চমৎকার এক সেঞ্চুরি করে ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন অ্যালিস্টার কুক। এই বিদায়ের ভেতর দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটের বিশেষ একটি দিকের ছোট্ট এক তালিকায় নাম তুলে ফেললেন ইংল্যান্ডের এই সাবেক অধিনায়ক। ক্যারিয়ারের প্রথম ও শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যান ইতিহাসে এসেছেন এ নিয়ে মাত্র পাঁচ জন। ক্যারিয়ারের শুরু ও শেষে সেঞ্চুরি করা সেই পাঁচ ব্যাটসম্যানকে নিয়ে এই আয়োজন।
রেগি ডাফ (১০৪ ও ১৪৬)
অত্যন্ত প্রতিভাধর একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে মনে করা হতো তাকে। কিন্তু মদ ও উশৃঙ্খল জীবন যাপনের কারণে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন এই অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান। অনেকেই তাকে তার সময়ের সেরাদের কাতারে রাখেন।
মেলবোর্নের সেই টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ১১২ রানের জবাবে ইংল্যান্ড ৬১ রানে অলআউট হয়েছিল প্রথম ইনিংসে। দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথম সারির ব্যাটসম্যান ডাফকে খানিকটা লুকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিলো অস্ট্রেলিয়া। ব্যাটিং অর্ডার পেছাতে পেছাতে ১০ নম্বরে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। আর সেখানে নেমেই অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেকে সেঞ্চুরি করলেন তিনি। অভিষেকে ১০ নম্বরে সেঞ্চুরি করা প্রথম ব্যাটসম্যান তিনি এবং দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান বাংলাদেশের আবুল হাসান রাজু। অস্ট্রেলিয়া সেই টেস্ট জিতেছিল ২২৯ রানে।
৩০ বছর বয়সেই ক্রিকেট ছেড়ে দিলেন ডাফ। এর মধ্যে দুটো ইংল্যান্ড সফর করেছেন ১৯০২ ও ১৯০৫ সালে। দুই সফরে রান করেছিলেন এক হাজারের উপর। দ্বিতীয় সফরের পর থেকেই ডুবে যেতে শুরু করেন ডাফ। মদ্যপানের নেশা একেবারে শেষ করে দিতে থাকে তাকে।
১৯০৫ সালে দ্বিতীয় ইংল্যান্ড সফরে ওভালে খেলেছিলেন ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট। সেই ড্র ম্যাচের প্রথম ইনিংসে সিবি ফ্রাই সেঞ্চুরি করেছিলেন ইংল্যান্ডের পক্ষ থেকে। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ইনিংস শুরু করতে নেমেছিলেন এবং ১৪৬ রানের চমৎকার এক ইনিংস খেলেছিলেন। ক্যারিয়ারে এই দুটি মাত্র সেঞ্চুরি। আর দুটোই ক্যারিয়ারের প্রথম ও শেষ টেস্টে।
বিল পনসফোর্ড (১১০ ও ২৬৬)
বহুভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায় বিল পনসফোর্ডকে। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের বড় সঙ্গী, অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান, দুই দু বার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ভাঙা ব্যাটসম্যান। তবে পনসফোর্ডের বড় পরিচয়, তিনি ছিলেন ব্র্যাডম্যান যুগেও অত্যন্ত উজ্জল এক তারকা।
৯০ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বয়স্ক ক্রিকেটার হিসেবে ১৯৯১ সালে মারা গেছেন। তার আগে ব্যাট হাতে অনেক কীর্তি করে গেছেন। এর মধ্যে আমাদের আলোচ্য হলো অভিষেকে ও শেষ ম্যাচে সেঞ্চুরি। এই জায়গায় তালিকার বাকিদের চেয়ে পনসফোর্ড একটু আলাদা হয়ে থাকবেন। কারণ তিনি শেষ ম্যাচে শুধু সেঞ্চুরি করেই ক্ষান্ত হননি, করেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি।
২৯টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন তিনি। তাতে ৪৮.২২ গড়ে ২১২২ রান করেছেন। সিডনিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯২৪ সালে অভিষেক হয়েছিল তার। প্রথম ম্যাচে অবশ্য ব্যাট করেছিলেন ৩ নম্বরে। সেখানে নেমেই ১১০ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ নম্বরে নেমে ২৭ রান করতে পেরেছিলেন। সেই ম্যাচ অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল ১৯৩ রানে।
১৯৪৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ টেস্ট খেলেছিলেন ওভালে। সেই ইনিংসে ডন ব্র্যাডম্যানের সাথে ৪৬২ রানের রেকর্ড জুটি করেছিলেন দ্বিতীয় উইকেটে। দুজনই করেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি। ব্র্যাডম্যান ২৪৪ ও পনসফোর্ড ২৬৬। শেষ ইনিংসে পনসফোর্ড হিট উইকেট হয়ে ফিরেছিলেন।
গ্রেগ চ্যাপেল (১০৮ ও ১৮২)
এই প্রজন্ম তাকে মনে রাখবে ভারতের একজন ব্যর্থ কোচ হিসেবে। কিন্তু ক্রিকেট ইতিহাস তাকে মনে রাখবে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ও ক্ষুরধার এক ক্রিকেট মস্তিষ্ক হিসেবে। গ্রেগ চ্যাপেলের ক্যারিয়ারটা পরিসংখ্যান দিয়েও ঠিক বোঝা যায় না। ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজ ক্যারিয়ারের একটা বড় সময় হজম করে না ফেললে তার ক্যারিয়ারের রানটা যে আরো বেশি হতো, তাতে সন্দেহ নেই।
তিন ভাই ইয়ান চ্যাপেল, গ্রেগ চ্যাপেল ও ট্রেভর চ্যাপেল অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। গ্রেগ ৮৭ টেস্টে ৫৩.৮৬ গড়ে ৭১১০ রান করেছেন। ক্যারিয়ারের শুরু ও শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি তো আছেই। মোট টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন ২৪টি।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল। সেই ম্যাচে দলের ব্যাটিং বিপদ সামাল দিয়ে ৭ নম্বরে নেমে ১০৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। ইয়ান রেডপ্যাথের সাথে তার জুটিই মূলত এই টেস্ট বাঁচিয়ে দেয়।
ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলেছিলেন সিডনিতে; পাকিস্তানের বিপক্ষে। অল্পের জন্য ডাবল সেঞ্চুরি মিস করেছিলেন সেই টেস্টে। ৪০০ বলে ১৮২ রানের অসামান্য এক ইনিংস খেলে দলের বিশাল স্কোর দাড় করিয়েছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে আর ব্যাট করার সুযোগ পাননি।
মোহাম্মদ আজাহারউদ্দিন (১১০ ও ১০২)
আজাহারউদ্দিন স্রেফ একজন ব্যাটসম্যান বা একজন ইতিহাস তৈরি করা অধিনায়ক ছিলেন না, ক্রীড়ালেখকরা বলেন তিনি ছিলেন ব্যাট নামের তুলি হাতে ২২ গজের এক শিল্পী। একটা সময় অবধি ভারতের সেরা অধিনায়ক ছিলেন তিনি। অত্যন্ত ভঙ্গুর একটা জাতীয় দল নিয়ে মারাত্মক লড়াই করে গেছেন এই মানুষটি। ব্যাট যে সবসময় তার হয়ে কথা বলেছে, তা নয়। তবে যখনই রান পেয়েছেন, সেটা একেবারে ছবির মতো সুন্দর হয়ে রয়ে গেছে। জহির আব্বাস ও গ্রেগ চ্যাপেলের মতোই প্রচণ্ড ক্ষমতাধর ও তাদের চেয়েও শৈল্পিক ছিলেন যেন লেগ সাইডে।
আজাহারের অভিষেক হয়েছিল তার আজীবনের প্রেম ইডেন গার্ডেনস-এ। একটা সময় বলা হতো, আজাহারকে ইডেন কখনো খালি হাতে ফেরায় না। এই প্রবাদের শুরু হয়েছিলো অভিষেক টেস্ট থেকেই।
১৯৮৫ সালে ইডেনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক। প্রথম ইনিংসে সুনীল গাভাস্কার, অংশুমান গায়কোয়াড়, দিলীপ ভেংসরকার, মহিন্দর অমরনাথরা বাঁচাতে পারছিলেন না ভারতকে। সে সময় রবি শাস্ত্রীকে নিয়ে রুখে দাড়িয়েছিলেন আজাহার। খেলেছিলেন ১১০ রানের অনিন্দ সুন্দর এক ইনিংস। সেই ইনিংসই আজাহারের জীবনের পথ ঠিক করে দিয়েছিল।
এরপর মোট ৯৯টি টেস্ট খেলেছেন ক্যারিয়ারে। কিন্তু ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান তার ব্যাটের দাপট সেভাবে বোঝাতে পারে না। ৪৫.০৩ গড়ে ৬২১৫ রান করেছেন। শেষটা আসলে বলে কয়ে হয়নি। অন্তত ১০০ টেস্ট খেলাটা আজাহারের খুব স্বপ্ন ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের ফিক্সিং কেলেঙ্কারি সেটা হতে দেয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিনি যখন ব্যাঙ্গালুরু টেস্ট খেলেন, তখন কল্পনাও করেননি এটা তার শেষ টেস্ট হতে যাচ্ছে।
যদিও দক্ষিণ আফ্রিকা সেই টেস্ট জিতে গিয়েছিল। কিন্তু আজাহার ধ্বংসস্তুপের মাঝে দাড়িয়ে নিজের সেই অঘোষিত শেষ টেস্টে খেলেছিলেন ১০২ রানের ইনিংস।
অ্যালিস্টার কুক (১০৪ ও ১৪৭)
এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন অ্যালিস্টার কুক। তিনি নিঃসন্দেহে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সেরা ওপেনার। দেশটির হয়ে সর্বোচ্চ রান স্কোরার হিসেবেই অবসরে গেলেন তিনি। ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহকদের তালিকায় কুক শেষ টেস্টে এসে উঠে এলেন ৫ নম্বরে। তার ওপরে আছেন শচীন টেন্ডুলকার, রিকি পন্টিং, জ্যাক ক্যালিস ও রাহুল দ্রাবিড়।
১৬১ টেস্টে ৪৫.৩৫ গড়ে ১২৪৭২ রান করে বিদায় নিলেন কুক। ক্যারিয়ারটা সবসময় এমন সুখের ছিল তা না। একটা সময় অবধি মনে করা হতো, শচীন টেন্ডুলকারের যে অবিশ্বাস্য সব রেকর্ড, সেগুলো কেউ ভাঙতে পারলে এই কুকই পারবেন। সেভাবেই কয়েকটা বছর খেলেছিলেন। কিন্তু শেষ কয়েকটা বছরে একদমই অ-ধারাবাহিক ছিলেন। একটা বড় ইনিংস খেললে অনেকদিন তার ব্যাটে খরা থাকে। মাঝারি ইনিংসও যেন খুঁজে পাওয়া কঠিন। বিশেষ করে ভারতের বিপক্ষে আরেকটা সিরিজের প্রথম চার টেস্টে রান না পাওয়ায় কুককে নিয়ে সমালোচনাও শুরু হয়ে গিয়েছিল।
অভিষেক টেস্ট ও শেষ টেস্টে সেঞ্চুরিয়ানদের এই যে তালিকা এখানে কুকক একটু আলাদা বিবেচনার দাবি রাখেন। তিনি অভিষেক ও শেষ টেস্টের দুই ইনিংসেই কমপক্ষে ৫০ রান পার করা একজন ব্যাটসম্যান।
অভিষেক হয়েছিল ভারতের বিপক্ষেই। নাগপুর টেস্টে প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৬০ রান। আর দ্বিতীয় ইনিংসে খেলেছিলেন ১০৪ রানের ইনিংস। ভাগ্যের খেলা, সেই ভারতের বিপক্ষেই খেললেন ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট। এবার প্রথম ইনিংসে করলেন ৭১ রান। আর দ্বিতীয় ইনিংসে খেললেন ১৪৭ রানের ইনিংস। ক্রিকেটের ইতিহাস তাকে মনে রাখবে নিঃসন্দেহে।
ফিচার ছবি- Reuters