১.
প্রতিটি জিনিসেরই একটা শুরু আছে। কিন্তু এই নামকরণটা ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল, সেটি সঠিকভাবে বলা যায় না। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়াটা ছিল নিয়মের জটিলতার কারণে। কিংবা ১৯৯৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়াটাকেও ধরে নেওয়া যায় ব্রায়ান লারা নামক এক ব্যাটসম্যানের খুব ভালো একটা দিনের কাছে হেরে যাওয়া। কিন্তু একটি ঘটনা যখন বার বার ঘটে এবং সেটি একই দলের সাথে, তখন মোটামুটি একটি বিষয় ‘কমন ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়ায় যে, নির্দিষ্ট দলটির হয়তো অন্য কোনো সমস্যা আছে।
খুব সম্ভবত এই বিষয়টি প্রথম তুলে এনেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ। একটা সময় প্রতি বছরের শেষভাগে অস্ট্রেলিয়াতে ত্রিদেশীয় একটা টুর্নামেন্ট হতো। ১৯৯৭-৯৮ সালে সেই টুর্নামেন্টের তিনটি দল ছিল অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা আর নিউজিল্যান্ড। গ্রুপ পর্যায়ের মুখোমুখি হওয়া চার ম্যাচের চারটিতেই অস্ট্রেলিয়াকে যথাক্রমে ৬৭ রান, ৪৫ রান, ৫ উইকেট আর ৭ উইকেটের ব্যবধানে পরাজিত করে। গ্রুপের ৮ ম্যাচের মাঝে মাত্র ১টি ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকা পরাজিত হয়।
ফাইনালে মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া আর দক্ষিণ আফ্রিকা। অনুমিতভাবে ফেভারিট দক্ষিণ আফ্রিকাই। সেই টুর্নামেন্টে ফাইনাল হতো ৩টি। প্রথম ফাইনালেও অস্ট্রেলিয়াকে ৬ রানে হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা। অস্ট্রেলিয়ার তখন টুর্নামেন্ট জিততে হলে বাকি দুই ফাইনালের দুটিতেই জিততে হবে। আর দক্ষিণ আফ্রিকা কেবল মাত্র পরের ম্যাচটি জিতলেই হয়, হারলেও তারপর আরেকটি ম্যাচে তাদের সুযোগ থাকবে।
টানা ৫টি ম্যাচ হারার পর অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে বাজি ধরার কেউ ছিল না। ঠিক সেই মূহুর্তে স্টিভ ওয়াহ সংবাদ সম্মেলনে বলে উঠলেন যে পরের দুটি ফাইনাল অস্ট্রেলিয়াই জিততে যাচ্ছে। কারণ হিসেবে তিনি বললেন, দক্ষিণ আফ্রিকা কাজের সময় ভেঙে পড়ে, নার্ভ শক্ত রাখতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে নিয়ে আসলেন ১৯৯৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের কথা। অস্ট্রেলিয়ানরা স্লেজিং করাতে ওস্তাদ, সবাই ধরে নিল যে মনস্তাত্ত্বিকভাবে জেতার জন্যেই স্টিভ এই কথা বলেছেন। তবে কারণ যা-ই হোক, পরের দুটো ম্যাচ জিতে টুর্নামেন্টটি অস্ট্রেলিয়া জিতে নিল আর দক্ষিণ আফ্রিকা পেয়ে গেল চোকার্স খেতাব।
২.
শুধু সেই টুর্নামেন্ট কিংবা বিশ্বকাপেই নয়, বড় টুর্নামেন্টে দক্ষিণ আফ্রিকার এই ভেঙে পড়াটা আসলে গবেষণার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। আলোচনা শুরু করার আগে টুর্নামেন্ট ভিত্তিক দক্ষিণ আফ্রিকার অঘটনগুলোতে একটু নজর বোলানো যাক।
১৯৯২ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল
২২ বছর নির্বাসনে থাকার পর বিশ্বকাপে ফিরে এসে দক্ষিণ আফ্রিকা ভালোই পারফর্ম করে। ৮ ম্যাচের মাঝে ৫টিতে জয় পেয়ে সেমিফাইনালে উঠে তারা। টুর্নামেন্টে তাদের চেয়ে বেশি জয় ছিল কেবলমাত্র নিউজিল্যান্ডের।
সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভালোই খেলছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ৪৫ ওভারে ২৫৩ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে একপর্যায়ে তাদের প্রয়োজন ছিল ১৩ বলে ২২ রান। দুই ব্যাটসম্যান ম্যাকমিলান আর ডেভ রিচার্ডসন যেভাবে খেলছিলেন, তাতে টার্গেটটাকে অসম্ভব মনে হচ্ছিল না। কিন্তু ম্যাচের এই পর্যায়ে বৃষ্টির জন্য খেলা বন্ধ হয়ে যায়। যখন খেলা শুরু হয়, তখন দক্ষিণ আফ্রিকাকে তখনকার নিয়ম অনুযায়ী রিভাইসড টার্গেট দেওয়া হয় ১ বলে ২২ রান। ম্যাচ সেখানেই শেষ আর দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্ভাগ্যের শুরু।
১৯৯৬ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল
গ্রুপ পর্বে দক্ষিণ আফ্রিকা ৫ ম্যাচের ৫টিতেই জয় পায়, তা-ও মোটামুটি একতরফাভাবেই। তাদের রান রেট ২.০৪; গ্রুপে দ্বিতীয় সেরা রান রেট ছিল পাকিস্তানের ০.৯৬। সেই সময়ে অন্য গ্রুপে শ্রীলঙ্কা যে মোটামুটি রান করায় দক্ষ ছিল তাদের রান রেটও ছিল ১.৬০। অন্যদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোয়ার্টারে উঠেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ৫ ম্যাচের মাঝে মাত্র ২টিতে জয়, এর মাঝে কেনিয়ার বিপক্ষেও ১টি ম্যাচে হার। নিশ্চিতভাবেই ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা ফেভারিট।
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার কপাল খারাপ কিংবা ব্রায়ান লারার দিন- যেটাই হোক না কেন, লারার সেঞ্চুরিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টার্গেট দিল ২৬৪ রানের। এই টার্গেটও একেবারে বড় ধরনের কিছু ছিল না। তবে টার্গেটটাকে নিজেরাই বড় বানিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা অল আউট হলো ২৪৫ রানে।
১৯৯৯ বিশ্বকাপ সুপার সিক্স
দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল টুর্নামেন্টের সবচেয়ে ফেভারিট দল। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা ছিল দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া যোদ্ধার মতো। দক্ষিণ আফ্রিকা যদি ম্যাচটা জিতে যায় তাহলে সমীকরণ ছিল অস্ট্রেলিয়া টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়বে আর সেমিতে দক্ষিণ আফ্রিকা মুখোমুখি হবে জিম্বাবুয়ের। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া জিতে গেলে সেমিতে আবার দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া লড়াইটাই হবে। সেমিফাইনালের লড়াইটাকে সহজ করার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা জেতার আপ্রাণ চেষ্টা করবে, সেটা বলাই বাহুল্য।
প্রথম ব্যাট করে দক্ষিণ আফ্রিকা করল ২৭১ রান। সেই টুর্নামেন্টে তখন পর্যন্ত এর চেয়ে বেশি রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড আর কোনো দলের নেই। এর সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার ফিল্ডিং যোগ করলে টার্গেটটাকে ৩০০+ ধরে নিলেও অযৌক্তিক হবে না।
৪৮ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর কেউ অস্ট্রেলিয়ার জয়ের সম্পর্কে আশাবাদী ছিলেন বলে মনে হয় না। দক্ষিণ আফ্রিকা তখন শিকারী বাঘের মতো উম্মত্ত। আরেকটা উইকেট পেলেই মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায় জয়। সেই মূহুর্তে হাল ধরলেন আয়রনম্যান খ্যাত স্টিভ ওয়াহ। কিন্তু সেই স্টিভ ওয়াহও জীবন পেলেন ব্যক্তিগত ৫৬ রানে। নিশ্চিত ক্যাচ ধরে উল্লাস করতে গিয়ে ক্যাচটা ড্রপ করলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম সেরা ফিল্ডার হার্শেল গিবস। সেই ম্যাচে শেষপর্যন্ত জয়ী হলো অস্ট্রেলিয়া আর স্টিভ ওয়াহ অপরাজিত থাকলেন ১২০ রানে।
১৯৯৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল
আগের ম্যাচের জয়টাকে অনেকেই অস্ট্রেলিয়ার ভাগ্যের জোরে জেতার কথা বলেছিলেন। বিষয়টা একেবারে অযৌক্তিকও ছিল না, যেহেতু ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় স্টিভ ওয়াহ একবার জীবন পেয়েছিলেন। সেমিতে তাই যখন অস্ট্রেলিয়া দল প্রথমে ব্যাট করতে নেমে চাপের মুখে পড়ল, তখন বিষয়টাকে একেবারেই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। ৪৯.২ ওভারে মাত্র ২১৩ রান করেই অলআউট হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু এই সামান্য রানটাকেও অসামান্য বানিয়ে ফেললেন মায়াবী স্পিনার শেন ওয়ার্ন (নাকি দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরা নিজেরাই!)। অনেক নাটকীয়তার পর ম্যাচের শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ৯ রানের। প্রথম দুই বলেই দুটো চার মেরে ম্যাচটিকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে এসেছিলেন ল্যান্স ক্লুজনার। বাকি ছিল ৪ বলে ১ রান। নিরুপায় স্টিভ ওয়াহ সব ফিল্ডারকে বৃত্তের ভেতরে নিয়ে আসলেন। সেই চাপেই কিনা জানা নেই, ইনিংসের চতুর্থ বলে পাগলাটে দৌড় দিলেন ল্যান্স ক্লুজনার। ডোনাল্ড প্রথমে রান নিতে মানা করেছিলেন, যখন দেখলেন ক্লুজনার অনেকটাই এগিয়ে এসেছেন তখন বাধ্য হয়ে তিনিও দৌড় দিলেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ডার তার আগেই উইকেট ভেঙে ডোনাল্ডকে রান আউট করে দিলেন। ফলাফল ম্যাচ টাই, আর টুর্নামেন্টের বাইলজ অনুযায়ী মুখোমুখি লড়াইতে এগিয়ে থাকার জন্য অস্ট্রেলিয়া চলে গেল ফাইনালে।
২০০০ নকআউট টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল
টুর্নামেন্টে দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল অস্ট্রেলিয়ার পরেই ফেভারিট, আর দুর্বল ভারত ছিল আন্ডারডগ। কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল মাত্র ৩৯.১ ওভারে, অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়াকে ভারত হারালেও তেমন শক্তভাবে খেলতে পারেনি। কিন্তু সেমিতে এসে সৌরভ গাঙ্গুলীর অসামান্য সেঞ্চুরিতে ভারত দাঁড় করালো ২৯৫ রানের এক বিশাল টার্গেট। দক্ষিণ আফ্রিকা ৪১ ওভারে ২০০ রানে অল আউট হয়ে ৯৫ রানের ব্যবধানে হেরে আরেকবার প্রমাণ করল যে, বড় আসরের দল এখনো তারা হয়ে উঠেনি।
২০০২ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল
নক আউট টুর্নামেন্টের নাম পাল্টে হলো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, আবারও সেমিফাইনালে মুখোমুখি দক্ষিণ আফ্রিকা আর ভারত। প্রথমে ব্যাট করে শেবাগ যুবরাজের ৫০+ আর দ্রাবিড়ের ৪৯ রানের ইনিংসে ভারত করল ২৬১ রান। জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকা দুর্দান্তই খেলছিল। দলের রান যখন ৩৬ ওভারে ১ উইকেটে ১৯২ তখন শারীরিক অসুস্থতার দরুন সেঞ্চুরি করা হার্শেল গিবস অবসর নিলেন। এটাই প্রয়োজন ছিল ভারতের। হরভজন সিংয়ের বলে যুবরাজের দুর্দান্ত একটা ক্যাচের শিকার হলেন জন্টি। ভারত দল যেন নিজেদেরকে খুঁজে পেতে থাকল। হাতের মুঠোয় থাকা ম্যাচটা দক্ষিণ আফ্রিকা হেরে গেল মাত্র ১০ রানে।
২০০৩ বিশ্বকাপ গ্রুপ পর্ব
ঘরের মাঠে হওয়া সেই বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সমীকরণটা এমন ছিল যে, পরের পর্বে যাওয়ার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাকে জিততেই হবে। বৃষ্টির জন্য ম্যাচটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম, ৪৪.৪ ওভার শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ ৬ উইকেটে ২২৩ রান। ডাকওয়ার্থ লুইস মেথড হিসেব করে শন পোলক মাঠে খবর পাঠালেন যে, যেকোনো সময় ম্যাচ বন্ধ হয়ে যেতে পারে বৃষ্টির জন্য। বাকি দুই বলে তাই অন্তত ৬ রান নিতেই হবে, সেটাও কোনো উইকেট না হারিয়ে। ৫ম বলে মার্ক বাউচার ছয় মেরে ম্যাচটাকে জমিয়ে দিলেন। শেষ বলটাতে দক্ষিণ আফ্রিকার টার্গেট ছিল যাতে কোনো উইকেট না পড়ে। বলটা কোনোরকমে ঠেকিয়ে ড্রেসিং রুমে হাসি মুখে ফেরত আসলেন দুই ব্যাটসম্যান মার্ক বাউচার আর ক্লুজনার। বৃষ্টির জন্য ম্যাচ বন্ধ হয়ে গেছে। আবার শুরু হবে তেমন সম্ভাবনা খুবই কম।
কিন্তু ড্রেসিং রুমে আসার পর তারা জানতে পারলেন, কী কাজটা তারা করেছে। ম্যাচ জেতার জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল ২৩০ রানের, ২২৯ রান করাতে ম্যাচটা ড্র হয়। পুরো দক্ষিণ আফ্রিকা আকুল হয়ে তাকিয়ে ছিল বৃষ্টি বন্ধ হবার জন্য। ম্যাচ শুরু করে মাত্র ১টি বল খেলে ১টি রান করতে পারলেও দক্ষিণ আফ্রিকা পরের পর্বে যেতে পারত। কিন্তু বৃষ্টির জন্য ম্যাচটা আর শুরুই হলো না!
শুধুমাত্র হিসেব ভুলের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা বাদ পড়ল গ্রুপ পর্ব থেকেই।
২০০৪ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি গ্রুপ পর্ব
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ম্যাচের শুরুটা ভালোই করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। লক্ষ্য দিয়েছিল ২৪৭ রানের। ৪৬ ওভার শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রয়োজন ছিল ৩১ রানের। ৪৭তম ওভারেই সর্বনাশটা ঘটল। আগের ৯ ওভারে ৩৭ রান দিয়ে ২ উইকেট পাওয়া পোলক এই ওভারে দিয়ে বসলেন ১৯ রান। ৪ ওভারে ৩১ রান থেকে ওভার শেষে প্রয়োজনটা দাঁড়াল ৩ ওভারে ১২ রান। ম্যাচটাও হাত থেকে ফসকে গেল। দক্ষিণ আফ্রিকাও বাদ পড়লো গ্রুপ পর্ব থেকে।
২০০৬ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি সেমিফাইনাল
‘বি’ গ্রুপের গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন দক্ষিণ আফ্রিকা মুখোমুখি হয়েছিল ‘এ’ গ্রুপের রানার্স আপ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। প্রথম ব্যাট করে দক্ষিণ আফ্রিকা করেছিল ২৫৮ রান। কিন্তু ক্রিস গেইলের ১৩৫ বলে অপরাজিত ১৩৩ রানের সুবাদে ম্যাচটি ৪৪ ওভারে অতি সহজেই জিতে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
২০০৭ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল
টপ ফেভারিট হিসেবেই বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেমি পর্যন্ত খুব খারাপ খেলেনি। সেমিতে পড়ে গেল সেই বিশ্বকাপের এবং ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা দল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। গ্রুপ পর্বেও একবার অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই ম্যাচটিতেও অস্ট্রেলিয়ার ৩৭৮ রানের লক্ষ্যে নেমে ২৯৪ রান পর্যন্ত করতে পেরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে সেমিফাইনালের হিসেবটাই আলাদা। নতুন ম্যাচ, নতুন হিসেব।
কিন্তু ম্যাচ শুরু হবার পর দেখা গেল, এই দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে নতুন কিছু করা সম্ভব নয়। টস জিতে ব্যাটিং করতে নেমে ম্যাকগ্রার তোপের মুখে পড়ে মাত্র ২৭ রানেই ৫ উইকেট পড়ার পর ম্যাচের বাকি সময়টা হয়ে গেল শুধুমাত্রই আনুষ্ঠানিকতা।
শেষপর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা অলআউট হলো ১৪৯ রানে, অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটা জিতে নিল মাত্র ৩১.৩ ওভারে।
২০০৯ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি
গ্রুপে অন্য দলগুলো ছিল নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কা। অনুমিতভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা ফেভারিট। কিন্তু টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই শ্রীলঙ্কার কাছে তারা হেরে গেল বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে। পরের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে হারালেও, শেষ ম্যাচে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে আবারও গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা।
২০১১ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল
গ্রুপ পর্বে ৬ ম্যাচের মাঝে ৫টিতেই জয় পেয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরের পর্বে তারা পায় অন্য গ্রুপের চতুর্থ দল নিউজিল্যান্ডকে। ৫০ ওভারে ২২২ রানের লক্ষ্যমাত্রা যেকোনো বিচারেই সহজ। দক্ষিণ আফ্রিকার শুরুটাও হয় ভালোভাবে। ২৪ ওভার শেষে মাত্র দুই উইকেট হারিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ ছিল ১০৮ রান। এর মানে, বাকি ২৬ ওভারে প্রয়োজন ৪.৩৮ রান রেটে ১১৪ রান, হাতে ৮ উইকেট। কিন্তু ২৪ তম ওভারের প্রথম বলে জ্যাক ক্যালিস আউট হবার পরেই যেন দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়দের মাঝে মরক লাগা শুরু হয়ে গেল। ১২৮ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে খাবি খেতে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকা শেষ পর্যন্ত অলআউট হয় ১৭২ রানে।
২০১৩ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি সেমি ফাইনাল
সেমিফাইনালে তারা মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ডের। কিন্তু প্রথমে ব্যাট করে মাত্র ১৭৫ রানে অল আউট হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ইংল্যান্ড ম্যাচটা শেষ করে দেয় মাত্র ৩৭ ওভারেই। এই ম্যাচের পর দক্ষিণ আফ্রিকান কোচ গ্যারি ক্রিস্টেন বলেন, “ম্যাচটাতে আমরা চোক করেছি। যা ঘটেছে সেটা আমাদের স্বীকার করে নেওয়া উচিত।”
২০১৫ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল
ম্যাচটিতে অদ্ভুতুড়ে অনেক কিছুই ঘটে। দুর্দান্ত ফিল্ডার হিসেবে পরিচিত এবি ডি ভিলিয়ার্স কোরি এন্ডারসনের সহজ রান আউট মিস করেন, যিনি পরবর্তীতে গ্র্যান্ড এলিয়টের সাথে শতরানের পার্টনারশিপ করেন। এছাড়া উইকেট কিপার ডি কক আরেকটি সহজ রান আউট মিস করেন। এগুলো ছাড়াও ম্যাচে আরো কিছু ক্যাচ মিসের ঘটনা ঘটে। শেষপর্যন্ত শেষ ২ বলে যখন ৫ রানের প্রয়োজন ছিল, তখন সময়ের সেরা বোলার ডেল স্টেইনের বলে এলিয়ট দুর্দান্ত একটা ছক্কা মেরে আবারও প্রমাণ করেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকা বড় টুর্নামেন্টে আসলেই চোকার্স।
২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি
র্যাঙ্কিংয়ে ১ নম্বর দল হিসেবে খেলতে আসে দক্ষিণ আফ্রিকা। বাকি তিন দল ছিল পাকিস্তান, ভারত আর শ্রীলঙ্কা। প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে ৯৬ রানে হারিয়ে ফেভারিটের মতোই শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু র্যাঙ্কিংয়ে ৮ নম্বরে থাকা পাকিস্তানের সাথে পরের ম্যাচেই ধরা খায় তারা। ভারতের সাথে শেষ ম্যাচটি তাই হয়ে যায় বাঁচা-মরার লড়াই।
২৪ ওভারে ১ উইকেটে ১১৬ রান থেকে ১৯১ রানে অলআউট হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। শেষ ৫১ রানে তারা ৮ উইকেট হারায়, যার মাঝে তিনটি ছিল রান আউট। টপ ফেভারিট দল গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ে নিজেদের নামের পাশে চোকার্স খেতাব লাগানোর স্বার্থকতা আরেকবার প্রমাণ করে।
৩.
এখন কথা হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা বাদে অন্যান্য অনেক দলও কিন্তু বিশ্ব দরবারের বড় প্রতিযোগিতায় বার বার ব্যর্থ হয়েছে। নিউজিল্যান্ডের কথাই ভাবুন। তারা কিন্তু বিশ্বকাপের ইতিহাসে ১১ বারের মাঝে ৭ বারই সেমিফাইনাল খেলেছে। অথচ ফাইনাল খেলেছে মাত্র ১ বার, ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে। তাদের সমান সংখ্যক সেমিফাইনাল খেলেছে কেবলমাত্র অস্ট্রেলিয়া। ৭ বার সেমিফাইনাল খেলে তারা ৭ বারই ফাইনাল উঠে, এর মাঝে ৫ বার চ্যাম্পিয়ন। অথচ নিউজিল্যান্ডের চেয়ে কম সেমিফাইনাল (৪ বার) খেলেও শ্রীলঙ্কার মতো দল ৩ বার ফাইনালে উঠে ১ বার চ্যাম্পিয়ন। এরপরেও কেন নিউজিল্যান্ডকে চোকার্স বলা হয় না?
এর কারণ হিসেবে বলা যায়, নিউজিল্যান্ড প্রতিবার যে দলগুলোর কাছে হেরে বাদ পড়েছে সেসব ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ দলগুলো তাদের চেয়ে ভালো খেলেছে কিংবা শক্তিমত্তা বা ঐতিহ্যের হিসেবেও এগিয়ে ছিল। নিউজিল্যান্ডের বাদ পড়াটা তাই অস্বাভাবিক মনে হয়নি। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা যে ক’বার বাদ পড়েছে তাতে মূল কারণ মনে করা হয়েছে চাপ সহ্য করতে না পারাটা।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের সবচেয়ে বাজে ম্যাচটাই খেলেছে সেই নির্দিষ্ট কিংবা আরো ভালোভাবে বললে সবচেয়ে প্রয়োজনের দিনটিতেই। তাদের হারার জন্য প্রতিপক্ষ কিংবা ভাগ্যের চেয়ে নিজেদের বাজে খেলাটাই মূল কারণ হিসেবে ধরা হয়। শেষ ৪ ওভারে ৩২ রান দিয়ে আরো অনেক দলই হেরেছে কিংবা এই একই টার্গেট দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাও অনেক ম্যাচ জিতেছে, কিন্তু হেরে গেছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ম্যাচগুলোতে। গ্রুপ ম্যাচে হেরে গেলেও অনেক সময় ফিরে আসার সুযোগ থাকে, কিন্তু নক আউট পর্বে নিজের সর্বোচ্চ সামর্থ্য প্রয়োগ করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
সামর্থ্য থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সামর্থ্যের প্রয়োগ ঘটিয়ে সর্বোচ্চ সফলতা অর্জন করা। সেই কাজটা নিঃসন্দেহে এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা করতে পারেনি। এই না করতে পারার জন্যেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে ক্রিকেটের চোকার্স বলা হয়। এই খেতাব দূর করার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা দলটিকে শুধু একটা কাজই করতে হবে- প্রয়োজনের দিনে নিজেদের স্বরুপে ফেরা।
তবে এই সহজ কাজটি করাই যে সবচেয়ে কঠিন, সেটি সম্ভবত এই দলটির চাইতে বেশি অন্য কোনো দল জানে না। ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রার্থনা একটাই, দক্ষিণ আফ্রিকার এই চোকিং মনোভাবটা তারা যেন তাড়াতাড়ি কাটিয়ে উঠতে পারে। এটা হলে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলের সাথে সাথে দর্শকদেরও লাভ বৈকি।
ফিচার ইমেজ: CricketCountry.com