উপমহাদেশের বাজে অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়ে দেশে ফিরেই অধিনায়কের পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন অ্যালিস্টার কুক। এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়েই শেষ হয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের মধ্যে অন্যতম অ্যালিস্টার কুকের অধিনায়কত্বের অধ্যায়।
ভারতের বিপক্ষে শোচনীয়ভাবে টেস্ট সিরিজ পরাজয়ের পর কুকের অধিনায়কত্ব শেষ হওয়ার পথেই ছিলো। এর আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টে পরাজয় এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে দেশের মাটিতে সিরিজ ড্রয়ের ফলে তার বদলি নতুন অধিনায়ক দেখতে চেয়েছেন অনেকেই।
গত বছর বাংলাদেশের মাটিতে ইংল্যান্ড দলের সফর নিয়ে চারদিকে সংশয় দেখা দিলেও আসার জন্য মুখিয়ে ছিলেন অ্যালিস্টার কুক। ওয়ানডে অধিনায়ক ইয়োন মরগান এবং ওপেনার অ্যালেক্স হেইলস বাংলাদেশে আসতে অসম্মতি জানান। ওদিকে অ্যালিস্টার কুক ওডিআই দলে না থাকলেও তিনি দলের সাথে উড়ে আসেন বাংলাদেশের আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। দলে না থাকা সত্ত্বেও মাঠের পাশে বসে পুরো ওয়ানডে সিরিজ উপভোগ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টে পরাজয়ের পর বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতির জন্য সাধুবাদ জানাতে ইতস্তত বোধ করেন নি অ্যালিস্টার কুক।
২০১১ সালে টেস্ট ক্রিকেটে অসাধারণ নৈপুণ্যের জন্য বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটারের পুরস্কার লাভ করেন কুক। পরের বছরের ২৯ শে আগস্ট অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসের অবসরের পর ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান তিনি।
অ্যালিস্টার কুকের প্রথম সফর ছিল উপমহাদেশের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে। সিরিজের প্রথম ম্যাচে তার শতকের পরেও ম্যাচ জিততে ব্যর্থ হয় ইংল্যান্ড। পরের ম্যাচে আবারো শতক হাঁকান তিনি, তবে সেই ম্যাচে জয় পেতে ভুল করে নি ইংল্যান্ড। মুম্বাই টেস্টে ইংল্যান্ড ১০ উইকেটে পরাজিত করে ভারতকে। অনেকের মতে ভারতের মাটিতে এটি ইংল্যান্ডের সেরা জয়।
ঐ সফরের প্রথম টেস্টে আহমেদাবাদে ৯ উইকেটের পরাজয়ের পর, পরের দুই টেস্টে মুম্বাই এবং কলকাতায় জয়ের মধ্য দিয়ে ৪ ম্যাচের সিরিজে ২-১ এ এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড। সিরিজের শেষ ম্যাচে নাগপুরে ড্রয়ের মধ্য দিয়ে ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমের পর ভারতের মাটিতে সিরিজ জিতে ইংল্যান্ড।
অ্যালিস্টার কুক ২০১০ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসাবে ২টি টেস্ট ম্যাচে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন, সেই দুই ম্যাচেও শতক হাঁকান তিনি। ভারতের বিপক্ষে ৪ টেস্টের সিরিজে প্রথম ৩ টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। যার ফলে প্রথম এবং একমাত্র অধিনায়ক হিসাবে নিজের প্রথম ৫ টেস্টে টানা শতক হাঁকানোর বিশ্বরেকর্ড রয়েছে এই ব্যাটসম্যানের।
নিজেদের মাটিতে দুইবার অ্যাশেজ জেতে ইংল্যান্ড অ্যালিস্টার কুকের নেতৃত্বে। ২০১২ সালে নেতৃত্ব পাওয়ার পর ২০১৩ সালে অধিনায়ক হিসাবে নিজের প্রথম অ্যাশেজ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৩-০ ব্যবধানে জয়লাভ করেন কুক। পরের অ্যাশেজে ইংল্যান্ডকে লজ্জার সাগরে ডুবিয়ে ৫ ম্যাচের সবকটিতে জয় তুলে নিয়ে ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করে অস্ট্রেলিয়া।
কিন্তু পরের অ্যাশেজেই ঘুরে দাঁড়ায় ইংল্যান্ড। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া দলের ফর্ম বিবেচনায় ক্রিকেটের বিশেষজ্ঞরা ধরেই নিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়া আবারো ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করতে যাচ্ছে। সব জল্পনাকল্পনা কাটিয়ে অ্যালিস্টার কুকের নেতৃত্বে তখন অস্ট্রেলিয়াকে ৩-২ ব্যবধানে হারিয়ে অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করেছিলো ইংলিশরা।
অধিনায়ক কুকের আরেকটি বড় অর্জন হলো সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে সাউথ আফ্রিকার মাটিতে ২-১ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জয়। সাউথ আফ্রিকার মাটিতে ৪ ম্যাচের সিরিজের প্রথম এবং তৃতীয় ম্যাচে জয়ের মধ্যে দিয়ে বেসিল ডি’অলিভেইরা ট্রফি নিজেদের করে নেয় ইংল্যান্ড।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইংল্যান্ডের সেরা অধিনায়কদের মধ্যে একজন অ্যালিস্টার কুক ৫৯টি টেস্ট ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে ২৪টি জয় এনে দিয়েছেন দলকে। অধিনায়ক হিসাবে ব্যাট হাতেও সফল অ্যালিস্টার কুক, নেতৃত্ব দেওয়া ৫৯ ম্যাচে রেকর্ডসংখ্যক ১২টি শতকের সাহায্যে ৪৬.৫৭ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৪৮৪৪ রান; যা ইংলিশ অধিনায়কদের মধ্যে সর্বোচ্চ।
মজার ব্যাপার হলো অ্যালিস্টার কুকের ক্যারিয়ারের টেস্ট ব্যাটিং গড় এবং অধিনায়ক হিসাবে ব্যাটিং গড় প্রায় সমান-সমান। টেস্টে তার ব্যাটিং গড় ৪৬.৪৫ এবং অধিনায়ক হিসাবে ব্যাটিং গড় ৪৬.৫৭।
গ্লৌচেস্টারশায়ারে জন্ম নেওয়া কুকের এসেক্স ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয়, মাত্র ১৬ বছর বয়সে। অভিষেকের পর থেকেই কাউন্টি ক্রিকেটে রানের ফোয়ারা ছুটাতে থাকেন তিনি, নিজের প্রথম মৌসুমে প্রায় ৫০ ব্যাটিং গড়ে রান করার পাশাপাশি এসেক্সকে শিরোপা এনে দেন কুক।
নিয়মিত রান পেতে থাকা কুকের ২০০৬ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় মার্কাস ট্রেসকোথিক্সের ইনজুরির কারণে। নিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে শতক হাঁকান তিনি। শুধুমাত্র ভারতের বিপক্ষে নয়, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলা তার প্রথম টেস্টেও সেঞ্চুরি করেছেন কুক।
ইংল্যান্ড জাতীয় দলে অভিষেকের আগে ইংল্যান্ড অনুর্ধ্ব-১৯ দলের হয়েও অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অনুর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটেও অধিনায়ক হিসাবে সফল কুক।
অধিনায়কের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেও আরো কয়েক বছর ইংল্যান্ডের হয়ে ইনিংস উদ্বোধন করতে চান তিনি। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের সর্বকালের সেরা এবং আধুনিক ক্রিকেটের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যানদের একজন অ্যালিস্টার কুক মাত্র ৩২ বছর বয়সেই ১৪০ ম্যাচে ৩০টি শতকের সাহায্যে ১১,০৫৭ রান করেছেন। বর্তমানে ব্যাটসম্যান অ্যালিস্টার কুকের একমাত্র লক্ষ্য টেন্ডুলকারকে ছাপিয়ে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। নিজের মতো করে আরো ৪-৫ বছর খেলে যেতে পারলেই টেন্ডুলকারের টেস্ট ক্রিকেটের রেকর্ড হুমকির মুখে পড়ে যাবে।
অভিষেকের পর থেকে অ্যালিস্টার কুক ব্যাট হাতে একের পর এক নতুন কীর্তি গড়েছেন, যার শুরুটা হয়েছিলো নিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচ থেকেই। নিজের প্রথম টেস্টে ভারতের বিপক্ষে শতক এবং অর্ধশতক হাঁকান কুক। দুর্দান্ত শুরু করা কুক নিজের প্রথম মৌসুমেই এক হাজারের অধিক রান পূর্ণ করেন টেস্ট ক্রিকেটে, টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র ২ জন ব্যাটসম্যানের এই কীর্তি রয়েছে।
ইংল্যান্ডের সবচেয়ে কম বয়সী ব্যাটসম্যান হিসাবে ২ হাজার, ৩ হাজার, ৪ হাজার, ৫ হাজার, ৬ হাজার এবং বিশ্ব ক্রিকেটে সবচেয়ে কমবয়সী ব্যাটসম্যান হিসাবে ৭ হাজার, ৮ হাজার, ৯ হাজার, ১০ হাজার এবং ১১ হাজার রান করেছেন কুক। অ্যালিস্টার কুক ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বেশি (১৪০টি) টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন এবং সবচেয়ে বেশি (৫৯টি) টেস্ট ম্যাচ নেতৃত্ব দিয়েছেন। এছাড়া একমাত্র ইংলিশ ক্রিকেটার হিসাবে ইংল্যান্ডের ৫০টি টেস্ট জয়ের সাক্ষী ছিলেন তিনি।
ধীরগতির ব্যাটসম্যান হলেও ওয়ানডে ক্রিকেটে সাফল্য পেয়েছেন কুক। ইংল্যান্ডের হয়ে রেকর্ডসংখ্যক ৬৯টি ম্যাচ নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ফাইনালে উঠিয়েছিলেন ইংল্যান্ডকে। এখন পর্যন্ত ৯২টি ওয়ানডে ম্যাচে ৩৬.৪০ ব্যাটিং গড়ে ৩,২০৪ রান করেছেন তিনি, প্রায় ৮০ স্ট্রাইক রেইটে।
ক্রিকেটপ্রেমীরা আশা করতেই পারে, আরো কয়েক বছর স্বভাবসুলভ ঠাণ্ডা মাথায় খেলে যাবেন অ্যালিস্টার নাথান কুক, নিজেকে নিয়ে যাবেন কিংবদন্তীদের কাতারে।
তার ডাক নাম শেফ। কাজটাও রাঁধুনিদের মতোই, যার স্বাদ পায় শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের বোলাররা।