যারা তর্কে-বিতর্কে নামছেন, তারাও জানেন, অন্য পক্ষকে মানানোটা বেশ শক্ত। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের মতো একদম সহস্র ক্রোশ ফারাক গড়লে আলাদা কথা, নয়তো কাউকে নিরঙ্কুশভাবে ‘সেরা’ রায় দিয়ে দেওয়াটা দুষ্করই। তবুও, শব্দটার মাহাত্ম্যই এমন যে, কেউ একটু সমকাল ছাড়িয়ে মহাকালের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল তো শুরু হয়ে গেল আলোচনা, ‘উনিই কি গোট? মানে, সর্বকাল-সেরা?’
মাঝে আলোচনাটা কিছুদিন থমকালেও ফের তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মিচেল স্টার্কের কারণে। কেউ কেউ তো দিয়ে দিচ্ছেন একদম আদ্যোপান্ত বিবৃতি। স্টার্কই সেরা কি না প্রশ্ন করা দূরে থাক, বিস্ময় চিহ্ন বসানোরও অবকাশ দিচ্ছেন না। সংশয়বাদীদের সামনে উল্টো ছুঁড়ে মারছেন একতাড়া পরিসংখ্যান। ১০৯ ম্যাচে ২১৯ উইকেট, মানে ইনিংসে ২ উইকেট পেলেও তাঁর মানদণ্ডে ‘গড়েরও নিচে’। ৯ বার ৫ উইকেট, তার ওপরে দুজন থাকলেও তারা ম্যাচ খেলেছেন দ্বিগুণেরও বেশি। বিশ্বকাপ পরিসংখ্যানটা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। বোলিং গড়, স্ট্রাইক রেট, ইকোনমি রেট – বেশ কয়েকভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে স্টার্ককে নিচে নামানোর চেষ্টা করতে পারেন। শুভকামনা থাকল আপনার জন্য, সফল হওয়াটা অসম্ভবই।
তবে, যে শব্দজোড়ার এত ওজন, তার উত্তরটা এমন সরল-সোজা তো হতে পারে না। বিশেষ করে, আমরা কথা বলছি ওয়ানডে ক্রিকেট নিয়ে, যার নিয়ম-কানুন যমুনার জলের মতোই সদা বহমান। এত-শত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে যে ফরম্যাট, সেখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই যুগের সরাসরি তুলনা টানাটা কেমন হয়ে যায় না!
আচ্ছা, এরও একটা সমাধান আছে। ভিন্ন দুই যুগের বোলারদের তুলনা না হোক, একই যুগের বোলারদের তুলনা তো হতেই পারে, তাই না? যেমন ধরুন, স্টার্ক ২০১০ সাল থেকে আজ অব্দি খেলছেন, তার মানে তার সময়টা এই ১৩ বছর, এই ১৩ বছরে অন্য যত বোলার খেলেছেন, তাদের চেয়ে স্টার্ক কতটা ভালো করেছেন, এ থেকেই বেরিয়ে আসবে সমকালে স্টার্ক কতটা ভালো। একইভাবে গ্লেন ম্যাকগ্রা, জোল গার্নার থেকে শুরু করে সব বোলারকেই মেপে দেখা হবে, তার সময়ে তিনি অন্য বোলারদের চেয়ে কতটা এগিয়ে ছিলেন। আপনাকে আশ্বস্ত করছি, নিজের যুগের সাপেক্ষে তুলনা করে সর্বকাল-সেরা নির্বাচিত করার এই পদ্ধতিটা বহু বছর পুরনো। নিশ্চয়ই ব্র্যাডম্যানকে অবিসংবাদিত সেরা আপনি মেনে নিতেন না, যদি তার সমসাময়িক আরও দু-চারজন ক্যারিয়ার শেষ করতেন ৯৫-১০০ গড় নিয়ে। তখন উল্টো বলতেন, ‘ব্র্যাডম্যানের ভাগ্যও বটে! ওই সময় ব্যাটিং করতে পারলে শচীন-কোহলি ১৫০ গড় নিয়ে শেষ করতেন।’
সমসাময়িক অন্যদের সঙ্গে কতটা দূরত্ব বজায় রেখেছেন, স্টার্ক-ম্যাকগ্রা-আকরামকে যদি এই প্রশ্নে ফেলা হয়, তাহলে তারা কোথায় দাঁড়াচ্ছেন, এই প্রশ্নটা তাই তোলা যায়। কোন কোন পরিমাপক বিবেচনা করা হচ্ছে, তা-ও জানিয়ে দেওয়া উচিত। সাম্প্রতিকে এক্সপেক্টেড উইকেট, এক্সপেক্টেড ইকোনমি রেটের মতো অনেক পরিমাপকই বের হয়েছে, তবে বোলারদের যাচাই করবার আদি এবং অকৃত্রিম মানদণ্ড তো ওই স্ট্রাইক রেট আর বোলিং গড়ই। স্ট্রাইক রেট দিয়ে ধরা যায়, কত কম বলে তিনি উইকেট নিতে পেরেছেন। আর, বোলিং গড়টা বোঝাবে, কত কম রান খরচায় উইকেট নিয়েছেন।
এখানে একটা পাদটীকা জুড়ে দেওয়া জরুরি। ক্রিকেটের বিশ্বায়নের সুবাদে ওয়ানডের সদস্যপদ পাওয়া দেশের সংখ্যা এখন ২০, পূর্বেও অনেক দেশই ৫০ ওভারের খেলা খেলতে নেমেছে, খেলাটায় যাদের অংশগ্রহণ আদতে নামকাওয়াস্তেই। হিসাব করত বসে যদি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার মতো একদমই উঠতি দলগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়। বিচারের আওতায় তাই ওই দলগুলোকেই নেওয়া হয়েছে, যারা টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে ২০১৮ সালের আগে। আর কেবলমাত্র সেসব বোলারই বিবেচনায় এসেছেন, যারা ওয়ানডে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন কিংবা খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন ১২০-এর বেশি উইকেট পেয়ে।
দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালের ২০ অক্টোবর অভিষেকের পর থেকে টেস্ট খেলুড়ে ১০ দলের বিপক্ষে স্টার্ক উইকেট নিয়েছেন ১৯৭টি। এই সময়ে তিনি বল করেছেন ৫১৮৩টি। অর্থাৎ, প্রতি ২৬.৩ বলে একবার প্রতিপক্ষ ব্যাটারকে প্যাভিলিয়নে ফিরিয়েছেন তিনি। আর রান হজম করেছেন ৪৪৮০টি। মানে, তাঁর বোলিংয়ের বিপক্ষে ২২.৭ রান তুলতেই একবার করে উইকেট দিয়েছেন ব্যাটাররা।
স্টার্কের আপাতদৃষ্টিতেই দর্শনীয় মনে হওয়া পরিসংখ্যানটা আরও দুর্দান্ত মনে হবে তার প্রজন্মের বাকিদের সঙ্গে তুলনায় গেলে। স্টার্ক-জমানায় ওয়ানডেতে বোলিং গড় ৩৩.১, আর তারা প্রতি উইকেটের জন্য খরচ করেছেন ৩৬.৪ বল। অর্থাৎ, স্টার্ক একটা উইকেট পেয়েছেন তার সময়ের অন্য বোলারদের চেয়ে ১০.১ বল আর ১০.৪ রান কমে।
এবার ইতিহাসের অন্য বোলারদের তাদের আমলের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যাক। অনেকের কাছেই সর্বকাল-সেরা বলে বিবেচিত ওয়াসিম আকরাম খেলেছেন প্রায় দুই যুগ। এই সময়ে পৃথিবীজোড়া বোলাররা বল করেছেন ২৯.৩ গড় ও ৩৮.৩ স্ট্রাইক রেটে। সেখানে আকরামের স্ট্রাইক রেট আর বোলিং গড় যথাক্রমে ৩৬.৮ ও ২৪.২। অর্থাৎ, যুগের বাকিদের সঙ্গে আকরামের তফাৎটা সেরকম আকাশ-পাতাল ছিল না। তার চেয়ে বরং গ্লেন ম্যাকগ্রাই সমসাময়িক অন্যদের সঙ্গে ব্যবধান গড়েছেন বেশি, তবে সেটাও শীর্ষ দশে আসার মতো নয়।
বোলার | ক্যারিয়ার | উইকেট | গড় | স্ট্রাইক রেট | যুগের গড় | যুগের স্ট্রাইকরেট |
মিচেল স্টার্ক | ২০১০/১০/২০-২০২৩/০৩/১৯ | ১৯৭ | ২২.৭ | ২৬.৩ | ৩৩.১ | ৩৬.৪ |
শেন বন্ড | ২০০২/০১/১১-২০১০/০৩/১৩ | ১৩৭ | ২১.৪ | ২৯.৪ | ৩০.৯ | ৩৬.৯ |
ট্রেন্ট বোল্ট | ২০১২/০৭/১১-২০২২/০৯/১১ | ১৮২ | ২৪.১ | ২৯.১ | ৩৩.৫ | ৩৬.৪ |
মোহাম্মদ শামি | ২০১৩/০১/০৬-২০২৩/০৩/১৯ | ১৪৪ | ২৬.৫ | ২৭.৭ | ৩৩.৬ | ৩৬.৩ |
ব্রেট লি | ২০০০/০১/০৯-২০১২/০৭/০৭ | ৩৫২ | ২৩.৪ | ২৯.৪ | ৩০.৮ | ৩৭ |
জোয়েল গার্নার | ১৯৭৭/০৩/১৬-১৯৮৭/০৩/২৮ | ১৪৪ | ১৯ | ৩৬.৭ | ২৭.৭ | ৩৮.৯ |
সাকলাইন মুশতাক | ১৯৯৫/০৯/২৯-২০০৩/১০/০৭ | ২৫২ | ২২.৭ | ৩১.৭ | ২৯.৫ | ৩৭.৩ |
অ্যালান ডোনাল্ড | ১৯৯১/১১/১০-২০০৩/০২/১৬ | ২৪৫ | ২২.৭ | ৩২.২ | ২৯.৪ | ৩৭.৯ |
ওয়াকার ইউনিস | ১৯৮৯/১০/১৪-২০০৩/০৩/০১ | ৩৮০ | ২৪.২ | ৩০.৬ | ২৯.৪ | ৩৮ |
সাঈদ আজমল | ২০০৮/০৭/০২-২০১৫/০৪/১৯ | ১৬৪ | ২৩ | ৩২.৯ | ৩১.৫ | ৩৫.৯ |
বোলিং গড়কে মিশিয়ে একটা একক পরিমাপক দাঁড় করানো গেলেই বোধ হয় বুঝতে সুবিধা হওয়ার কথা, কে সবচেয়ে ভালো। একটা কাজ করা যাক চলুন, নির্দিষ্ট বোলারের স্ট্রাইক রেট আর গড়কে যথাক্রমে তার সময়ের স্ট্রাইক রেট আর গড় দিয়ে ভাগ করা হোক প্রথমে। পরে দুটো সংখ্যা গুণ করলেই বেরিয়ে আসবে যুগের তুলনায় তিনি আসলেই কতটা ভালো।
বোঝার সুবিধার্থে ওয়াসিম আকরামের সংখ্যাগুলোই বিবেচ্য ধরুন। তার স্ট্রাইকরেট ছিল ৩৬.৮, আর তার সময়ে বোলাররা গড়ে উইকেট পেতেন ৩৮.২ বলে। অনুপাত দাঁড়াচ্ছে ০.৯৬৩। আর বোলিং গড়ের অনুপাত ০.৮২৬। শেষের দুটি সংখ্যা গুণ করে ‘যুগের অনুপাতে কতটা ভালো’ বলে যে পরিমাপকের কথা বলা হয়েছিল, সেই সংখ্যাটা হচ্ছে ০.৭৯৫। এবং, এই সংখ্যার বিচারে আকরামের চেয়ে এগিয়ে থাকছেন ২৩ জন।
বোলার | যুগের অনুপাতে কত ভালো |
মিচেল স্টার্ক | ০.৪৯৬ |
শেন বন্ড | ০.৫৫২ |
ট্রেন্ট বোল্ট | ০.৫৭৪ |
মোহাম্মদ শামি | ০.৬০২ |
ব্রেট লি | ০.৬০৪ |
জোল গার্নার | ০.৬৪৭ |
সাকলাইন মুশতাক | ০.৬৫৪ |
অ্যালান ডোনাল্ড | ০.৬৫৬ |
ওয়াকার ইউনিস | ০.৬৬৩ |
সাঈদ আজমল | ০.৬৬৯ |
কুলদীপ যাদব | ০.৬৭২ |
‘খেলা তো হতো আমাদের সময়ে’-জাতীয় শোর তোলা প্রজন্মকে তালিকাটা ধাক্কাই দেবে। মিচেল স্টার্ককে সবার ওপরে দেখেই যে তার আমলে বোলিং গড় আর স্ট্রাইকরেট খারাপ হয়েছে ভালো বোলারের অভাবে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা যাবে, ওই সুযোগও নেই।
ট্রেন্ট বোল্ট কিংবা মোহাম্মদ শামি তো স্টার্কের সমসময়েরই বোলার।
পরিসংখ্যান কৃতজ্ঞতা: কার্তিকেয়া দাতে
(সমস্ত পরিসংখ্যান ১৯ মার্চ, ২০২৩ অব্দি)