শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের এক দুর্ভাগা চরিত্র বলা যায় অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে।
কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনের মতো দুই মহীরুহ চলে যাওয়ার পর শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট এক অতল খাঁদে পড়ে গেছে। অনেক রকম চেষ্টা করেও এখান থেকে টেনে বের করা যাচ্ছে না দলটিকে। এই সময়ে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল অবধি সবচেয়ে লম্বা সময়টা ধরে শ্রীলঙ্কা দলের দায়িত্ব সামলেছেন ম্যাথুস।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে তিনি অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন। এরপর থেকে শ্রীলঙ্কা দল আরো এলোমেলো পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়। একটার পর একটা অধিনায়কত্ব বদল করতে থাকে তারা। কোনো সমাধান আসে না। শেষ অবধি তারা সমাধান হিসেবে হাত বাড়ায় সাবেক বাংলাদেশী কোচ চান্দিকা হাথুরুসিংহের দিকে।
হাথুরুসিংহে শ্রীলঙ্কা দলের দায়িত্ব নিয়েই অন্তত সীমিত ওভারের জন্য সেই ম্যাথুসের ওপরই আবার ভরসা করেন। তিনি অনুরোধ করে এই অলরাউন্ডারকে বিশ্বকাপ অবধি অধিনায়কত্ব করতে রাজি করান।
এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাথুসের নেতৃত্বে ভালো একটা সিরিজ কাটায় শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এশিয়া কাপে হয় ভরাডুবি। আর এই ভরাডুবির দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ম্যাথুস। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে সর্বোচ্চ রান করা ম্যাথুসকে দল থেকেও বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।
এরকম একটা বাস্তবতায় শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডকে উদ্দেশ্য করে একটা চিঠি লেখেন ম্যাথুস। যেখানে তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে বলে পরিষ্কার ইঙ্গিত দেন তিনি। তাকে অনুরোধ করে অধিনায়কত্বে ফিরিয়েছিলেন হাথুরুসিংহে। কিন্তু সেই হাথুরুসিংহেই দলের পরাজয়ের সময় দায় নিতে অস্বীকার করলেন। তিনি সব দায় চাপালেন একা অধিনায়ক ম্যাথুসের ওপর। আর এতেই বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ ম্যাথুস।
হাথুরুসিংহের অবশ্য এই পরাজয়ের দায় অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশে থাকতেও এই দেশের সিনিয়র ক্রিকেটারদের বিভিন্ন সময় পরাজয়ের পর দায়ী করার নজির আছে তার। বাংলাদেশের ৫ সিনিয়র ক্রিকেটারের প্রায় সবার সাথেই আলাদা আলাদা করে সমস্যা ছিলো তার। মাশরাফি বিন মুর্তজাকে টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিতে বাধ্য করেছিলেন তিনি। সমস্যা ছিলো সাকিব, মুশফিক, রিয়াদ ও তামিমের সাথেও।
সেই অধ্যায় পুরোনো হয়ে গেছে। এখন হাথুরুসিংহে নিজের দেশের দায়িত্বে আছেন। সেখানেও সেই পুরোনো অভিযোগ তার বিপক্ষে।
অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের পুরো চিঠি
প্রিয় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা,
গত শুক্রবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ তারিখে এসএলসি (শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট) হয়ে যাওয়া সভার সূত্র ধরে আমি আপনাকে লিখছি। যে সভায় সকল নির্বাচকের সঙ্গে জাতীয় ক্রিকেট কোচ জনাব চান্দিকা হাথুরুসিংহেও অংশ নিয়েছিলেন। ওই সভায় নির্বাচক কমিটি এবং কোচ আমাকে জানান যে, আমাকে শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়কত্ব থেকে সরে যেতে হবে।
যদিও শুরুতে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। কিন্তু এটা খুব দ্রুতই অনুধাবন করলাম যে এশিয়া কাপে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাজে পারফরম্যান্সের যে কেলেঙ্কারি, সেজন্য আমাকে বলির পাঠা বানানো হচ্ছে। আমি এই দোষের ভাগিদার হতে রাজি আছি। কিন্তু সেই সাথে আমার একার ওপর সব দোষ চাপিয়ে দেওয়ায় আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। আপনি যেমনটা জানেন যে, সব সিদ্ধান্ত (দলের ক্ষেত্রে) নির্বাচকদের ও কোচের সাথে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতেই নেওয়া হয়। যদিও আমি এই মতের সাথে একমত নই যে, পরাজয়ের কারণ শুধুমাত্র অধিনায়ত্বই ছিলো; তারপরও আমি আগ্রহভরে এবং সর্বান্তকরণে নির্বাচক কমিটি ও প্রধান কোচ যে আমাকে সরে যেতে বলেছেন, সেটাকে শ্রদ্ধা দেখিয়েছি এবং তাদের মতমতো তাৎক্ষণিকভাবে সেটা করেছি।
আপনার মনে থাকা উচিতক যে শ্রীলঙ্কা দলের সব ফরম্যাটে ৫ বছর ধরে অধিনায়কত্ব করার পর আমি নিজে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিয়েছি। ওই দফায় আমার অধিনায়কত্বে আমরা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জিতেছি, অস্ট্রেলিয়াকে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করেছি এবং ২০১৪ এশিয়া কাপ জয় ছিলো আরেকটা স্মরণীয় ঘটনা। যা-ই হোক, দলের বৃহত্তর স্বার্থে আমি মনে করেছি, দলের নতুন নেতৃত্ব তৈরি হওয়া উচিত। তাই স্বেচ্ছায় আমি ২০১৭ সালের জুলাই মাসে সব ফরম্যাটের নেতৃত্ব ছেড়ে দেই।
এরপর শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট সব ফরম্যাটে ভারী সব পরাজয়ের ভেতর দিয়ে গেছে। আর এই সময়ে তারা অনেক অধিনায়ক নিয়োগ করেছে। যেমন উপল থারাঙ্গা, থিসারা পেরেরা, চামারা কাপুগেদেরা, লাসিথ মালিঙ্গা ও দিনেশ চান্দিমাল ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর অবধি ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে অধিনায়কত্ব করেছে। এরপর জনাব চান্দিকা হাথুরুসিংহেকে কোচ নিয়োগ করার পরপরই তিনি আমার সাথে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করেন। আমাকে অনুরোধ করেন যে, ২০১৯ বিশ্বকাপ অবধি আমি অধিনায়কত্ব করার ব্যাপারটা পুনর্বিবেচনা করতে পারি কি না। যদিও আমি নিজে, আমার পরিবার এবং আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আমাকে এই মশাল বহনের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেছে। কিন্তু হাথুরুসিংহের ওপর বিশ্বাস রেখে এবং শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তার পরিকল্পনায় আস্থা রেখে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমি বিশ্বকাপ অবধি এই কাজ করতে সম্মত হয়েছিলাম।
যদিও আমরা এশিয়া কাপে বাজে ধরনের পরাজয় নিয়ে এসেছি, যেটাকে একটা ধাক্কা বললেও কম বলা হয়। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ভালো একটা সিরিজ কাটানোর পর এই ফলাফল। তবে আমি রেকর্ড রাখার জন্য হলেও বলতে চাই, এরকম সব ইস্যু রেখে আমার ছেড়ে যাওয়া বা পালিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিলো না; বিশেষ করে বিশ্বকাপ যখন আর মাত্র ডজনখানেক ম্যাচ দূরে, এমন সময়ে। আরও বলতে চাই যে, একজন খেলোয়াড় হিসেবে আমার দায়বদ্ধতা থেকে আমি নিজেকে শ্রীলঙ্কা দলকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সবসময় তৈরি রাখতে চাই। আর যেকোনো সময় আমার সেরাটা দিতে প্রস্তুত থাকতে চাই। আমি একইসাথে বিশ্বাস করি যে, যদি নির্বাচকরা এবং কোচ মনে করেন যে, আমি ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি খেলার জন্য ফিট নই এবং আমার জাতীয় দলে আর কোনো জায়গা নেই, আমি তাহলে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেওয়ার কথা বিবেচনা করবো। কারণ, আমি কখনো নিজেকে দলের বোঝা হিসেবে দেখতে রাজি নই।
আমি এই খেলাটা সবসময় সর্বোচ্চ সততা দিয়ে খেলেছি। সবসময় আমি আমার সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। সেই সাথে অনুভব করছি যে, এখনও আমি এই ফরম্যাটগুলো খেলার জন্য ফিট আছি। সেই সাথে আমি দলে নিজের জায়গা ধরে রাখার জন্য বছরের পর বছর ধরে যথেষ্ট পারফর্মও করেছি। আপনি এটাও জানবেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে দুই দল মিলিয়ে সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলাম আমি।
এই সকল কিছু পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমি তাৎক্ষণিক কার্যকরভাবে, নির্বাচকদের ও প্রধান কোচের অনুরোধ রেখে শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের অধিনায়কত্ব থেকে পদত্যাগ করেছি। আমি নির্বাচকদের ও জাতীয় কোচকে ধন্যবাদ জানাতে চাই যে, তারা আমার সাথে একান্তে কথা বলেছেন এবং এশিয়া কাপ বিষয়ে আপনার চিন্তা আমার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন এবং আমাকে এভাবে সরে দাঁড়ানোর সুযোগ দিয়েছেন।
আমি পুরো জাতীয় ক্রিকেট দলের এবং আপনাদের সকলের মঙ্গল কামনা করি।
শুভ কামনা।
অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস।