। কিন্তু এই মৌসুমটি তাদের জন্য হয়ে দাঁড়ায় একটি ‘গ্রেট’ মৌসুমে।
তবে এই ৩৪ বছর বয়সী স্ট্রাইকার জানেন যে তার সময় আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে। জানে রিয়াল মাদ্রিদ কর্তৃপক্ষও। বেনজেমাকে ছাড়া মাঠের খেলা কেমন হবে, তা সাজানোর প্রক্রিয়াও হয়তো এরই মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে এত পাওয়ার মধ্যেও একটা জিনিস অধরাই ছিল সবসময় বেনজেমার সামনে, সেটি হলো ব্যালন ডি’অর। এত বছর প্রথম সারির ফুটবলারদের মধ্যে থেকেও, বেশ কয়েকবার শিরোপাজয়ী দলের সদস্য হয়েও, তার সুযোগ হয়নি সেই সোনালী রঙের বলটির ছোঁয়া পাওয়ার। বারবার তার সামনে দিয়ে এটি নিয়ে যাচ্ছিলেন সতীর্থ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের লিওনেল মেসি, এমনকি মাঝে আরেক সতীর্থ লুকা মদরিচও জিতেছিলেন একবার। তবে এবার হয়তো বা স্বর্ণালী সুযোগ একদম সামনে। দলীয় অর্জন বলুন কিংবা ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান, দুই জায়গাতেই বেনজেমা এখন অন্য যেকোনো ফুটবলারের চাইতে এগিয়ে। এছাড়া আগামী নভেম্বরে আসছে ফুটবল বিশ্বকাপ, সেখানেও তার সামনে সুযোগ রয়েছে জাতীয় দলের হয়ে ২০১৪ সালের পর আবারও নিজেকে উজাড় করে দেয়ার।
ফুটবলে ব্যক্তিগত অর্জনের মধ্যে ব্যালন ডি’অরকে তর্কসাপেক্ষে বর্তমানের সেরা ফুটবলারের মুকুট বলা হয়। রেকর্ড ৭ বার এই খেতাব জিতেছেন লিওনেল মেসি। সেই মেসির মতেও এবারের ব্যালন ডি’অর পাবার একমাত্র যোগ্য দাবিদার করিম বেনজেমা। গত মৌসুমের ব্যালন বিজয়ী এ নিয়ে বলেন,
“এখানে কোনো সংশয় নেই। পরিষ্কারভাবেই বেনজেমা দুর্দান্ত একটা বছর পার করেছে এবং শেষ করেছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের মাধ্যমে। শেষ ১৬-র লড়াই থেকে একদম শেষ পর্যন্ত প্রতিটি খেলাতেই সে ছিল দলের জন্য অপরিহার্য। আমি মনে করি এই বছর কোনো সংশয় নেই (ব্যালন জয়ে) এখানে।”
ম্যাথিউ ভালবুয়েনার সেক্স-টেপ কেলেংকারিতে জায়গা হারিয়েছিলেন বেনজেমা, এবারের ইউরো দিয়েই জাতীয় দলের হয়ে বড় মঞ্চে প্রত্যাবর্তন করেন। ইউরোর ফলাফল তাদের পক্ষে যায়নি মোটেও। উলটো সুইজারল্যান্ডের মতো দলের কাছে শেষ মুহূর্তে দুই গোল খেয়ে এরপর টাইব্রেকারে গিয়ে হেরে যায় তারা। বেনজেমা কিন্তু সেখানে নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করে গিয়েছিলেন, তবে সুবিধা করে ওঠা যায়নি। আবার নিজের এই নৈপুণ্য ধরে রেখেছিলেন নেশন্স লিগের জন্যও। স্পেনকে হারিয়ে পরে নেশন্স লিগের দ্বিতীয় মৌসুমের বিজয়ী হয় ফ্রান্স।
এত কিছুর পরও বেনজেমাকে আপনার ব্যালন বা ফিফা বেস্টের যোগ্য দাবিদার মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার এইরকম প্রদর্শনী এবার ছিল রীতিমতো অতিমানবীয়। মেসি-রোনালদোর মতো দুই সর্বকালের সেরাদের মধ্যে থাকায় এতদিন তিনি স্পটলাইট পাননি সেভাবে। তবে তাদের ক্যারিয়ার এখন অনেকটাই বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে, এ বছর তাই অনেকটাই খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসার সুযোগ পেয়েছেন বেনজেমা। আর তাদের অনুপস্থিতিতে লা লিগাকে মাতিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এমন ভাঙাচোরা দল আর বেশ কিছু তরুণ সতীর্থকে নিয়ে লা লিগা জয়ের পাশাপাশি জিতেছেন উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে রিয়াল হারিয়ে এসেছে পিএসজি, চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটি ও লিভারপুলের মতো ক্লাবকেও। এর মধ্যে পিএসজির সাথে দ্বিতীয় লেগে একাই ‘করিম বেনজেমা শো’ দেখিয়ে রিয়ালকে নিয়ে গিয়েছিলেন কোয়ার্টার ফাইনালে। এরপর সেমিফাইনালে রিয়াল ম্যানচেস্টার সিটির ফাইনালে যাওয়া আটকিয়ে দেয় অতিরিক্ত যোগ করা সময়ে ২ গোল করে। পুরো মৌসুমই বলতে গেলে ফুটবল-বিশ্ব সাক্ষী হয়েছে এই ‘করিম বেনজেমা শো’-এর। এমন পারফরম্যান্সের পর ব্যালন ডি-অর যে তারই সবচেয়ে বেশি প্রাপ্য, সেটা বলাই বাহুল্য। আর তাই তিনি সেটা এবার না পেলেই অত্যন্ত আশ্চর্য ব্যাপার বলে ঠাহর হবে বৈকি।