ফুটবলে বিপক্ষ দল ছাড়াও আরেকটি প্রতিপক্ষের সাথে নীরব লড়াই করতে হয় খেলোয়াড়দের, তা হলো ইনজুরি। ক্যারিয়ারের যেকোনো সময়ে প্রতিপক্ষের বিপজ্জনক আঘাত, অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা, নিছক অসতর্কতা কিংবা অনিচ্ছাকৃত ভুলে শেষ হয়ে যেতে পারে একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের লালিত স্বপ্ন। বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের স্বপ্ন থাকে ত্রিশের পরও সামর্থ্য অনুযায়ী খেলা চালিয়ে যাওয়া এবং যতদিন সম্ভব ক্যারিয়ার সামনে নিয়ে যাওয়া। ইচ্ছে থাকে নিজের সেরাটা দিয়ে সেরা সময়ে অবসর নেওয়ার।
অনেকের স্বপ্ন পূরণ হয়। তবে কারো কারো স্বপ্ন পূরণ হয় না। ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে ক্যারিয়ার শেষ করতে হয় অল্প সময়েই। ফুটবলারদের জীবনে ইনজুরি হয়ে আসে নীরব ঘাতক হয়ে, ক্রমাগত লড়াই চালিয়ে গেলেও একসময় উপলব্ধি হয়ে যায় শরীর আর নিতে পারছে না। বাধ্য হয়ে অবসরে যেতে হয় খেলোয়াড়দের। প্রত্যেক প্রজন্মে ক্যারিয়ারের পূর্ণতা পায়নি এমন কম-বেশি খেলোয়াড়ের দেখা পাওয়া যায়। ইনজুরির সাথে যুদ্ধ করে পরাজয় বরণ করা দুর্ভাগা কিছু খেলোয়াড় নিয়ে থাকছে আজকের আলোচনা। এদের কাছ থেকে হয়তো ফুটবলের অনেক কিছুই পাওয়ার ছিল।
ব্রায়ান ক্লাফ
কিংবদন্তি এই ইংলিশ কোচের নাম শুনলেই তার অনবদ্য কোচিং ক্যারিয়ারের কথা চলে আসে। তবে একজন স্ট্রাইকার হিসেবে ব্রায়ান ছিলেন দুর্দান্ত। একজন স্ট্রাইকারের অর্জনের মাপকাঠি যদি শুধুমাত্র গোল হয়, তাহলে ব্রায়ানের অর্জন ছিল অসামান্য এবং নিজেকে নিয়ে যেতে পারতেন সাফল্যের চরম শিখরে। কিন্তু না, পারেননি তিনি।
ইংলিশ লিগে সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে ২৫০ গোলের মাইলফলক ছোঁয়া স্ট্রাইকার হলেন ব্রায়ান এবং তার এই রেকর্ড আজও বিদ্যমান। ১৯৬২ সালের বক্সিং ডে, সান্ডারল্যান্ডের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন অসাধারণ ফর্মে থাকা ব্রায়ান, ম্যাচে প্রতিপক্ষ ব্যারির গোলরক্ষকের সাথে একটি সংঘর্ষ শেষ করে দেয় প্রতিভাবান এই স্ট্রাইকারের গোলরথ। হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেলে প্রায় দুই বছর মাঠের বাইরে কাটাতে হয় তাকে। মিডলসব্রোর হয়ে মাত্র ২২২ ম্যাচে ২০৪ গোল এবং সান্ডারল্যান্ডে গিয়ে মাত্র ৭৪ ম্যাচে ৬৯ গোল করা ব্রায়ান শেষপর্যন্তও হার মানতে চাননি। দুই বছর পর মাঠে ফিরে আসেন। কিন্তু ফিরে আসলেও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে আবারো প্রতিপক্ষের রক্ষণে আতংক হয়ে ওঠা হয়নি আর। ইনজুরির সাথে না পেরে মাত্র ৩ ম্যাচের পর ২৯ বছর বয়সে অবসর নিতে বাধ্য হন এই স্ট্রাইকার।
মার্কো ফন বাস্তেন
৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার ডাচ কিংবদন্তি স্ট্রাইকার মার্কো ফন বাস্তেন ১৯৮১ সাল থেকে শুরু করে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ফুটবল মাঠ। প্রতিপক্ষের রক্ষণ শিবির গুড়িয়ে দিয়ে গোলের পর গোল করেছেন। আয়াক্সের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা বাস্তেনের ক্যারিয়ার শেষ হয়েছিল এসি মিলানে। ইনজুরির কারণে ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ খেলতে না পারার আক্ষেপ হয়তো আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন এই কিংবদন্তি।
তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল তার খেলার ধরণ, গোলের নেশা এবং তৎকালীন সময়ে মারাত্মক সব ট্যাকলের শিকার হয়ে। বলা হয়, বাস্তেন একটি গোল করতে গিয়ে কমপক্ষে তিনটি লাথি হজম করতেন। বয়সের অনুপাতে বেশি পরিমাণ ফুটবল খেলাকেও বাস্তেনের ইনজুরির অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।
গোড়ালির হাড়ের ইনজুরি বাস্তেনকে বারবার সার্জনের অপারেশন টেবিলে যেতে বাধ্য করেছিল। ক্লাব ক্যারিয়ারে ৩৭৩ ম্যাচে ২৭৬ গোল করেছিলেন বাস্তেন, জাদুকরী ক্যারিয়ারে দেশের হয়ে তার গোল ২৪টি। এসি মিলানে থাকাকালীন সময়ে আবারো গোড়ালির ইনজুরিতে আক্রান্ত হলে পুরো ১৯৯৩-৯৪ মৌসুম মাঠের বাইরে কাটান তিনি।
আসন্ন বিশ্বকাপ খেলতে চাইলেও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত যেন না ঘটে তাই ক্লাব তাকে খেলতে বারণ করেছিল। শেষপর্যন্ত আর মাঠে ফিরতে পারেননি, ১৯৯৫ সালে ৩০ বছরে পা দিতেই ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে দেন এই ডাচ কিংবদন্তি। ইনজুরির ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে বাস্তেন বলেছিলেন, “কীভাবে আমি গোড়ালিকে আক্রান্ত করেছি তা নয়, আমার জন্য সবচেয়ে বেশি হতাশার হলো কিছু ডাক্তারের চিকিৎসা। আমার গোড়ালির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে যে, সে কোনো খেলোয়াড় নয়, সে একজন সার্জন।”
জাস্ট ফন্টেইন
ফরাসি কিংবদন্তি জাস্ট ফন্টেইন বিখ্যাত এক বিশ্বকাপে তার ১৩ গোলের রেকর্ডের জন্য। ১৯৫৮ সালের এই অর্জন আজ পর্যন্ত কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। নিজের সময়ের অন্যতম সেরা এই খেলোয়াড় ছিলেন একজন অসাধারণ গোলমেশিন। ১৯৫৩-৬২, এই স্বল্প সময়ের ক্লাব ক্যারিয়ারে ফন্টেইনের গোল সংখ্যা ২৩৫ ম্যাচে ১৯৭। দেশের হয়ে ১.৪৩ গড়ে ২১টি ম্যাচ খেলেই গোল করেছিলেন ৩০টি। ফুটবল বিশ্বকাপে মাত্র দুজন খেলোয়াড়ের একজন এই কিংবদন্তি, যারা বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচে গোল করেছিলেন।
ফন্টেইন ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ফ্রান্স ও জন্মভূমি মরক্কোর। পেলের করা ১২৫ জন জীবিত কিংবদন্তির তালিকায় রয়েছেন ফন্টেইন এবং ফরাসি ফুটবল কর্তৃক বিগত ৫০ বছরের সেরা ফরাসি ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০০৩ সালে। ১৯৬০ সালেই পরপর দুবার পা ভেঙ্গে গিয়েছিল তার।
ইনজুরিকে শেষপর্যন্ত পরাজিত করতে পারেননি তিনি। ১৯৬২ সালের জুলাইতে ইনজুরির ধকল সামলে উঠতে না পারায় মাত্র ২৮ বছর বয়সেই বুট জোড়া তুলে রাখেন তিনি। অর্জনের খাতায় হয়তো আরো অনেক কিছু যোগ হতে পারতো তার, কিন্তু সব আলো কেড়ে নিয়েছিল ইনজুরি।
ডিন অ্যাশটন
প্রতিপক্ষের আঘাতে অবসর নেয়ার নেয়ার ঘটনা অনেক। তবে নিজের দলের খেলোয়াড়ের আঘাতে অবসর নিতে বাধ্য হওয়া ফুটবলার খুব কমই আছে। এমন দুর্ভাগাদের একজন হলেন ডিন অ্যাশটন। আলেক্সান্ড্রাতে ২০০০ সালে ক্যারিয়ার শুরুর পাঁচ বছর পর ইংলিশ ক্লাব নরউইচে পাড়ি জমান এই স্ট্রাইকার। দারুণ পার্ফরম্যান্সের সুবাদে পরের বছরই তাকে দলে টেনে নেয় ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড। ওয়েস্ট হ্যামের হয়ে মাঠে নিজের চোখ ধাঁধানো পার্ফরম্যান্স করেন। এর ফলে ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ আসে। ম্যাচটির প্রশিক্ষণ চলাকালে রাইট ফিলিপের ভয়াবহ আঘাতে গোড়ালি ভেঙ্গে যায় অ্যাশটনের। এই আঘাতই শেষ করে দেয় ফর্মের তুঙ্গে থাকা এই স্ট্রাইকারের ক্যারিয়ার। ২০০৬-০৭ মৌসুমের পুরোটা তাকে মাঠের বাইরে থাকতে হয়।
২০০৮ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে নিজের প্রথম ও শেষ ম্যাচটি খেলেছিলেন ত্রিনিদাদের বিপক্ষে। পরবর্তী ২০০৮-০৯ মৌসুমে মাঠে ফিরে নিজের পুরনো ফর্মে ফেরার কিছুটা আভাস দিলেও গোড়ালির ইনজুরিতে ভুগেন তিনি। প্রিমিয়ার লিগে মাত্র ৬২টি ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়েছিলো অ্যাশটনের, গোল করেছিলেন ২২টি। ক্রমাগত ইনজুরির সমস্যা সামলে উঠতে না পারায় ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে মাত্র ২৬ বছর বয়সে অবসর নেন তিনি। ইনজুরি কেড়ে না নিলে হয়তো প্রিমিয়ার লিগ ও ইংলিশ ফুটবলের একজন কিংবদন্তি হয়ে উঠতেন অ্যাশটন।
জেবাস্তিয়ান ডাইসলার
নিজের সময়ে জার্মানির সম্ভাবনাময় একজন খেলোয়াড় ছিলেন ডাইসলার। কিন্তু নিজের সেরাটা দিতে পারেননি কখনোই। গোটা ক্যারিয়ার জুড়েই ভুগেছেন নানাবিধ ইনজুরিতে। সবচেয়ে মারাত্মক ছিল লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়া এবং সাইনোভিয়াল মেমব্রেনের সমস্যা।
বুরুশিয়া মনশেনগ্লাডবাথে শুরুর পর হেয়থা বার্লিনের হয়ে খেলেছিলেন। সাফল্যের পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে যেতে ২০০২ সালে যোগ দিয়েছিলেন পৃথিবীর অন্যতম সেরা ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখে। কিন্তু বিধি বাম। ক্রমাগত ইনজুরির ধকলে সাড়ে চার বছরে বায়ার্নের হয়ে মাঠে নামতে পেরেছিলেন মাত্র ৬২টি ম্যাচে। ইনজুরিতে পড়ে ক্যারিয়ার ধ্বংসের মুখে পড়ে যাওয়ায় একসময় প্রবল হতাশায় ভুগতে থাকেন। হতাশার সমস্যার জন্যও তাকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়।
শেষপর্যন্ত কিছুটা থিতু হন ২০০৪-০৫ মৌসুমে। বায়ার্নের হয়ে পুরো মৌসুমেই মাঠে থাকতে পেরেছিলেন তিনি। মাইকেল বালাক বায়ার্ন ছাড়ার পর, দলে মাঝমাঠের কাণ্ডারি হয়ে উঠেছিলেন তিনিই। ২০০৬ সালে আবারো ডান হাঁটুর সাইনোভিয়াল মেমব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হলে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ দলে জায়গা হয়নি তার। কয়েক মাস পর মাঠে ফিরলেও শরীরের সাথে মনের জোরও হারিয়ে ফেলেছিলেন। শেষপর্যন্ত ইনজুরির কাছে বাধ্য হয়ে হার মেনে ২০০৭ সালে ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে ইতি টানেন ক্যারিয়ারের।
বেন কলেট
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড় কলেটের ক্যারিয়ার বলতে গেলে শুরুর আগেই শেষ হয়ে যায়। ইউনাইটেডের একাডেমি থেকে উঠে আসা এই তরুণের সামনে ছিল দারুণ সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার, কিন্তু মারাত্মক আঘাতের শিকার হয়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই অবসর নিতে হয় তাকে। ২০০৩ সালে মিডলসব্রোর বিপক্ষে একটি ম্যাচে গ্যারি স্মিথের আঘাতে ডান পায়ের দুটি হাড় ভেঙ্গে যায়। এই ইনজুরি থেকে আর কখনোই পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি তিনি।
এই ঘটনা আদালতে গড়ালে ২০০৮ সালে কলেটের ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত করার দায় স্বীকার করে মিডোলসব্রো ও স্মিথ। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ও গ্যারি নেভিলের মতে, ইনজুরি যদি না থামিয়ে দিতো তাহলে কলেট একজন সফল ফুটবলার হতে পারতেন। ইনজুরিতে আক্রান্ত না হলে, সপ্তাহে কলেট ১৩ হাজার ইউরো আয় করতে পারতেন এবং ৩৫ বছর পর্যন্ত খেলতে পারতেন। তাই সামগ্রিক বিবেচনায়, কলেটকে ৪.৫ মিলিয়ন ইউরো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রায় দিয়েছিল আদালত।
লেডলি কিং
অনেকেই মনে করতেন, লেডলি কিং হতে পারতেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন সেন্টার ব্যাক। ফরাসি কিংবদন্তি অরি বলেছিলেন, প্রতিপক্ষ হিসেবে মুখোমুখি হওয়া কিং ছিল তার দেখা সেরা ডিফেন্ডার। ১৯৯৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত উত্তর লন্ডনের টটেনহ্যামেই কাটিয়েছেন নিজের সম্পূর্ণ ক্যারিয়ার। কিন্তু এত লম্বা সময় ধরে একটি ক্লাবে থাকলেও খেলতে পেরেছিলেন মাত্র ৩১৫টি ম্যাচ। তার ইনজুরি সম্বন্ধে তৎকালীন স্পার্স কোচ রেডন্যাপ বলেছিলেন,
“এর কোনো নিরাময় নেই। অপারেশন করারও কিছু নেই। …এটা শুধু পরিচালনার ব্যাপার। খেলার পর এটি ফুলে ওঠে এবং সাধারণত কমপক্ষে ৭দিন সময় লাগে আবার সেরে উঠতে। সে খুব কমই প্রশিক্ষণে আসে, বেশিরভাগ সময়ে ব্যায়ামাগারে যায় নিজেকে ঠিক রাখার জন্য। কিন্তু দৌড়াদৌড়ির মতো কিছু নয়। সে যদি মৌসুমে ২০টি ম্যাচও খেলে, তবুও তাকে রাখা যায়, কারণ সে এতটাই ভালো যে এতে আমাদের জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।”
তার বাম হাঁটুতে কোনো কোমলাস্থি (cartilage) ছিল না। কিংয়ের ডাক্তার তাকে অতিমানব হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ইনজুরির সাথে টানা যুদ্ধ করে গেলেও শেষের দিকে আর টেনে নেয়া সম্ভব হচ্ছিল না তার পক্ষে। পার্ফরম্যান্সে ছাপ পড়তে থাকে মারাত্মক ইনজুরির। অবশেষে ২০১২ সালে কিং ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। ইংল্যান্ডের হয়ে ২১টি ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি এবং গোল করেছিলেন ২টি।
ফিচার ইমেজ- thesun.co.uk