কেনিংটন ওভারে যখন সৌম্য সরকার মাঝারি মানের কালবৈশাখী ঝড় তুলছিলেন, তখনই টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে এলো পুরনো এক ম্যাচের ভিডিও। গিবস, ডেল স্টেইনরা যেবার বাংলাদেশকে সাড়ে ১২ ওভারের মধ্যে ‘প্যাকেট’ করে দিয়েছিল। যেবার বাংলাদেশ সোয়া ৩৫ ওভার ব্যাট করে ১০৮ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল সেই ম্যাচের ভিডিও। পর্দায় সেই ভিডিও দেখতে দেখতে সেই শুরুর সময়েই ধারাভাষ্যকার বলছিলেন, ‘হোয়াট আ চেঞ্জ ফর বাংলাদেশ’। সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ বদলেছে আগাগোড়া।
যে স্বপ্ন নিয়ে ইংল্যান্ডের পথে উড়েছিল বাংলাদেশ, তা সত্যিকার অর্থেই সফল। অন্তত প্রথম ধাপে নিজেরা যেভাবে যা চেয়েছিল, তাই করতে পেরেছে বাংলাদেশ। নিজেদের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে বাংলাদেশ জিতেছে ২১ রানের ব্যবধানে। যদিও শুরুতে ব্যাট হাতে পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কার ব্যাটিংয়ে ভরাডুবি দেখে মনে হচ্ছিল, উপমহাদেশের সবাই বোধহয় এভাবেই ডুববে। কারণটা পারফরম্যান্স নয়, বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল অপরিচিত কন্ডিশনের কথা। কিন্তু পাকিস্তান যে অনেক আগে থেকেই সেখানে পৌঁছেছে! আফগানিস্তানের ২০০ রানের কোটা পার করা দেখে খানিকটা বিশ্বাস জাগে। নিজেদের প্রথম ম্যাচে হার মানা দক্ষিণ আফ্রিকা বাংলাদেশের বিপক্ষে জিততে মরিয়া তা নিশ্চিত। কিন্ত বাংলাদেশও যে মরিয়া, জিততে! কিন্তু তামিম-সৌম্যের টি-টোয়েন্টি মেজাজে শুরুটা ভালো এগিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। মিডল অর্ডারে সাকিব আল হাসান আর মুশফিকুর রহিমের ৭০+ রানের দারুণ ইনিংস, মিঠুন-মোসাদ্দেকদের কম বলে বেশি রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংসগুলো, সবশেষে বলতে হয় মাহমুদউল্লাহর ৩৩ বলে করা ৪৬ রানের অপরাজিত ইনিংসটি শেষদিকে বাংলাদেশকে ৩০০ রানের কোটা পার করে দিয়েছে অনায়াসে। বিশ্বকাপ তো বটেই, ওয়ানডে ক্রিকেটেই বাংলাদেশ ভেঙেছে তাদের সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের রেকর্ডটিও।
তবে এবারের বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের ম্যাচ পর্যন্ত উপমহাদেশের দলগুলোর মোট সংগ্রহ নিয়ে যে রাহুর গ্রাস চলছিল, তা যে বাংলাদেশ কাটিয়ে ফেলতে যাচ্ছে, তা জানান দিয়েছে সাকিব-মুশফিকের জুটি। দুজনের ব্যাটে এসেছে ১৪২ রানের জুটি, যা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা জুটি। সাকিবরা নিজেরাও এই খবর জানতেন না। তবে তিনি মুশফিকের সাথে ব্যাটিংটা বরাবরই উপভোগ করেন, সে কথা উল্লেখ করে ম্যাচশেষে বললেন,
‘আমি রেকর্ডের ব্যাপারটি জানতাম না। তবে জুটিটি দলের কাজে লেগেছে। আমরা দুজন মিলে ইনিংসটি এগিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয়, আমরা কাজটা ভালোভাবেই করতে পেরেছি।’
সেটা আর বলতে!
১.
বাংলাদেশের শুরুটা হয়েছিল টস হেরে। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসি আমন্ত্রণ জানালেন ব্যাটিংয়ে। মাশরাফি মনে মনে কি চেয়েছিলেন, তা বোঝা ভার। কিন্তু সিদ্ধান্তটা যে শেষ পর্যন্ত শাপেবর হয়েছে বাংলাদেশের জন্য, তা তো ফলাফল দেখলেই টের পাওয়া যায়।
তামিমের ইনজুরি ছিল। ভারতের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচেও মাঠে নামেননি। এরপর যেদিন অনুশীলনে নামলেন, হাতে চোট পেলেন। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তার মাঠে নামা নিয়ে শঙ্কা ছিল। সেই শঙ্কা কাটিয়ে দেশের সেরা এই ওপেনার মাঠে নামলেন। কিন্তু বড় রান করা হলো না। ২৯ বল মোকাবেলা করে ব্যক্তিগত ১৬ রানে কট বিহাইন্ডের ফাঁদে পড়ে বিদায় নিলেন। যদিও ততক্ষণে সৌম্যকে সাথে নিয়ে গড়েছেন ৬০ রানের জুটি। দলের রানের চাকায় আরও ১৫ রান যোগ হতেই ৭৫ রানের মাথায় আউট হলেন সৌম্য। তার ৩০ বলে করা ৪২ রানের ইনিংসটি সত্যিকার অর্থেই শুরুর মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। মোদ্দা কথা, প্রোটিয়া বোলারদের উপর শুরুতে যে চাপ তৈরি করার পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশের, তা সম্ভব হয়েছে সৌম্যর ইনিংস দিয়ে। এরপর সাকিবের ৭৫ রানের ইনিংস, মুশফিকের ৭৮ রানের ইনিংসের পর মোহাম্মদ মিঠুনের ২১ রান, মোসাদ্দেকের ২৬ রান, আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের একপাশ আটকে রেখে ইনিংসকে টেনেছেন অভিজ্ঞতার মিশেলে। সবকিছু মিলিয়ে নির্ধারিত ৫০ ওভারে বাংলাদেশ তুলে নেয় ৩৩০ রানের সংগ্রহ।
জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকাও শুরু করেছিল সতর্কতার সাথে। ওপেনিং জুটিতে আসে ৪৯ রান। টপ অর্ডারের প্রায় সব ব্যাটসম্যান মাঝারি ঘরানার ইনিংস খেলেছেন। তবে বাংলাদেশের বোলারদের উপর চেপে বসে ক্রমশ বিপদজনক হয়ে উঠেছিলেন অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসি। ৫৩ বলে ৬২ রানের ইনিংস খেলা সেই বিপদকে সরিয়েছেন মেহেদি হাসান মিরাজ। তার বলে ডাউন দ্য উইকেটে এসে ঘুরিয়ে মারতে গিয়ে সরাসরি বোল্ড হন ডু প্লেসি। তবে বল উইকেটে না লেগে মুশফিকের গ্লাভসে পৌঁছালেও উইকেট হারানোর শতভাগ সম্ভাবনা ছিল তার। দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে ডু প্লেসির ইনিংসটি সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত। শেষ পর্যন্ত ৮ উইকেটে ৩০৯ রানে থেমে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। বল হাতে পুরনো ধাঁচে ফিরেছেন বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমান; ৩ উইকেট নিয়েছেন তিনি, যদিও ছিলেন খরুচে। ১০ ওভারে ৬৭ রান দিয়েছেন তিনি। মিরাজ ১০ ওভারে ৪৪ রান খরচে ১ উইকেট। পেস বোলিং অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন ৮ ওভারে ৫৭ রান খরচ করে নিয়েছেন ২ উইকেট। সাকিব ১০ ওভার, ৫০ রান আর ১ উইকেট। তবে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা এদিন নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। ৬ ওভারে ৪৯ রান এসেছে তার বল থেকে। হয়তো এ কারণেই নিজের কোটা পূর্ণ করেননি তিনি।
২.
ত্রিদেশীয় সিরিজ থেকে জয়ের যে ক্রমিক, তা ক্রমশ বাড়ছে বাংলাদেশের। সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্বকাপের শুরুটাও দারুণ হলো। কিন্তু জয়ের খুশির জোয়ারে গা ভাসাতে নারাজ বাংলাদশ। সামনে রয়েছে বাকি ম্যাচ, পাখির চোখ সেদিকেই।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মাশরাফি যেমনটা বললেন,
‘জয় দিয়ে শুরু করাটা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। আয়ারল্যান্ডে আমরা খুব ভালো একটা সফর কাটিয়ে এসেছি। সেই রেশটা ধরে রাখার দরকার ছিল। ব্যাটসম্যানরা সেই ছন্দটা ধরে রেখেই শুরুটা এনে দিয়েছিল। টস হেরে ব্যাটিং পাওয়াটাও দারুণ কাজে লেগেছে। অবশ্য এটা এমন একটা উইকেট, এর আগে এখানে একটা ম্যাচ হয়ে গেছে। তাই টস জিতলেও দ্বিধা কাজ করত, ব্যাটিং নেব নাকি বোলিং। মুশফিক তো সবসময়ই এমন ইনিংস খেলে দেয়, যেখানে ওর স্ট্রাইক রেট খুব উঁচুতে থাকে। সাকিবও কী দারুণ ব্যাটিং করেছে। তবে বিশেষ করে সৌম্যের কথা বলতেই হবে। শুরুতে সৌম্য যে ছন্দটা ঠিক করে দিয়েছিল, সেটাই মাহমুদউল্লাহ-মোসাদ্দেক মিলে শেষ টেনেছে।’
৩৩০ রান, বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ। কিন্তু এই রানের পরও নির্ভার থাকার কোন সুযোগ ছিল না মাশরাফির সামনে। সেটা প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা বলেই হয়তো। এমন রান চেজ করে জয় পাওয়াটা প্রোটিয়াদের জন্য একরকম ডালভাত। কিন্তু প্রথম ম্যাচে হেরে থাকা দলটি দ্বিতীয় ম্যাচে নিজেদের আত্মবিশ্বাস তুলে ধরতে পারেনি।
মাশরাফির ভাষায়,
‘এই স্কোর গড়েও নির্ভার থাকার উপায় ছিল না। আমরা জানতাম, আমাদের ভালো জায়গায় বোলিং করতে হবে। কারণ, এটা ব্যাটিংয়ের জন্য খুব ভালো একটা উইকেট ছিল। তাই একের পর এক বোলারকে আক্রমণে পরিবর্তন করেছি, যেন ঠিক সময়ে উইকেট তুলে নিতে পারি। ভালো দিক হলো, পরিকল্পনাটা কাজে দিয়েছে। ঠিক সময়ে আমরা উইকেট তুলে নিতে পেরেছি। এখানেও স্পিনারদের কৃতিত্ব আছে। ওরাই চাপটা তৈরি করে দিয়েছিল। মোস্তাফিজ আর সাইফ শেষটা টেনে দিয়েছে।’
কেনিংটন ওভালে দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে বাংলাদেশের দর্শক ছিল অনেক বেশি। যেন লন্ডনের বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ। মাঠের বাইরের এই সমর্থনটাও অনেকখানি মনস্তাত্ত্বিকভাবে এগিয়ে দিয়েছে মাশরাফিদের। সে কারণেই কিনা ম্যাচ শেষে তাদেরকে স্মরণ করতে ভুললেন না জনপ্রিয় এই অধিনায়ক,
‘দর্শক আজ আমাদের সঙ্গে সবসময় ছিল। বাংলাদেশের সব সমর্থকদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। আশা করি, আমাদের বাকি ম্যাচগুলোতেও এভাবে মাঠে এসে সমর্থন দিয়ে যাবে। আর দেশে যারা টিভিতে খেলা দেখছিলেন, তারাও প্রত্যাশা করেছিলেন আমরা জিতব। আশা করি, তাদের জন্য আরও একটা জয় এনে দিতে পারব, নিউ জিল্যান্ড ম্যাচটাও ভালো হবে।’
সে প্রত্যাশাতেই আজ ওই এগারোজনের দিকে তাকিয়ে থাকবে গোটা বাংলাদেশ।
৩.
তবে নিজেদের পারফরম্যান্স নিয়ে সাকিব আল হাসানের ভাবনাটা অন্যরকম। তার চোখে, বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরেই ‘বিপজ্জনক’। কিন্তু সেটা নাকি বিদেশিরা মানতে চায় না। তিনি ইঙ্গিত দিলেন, বাংলাদেশকে ছোট করে দেখতে গেলেই বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,
‘সবসময়ই আমরা বলার চেষ্টা করি আমরা শক্তিশালী দল, বিপদজ্জনক দল। তবে বাইরের দেশের লোকেরা খুব বেশি পাত্তা দেয় না! এ জায়গাগুলোয় আমাদের প্রমাণের সুযোগ আছে। আমাদের শুরুটা ভালো হলো। মনে করি, সবাই খুবই ভালো অবস্থানে আছে, বিশেষ করে মনস্তাত্ত্বিকভাবে। এভাবে যেতে পারলে আমাদের অনেক দূর যাওয়া সম্ভব।’
নিজেরা যতই শক্তিশালী হন না কেন, এখনই গা ভাসাতে নারাজ তিনি। এবারের বিশ্বকাপে নিজেদের নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। তাই শুরুটা যেমন হলো, সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা চায়। তবে হ্যাঁ, নিজেদের এমন বিশ্বকাপই চেয়েছিলেন তিনি।
সাকিব বলেন,
‘আমি মনে করি, এটি আমাদের অন্যতম সেরা জয়। আমরা আগেও বিশ্বকাপে ম্যাচ জিতেছি, আপসেট ঘটিয়েছি। এটা তো আমার চতুর্থ বিশ্বকাপ। এ বিশ্বকাপে আমাদের প্রমাণ করার অনেক কিছুই আছে। আজ আমরা জিতেছি। এভাবেই বিশ্বকাপের শুরুটা করতে চেয়েছিলাম। শুরুটা তো এর চেয়ে দারুণভাবে আর হতে পারত না। ইংল্যান্ডে আসার আগেই আমাদের মধ্যে একটা বিশ্বাস ছিল। এ ধরনের শুরুটাই আমাদের দরকার ছিল। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা এমন দারুণ একটা শুরু পেয়েছি।’
এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রতি প্রত্যাশার চাপ অনেক বেশি। পাশাপাশি বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে, ‘ইমোশনাল টিম’। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ যখন প্রথম ম্যাচেই তাক লাগিয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশকে নিয়ে পরবর্তী প্রতিপক্ষরা অন্যভাবেই ভাবতে চাইবে। হয়ে যাবে সতর্ক। সে কথাই মনে করিয়ে দিলেন সাকিব।
বললেন,
‘আমাদের মাত্র শুরু হলো। আরও আটটা ম্যাচ আছে। আরও কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে হবে। এ ম্যাচের পর প্রতিপক্ষ আরও সতর্ক হয়ে খেলবে আমাদের সঙ্গে। আমাদের আরও ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। আরও ভালোভাবে পরিকল্পনা কাজে লাগাতে হবে। সবাই আমাদের নিয়ে সতর্ক থাকবে, সেটি আমাদের জন্য একদিক দিয়ে ভালো। এতে তাদের টেনশন কিংবা নার্ভাসনেস কাজ করবে। অন্যদিকে ভীষণ নজর থাকবে আমাদের উপর।’
নিজেদের কাজটা নিজেদেরকেই করতে হবে। সেটা যতই কঠিন হোক না কেন। বাংলাদেশ এবার নিজেদের ইতিহাসের সেরা দল, বিশ্বকাপের অন্যতম অভিজ্ঞ দল। লক্ষ্য এখন একটাই, স্বপ্নকে সত্যি করার। ট্রেন্টব্রিজে আজ সেই স্বপ্নটাকে বুকে নিয়েই মাঠে নামবে টাইগাররা। আর স্বপ্নালু চোখে ওই এগারো জোড়া কাঁধেই ভরসা খুঁজবে বাংলাদেশ।