বেশ কয়েক বছর ধরে চেলসি ১৮ বছরের কম বয়সী খেলোয়াড়দের কেনার ব্যাপারে ফিফার কোনো নিয়মের ধার ধারেনি। ভবিষ্যতে বিপদে পড়ার সম্ভবনা থাকলেও চেলসি বোর্ডের এ বিষয় নিয়ে কোনো ভাবান্তর ছিলো না। অবশেষে, নড়েচড়ে বসেছে ফিফা। এই নিয়মভঙ্গের জন্য চেলসিকে দোষী প্রমাণ করে তাদের আদেশ, আগামী দুই মৌসুম দলে কোনো খেলোয়াড় কেনা যাবে না। যদিও আপিল করে শাস্তির মেয়াদ কমানোর সুযোগ আছে চেলসির কাছে। কিন্তু সেটা শুধু মেয়াদ কমাতে সম্ভব, শাস্তি বাতিল করতে নয়। বর্তমানে চেলসির দলের অবস্থাও তেমন সুবিধার না। দলের আবহাওয়া ঠিক করতে বেশকিছু দল-বদল করা প্রয়োজন ছিলো তাদের। কিন্তু ফিফার শাস্তির কারণে সে আশা গুড়েবালি। কিন্তু ইচ্ছা করলেই চেলসি তাদের এই শাস্তিতে আর্শীবাদ হিসেবে গ্রহণ করে নিতেই পারে!
ফুটবলের ইতিহাসে এই দল বদলের নিষেধাজ্ঞা নতুন নয়। ইউরোপের অনেক বড় বড় ক্লাবও এই শাস্তির শিকার হয়েছে। ফিফার অনেক নিয়মের মাঝে ১৮ বছরের কম বয়সী খেলোয়াড় কেনার ব্যাপারেও একটি নিয়ম আছে, যা সুষ্ঠুভাবে না মানলে ফিফা কোনো ক্লাবকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খেলোয়াড় কেনা-বেচা থেকে দূরে রাখে। অধিকাংশ ক্লাবের জন্যই এই নিয়ম একটি যন্ত্রণা, যার জন্য ভুগতে হয় পরের কয়েক মৌসুমও।
ইতালির রোমা থেকে স্পেনের লা লিগার ক্লাব বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ ও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ পর্যন্ত এই দল-বদল নিষেধাজ্ঞার শিকার। ২০০৪ সালে রোমাকে ফিফা দল বদলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ফরাসি ডিফেন্ডার ফিলিপে মেক্সিসের ট্রান্সফারকে কেন্দ্র করে। যদিও এখানে বয়স নয়, দল বদলে অর্থগত অনিয়ম খুঁজে পেয়েছিলো ফিফা।
১৮ বছরের কম বয়সী খেলোয়াড় নিয়ম না মেনে দলে টানার জন্য দুই মৌসুম খেলোয়াড় কেনা থেকে বার্সেলোনাকে দূরে রেখেছিলো ফিফা। এই শাস্তি শুরু হয়েছিলো ২০১৪ সালের গ্রীষ্মকালীন দল-বদলের মৌসুম থেকে। তবে এক্ষেত্রে বার্সেলোনা সুযোগ পেয়েছিলো তাদের কাঙ্ক্ষিত শাস্তি শুরু হবার আগেই খেলোয়াড় কিনে রাখতে। তাই বার্সেলোনা কিনেছিলো মার্ক আন্দ্রে টার স্টেগান, থমাস ভারমায়লেন ও জেরেমি ম্যাথিউকে। চেলসিও আগামী মৌসুমে ২০০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করতে প্রস্তুত ছিলো, হয়তো জিনেদিন জিদানকেও নিয়ে আসতেন রোমান আব্রাহোমোভিচ। তবে চেলসি কোনো সুযোগ হয়তো পাচ্ছে না। সম্ভবত তাদের নিষেধাজ্ঞার শাস্তি শুরু হবে আগামী দল-বদলের মৌসুম থেকেই।
বার্সেলোনার এই শাস্তির মেয়াদ যখন শেষের দিকে, সে সময় নতুন করে দোষী প্রমাণিত হয় রিয়াল মাদ্রিদ ও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরের কম বয়সী খেলোয়াড়দের তাদের যুব অ্যাকাডেমিতে যোগ করেছে ফিফার দেওয়া নিয়ম না মেনেই। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রিয়াল মাদ্রিদও করেছিলো একই কাজ। যদিও এ দুই দলকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জরিমানাও দিতে হয়েছিলো ফিফাকে। চেলসির ক্ষেত্রেও একই পরিণতি। যদিও জরিমানার অর্থ স্প্যানিশ দুই ক্লাবের তুলনায় ঢের বেশি।
বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ বা অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ সব ক্লাবগুলোর ক্ষেত্রেই দোষী সাব্যস্ত হবার পরের মৌসুম থেকেই শাস্তি প্রদান করা হয়নি। দল গোছানোর জন্য একটি ট্রান্সফার মৌসুম সময় পেয়েছিলো তারা। আর বার্সেলোনা নিষেধাজ্ঞা চলমান পর্যায়ে কিনেছিলো আলেক্স ভিদাল ও আর্দা তুরানকে। তবে তাদের মাঠে নামতে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো ৬ মাস। এছাড়াও এই তিন ক্লাব তাদের যুবাদের উপর ভরসা রাখে। নিষেধাজ্ঞার সময় তাদের অ্যাকাডেমির খেলোয়াড়দের ব্যবহার করেছে তারা। তাই খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হয়নি তাদের।
তবে যেসব ক্লাব তাদের অ্যাকাডেমির তরুণ তুর্কিদের ব্যবহার করতে আগ্রহী নয়, অর্থের ঝনঝনানি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড় কিনে ব্যবহার করতে বেশি পছন্দ করে তাদের জন্য এই দল-বদল নিষেধাজ্ঞা বিভীষিকার মতো। কারণ টানা দুটি মৌসুম যদি দলে নতুন খেলোয়াড় না আসে বা কোচের ট্যাকটিস অনুযায়ী পর্যাপ্ত খেলোয়াড় না থাকে তবে ভালো ফলাফল যে আসবে না তা অনুমেয়। আর নিষেধাজ্ঞা শেষেই ইচ্ছামতো খেলোয়াড় কিনতে পারে না সেই ক্লাবটি। ফিফার নজর তো থাকে, আর বড় ট্রান্সফারের জন্য স্বভাবত ভয় তো কাজ করেই। আর এই ধরনের একটি ক্লাব হচ্ছে চেলসি, যারা সদ্য খেলোয়াড় কেনার নিষেধাজ্ঞার প্রকোপে পড়েছে।
চেলসি ১৮ বছরের কম বয়সী খেলোয়াড় কিনতে গিয়ে এই শাস্তির মুখে পড়লো। অথচ চেলসি কি কখনও এসব খেলোয়াড়দের ঠিকমতো ব্যবহার করেছে? অথচ তাদের খেলোয়াড় কিনে লোনে দেওয়ার সংখ্যা আর একটু হলেই হাফ-সেঞ্চুরিতে পৌঁছে যেত। এবার জানুয়ারি ট্রান্সফার উইন্ডোর পর জানা গেছে, ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে চেলসির ৪২ জন খেলোয়াড় ধারে আছে, যাদের অধিকাংশের বয়স ২০ এর আশেপাশে। আর এদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা ইউরোপের যেকোনো প্রথম সারির দলে খেলার যোগ্যতা রাখে।
কিন্তু ঘরের ছেলেদের চেলসি কখনও ব্যবহার করেনি। কয়েকজন লোনে থাকা অবস্থায় নজর কাড়লেও চেলসির মন ভোলাতে পারেনি। যদি তা-ই হতো, তাহলে রোমেলু লুকাকু, নেমানিয়া ম্যাতিচ, ড্যানিয়েল স্টারিজ, মোহাম্মদ সালাহ ও কেভিন ডি ব্রুইনের মতো খেলোয়াড় এখন স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে খেলতেন। চেলসি কিন্তু থেমে থাকেনি। ঘরের যুবাদের অনাগ্রহ করে বিপুল অর্থ দিয়ে কিনেছে মিচি বাৎশুয়াই, তিমুই বাকাইয়োকো, কেপা আরিজাবালাগা, জর্জিনহো, আলভারো মোরাতা বা আন্তোনিও রুডিগারের মতো খেলোয়াড়দের। যদিও এসব খেলোয়াড়ের ভেতর সবাই যে চেলসিতে নাম কামিয়েছে তা-ও কিন্তু নয়।
ঘরের ছেলেদের লোনে পাঠিয়ে চেলসি মাঝে কিছু অর্থ পানিতে ফেলার মতো খেলোয়াড় কিনেছে। ডেভিড জাপ্পাকস্তা, এমারসন পালমেইরি, ড্যানি ড্রিংকওয়াটার ও রবার্ট গ্রিনদের মতো খেলোয়াড় কেনার পেছনে কী কারণ ছিলো তা আজও বোধগম্য নয়। তবে আসন্ন দল-বদল নিষেধাজ্ঞা কি চেলসির চিন্তাভাবনা বদলে দেবে?
মারিজিও সারি সেসব কোচদের একজন যাদের ট্যাকটিস অনুযায়ী পর্যাপ্ত খেলোয়াড় প্রয়োজন হয়। সারি এখনও তা পাননি। তবে এই নিষেধাজ্ঞার জন্য তাকে লোনে থাকা খেলোয়াড় ও অ্যাকাডেমির দিকে তাকানো ছাড়া উপায় নেই। গোলরক্ষক হিসেবে কেপা আরিজাবালাগা আছেন। তিনি যতই বিতর্কের জন্ম দেন না কেন, গোলরক্ষক হিসেবে এই বয়সে তিনি নিজেকে প্রমাণ করে ফেলেছেন। তবে একজন বদলি খেলোয়াড় প্রয়োজন তার। উইলি ক্যাবায়েরো তার চুক্তির মেয়াদ বাড়াননি। তাই অতিরিক্ত গোলরক্ষক হিসেবে এদুয়ার্দোকে ডাকা যেতে পারে। তিনি বর্তমানে ভিতেস আর্নহেমে লোনে খেলছেন। এছাড়াও আছেন ন্যাথান ব্যাক্সটার। অতিরিক্ত গোলরক্ষক হিসেবে তারা মন্দ নয়।
অ্যাকাডেমি থেকে পাশ করা প্রতিভাবান খেলোয়াড় আন্দ্রেস ক্রিটেনসেন আছেন। কিন্তু সারি তাকে ব্যবহার না করে নিয়মিত খেলান বয়সের ভারে ফুরিয়ে যেতে বসা ডেভিড লুইজকে। ফরাসি ডিফেন্ডার কার্ট জুমা অনেকদিন ধরেই লোনে আছেন। পাশাপাশি এ মৌসুমে এভারটনের হয়ে দারুণ ফর্মে আছেন তিনি। যেকোনো ক্লাবের প্রথম পছন্দের ডিফেন্ডার হবার যোগ্য জুমা। অথচ চেলসি দলেই তার জায়গা হয় না। এমন আরেকজন খেলোয়াড় ওলা আইনা। তিনি বর্তমানে আছে তুরিনোতে। যথেষ্ট প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও কন্তে তাকে ব্যবহার করেননি। সারিও একই পথে হাঁটছেন।
চেলসি দলে একমাত্র রাইট-ব্যাক সিজার আজপিলিকুয়েতা। প্রতি ম্যাচেই নামছেন তিনি কোনো বিশ্রাম ছাড়া। টানা খেলে গেলে যেকোনো রক্তমাংসের মানুষ একসময় ক্লান্ত হবেই। ক্লান্ত হয়ে আজপিলিকুয়েতা মাঝেমাঝেই খেই হারিয়ে ফেলেন, হুটহাট ফর্ম চলে যায়। কিন্তু বিকল্প রাইট-ব্যাক না থাকার কারণে তাকে বাধ্য হয়ে নামতেই হয়। কিন্তু রিস জেমস উইগান অ্যাথলেটিকের হয়ে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। ইচ্ছা করলেই দলে অতিরিক্ত রাইট-ব্যাক হিসেবে তাকে রাখা যায়। এভাবে দল সাজানোর পরিকল্পনা করলে রক্ষণ কিন্তু আরেকটু মজবুত হতেই পারে।
এ মৌসুম শেষেই মাতেও কোভাচিচ ফিরে যাবেন রিয়াল মাদ্রিদে। লোন চুক্তি শেষে তাকে কিনে ফেলার সুযোগ পাবে না চেলসি। তাই জর্জিনহো ও কান্তের পাশে কে খেলবেন তা নিয়ে বেশ মাথা ঘামাতে হবে সারির। কিন্তু উপায় আছে। এ বছর রস বাকরেলি বেশ মানিয়ে নিয়েছেন দলের সাথে। জর্জিনহো ও কান্তের পাশে তাকে নিয়মিত খেলানোর ঝুঁকিটা এখন নেয়া যেতেই পারে। এছাড়াও আছেন রুবেন-লফটাস চিক। ইংল্যান্ডের অন্যতম ইয়াংস্টার তিনি। সুযোগ পেলে তিনি মিডফিল্ডত্রয়ীর একজন হতে পারা সক্ষমতা রাখেন। তিমুই বাকাইয়োকোও নিজেকে প্রায় ফিরে পেয়েছেন, তাকে ফেরানো যেতে পারে। আর ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিক তো নতুন মৌসুমে যোগ দিচ্ছেন স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে।
এছাড়াও, মার্কো ভ্যান গিঙ্কেল নামক একজন খেলোয়াড় চেলসিতে যে আছেন, সেটা কোচ তো দূরের কথা, খোদ সমর্থকদের মনে আছে কি না সন্দেহ! গত বছর পিএসভি আইন্দভেনের হয়ে দারুণ খেলেছিলেন বলে এ মৌসুমে দলে রেখেছিলো তাকে। কিন্তু তাকে নিয়ে সমস্যা যেন শেষ হচ্ছেই না। আর নিউক্যাসল ইউনাইটেডে ব্রাজিলিয়ান উইংগার কেনেডি বেশ নাম করেছেন। এছাড়াও ম্যাসন মাউন্টি আছেন। ডার্বি কাউন্টিতে যিনি ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডকে মুগ্ধ করেছেন। ইচ্ছা করলেই এদেরকে ফিরিয়ে এনে দল গোছানো যায়। তারা ব্যর্থ হলো সেটা পরের কথা, বিপদে সুযোগকে ব্যবহার না করতে পারলে যে পরিবর্তনও বোঝা যাবে না।
বর্তমান দলে আক্রমণাত্মকভাগের অবস্থা চেলসির সবথেকে খারাপ। অথচ সেখানেই রয়েছে তাদের দারুণ সব খেলোয়াড়। মৌসুম শেষেই গঞ্জালো ইগুয়াইন বিদায় নেবেন। আলভারো মোরাতাকে চেলসি বোর্ড স্পেনে রেখে দিতে পারলেই খুশি হয়। আর বাকি থাকেন অলিভিয়ে জিরু। ৩২ বছর বয়সী এ স্ট্রাইকার নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন অনেক আগেই। কিন্তু অ্যাস্টন ভিলাতে তরুণ তুর্কি ট্যামি আব্রাহাম ২৯ ম্যাচে ২০ গোল দিয়ে যে উড়ছে, সেদিকে চেলসি বোর্ডের কোনো খেয়াল নেই। অথচ স্ট্রাইকারের আসনে তাকে বসিয়ে একবার চেষ্টা তো করা যেতেই পারতো! এবং সেই সময় আসন্ন। উইলিয়ান ও পেদ্রো বয়সের ভারে অনেকটা নিভে গেছেন। তাদের আসন নিতে পারতেন ১৮ বছর বয়সী ক্যালাম-হার্ডসন অডৌই। অথচ তিনিও দলে উপেক্ষিত। এদিকে হার্ডসন অডোইকে পাখির চোখ করে রেখেছে বায়ার্ন মিউনিখ।
তাই একরকমভাবে এই নিষেধাজ্ঞা হতে পারে চেলসির জন্য টার্নিং পয়েন্ট। আর যদি তারা নিজেদের স্বভাব নিয়েই চলতে থাকে। তাহলে দল-বদল নিষেধাজ্ঞার ভুক্তভোগী হতে হবে বেশ কয়েক বছর। এত খেলোয়াড় লোনে দিয়ে রাখার জন্য বরাবরই তারা প্রশ্নবিদ্ধ। যদি তারা তাদের লোনে থাকা খেলোয়াড় ও অ্যাকাডেমির যুবাদের ব্যবহার করে, তাহলে গর্ব করে বলতেই পারবে, “আমরা তো এমন দুঃসময়ের জন্যই এত তরুণ প্রতিভা কিনে রেখেছিলাম!“