লিভারপুলের পরিবেশ গত দুই বছরে হুট করে বদলে গেছে। আসলে বদলেছেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। তার ছোঁয়ায় ক্লাবের প্রায় সকল দিকে পরিবর্তনের জোয়ার এসেছে। তিনি এসে সমর্থকদের হারিয়ে ফেলা স্বপ্ন আবার নতুন করে দেখার শক্তি দিয়েছেন, দলটাকে তার মতো সাজিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্ত সবদিকে উন্নতি লক্ষ্য করা গেলেও একটি দিকে কোনো উন্নতি হয়নি বললেই চলে। ইয়ুর্গেন ক্লপ দায়িত্ব নেবার পরও লিভারপুল কোনো শিরোপা জিততে পারেনি।
লিভারপুলের দায়িত্ব নেবার পর ক্লপের সবথেকে বড় সাফল্য লিভারপুলকে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে তোলা। হয়তো ফাইনাল জিতে ইতিহাসটাও রচনা করে ফেলতে পারতেন যদি ভাগ্য এবং সবকিছু তাদের বিপক্ষে না থাকতো। মোহাম্মদ সালাহ ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে ম্যাচের প্রথম ৩০ মিনিটের মাথাতেই মাঠ ছাড়লেন, লরিস কারিওস করলেন শিশুসুলভ ভুল, আর সেদিন লিভারপুলের খেলার ধরণও তেমন জুতসই ছিলো না। ক্লপ বুঝেছিলেন, তার হাই প্রেসিং ফুটবলের সাথে পুরো মৌসুম খেলার জন্য বর্তমান স্কোয়াড যথাযথ না। আর যদি লিভারপুল আসলেই চ্যাম্পিয়নস লিগে টিকে থাকতে চায় বা প্রিমিয়ার লিগ জিততে চায়, তাহলে লাগবে সবদিক থেকে শক্তিশালী একটি দল। যেখানে মোহাম্মদ সালাহ বা জর্দান হেন্ডারসন বা রবার্তো ফিরমিনো মাঠে না নামলেও যেন সমস্যা না হয়।
ব্রেন্ডন রজার্সের রেখে যাওয়া লিভারপুল দলের সাথে ক্লপের দলটির দিকে তাকালে বোঝা যাবে পরিবর্তনের মাত্রা কতটুকু। ক্লপ আক্রমণাত্মক ফুটবলে বিশ্বাসী, বিশ্বাসী দ্রুতগতির ফুটবলে আর গোল করতে। তাই তিনি প্রথমে আক্রমণের দিককে মেরামত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্ত আক্রমণদিকে ঠিকঠাক করলেও ক্লপের দলে রক্ষণ ও মধ্যমাঠের অবস্থা ছিলো বেহুলার বাসরের মতো। কিন্ত সবদিকে পরিবর্তন তো আর একই মৌসুমে আনা সম্ভব নয়। তাই ক্লপ সময় নিলে পুরো দুটি মৌসুম। এবং অবশেষে তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ স্কোয়াড পেয়েছেন যা নিয়ে প্রিমিয়ার লিগ থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগ সবখানে মাথা তুলে লড়তে পারবেন।
প্রথমে আসা যাক গোলরক্ষক পজিশনে। প্রথমদিকে ক্লপের প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক ছিলেন সিমিওনে মিনিগোলেত। কিন্ত ক্লপ এবং লিভারপুল ধীরে ধীরে তার উপর শুধু আস্থাই হারিয়েছেন। মিনিগোলেত মধ্যমমানের গোলরক্ষক হলেও সেই মধ্যমমানের পারফর্মেন্সই তিনি সবসময় দিয়েছেন কি না সন্দেহ আছে। তাই এবার চ্যাম্পিয়নস লিগে তাকে বদলে লরিস কারিওসকে সুযোগ দিয়েছিলেন।
লিভারপুলে আসার পর কারিওসকে ক্লপই কিনেছিলেন মেইঞ্জ থেকে। তিনিও ঠিকঠাক ছিলেন, কিন্ত শেষ সময়ে এসে তিনিও আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি। ক্লপ ভাবলেন, এবার পরিবর্তন দরকার। এবং ক্লপের পরিবর্তন ছিলো বড় ধরনের বিস্ফোরণ। রোমা থেকে রেকর্ড পরিমাণ ট্রান্সফার ফির বিনিময়ে তিনি দলে এনেছেন অ্যালিসন বেকারকে, যিনি বর্তমান ফুটবলের অন্যতম সেরা গোলরক্ষকদের একজন হিসেবে নিজেকে খুব দ্রুত প্রমাণ করেছেন। অ্যালিসন আসার পর খুব সম্ভবত মিনিগোলেতকে বিক্রি করে দিতে আগ্রহী লিভারপুল। তাই দ্বিতীয় পছন্দের গোলরক্ষক লরিস কারিউস আর অ্যালিসন থাকার দরুণ গোলরক্ষক পজিশনে ক্লপের মনে হয় না আর দ্বিতীয়বার ভাববেন।
মার্টিন স্কার্টেল, ব্রাড স্মিথ ও চূড়ান্ত রকমের ফ্লপ সাখোকে বিক্রি করে দিলে লিভারপুলের রক্ষণ অনেকটাই ফাঁকা হয়ে গিয়েছিলো। রাগনার ক্লাভান ও জোয়েল মাটিপকে কিনলেও তারা কুঁড়িই থেকে গেছেন। প্রিমিয়ার লিগে সেভাবে ফুটে উঠতে পারেননি। তাই ক্লপের দরকার ছিলো একদম বিশ্বমানের একজন ডিফেন্ডারের। কয়েক দফা চেষ্টার পর তিনি রেকর্ড গড়ে কিনেছেন ভার্জিল ভ্যান ডাইককে। একসময়ের সমস্যা এবার তাই আর প্রকট রূপ ধারণ করতে পারবে না।
বেঞ্চে ক্লাভান ও মাটিপ থাকার কারণে বিপদে পরিস্থিতি সামাল দেবার মতো অস্ত্র থাকবে ক্লপের কাছে। কিন্ত এ মৌসুমে লিভারপুল রক্ষণে কোনো পয়সা খরচ করেনি। একসময় লিভারপুলের ফুলব্যাকের দায়িত্বে নাথান ক্লাইন ও আলভারো মরেনো ছিলেন। তাদের অনুপস্থিতিতে বর্তমানে জায়গা পাকা করে ফেলেছেন ট্রেন্ট আলেক্সজান্ডার-আর্নল্ড ও অ্যান্ড্রু রবার্টসন। কিন্তু তারা দুজনেই আক্রমাণত্মক ফুলব্যাক। পজিশন ছেড়ে আক্রমণে অংশ নিলে তখন দেয়ান লভরেন একা সামাল দিতে পারবেন তো? রক্ষণে পুরনো সেই সমস্যা না থাকলেও শুধুমাত্র এ প্রশ্নটি থেকে যায়।
মিলনার, হেন্ডারসন, ওয়াইনালদুম অথবা হেন্ডারসন, চ্যান, মিলনারদেরই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মধ্যমাঠে ব্যবহার করেছেন ক্লপ। কিন্ত সমস্যা হলো এদের সবাই আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার। বর্তমান ফুটবল ফর্মেশনে তিনজন আক্রমণাত্মক ফুটবলার, যারা রক্ষণে তেমন পারদর্শী না, তাদের দিয়ে স্কোয়াড সম্পূর্ণ হয় না। গত মৌসুমে লিভারপুল চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল পর্যন্ত গেলেও মাঝমাঠে এই দুর্বিষহ সমস্যা বহাল তবিয়তে ক্লপের ঘাড়ে ঝুলে ছিলো। কিন্ত ক্লপ এবার এই সমস্যা সমাধান করে ঈর্ষণীয় এক মধ্যমাঠ বানিয়ে ফেলেছেন।
এবার ক্লপ খুব পরিকল্পিতভাবে পজিশন অনুযায়ী খেলোয়াড় কিনেছেন। যেমন- নাবি কেইতা। কেইতার আসা নিশ্চিত ছিলো অনেক আগেই। তবে তিনি দলে যোগ দিয়েছে এ মৌসুমে। আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হলেও কেইতা রক্ষণ ও আক্রমণ অদলবদল করে খেলেন। ফলে একদম রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের উপর চাপ কম হয়। একপাশে হেন্ডারসন ও অন্যপাশে কেইতাকে রেখে মাঝে থাকবেন ফ্যাবিনহো, যাকে মোনাকো থেকে এ মৌসুমে কিনেছে লিভারপুর।
একসময়ে ফ্যাবিনহো মূলত রাইটব্যাকে খেলতেন। তবে এখন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড এবং সেন্ট্রাল মিডফিল্ডেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ক্লপের খেলার ধরণ অনুযায়ী ফ্যাবিনহোর ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলার সম্ভাবনা বেশি। তবে তিনি মাঝমাঠের রক্ষণ সামলানোর পাশাপাশি মাঝে মাঝে আক্রমণেও সহায়তা করতে পারেন। মোনাকোর হয়ে গত মৌসুমের পারফর্মেন্স দেখলে এমন তথ্যই পাওয়া যায়। অালেক্স অক্সালিড-চেম্বারলিন এ মৌসুমে ইনজুরি থেকে না-ও ফিরতে পারেন। তাতে এই তিনজনের বদলি হিসেবে ওয়াইনালদুম, মিলনার ও লাল্লানা তৈরি থাকবেন বেঞ্চে।
লিভারপুলের আক্রমণভাগ এমনিতেই ধারালো। ইউরোপের অন্যতম ভয়ংকর আক্রমণত্রয়ী এবার আরও ভয়ংকর হবে পর্যাপ্ত বিশ্রামের কারণে। কারণ প্রিমিয়ার লিগের জটিল শিডিউলের ভেতর কম গুরুত্বপূর্ণ বা নিম্নসারির দলের সাথে স্কোয়াডে থাকবেন জেদরান শাকিরি, যিনি মানে ও সালাহর বদলে মাঠে নামবেন। আর ফিরমিনোর বদলি খেলোয়াড় হিসেবে ক্লপ এবার অাস্থা রাখছেন ড্যানিয়েল স্টারিজের উপর।
ক্লপ সাধারণত ৪-৩-৩ ফর্মেশনেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কিন্ত এ মৌসুমে তিনি তার চিন্তাভাবনা বদল করে আরও আক্রমণাত্মক কৌশল অবলম্বন করতে পারেন। ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে শাকিরিকে ফ্রি রোলে নামালে স্কোয়াডের শক্তি যেমন আরো বেড়ে যায়, তেমনই হাই প্রেসিং ফুটবল খেলার প্রবণতা বেশি থাকে।
ক্লপ বুঝতে পেরেছিলেন, দুর্বল রক্ষণ ও মধ্যম মানের মিডফিল্ডারদের নিয়ে লিভারপুল বেশি দূর যেতে পারবে না। আর পর্যাপ্ত খেলোয়াড় না নিয়ে বা খর্বশক্তির দল নিয়ে তার হাই প্রেসিং ফুটবলও খাটবে না। সেই সাথে মানে, ফিরমিনো বা লভরেনের মতো গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়রাই বেশি মাত্রায় ইনজুরিপ্রবণ। আবার তার নিজের ট্যাকটিসের কারণে গত মৌসুমে অনেক খেলোয়াড়ই ইনজুরিতে ভুগেছেন। তাই পূর্ণাঙ্গ একটি দল থাকলেও চাপে ক্লপ নিজেই। তিনি কি এবার পারবেন দুর্দান্ত এ দলটির যথাযথ ব্যবহার করে অলরেডদের শিরোপা-স্বপ্ন পূর্ণ করতে?
ফিচার ইমেজ: Getty Image