১.
সময়টা ১৯৮৩ সাল, জুন মাসের ১৮ তারিখ। গ্রীষ্মকাল চলছে ইংল্যান্ডে। চমৎকার আবহাওয়া, মৃদু বাতাস বইছে। মাথার উপরে সহনীয় মাত্রায় তাপ ছড়াচ্ছে সূর্য। সব মিলিয়ে ব্যাটিং করার জন্য আদর্শ পরিবেশ যাকে বলে। বিশ্বকাপের একটা ম্যাচ খেলার জন্য টস করতে নামলেন কপিল দেব আর ডানকান ফ্লেচার। টসে জিতলেন কপিল, চোখ বন্ধ করে ব্যাটিং নিলেন তিনি।
কিন্তু বিধিবাম! সম্পূর্ণ ‘ব্যাটিং’ পিচে হুট করেই আগুন ঝরাতে শুরু করলেন জিম্বাবুয়ের দুই বোলার পিটার রসন আর কেভিন কারেন। স্কোরবোর্ডে কোনো রান ওঠার আগেই ফিরে গেলেন সুনীল গাভাস্কার, দলীয় ৬ রানে ফিরলেন আরও দুই ব্যাটসম্যান কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত আর মহিন্দর অমরনাথ।
৯ রানে চতুর্থ উইকেট হিসেবে আউট হলেন সন্দ্বীপ পাতিল। আর তখনই ক্রিজে এলেন কপিল দেব। আসার কিছুক্ষণের মধ্যে আরও এক সতীর্থকে হারালেন, তার নাম যশপাল শর্মা। স্কোর তখন ১৭/৫, ভয়াবহ ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে গেছে ভারত!
এরপর কী হয়েছিল, তা পাঠক জানবেন অবশ্যই। তবে তার আগে ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ থেকে একবার ঘুরে আসা যাক।
২.
আগের দু’বারের মতো ক্রিকেট বিশ্বকাপের তৃতীয় আসরও ইংল্যান্ডেই বসেছিল, তবে সেবার স্বাগতিক হিসেবে তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল ওয়েলসও। মোট আটটি দল অংশ নিয়েছিল সে আসরে। চার দল করে আটটি দলকে ভাগ করা হয় দুই গ্রুপে। গ্রুপ এ’তে ছিল ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, নিউ জিল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কা, গ্রুপ বি’তে ছিল অস্ট্রেলিয়া, জিম্বাবুয়ে, ভারত আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
নিজেদের প্রথম ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়াকে ১৩ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপের অন্যতম বড় অঘটনের জন্ম দেয় জিম্বাবুয়ে। আগের দু’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৩৪ রানে হারিয়ে আরেক অঘটন ঘটায় ভারত। মনে রাখা প্রয়োজন, ওয়ানডেতে ভারত তখনও দুর্বল দল হিসেবেই বিবেচিত হতো। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পরের ম্যাচেও পাঁচ উইকেটের জয় পায় কপিল দেবের দল। কিন্তু তারপরই অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টানা দুইটি ম্যাচে হেরে খাদের কিনারায় চলে যায় তারা। হারগুলো হয়ও শোচনীয়ভাবে, যার ফলে রানরেট বেশ কমে যায় অস্ট্রেলিয়ার তুলনায়।
এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় ছিল একটাই। পরের দুই ম্যাচে জিততে হতো ভারতকে। সেই দুই ম্যাচের প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে ভারত।
৩.
ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে এলেন রজার বিনি। তাকে নিয়ে ৬০ রানের একটা সময়োপযোগী পার্টনারশিপ গড়লেন কপিল। ব্যক্তিগত ২২, আর দলীয় ৭৭ রানে আউট হলেন বিনি, উইকেটে এলেন রবি শাস্ত্রী। স্কোরবোর্ডে ১ রান যোগ করে তিনিও হাঁটা ধরলেন সাজঘরের দিকে। কপিল তখনও আছেন বটে, কিন্তু কেউ যদি তাকে সঙ্গ না দেয়, তবে তারও করার কিছু থাকবে না।
এরপর এলেন মদন লাল। তার সাথে আরেকটা কার্যকরী জুটি গড়লেন কপিল, দলকে নিয়ে গেলেন ১৪০ পর্যন্ত। তারপর কারানের বলে মদন লাল ধরা পড়লেন উইকেটকিপার ডেভ হটনের হাতে।
৮ উইকেট পড়ে গেল। জিম্বাবুয়ের ক্যাপ্টেন ডানকান ফ্লেচার হয়তো তখন ১৫০ রানের মধ্যে প্রতিপক্ষকে আটকে ফেলার স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু তার স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন নবম উইকেট হিসেবে নামা সৈয়দ কিরমানি। নিজে যে অনেক রান করে ফেললেন, তা নয়। কিন্তু কপিলের সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার ছিল, সেটাই দিলেন তিনি।
নামার পর থেকেই রয়েসয়ে খেলছিলেন কপিল, ঝুঁকি প্রায় নিচ্ছিলেনই না। কিরমানি নামার পরে হাত খোলা শুরু করলেন তিনি। এক ইন্টারভিউয়ে কিরমানি বলেছিলেন, ‘ক্রিজে এসে ক্যাপ্টেনকে তার স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে বললাম।‘
পুল, হুকসহ বিভিন্ন শটের পসরা সাজিয়ে বসলেন যেন। এই জুটিতে এলো ১২৬ রান। সে সময় ৬০ ওভারে এক ইনিংস হতো, ৪৯তম ওভারে সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন কপিল, লাগল মাত্র ৭২ বল। এবং তার পরের ১১ ওভারেই করলেন ৭৫ রান! একদিনের ক্রিকেটের বয়সই তখন মাত্র ১২ বছর, টি-টোয়েন্টির নামও শোনেনি কেউ। আর নবম উইকেট জুটিতে ১২৬ রান রেকর্ড হয়ে ছিল প্রায় ২৭ বছর, ২০১০ সালে এই রেকর্ড ভেঙে দেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস আর লাসিথ মালিঙ্গা।
ইউটিউবে গেলে অনেক পুরাতন ম্যাচ কিংবা ইনিংসেরও ভিডিও পাওয়া যায়। দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, কপিলের সেই অসাধারণ ইনিংসের ভিডিও ফুটেজ কারো কাছেই নেই। তখন টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ছিল কম, খেলা সম্প্রচারের দায়িত্বে ছিল বিবিসি। এই ম্যাচের দিন বিবিসির কর্মীরা কোনো এক কারণে ধর্মঘটে ছিলেন, মাঠে তাই ছিল না কোনো ক্যামেরাম্যান। কিছু ছবি ছাড়া এই ইনিংসের আর কোনো ফুটেজই নেই।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আর উইকেট পড়ল না, কপিল আর কিরমানি মিলেই ইনিংস শেষ করলেন। এই দু’জন যখন ফিরছেন, তখন ভারতের রান ২৬৬। কপিলের রান ১৭৫, ১৬টি বাউন্ডারি আর ৬টি ওভার বাউন্ডারিতে এই রান তিনি করেছিলেন মাত্র ১৩৮ বলে। আর কিরমানি করেছিলেন ইনিংসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ২৪ রান!
৪.
৬০ ওভারে ২৬৭ রান সে সময়ে খুব সহজ লক্ষ্য ছিল না। তবে রান তাড়া করতে নেমে শুরুটা মন্দ হলো না জিম্বাবুয়ের, বিনা উইকেটে ৪৪ তুলে ফেললেন দুই ওপেনার রবিন ব্রাউন আর গ্র্যান্ট প্যাটারসন। তখনই প্যাটারসনকে এলবিডব্লিউ’র ফাঁদে ফেলে কপিলকে উইকেট এনে দিলেন রজার বিনি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জিম্বাবুয়ে পরিণত হলো ৬১/৩ এ, ফিরে গেলেন জ্যাক হেরন আর অ্যান্ডি পাইক্রফটও।
ব্রাউন তখনও আছেন, সামলে নেয়ার চেষ্টা করছেন বিপর্যয়। কিন্তু দলের রান যখন ৮৬, তখন আউট হয়ে গেলেন তিনি, তার উইকেটটা নিল দুর্ভাগ্য! দুর্ভাগ্যই বটে। রান আউট হয়ে গেলেন তিনি।
ক্রিজে তখন ডেভ হটন আর ক্যাপ্টেন ডানকান ফ্লেচার। এই ঘটনার প্রায় ৮ বছর পরে টেস্ট স্ট্যাটাস পায় জিম্বাবুয়ে, অভিষেক টেস্টেই শতক হাঁকিয়েছিলেন ডেভ। সে গল্প আরেকদিন হবে, আপাতত আবার ম্যাচে ফেরা যাক।
দলের রান যখন ১০৩, সে সময় ডেভও ফিরে গেলেন। এর ১০ রান পরই গেলেন ক্যাপ্টেন ফ্লেচার। স্কোর ১১৩/৬, ম্যাচ ভারতের হাতের মুঠোয় এসেই গেছে প্রায়।
কিন্তু তখনই জ্বলে উঠলেন কেভিন কারেন! এই ভদ্রলোকের আরেকটা পরিচয় আছে, এবারের আইপিএলে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের হয়ে খেলা স্যাম কারেনের বাবা। বাটচার্ট নামের এক সতীর্থকে নিয়ে কেভিন সপ্তম উইকেটে যোগ করলেন ৫৫ রান। দলের ১৬৮ রানে বাটচার্টকে বোল্ড করলেন বিনি। জিম্বাবুয়ের জয় তখন প্রায় অস্তগামী, শুধুমাত্র কারেন আছেন বলেই পুরোপুরি নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না।
আট নাম্বারে নামা জেরাল্ড পেকওভারের সাথে কারেনের ২১ রানের একটা পার্টনারশিপ হলো। সেই জুটিও ভাঙল একসময়, স্কোর তখন ১৮৯/৮।
কারেনের বীরত্ব শেষ হলো ২৩০ রানে। নবম উইকেট হিসেবে মদন লালের বলে রবি শাস্ত্রীর হাতে যখন ধরা পড়লেন, তখন তার রান ৭৩। আর তার আউটের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেল জিম্বাবুয়ের জয়ের সকল সম্ভাবনা। বাকি থাকল শুধুই আনুষ্ঠানিকতা।
যার হাত ধরে এতগুলো রান করতে পেরেছিল ভারত, সেই কপিল দেবই তুলির শেষ আঁচড়টা দিলেন। ট্রাইকোসকে কট অ্যান্ড বোল্ড করে জিম্বাবুয়ের ইনিংসটা মুড়িয়ে দিলেন, ভারত পেল ৩১ রানের জয়। সেই ম্যাচে ১১ ওভার বোলিং করে এই একটি উইকেটই পেয়েছিলেন কপিল, কিন্তু রান দিয়েছিলেন মাত্র ৩২। তার আঁটসাঁট বোলিং যে জিম্বাবুয়েকে আটকে রাখতে সাহায্য করেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এই ম্যাচ থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাস দিয়েই পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয় ভারত। পরের ইতিহাস তো সবারই জানা। ফাইনালে ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কাপ হাতে তুললেন কপিল।
কপিলের এই ইনিংসের গুরুত্ব ও মহিমা এত স্বল্প শব্দে তুলে আনা সম্ভব নয়। এই বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকে ভারত ধীরে ধীরে পরাশক্তি হয়ে ওঠে ক্রিকেটে। কিন্তু কপিল ওই ইনিংসটা না খেললে জিম্বাবুয়েকে হারাতে পারতো না ভারত, পরের ম্যাচে হয়তো জিততে পারতো না অস্ট্রেলিয়ার সাথেও। সেক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন হওয়া তো দূরের কথা, গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নিতে হতো তাদেরকে।
ভারতের একদিনের ক্রিকেটের ভিত কপিল দেবের ওই ইনিংসের উপরে দাঁড়িয়ে আছে বললে খুব বেশি বোধহয় অত্যুক্তি করা হবে না।