সময়টা ১৯৯১ সাল, যখন অন্য আরেকজনের বদলে জর্ডানের সহযোদ্ধা হিসেবে স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখার সুযোগ পান মাইকেল। যার বদলে তিনি এসেছেন সেই বার্ট্রার্ন্ড গেছ্ট তখন জেলখানায় ছুটি কাটাচ্ছিলেন! মাইকেল সপ্তম হয়ে রেস শেষ করেন। কিন্তু এতটুকুতেই জর্ডানের চক্ষু ছানাবড়া! পুরো টিমের কারও বিশ্বাসই হচ্ছিলো না যে, কেউ এত জোরে ছুটতে পারে। নয়তো পুরো রেসিং ট্র্যাকের দূরত্বই কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা তো কেবল শুরু, বিশ্ব সেদিন একজন রেসিং লিজেন্ডের গতি নিয়ে ছেলেখেলা দেখেছিলো।
মাইকেল শুমাখ্যারের রেসিং ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল বাবার হাত ধরে। ১৯৬৯ সালের ৩ জানুয়ারি জার্মানির হুর্টে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ৪ বছর বয়সে বাবা তাকে একটি কার্ট (একধরনের রেসিং কার সংস্করণ) তৈরি করে দেন। তার কিছুদিন পরেই স্থানীয় একটি কার্ট ক্লাবে তাকে ভর্তি করানো হয়। সবকিছু ঠিকমতোই চলছিলো, কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো তার বয়স। কারণ ১৪ বছর বয়সের আগে সেখানে কাউকে রেসিং করার লাইসেন্স দেওয়া হয় না। তাই অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিলো না। অবশেষে ১৯৮৩ সালে তাকে রেসিংয়ের লাইসেন্স দেয়া হয়। পরবর্তী বছরই শুমাখ্যার জার্মানিতে অনুষ্ঠিত জুনিয়র কার্ট চ্যাম্পিয়নশিপে জয়ী হন।
১৯৮৯ এবং ১৯৯০ এই দুই বছরে ওয়াইলি ওয়েবারের টিমে চুক্তিবদ্ধ হয়ে রেসে অংশ নেন মাইকেল। চুক্তি অনুযায়ী পারিশ্রমিকও পান তিনি, কিন্তু সেবার ফর্মুলা-৩ রেসে তৃতীয় স্থানে থেকেই সন্তুষ্ট হতে হয় তাকে। তবে তার কারিশমার জায়গাটা অন্যখানে, যার কারণে গতির কথা আসলেই শুমাখ্যারের নাম চলে আসবে।
ফর্মুলা ওয়ান
বেলজিয়ান গ্র্যান্ড প্রিক্সে অংশগ্রহণ ছিল মাইকেল শুমাখ্যারের জন্য বড় টুর্নামেন্টগুলোর মধ্যে একটি, যেটিতে খুব একটা ভালো না করলেও সবার নজর কেড়েছিল তার গতি। জর্ডান শুমাখ্যারকে দলে ভেড়াতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো। পরের বছরের জন্য জর্ডান ‘ইয়ামাহা’ ব্যবহার করবে বলে ঠিক করে। তাই ওয়েবার মাইকেলকে সতর্ক থাকতে বলেন। কারণ ইয়ামাহার ইঞ্জিন মানের দিক থেকে দ্বিতীয় সারির বলে ওয়েবারের ধারণা ছিলো, এবং তার ধারণা সত্যি প্রমাণিত হয়।
এই ঘটনার পর মাইকেল বেনিটনের দলে নাম লেখান, যেখানে তিনি রবার্তো মরেনোর বদলে খেলার সুযোগ পান। এই সিজনে তিনি আরও পাঁচটি গ্র্যান্ড প্রিক্সে অংশগ্রহণ করেন নেলসনের সতীর্থ হয়ে। ১৯৯২ সালে শুমাখ্যার মার্টিন ব্রান্ডলের সাথে পার্টনারশিপে যান, এবং স্পাতে পা ফেলার মাত্র এক বছরের মাথায় তিনি জয়ের দেখা পান। পরের বছর, ১৯৯৩ সালে, রিকার্ডো প্যাট্রিস শুমাখ্যারের সাথে মিলে ফর্মুলা ওয়ানের ট্র্যাকে পা রাখেন। এটাই ছিলো রিকার্ডোর জন্য শেষবারের মতো ফর্মুলা ওয়ানে অংশগ্রহণ। সেই বছর মাইকেল আরেকটি জয়ের দেখা পান পর্তুগিজ গ্র্যান্ড প্রিক্সে।
পরবর্তীতে ১৯৯৪ এর সিজনে মাইকেল কম শক্তির ফোর্ড জিটেক ভি-৮ এ চড়ে সর্বপ্রথম এককভাবে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে জয়ের স্বাদ নেন। এই জয় তার জন্য হালে পানি আনার মতো ছিলো। কারণ এর আগের সময়গুলো ঠিক ভালো যাচ্ছিলো না তার জন্য। পরপর ব্রিটিশ এবং বেলজিয়ান গ্র্যান্ড প্রিক্স থেকে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পর নিজেকে প্রমাণের জন্য জয়টি প্রয়োজন ছিলো তার জন্য। তাছাড়া সেই বছর ইতালিয়ান এবং পর্তুগিজ গ্র্যান্ড প্রিক্স থেকেও দুই ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন শুমাখ্যার। কারণ তিনি ট্র্যাকের নিয়ম ভঙ্গ করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন, যার কারণে কমিটি তার চ্যাম্পিয়নশিপ বাতিল করে এবং তাকে দুই ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করে।
১৯৯৫ এর সিজনে মাইকেল বলতে গেলে একাই রেসিং ট্র্যাকে দাপিয়ে বেড়ান এবং নয়টি গ্র্যান্ড প্রিক্স জয়ের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়নের মুকুট নিজের করে নেন। সেবার তিনি প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের উপর যথেষ্ট কর্তৃত্ব ফলাতে পেরেছিলেন। তাদের উপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করতে গিয়ে নিজেও ট্র্যাকের বাইরে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন। যদিও ট্র্যাককে একাই শাসন করার কারণে প্রতিবারই সামলে নিয়েছেন নিজেকে।
১৯৯৬ সালের সিজনে মাইকেল রেকর্ড ৩০ মিলিয়ন ডলারে ফেরারিতে যোগ দেন। নিজের যোগ্যতাকে ঝালিয়ে নিতে এরকম একটি দলবদল সময়ের প্রয়োজন হিসেবে দেখা দিয়েছিলো। তাছাড়া নিজের গতির উপর কিছুটা মরচে ধরেছিলো বলেও সন্দেহ হয়েছিলো মাইকেলের! একই বছর এডি ইরভিনও জর্ডান থেকে মাইকেলের দলে যোগ দেন। এডিকে সানন্দে নিজের সঙ্গী করে নেন মাইকেল।
মাইকেলকে চালাতে দেয়া হয়েছিলো ফেরারি এফ-৩১০, যেটির হ্যান্ডলিং ছিলো নিম্নমানের। তিনি ব্যাপারটি টের পেলেও ট্র্যাক ছেড়ে যাওয়া তার কাছে সমীচীন মনে হলো না। তিনি বরং নিজেকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন। কারণ তার আগে থেকেই নিজেকে পরখ করে নেয়ার ইচ্ছে ছিলো। সবমিলিয়ে তিনি একান্ত নিজের যোগ্যতায় তিনবার জয়লাভ করেন, যার ভেতর স্প্যানিশ গ্র্যান্ড প্রিক্সে তার ড্রাইভিং সেরা হিসেবে ঘোষিত হয়।
সবসময়ের যোগ্য প্রতিযোগী ডেমন হিল ট্র্যাক থেকে ছিটকে যাওয়ার পর মাইকেলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ট্র্যাকে টিকে রইলেন সাবেক কার্ট চ্যাম্পিয়ন জ্যাকস্ ভিলেন্যাভু। সালটা ১৯৯৭, মাইকেলের হাতে ফেরারির স্টিয়ারিং। ইতোমধ্যে এই কারটির সাথে নিজেকে ভালোই মানিয়ে নিয়েছেন তিনি। যদিও জ্যাকস্ মাইকেলকে ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু খেলার ফলাফলে তখন মাইকেল পাঁচটি গ্র্যান্ড প্রিক্স জয় করে নিয়েছেন। পরবর্তী ল্যাপগুলো তিনি আরও অবিশ্বাস্য কম সময়ে পার হচ্ছিলেন। বিপদটা দেখা দিল যখন মাইকেল চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে এক পয়েন্ট দূরে এবং সেই সময় ভিলেন্যাভু তাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মাইকেল ভিলেন্যাভুর কারকে একপাশে চাপা দেন এবং সেটা একপাশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে নিলে মাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্র্যাকের বাইরে গিয়ে পড়েন। কর্তৃপক্ষ এমন আচরণের জন্য মাইকেলকে ট্র্যাকে অযোগ্য ঘোষণা করে এবং পুরো সিজনে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯৯৮ সিজনে মাইকেল ট্র্যাকের জন্য ততটা ফিট ছিলেন না, যার কারণে দেখার মতো কোনো কিছু করতে পারেননি। ১৯৯৯ এর সিজনে মাইকেল ব্রিটিশ গ্র্যান্ড প্রিক্সে দুর্ঘটনার শিকার হন। তার স্থলাভিষিক্ত হন সতীর্থ ইরভিন। ইরভিন ভালো করতে পারলেও জয়ের দেখা পাননি, যার কারণে সবাই শুমাখ্যারকে ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনার পক্ষে ছিলেন। তিনি ট্র্যাকে ফিরেই পরপর দুটো রেসে জয়লাভ করেন। দলের বাকিরা তখন নিজেদের হতাশা ঢাকতে অদ্ভুত সব কারণ দেখাতে থাকে। তাদের মতে, শুমাখ্যার আহত হওয়ার পর বিশ্রাম নেয়ার সময় পেয়েছিলো, কিন্তু তারা পুরো সিজনে কোনো বিশ্রাম পায়নি!
আহত হওয়ার পর দ্রুত ফিরে আসা শুমাখ্যারের মনোবল অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিলো। যার ফলাফল হিসেবে ২০০০ সালের সিজনে চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। ২০০৪ সাল পর্যন্ত নিজের অবস্থান ধরে রাখতে সমর্থ হন। ২০০৫ এবং ২০০৬ সিজনে তিনি নিজের পজিশন ছেড়ে দেন ফার্নান্ডো এলেনসোর কাছে। ২০০৬ সালে তিনি রেসিং ট্র্যাককে বিদায় জানান। এই অবসরে মাইকেলকে কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয় ফেরারি। ২০০৯ সালে ফেরারির রেসার আহত হলে গুজব ছড়াতে থাকে, মাইকেল হয়তো আবার রেসিং ট্র্যাকে ফিরবেন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা মিথ্যে প্রমাণিত হয়, কারণ সেই সময় তিনিও বাইক রেসিংয়ের কারণে আহত হয়েছিলেন। সেবার তিনি ঘাড়ে চোট পান।
যদিও মাইকেল আবারও ট্র্যাকে ফিরেছিলেন ২০১০ সালে, মার্সিডিজের সাথে তিন বছরের চুক্তির ভিত্তিতে। ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মাইকেল মার্সিডিজের হয়ে ট্র্যাকে লড়েন। পুরো তিন সিজনে তিনি নবম, অষ্টম এবং তেরোতম হয়ে আবার অবসরে গিয়েছিলেন।
মাইকেল শুমাখ্যারের জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসে ২০১৩ সালে। রেসিং ট্র্যাক থেকে অবসর নেয়ার পর ছুটি কাটাতে গেলেন ফ্রান্সে। সেখানে তিনি বরফের উপর স্কি করবেন বলে ঠিক করেন। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। কিন্তু স্কি করার একটি পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাথরের সাথে ধাক্কা লেগে মাথায় গুরুতর চোট পান তিনি। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হয়। এই ঘটনার পর প্রায় ছয় মাস তিনি কোমায় ছিলেন।
তার কোমা থেকে ফিরে আসাটা ডাক্তাররা মিরাকল হিসেবে অভিহিত করেন। এর পর থেকেই তিনি সুইজারল্যান্ডে পরিবারের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। স্ত্রী এবং দুই সন্তান নিয়েই মাইকেলের সাধারণ জীবন-যাপন। সাতবারের ফর্মুলা ওয়ান চ্যাম্পিয়ন কি কখনো ভেবেছিলেন, জীবনের একটা পর্যায়ে এসে গতির দানবকে এভাবে শুয়ে-বসে কাটাতে হবে? তার ভক্তদেরও একটাই জিজ্ঞাসা, রেসিং ট্র্যাকের একক রাজপুত্র কবে আবার ফিরছেন? আদৌ কি আর ফিরবেন তিনি?