বিদায়, লিটল চিফ

হাভিয়ের মাশ্চেরানো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বুটজোড়া তুলে রাখবেন। অবশ্য সাধারণ ফুটবল দর্শকদের চোখের আড়াল হয়েছেন, তার দু’বছর পেরিয়ে গেছে। 

২০১৮ এর জানুয়ারিতে ছেড়েছিলেন বার্সেলোনা, সে বছরই বিশ্বকাপে আরেকবার হৃদয় ভাঙার পর বললেন, আর না। এরপর চীনে হেবেই ফরচুন ঘুরে স্বদেশের মাটিতে ক্লাব এস্তুদিয়ান্তেস। সেখান থেকেই ঘোষণা, আর নয়। 

অর্জনের খেরোখাতায় তার প্রজন্মের সব আর্জেন্টাইনের মতো তার ডালিটাও শূন্য। বার্সেলোনার বদৌলতে অবশ্য ১৯টি ট্রফি, পাঁচটি লিগ শিরোপার সঙ্গে দু’টি চ্যাম্পিয়নস লিগও আছে সেখানে। 

ক্যারিয়ারের দীর্ঘতম সময় কাটিয়েছেন বার্সেলোনার হয়েই; Photo: Laurence Griffiths/Getty Images

হাভিয়ের মাশ্চেরানোর ক্যারিয়ার, কোথায় খেলেছেন, কী কী জিতেছেন – সেটার ফর্দ খুঁজতে গেলে গুগলই আপনাকে পথ দেখাবে। কিন্তু গুগল কি শত চেষ্টা করেও এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে, মাশ্চেরানো কে ছিলেন? মাশ্চেরানো কী ছিলেন? 

খুব সম্ভবত না। মাশ্চেরানোকে আপনি তার ক্যারিয়ারের সাত শতাধিক ম্যাচের সংখ্যাতে পাবেন না। মাশ্চেরানোকে খুঁজতে হলে আপনাকে ডুব দিতে হবে অতীতে, ২০১১ কিংবা ২০১৪ সালে। 

সেবারের চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডে বার্সেলোনার প্রতিপক্ষ আর্সেনাল। ঘরের মাঠ এমিরেটসে প্রথম লেগটা আর্সেন ওয়েঙ্গার শিষ্যরা পকেটে পুরেছিল ২-১ গোলে। ফিরতি লেগে যখন মিনিটের কাটা ৮৭ এর ঘর পেরিয়ে গেছে, লিওনেল মেসির জোড়া গোলের সঙ্গে জাভির গোলে ৩-১ ব্যবধানে এগিয়ে কাতালানরা, অ্যাগ্রেগেটে লিড তখন ৪-৩। 

ঠিক সেই সময় লেফটব্যাক আদ্রিয়ানোর ভুলে ফাঁকা জায়গায় বল পেয়ে গেলেন জ্যাক উইলশায়ার। বল পেয়ে নিখুঁত পাসে খুঁজে নিলেন স্ট্রাইকার নিকোলাস বেন্টনারকে। বেন্টনার গোল করলেই অ্যাওয়ে গোলের হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালের টিকেট কেটে ফেলবে গানাররা। 

বেন্টনারকে আটকে দিলেন!; Photo: Mike Egerton/Getty Images

কিন্তু ঠিক সেই সময় নিখুঁত এক ট্যাকেলে বার্সেলোনাকে বাঁচালেন এক আর্জেন্টাইন। বার্সেলোনার আর্জেন্টাইন শুনলে মেসির নাম মাথায় আসাটাই স্বাভাবিক, তবে সেবার তাদের বাঁচানোর দায়টা নিতে হয়েছিলো মাশ্চেরানোর।

সেই ট্যাকলে দুই কোচের প্রতিক্রিয়াই বলে দিচ্ছিল মাশ্চেরানোর মাহাত্ম্যের কথা। পেপ গার্দিওলা যেখানে ভীষণ খুশিতে উন্মত্ত উদযাপন করছেন, আর্সেন ওয়েঙ্গার সেখানে হাঁটুর ওপর বসে পড়ে অবিশ্বাস নিয়ে তাকাচ্ছেন বার্সেলোনা বক্সের দিকে। যেন কোন এক দৈববলে মাশ্চেরানো আটকে দিয়েছিলেন আর্সেনালকে। 

সেই দৈব আবারও মাশ্চেরানোর ওপর ভর করলো বছর তিনেক পর, এবার বিশ্বকাপে। ২৮ বছরের বিশ্বকাপ-খরা ঘোচানোর মিশনে সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌছে গিয়েছিল আলেহান্দ্রো সাবেলার দল। সামনে নেদারল্যান্ডস, যারা শেষবার পুড়েছিলো আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা নামের আগুনে। 

অন্য সেমিফাইনালে জার্মানি যেখানে করলো গোলৎসব, আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস সেখানে বড্ড ম্যাড়মেড়ে। কোনো দলই ঠিক পরিষ্কার সুযোগ তৈরি করতে পারল না, গোলশূন্য ড্র হয়ে অতিরিক্ত সময়ের দিকে এগুচ্ছে খেলা, চলছে ৯০ মিনিট শেষে স্টপেজ টাইম। 

ঠিক সেই মুহূর্তে মরা ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণ করতেই যেন আর্জেন্টিনার বক্সে ঢুকে পড়লেন আরিয়েন রোবেন। শটটাও নিলেন, কিন্তু সারা জীবন আড়াল খুঁজে বেড়ানো আর্জেন্টাইন দেবদূত ঠিকই নিখুঁত ট্যাকল আরেকবার করে ফেললেন। নাহ, রোবেনকে ছুঁতে চাইলেন না তিনি; স্রেফ বলকে পাখির চোখ করে প্রাণপণে বাড়িয়ে দিলেন বিশ্বাসী ডান পা, আর সেটা কোনোক্রমে বলটাকে ছুঁয়ে দিল একদম শেষ মুহূর্তে। রোবেন অবিশ্বাসে দু’হাতে নিজের মুখ জড়িয়ে ধরেন, কিন্তু তাতে বাড়ে স্রেফ আফসোস। 

সেই মহাকাব্যিক ট্যাকল; Photo: Adrian Dennis/Getty Images

সেই ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময় ঘুরে টাইব্রেকারে। সেখানে সার্জিও রোমেরোর অনন্যতা, ফাইনালে আর্জেন্টিনা। 

সেই ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে যখন মারিও গোৎজে আর্জেন্টাইন ডি-বক্সে মরণকামড় দেবার জন্য বল পান, তখন হয়তো প্রতিটি আর্জেন্টিনা-ভক্তই তার পাশে খুঁজেছিলেন মাশ্চেরানোকে, পাননি। আর্জেন্টিনাও পায়নি বিশ্বকাপ। তাই এত এত গোলের ভিড়েও সেই বিশ্বকাপের আইকনিক দৃশ্য হয়ে দাঁড়াল শেষ পর্যন্ত মেসির বিশ্বকাপ ট্রফির দিকে এক পৃথিবী দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকার ছবিটি। ভাগ্যের কী পরিহাস দেখুন, ফাইনালের পর আপনি মাশ্চেরানোকে খুঁজে দেখলেনও না, পেলেনও না। 

অথবা আপনি মাশ্চেরানোকে খুঁজে পাবেন তার বার্সেলোনা ক্যারিয়ারে। যতদিনে বার্সায় এসেছেন, ততদিনে গায়ের সঙ্গে এঁটে গেছে বিশ্বের অন্যতম সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের তকমা। লিভারপুলে খেলেছেন স্টিভেন জেরার্ড ও জাবি আলোনসোর পাশে, আর্জেন্টিনায় ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডের পজিশনটাও নিজের পকেটেই। কিন্তু স্বপ্নপূরণ করতে বার্সায় এসে বুঝলেন, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডে মাঝেমধ্যে সুযোগ হতে পারে, তবে সে আশায় বসে থাকলে বেঞ্চেই জায়গা নিশ্চিত। কেননা, বার্সেলোনার ঘরের ছেলে সার্জিও বুস্কেটস তখন নিজের সেরা ফর্মে; সেই বুস্কেটস, যিনি সময়ের সাথে নিজেকে বানিয়েছেন সর্বকালের সেরাদের একজন। 

মাশ্চেরানো তাই লড়াই করেন, নিজের সাথে, সময়ের সাথে। নিজেকে সময়ের সাথে সাথে রূপান্তরিত করেন সেন্টারব্যাকে। পুয়োল চলে যাবার পর তার অভাব চোখে পড়েনি বার্সেলোনার। অথচ মাশ্চেরানোর বিদায়ের পর থেকে? বার্সেলোনার ডিফেন্স যেন তাসের ঘর, সামান্য বাতাসেই ভেঙে পড়ে হুড়মুড়িয়ে। 

বার্সেলোনা কিংবা আর্জেন্টিনার গোল উদযাপনের সময় কোচের কাছে চলে যেতেন মাশ্চেরানো। কোচ তাকে কী যেন বলতেন, মাশ্চেরানো ভদ্র ছেলের মতো শুনে চলে আসতেন, বুঝিয়ে দিতেন সবাইকে। মাশ্চেরানো এমনই, তাকে উদযাপনে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, ক্যামেরায়ও।

বার্সাকে বিদায় বলার দিন; Photo: Lluis Gene/Getty Images

তবে মাশ্চেরানো কাঁদেন। বার্সেলোনা ছেড়ে যাবার দিন কাঁদেন। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, 

‘আমি ভাগ্যবান, কারণ সাড়ে সাত বছর আগে আমি এসেছিলাম একটি স্বপ্ন পূরণ করতে। আর এখন জেগে উঠতে হবে, স্বপ্নের সময় শেষ। স্বপ্নটা টিকে ছিল আমি যতটুকু ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক লম্বা সময়। কিন্তু সময় এসেছে বিদায় বলার। এবং এতখানি ভালোবাসা নিয়ে যেতে পারাটা একজন মানুষের জীবনের সেরা ব্যাপার।’

কিন্তু তবু ক্যামেরার লেন্স লিওনেল মেসির কান্নাকে খুঁজে বেড়ায়, মাশ্চেরানোর কান্না থাকে উপেক্ষিত। বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে ছিটকে পড়ে জানিয়ে দেন, এই ছিল শেষবার, তবে কান্না থাকে না চোখে। বোধহয় সেবার মেনেই নিয়েছিলেন, সময় শেষ। অথবা ছয় মাস আগে বার্সেলোনাকে বিদায় বলার পর অপেক্ষায়ই ছিলেন এই দিনের তাই। 

তার বছরদুয়েকের কিছু সময় পর মাশ্চেরানো আরেকবার বিদায় বলেন ফুটবলকে। তবে এবার শেষবারের মতো। আর মাঠে নেমে হুটহাট ট্যাকল করে প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেবেন না। আর্জেন্টিনা কিংবা বার্সেলোনা হয়তো হতাশ হয়ে ১৪ নম্বর জার্সিটা দিয়ে যাবে একজনের পর আরেকজনকে, কিন্তু মাশ্চেরানোকে পাওয়া যাবে না। সান লরেঞ্জোতে জন্ম নেওয়া ছোটখাটো গড়নের বিশাল হৃদয়ের তাকে হন্যে হয়ে খুঁজবে সবাই, প্রতিধ্বনিত হবে স্রেফ দীর্ঘশ্বাস। 

শুরুর প্রশ্নের উত্তর কী? হাভিয়ের মাশ্চেরানো কে? 

হাভিয়ের মাশ্চেরানো ছিলেন লিটল চিফ। হাভিয়ের মাশ্চেরানো সিংহহৃদয় এক ফুটবলার, যিনি পিছু হটতে জানেননি, যিনি সবুজ ঘাসের ওই ৯০ মিনিটে নিজের জীবন বাজি রাখতে রাজি ছিলেন। যার কাছে বলটা জেতাই ছিল উদ্দেশ্য, যার কাছে ট্যাকলটার আগে ও পরের মুহূর্তগুলো ঝাপসা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সব ফেলে মাথায় তখন নিখুঁত ট্যাকল করবার ইচ্ছে, এবং তিনি সেটা করতেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। আর করবেন না। ১৪ নম্বর ওই জার্সি পরে কেউ আর ঠিক নিখুঁত ট্যাকলটা করবার জন্য অপেক্ষা করবেন না। 

একজন মাশ্চেরানোকে খুঁজবে সবাই; Photo: Jamie Squire/Getty Images

রিভারপ্লেটে শুরু, এস্তুদিয়ান্তেসে শেষ। মাঝখানে করিন্থিয়ানস, ওয়েস্টহ্যাম, লিভারপুল, বার্সেলোনা, হেবেই ফরচুন। এখন শেষ। 

মাশ্চেরানো আর মাঠে রক্ত ঝরাবেন না। আর নিখুঁত ট্যাকেল করবেন না। আরেকবার বিদায় তার মুখ থেকে আর কখনও শুনতে হবে না। 

বিদায়, হাভিয়ের মাশ্চেরানো। বিদায়, লিটল চিফ। আপনার নাম ধ্বনিত হবে আর্জেন্টিনায়-বার্সেলোনায় বহু দিন। প্রজন্মান্তরে গল্প হবে, 

‘জানো? আমাদের একজন লিটল চিফ ছিল!’

An article on Javier Mascherano, the former Argentina and Barcelona player, who announced his retirement on 16 November 2020. 

Featured Photo: Shaun Botterill/Getty Images

Related Articles

Exit mobile version