বিকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি। একটু পরেই শুরু হবে এশিয়ান গেমসের সমাপনী অনুষ্ঠান। মশাল নেভানো হবে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা-পালেমবাংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের ১৮তম আসরের। পরবর্তী আসরকে স্বাগতম জানানোর অপেক্ষায় এশিয়াবাসী। জাকার্তার গেলোরা বাং কারনো স্টেডিয়ামে ধীরে ধীরে অ্যাথলেটদের প্রবেশ শুরু হয়েছে। বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় কেউ কেউ এসেছেন রেইনকোট পরে, কারো কারো হাতে আবার নিজের দেশের ছোট্ট পতাকা।
পদকজয়ী অ্যাথলেটদের মুখে স্বস্তির হাসি। বাকিদের মুখে হাসি থাকলেও আড়ালে চাপা হতাশা। নিজেদের আয়োজনে খুশি ইন্দোনেশিয়া। সমাপনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট থমাস বাখ। এশিয়ান গেমসের পরবর্তী আসর বসবে চীনের হ্যাংঝো শহরে ৷ বিশেষ আমন্ত্রণে তাই নিজ শহরের প্রচারণায় সমাপনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন হ্যাংঝো শহরের দুই কৃতি সন্তান বিশ্ববিখ্যাত ই-কমার্স সাইট আলীবাবার সহ-প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা এবং অলিম্পিকে স্বর্ণপদকজয়ী সাঁতারু সান ইয়াং।
সমাপনী অনুষ্ঠানটি স্মরণীয় করে রাখতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না আয়োজকদের। দেশ-বিদেশের নানা শিল্পী এবং নৃত্যশিল্পীদের নজর কাড়া পারফরম্যান্সে মুগ্ধ অ্যাথলেটরা, সাথে স্টেডিয়ামে আসা দর্শকরাও। একটু পরে অলিম্পিক কাউন্সিল অফ এশিয়ার প্রেসিডেন্ট শেখ আহমাদ আল ফাহাদ আল আহমেদ আর সাবাহর সমাপনী বক্তব্য। পরবর্তী আসরকে স্বাগতম জানিয়ে এবারের আসরকে বিদায় জানানো, ধীরে ধীরে নিভলো মশাল। সেই সাথে এশিয়ান গেমসে ব্যর্থতার একটি অধ্যায় শেষ করলো বাংলাদেশ।
১৯৫১ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় ১ম এশিয়ান গেমস। নিয়মানুসারে ৪ বছর পর পর এশিয়ান গেমস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও ৩ বছর পর ১৯৫৪ সালে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ান গেমসের ২য় আসর। ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ। সেই আসরে বাংলাদেশ ছিল পদকশূন্য। পরের আসরেও ১৯৮২ সালে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে বাংলাদেশকে। ১৯৮৬ এশিয়ান গেমসে বক্সার মোশাররফ হোসেন জেতেন ব্রোঞ্জ, যা এশিয়ান গেমসের ইতিহাসে বাংলাদেশের পাওয়া প্রথম কোনো পদক।
১৯৮৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত টানা ৮ আসরের কোনোবারই এশিয়ান গেমস থেকে খালি হাতে ফেরেনি বাংলাদেশ ৷ এ পর্যন্ত এশিয়ান গেমসে পাওয়া বাংলাদেশের মোট পদক সংখ্যা মোট ১২টি। ১৯৭৮ এবং ১৯৮২ সালের পর এই প্রথম এশিয়ান গেমসে পদকশূন্য বাংলাদেশ। এশিয়ান গেমসে বরাবরই চীনের দাপট। ব্যতিক্রম ছিলনা এবারও। এবারের এশিয়ান গেমসে অংশ নিয়েছে এশিয়ার ৪৫টি দেশের মোট সাড়ে এগারো হাজারেরও বেশি এ্যাথলেট। পদক পেয়েছে মোট ৩৭টি দেশের অ্যাথলেটরা। পদকজয়ীদের তালিকায় আছে পাকিস্তান, নেপাল কিংবা আফগানিস্তানও। ১৪টি ইভেন্টে ১১৭ জন অ্যাথলেট নিয়েও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে বাংলাদেশকে। তবুও সফলতা বলতে গেলে ফুটবলে কাতারকে হারিয়ে ২য় রাউন্ডে উত্তীর্ণ হওয়া। হতাশ করেছেন শ্যুটাররা। প্রত্যাশা ছিল গত সাউথ এশিয়ান গেমসে সোনাজয়ী ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্তকে নিয়ে।
তবে সেই প্রত্যাশার সাথে আর প্রাপ্তির মিলন ঘটেনি ৷ মাবিয়া ছিলেন এবারের এশিয়ান গেমসে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পতাকা বহনকারী। তবে সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছে কাবাডি। এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের পাওয়া মোট ১২টি পদকের ৭টিই এসেছে কাবাডি থেকে, যার মধ্যে ৫টি পুরুষ দলের এবং বাকি ২টি নারী দলের। তবুও সীমিত এই সাফল্যটুকুই হোক না বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
১. এশিয়ান গেমস ১৯৮৬, সিউল (দক্ষিণ কোরিয়া)
সিউলে অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ান গেমসের ১০ম আসর। ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ই অক্টোবর পর্যন্ত চলা এই গেমসে অংশ নেয় ২৭টি দেশ। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে উত্তর কোরিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, আফগানিস্তানসহ মোট ১০টি দেশ নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়।
ফুটবল, হকি এবং বক্সিংয়ে অংশ নেয় বাংলাদেশ। একই গ্রুপে বাংলাদেশের সাথে ছিল কুয়েত, ইরান, জাপান এবং নেপাল। ফুটবল থেকে একমাত্র জয়টি আসে নেপালের বিপক্ষে। আগের বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ার গেমসে সোনা জেতেন মোশাররফ হোসেন। তাকে নিয়ে অন্যরকম প্রত্যাশা ছিল বক্সিং ফেডারেশনের। নিরাশ করেননি তিনি, বক্সিংয়ের ৮১ কেজি লাইট হেভিওয়েট ওজন ক্যাটাগরিতে ভারতের ধ্যানবাহাদুর গুরুংয়ের সাথে ব্রোঞ্জ জেতেন রাজশাহীর এই বক্সার, তৈরি হয় ইতিহাস। প্রথমবারের মতো এশিয়ান গেমসে পদক পায় বাংলাদেশ। বলা বাহুল্য, সেই ব্রোঞ্জ পদকটি এশিয়ান গেমসে বক্সিং থেকে পাওয়া বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র পদক ৷
২. এশিয়ান গেমস ১৯৯০, বেইজিং (চীন)
১১তম আসরে প্রথম চালু করা হয় কাবাডি। অংশ নেয় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, জাপানসহ মোট ৬টি দেশ। নিয়ম অনুযায়ী, প্রত্যেকটি দলই খেলবে রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতিতে। পয়েন্ট অনুসারে শীর্ষ তিন দল জিতবে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জ। পাঁচ ম্যাচে পাঁচটিতেই জয় নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থেকে সোনা নিশ্চিত হয় ভারতের। সমান সংখ্যক ম্যাচ খেলে সমান পয়েন্ট অর্জন করে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ। দুই দলের মধ্যে পুনরায় আয়োজন করা হয় ম্যাচ। সেই ম্যাচে ১৯-১৪ পয়েন্টে পাকিস্তানকে হারিয়ে রৌপ্যপদক জেতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান পায় ব্রোঞ্জ ।
৩. এশিয়ান গেমস ১৯৯৪, হিরোশিমা ( জাপান)
আগের আসরেই কাবাডিতে চীন অংশ নিলেও এই বছরে অংশ নিতে পারেনি। অংশ নেয় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ মাত্র পাঁচটি দেশ। প্রথম ম্যাচটি ছিল ভারত-পাকিস্তানের। দুই দেশের লড়াই সীমান্তে যতটুকু, খেলার মাঠে তার এক চুলও কম নয়। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। নানা অনিয়ম এবং বিতর্কে ভরপুর সেই ম্যাচটি বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। তবে বাকি তিনটি দেশের সাথে জিতে যথারীতি পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থেকে আবারও স্বর্ণ জেতে ভারত। আগের বছর রৌপ্যপদক জেতা বাংলাদেশ এবার পায় ব্রোঞ্জ। বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে রৌপ্যপদক জেতে পাকিস্তান।
৪. এশিয়ান গেমস ১৯৯৮, ব্যাংকক (থাইল্যান্ড)
এশিয়ান গেমসের প্রত্যেক আসরেই বাড়তে থাকে প্রতিযোগী, বাড়তে থাকে ইভেন্টের সংখ্যাও। কাবাডিতে অংশ নেওয়া দলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় সাতে। তবে মাত্র চারটি ম্যাচ খেলেই গেমস থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয় নেপাল। এশিয়ান গেমসে কাবাডিতে অলিখিত এবং অঘোষিত চ্যাম্পিয়ন ভারত। ব্যতিক্রম ঘটেনি সেবারও, সর্বোচ্চ পয়েন্ট নিয়ে আবারো সোনা যায় ভারতের ঘরে। থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ৮৪-১৩ ব্যবধানে জেতে বাংলাদেশ, তবে পয়েন্ট তালিকায় গতবারের মতো সেবারও বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে রৌপ্যপদক জেতে পাকিস্তান, বাংলাদেশ পায় ব্রোঞ্জ।
৫. এশিয়ান গেমস ২০০২, বুসান (দক্ষিণ কোরিয়া)
দক্ষিণ কোরিয়ায় এশিয়ান গেমসের ১৩তম আসর। প্রথমবার কাবাডিতে অংশ নেয় মালয়েশিয়া। এবারও কাবাডির শ্রেষ্ঠত্ব যায় ভারতের কাছে। তিনটি ম্যাচ জিতে সমান পয়েন্ট পায় বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান। তবে বিগত ম্যাচগুলোর গেম পয়েন্ট যোগ করে মোট পয়েন্টের হিসেবে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে রৌপ্যপদক জেতে বাংলাদেশ।
৬. এশিয়ান গেমস ২০০৬, দোহা (কাতার)
১২টি ইভেন্টে মোট ৭৩ জনকে নিয়ে কাতারের দোহাতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে অংশ নেয় বাংলাদেশ। এশিয়ান গেমসে কাবাডিতে প্রথমবারের মতো খেলে ৮টি দল। এই আট দলকে ভাগ করা হয় দুই গ্রুপে। গ্রুপ-এ’তে বাংলাদেশের সঙ্গী হয় পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড। দুই গ্রুপের শীর্ষ দুই দল ভারত ও পাকিস্তান লড়াই করে স্বর্ণপদকের জন্য। আর তাতে ৩৬-২৩ পয়েন্টে পাকিস্তানকে হারিয়ে টানা পঞ্চমবারের মতো কাবাডিতে সোনা জেতে ভারত। ব্রোঞ্জের লড়াইয়ে ইরানের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ এবং ৩৭-২৬ পয়েন্ট ব্যবধানে ইরানকে হারিয়ে ব্রোঞ্জ পদক জিতে নেয়।
৭. এশিয়ান গেমস ২০১০, গুয়াংজু (চীন)
এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য আসে এই আসরেই। এ আসরে একটি স্বর্ণপদকসহ তিনটি পদক পায় বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত করা হয় ক্রিকেটকে, তবে তাতে অংশ নেয়নি ক্রিকেটের ‘এশিয়ান জায়ান্ট’ ভারত। ফাইনালে আফগানিস্তানকে ৫ উইকেটে হারায় বাংলাদেশ। আশরাফুল, নাসির, সাব্বিরদের হাত ধরে ২০১০ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ পায় তার প্রথম স্বর্ণপদক। গুয়াংজু থেকে ভেসে আসে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’র সুরধ্বনি। নারী ক্রিকেটে পাকিস্তানের কাছে হেরে স্বর্ণপদক হাতছাড়া হয় বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের। বিগত আসরগুলোতে কাবাডি থেকে সফলতা আসে বাংলাদেশ পুরুষ কাবাডি দলের হাত ধরেই। তবে এই আসরে পুরুষ কাবাডি দলকে ছাপিয়ে যায় নারীরা। ইরানের সাথে যৌথভাবে ব্রোঞ্জ লাভ করে বাংলাদেশ নারী কাবাডি দল।
৮. এশিয়ান গেমস ২০১৪, ইনচেন (দক্ষিণ কোরিয়া)
আগের বছর পুরুষ ক্রিকেট থেকে আসে সোনা। একই লক্ষ্যে এবারও মিশন শুরু করে বাংলাদেশ। সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি টাইগাররা প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নামার পর ১১ ওভার শেষে হানা দেয় বৃষ্টি। পরে আর মাঠে গড়ায়নি খেলা, টস ভাগ্যে নির্ধারণ করা হয় ম্যাচের ফলাফল। ভাগ্য সহায় হয়নি বাংলাদেশের, ফাইনালে পৌঁছে যায় শ্রীলঙ্কা। হংকংয়ের বিরুদ্ধে ২২ রানে জিতে ব্রোঞ্জ পদক পায় বাংলাদেশ। নারী ক্রিকেটে এবারও পাকিস্তানের কাছে হারতে হয় নারী ক্রিকেট দলকে। অন্য দিকে, আগের বছর ব্রোঞ্জ জেতা নারী কাবাডি দলকেও এবারও ব্রোঞ্জ পদকেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
ফিচার ইমেজ: cricketcountry.com