বাবা,
তুমি একটা গল্প লিখতে চেয়েছিলে। এমন একটা গল্প, যাতে নায়ক হব আমি। সেখানে সংগ্রাম থাকবে, ঘাত-প্রতিঘাত থাকবে, উত্থান-পতনের রোমাঞ্চ থাকবে, আর দিনের শেষে যুদ্ধজয়ী সৈনিক বেশে তোমার কাছে ফেরার ক্ষণটাও থাকবে।
বাবা, তোমার লেখা গল্পটায় অবশেষে যবনিকাপতন ঘটেছে। কিন্তু যেই মুহূর্তে গল্পটা তোমাকে পড়ে শোনাব বলে মনস্থির করেছি, সেক্ষণেই তুমি ওই আকাশে পৌঁছে আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে শুরু করলে!
বলো না বাবা, ঐ দূর আকাশের কোন নক্ষত্রটা তুমি? তোমাকে যে আমার গল্প শোনানো বাকি!
***
তোমার কী ওই দিনগুলোর গল্প মনে পড়ে? তখন আমার বয়স কত, এই ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ চুকিয়েছি কেবল! বড় ভাইয়া প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে হবে ভাব, মা চাইতেন আমিও যেন ওই পথেই এগোই। কিন্তু ক্লাসের সাদা চক আর কালো বোর্ডের চাইতে মাঠের সবুজ ঘাসটাই আমাকে বেশি টানত তখন। যে সংসারে প্রতিটি পা ফেলতে হয় হিসাববিজ্ঞানের জাবেদাখাতা মিলিয়ে, সে ঘরের ছেলের এহেন ভবঘুরেমিতে মা হতেন ত্যক্ত-বিরক্ত। আপনার বিবি অর্থাৎ আমার মা তাই হররোজই বলতেন, ‘পরে আবার বলো না, সব কিছু বড় ভাইয়ার জন্যেই করেছি। তোমার জন্যে কিচ্ছু না।’ শুনে আমি কেবল বলতাম, ‘ওসব কিছুই বলবো না, মা। তোমার আমাকে নিয়ে অত-সমস্ত ভাবতে হবে না।’
দৃপ্তকণ্ঠে অমন ঘোষণা দেবার সাহসটা কোত্থেকে মিলত, বলতে পারো? তুমি বোধহয় তখন যাত্রী-সন্ধানে হায়দরাবাদের পথে-প্রান্তরে হন্যে হয়ে ঘুরছ। আর দশজন অটোরিকশাচালক যা করে আরকি! এভাবে অটো চালিয়েই তো আমাদের সংসার চালাতে তুমি, বাড়ি ভাড়া দিতে, বড় ভাইয়ার পড়ালেখায় রাজ্যের খরচ করতে। আর আমিও যেন উড়নচণ্ডী হয়ে মাঠে-মাঠে ঘুরে বেড়াতে পারি, তার জন্যে দৈনিক ৭০ রুপির একটা বরাদ্দও বাঁধা রাখতে সব খরচ মিটিয়ে। টানাপোড়েনের সংসারেও তাই যে অবাধ দস্যিপনায় মাততে পারতাম আমি, সে তো এই মন্ত্র জেনেই, ‘বাবা আছে!’
আয়-উপার্জনের ভাবনা সরিয়ে আমি তাই পেতাম চিত্ত আনন্দে ক্রিকেট খেলে বেড়ানোর সুযোগ। ক্রিকেটার হতেই হবে, অমন কিছু ভেবে নয় অবশ্যই। বাড়ির পাশে টেপ-টেনিস বলে ক্রিকেট খেলাতেই স্বর্গসুখ মিলত আমার। জোরে বল ছুঁড়তে পারতাম বলে এ পাড়া, ও মহল্লা থেকে টেপ-টেনিস ক্রিকেট খেলতে ডাক আসত হরহামেশাই। এমনি করে দাপিয়ে টুর্ণামেন্ট খেলে উপরি কিছু আয়-উপার্জনের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছিল একটা সময় গিয়ে।
আচ্ছা, আমার প্রথম উপার্জনের গল্পটা মনে আছে তোমার? ওই যে সেবার, কী একটা টেপ-টেনিস বলের টুর্নামেন্টে তার দলে খেলতে নিয়ে গিয়েছিলেন মামা। সেদিন ম্যাচে প্রতিপক্ষের দশ উইকেটের নয়টিই অন্তর্যামী বরাদ্দ রেখেছিলেন আমার জন্যে, ম্যাচটাও জিতেছিলাম আমরা। খুশিতে গদগদ হয়ে মামা তাই ৫০০ রুপি দিয়েছিলেন আমাকে। সে আমলে ৫০০ রুপি! পৃথিবীর সমস্ত হীরা-জহরতকে বাঁয়ের পাল্লায় রেখে অন্য পাল্লায় এই অর্থটুকু রাখলে নিক্তি নিশ্চিত করে ডানেই হেলে পড়ত।
ক্রিকেটটা যে আমি ভালোই খেলি, বানজারা হিল পল্লীর বাসিন্দাদের কাছে অবিদিত ছিল না তা। টেপ-টেনিস বলের ক্রিকেটার থেকে আচমকাই যে পেশাদার ক্রিকেটের দুনিয়াতে আবিষ্কার করেছিলাম নিজেকে, এর পেছনে তো লোকে-মুখে নিজের নামের প্রচারটাও অনুঘটক হয়ে কাজ করেছিল।
চারমিনার ক্রিকেট ক্লাবের সচিব মোহাম্মদ মাহবুব আহমেদ লোকে-মুখেই শুনেছিলেন, মোহাম্মদ সিরাজ বলে একটা বোলার এসেছে মহল্লাতে, খুব জোরে বল ছুঁড়তে পারে। মাহবুব স্যারের কথাটা একটু বাড়তি করে না বললেই নয়। আমার খেলার জুতো, জার্সি, যাতায়াত খরচার কিছুটা জোগান তো এই মানুষটির থেকেও এসেছিল কখনো-সখনো। নতুন প্রতিভাকে মঞ্চ তৈরি করে দেবার জন্যেও জুড়ি ছিল না তার। শোনা কথার সত্যতা যাচাই করতে বিজয়ানন্দ উদ্যানে এসে একদিন আমার বোলিং দেখতে বসেছিলেন তিনি। সেদিন আমার বলের গতি প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে সঙ্গে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল তার মনে জমে থাকা সমস্ত প্রশ্নও। তাৎক্ষণিকই তাই আমায় প্রস্তাব করেছিলেন, ‘আমার দলে খেলবে?’
পেশাদার ক্রিকেটার হবার আগ্রহটা ততদিনে আমার ভেতরে বেশ গেড়ে বসেছে। তুমিও চাইতে, ছেলে যা-ই করুক না কেন, তাতে যেন দেশের নামটা উজ্জ্বল হয়। আর দেশটার নাম যখন ভারত, তখন ক্রিকেটের চাইতে রোশনাই ছড়াবার ভালো সুযোগ আর কোথায় মেলে!
পেশাদারভাবে ক্রিকেটটা কোথায় শুরু করা যায়, তার সুযোগ খুঁজছিলাম আমি। কিন্তু কোথায় গিয়ে সুযোগটা চাইতে হয়, তা নিয়ে তো যথেষ্ট জানা-শোনা ছিল না আমাদের। সেই মুহূর্তে ভাগ্যলিখিয়ে যখন মাহবুব স্যারকে দিয়ে ওই প্রশ্ন পাঠালেন, আমার তাই না বলবার কোনো কারণ ছিল না।
ততদিনে জীবনের বিশ বসন্ত পেরিয়ে গিয়েছি আমি। ভারতীয় ক্রিকেটের হাল-হকিকত সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান রাখা মানুষটিও জানেন, এ বয়সে গিয়ে ক্রিকেট বলের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটাটা কোনো কাজের কথা নয়। সাততাড়াতাড়িই তাই মনকে বুঝিয়েছিলাম, ‘ওপরে উঠতে চাও তো ওই নতুন চর্মগোলকের ঘ্রাণটা পুরোপুরি মিলিয়ে যাবার আগেই নিজেকে কিছু করে দেখাতে হবে।’
আচ্ছা, তোমার ছেলের ক্রিকেট বলে শুরুর ম্যাচগুলোর গল্প শুনিয়েছ তোমার ওপারকার বন্ধুদের? না শোনালেই ভালো। ১৬৩ গ্রাম ওজনের বলে যেদিন অভিষেক ঘটেছিল আমার, সমস্ত স্নায়ুযুদ্ধকে ফুৎকারে উড়িয়ে বালাজি ক্রিকেট ক্লাবের বিপক্ষে পকেটে পুরেছিলাম পাঁচ উইকেট। এতটুকু শুনেই যদি ক্রিকেটকে জলবৎ তরলং ভেবে ফেলেন কেউ কেউ, তবে আমার দ্বিতীয় ম্যাচের পরিসংখ্যান তাদের ঘুণাক্ষরেও বলবে না যেন। কোনো বোলার দ্বিতীয় ম্যাচের দুই ইনিংস মিলিয়ে তের উইকেট নিয়েছেন জানলে তো তিনি ক্রিকেটকে খেলা বলে স্বীকৃতি দিতেই অস্বীকৃতি জানাবেন!
আমার জীবননায়ের পালে দমকা হাওয়া লাগবার সূচনাও তো ওই ক্লাব ক্রিকেটেই। দু’দিন আগেও গলি ক্রিকেট মাতিয়ে ফেরা আমি হঠাৎ করেই উঠে এসেছিলাম ক্লাব ক্রিকেটে, সেখান থেকে চকিতেই হায়দরাবাদের অনূর্ধ্ব-২৩ রঞ্জি দলে। সেখানে কয়েক ম্যাচ খেলেছি কি খেলিনি, পৌঁছে গিয়েছিলাম হায়দ্রাবাদের মূল রঞ্জি দলের তোরণে।
প্রথম মৌসুমে অবশ্য মাঠে নামবার সুযোগ পাইনি তেমন। যা পেয়েছিলাম দ্বিতীয় মৌসুমে, অর্থাৎ ২০১৬-১৭তে। আর সেখানে যা করেছিলাম, তা বর্ণনে বোধহয় ‘বাজিমাত’ শব্দটিই যুতসই। ১৮.৯২ গড় আর ৩৯ ছোঁয়া স্ট্রাইক রেটে উইকেট তুলে নিয়েছিলাম ৪১ উইকেট। শীর্ষ উইকেট সংগ্রাহকদের তালিকায় আমার ওপরে ছিল মোটে দুইজন। উইকেট সংখ্যা আরও কিছু বাড়লেও বাড়তে পারত, যদি মুম্বাইয়ের বিপক্ষে শেষ-আটের ম্যাচে আমার নেয়া নয় উইকেটের পাশে বাকি সতীর্থদের স্কোরকার্ডও কিছুটা ঔজ্জ্বল্য ছড়াতো। তুমি অবশ্য সান্ত্বনাবাণী বিলাতে এই বলে, আমার কারণেই নাকি সেবার হায়দ্রাবাদ রঞ্জির কোয়ার্টার-ফাইনাল খেলেছে। ২০১১-১২ মৌসুমের পরে যে কাণ্ড ঘটেছিল প্রথমবারের মতো।
রেস্ট অব দ্য ইন্ডিয়ার হয়ে ইরানি ট্রফিতে অভিষেকের ঘটনাও ওই মৌসুমেরই। তবে আমি অবশ্য তখন আইপিএলের বাগানে নবকুঁড়িরূপে আবির্ভাবের ক্ষণটাই গুনছিলাম কেবল। কেননা, জাতীয় দলের নির্বাচকদের নজরে আসবার সেরা সুযোগটা ওখানেই মেলে। সুযোগ মেলে দেশব্যাপী নিজের নামটা রটিয়ে দেবার, সুযোগ আসে রাষ্ট্র-রাষ্ট্র থেকে আসা জগদ্বিখ্যাত ক্রিকেটারদের সঙ্গে চিন-পরিচিত হবার। ম্যাচে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে জেতা না যাক, অন্তত শেখার মওকাটাও মেলে পুরোপুরি। আর আইপিএল মানে তো অর্থেরও ঝনঝনানি। রঞ্জি দলের অনুশীলনে সবাই আসত গাড়ি হাঁকিয়ে, আর আমার যেতে হত প্লাটিনা বাইকে চড়ে, জন্মাবধি হিসেব-নিকেশে চলা আমি ওই অর্থ-কড়ির মোহটা উপেক্ষা করতাম কী করে!
আমার জন্যে আইপিএলের দ্বার খুলে গিয়েছিল ২০১৭ সালে। আর সব নবাগতর মতোই আমার ভিত্তিমূল্য ছিল বিশ লাখ রুপি, সেখান থেকেই দর কষাকষি করে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ ২.৬ কোটি রুপিতে কিনে নিয়েছিল আমায়! কী অপার আনন্দ যে তখন হচ্ছিল, তার ছিঁটেফোঁটা বর্ণনের প্রতিভাটুকুও যদি জগদীশ্বরের কাছ থেকে মিলত! খুশির হেতু ছিল মূলত দু’টি। প্রথম কারণটা অক্রিকেটীয়ই। অনূর্ধ্ব-২৩ দলে খেলতে শুরু করবার দিন থেকেই টুকটাক উপার্জন করে তোমার কাঁধ থেকে সংসার সামলানোর বোঝা কিছুটা হলেও কমাতে পেরেছিলাম। কিন্তু তোমাকে অটোচালনার কাজ থেকে পুরোদস্তুর অবসরে পাঠাবার কিংবা আমাদের জন্যে ছোট্ট একটা বাড়ি গড়বার স্বপ্নটা তো ওই আইপিএলের টাকাতেই পূরণ হতে যাচ্ছিল। আর ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলি, তো যুক্ত হচ্ছিল ঘরের ফ্র্যাঞ্চাইজিতে খেলবার আনন্দ, যেখানে মিলত ভিভিএস লক্ষ্মণ, মুত্তিয়া মুরালিধরনদের স্নেহের পরশ, এতেও ভালো না লেগে পারে বলো?
অভিষেক মৌসুমটা অবশ্য মনে রাখার মতো কাটেনি। অবশ্য আমার গোটা আইপিএল অধ্যায়েরই তো এই বিস্মরণীয় শব্দটির সঙ্গে সখ্যতা। প্রথম ম্যাচ খেলেছিলাম ২০১৭-য়ের ১৯ এপ্রিল। দর্শকসারিতে তোমরা সবাই ছিলে সেদিন। প্রথমে ব্যাট করে স্কোরবোর্ডে ১৯১ তুলেছিলাম আমরা। প্রথম ওভার ভুবি (ভুবনেশ্বর কুমার) ভাই করবার পর অপরপ্রান্ত থেকে ইনিংসের গোড়াপত্তন করেছিলাম আমি। স্বপ্ন দেখেছিলাম, গৌরচন্দ্রিকাটা মধুর কিছুই হবে। অথচ প্রথম বলেই স্যাম বিলিংস চার মেরে আমার স্বপ্নডানা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিল একদম। যদিও ওই ওভারেই বিলিংসকে দীপক হুদার ক্যাচ বানিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছিলাম আমি, তবে এর আগেই বিলিয়ে ফেলেছিলাম ১২ রান। আমার তামাম আইপিএল-জীবনটা এই ওভারের ছকেই বাঁধা চলে। উইকেট পেয়েছি, মাঝেমধ্যে কলকাতা নাইট রাইডার্স (৪-২-৮-৩) কিংবা চেন্নাই সুপার কিংসের বিপক্ষে (২-১-৫-১) ম্যাচও এসেছে এই জীবনে, প্রথম বোলার হিসেবে আইপিএলে টানা দু’টো ওভারে কোনো রান না দেওয়ার কৃতিত্বও দেখিয়েছি; কিন্তু ওসব বিচ্ছিন্ন স্মৃতিই। এখন অব্দি খেলা ৩৫ ম্যাচের আইপিএল ক্যারিয়ারে উইকেট তুলেছি ৩৯টি, কিন্তু ওভারপ্রতি রান খরচার হারটা ঘুরপাক খাচ্ছে নয়ের আশেপাশেই।
আমার বোলিং নিয়ে তাই লোকে-মুখে সমালোচনা শুনি বিস্তর। ফেসবুক-টুইটার তো নেই, তবে দুয়েকজন বলেছে, সেখানে নাকি আমাকে ‘রানমেশিন’ ডেকেই সুখ খুঁজে পায় অনেকে। তা সুখ পেলে পাক না তারা, তাদের মুখ তো আমি থামাতে পারব না। আর নিজের সীমাবদ্ধতা আমার অজানা নয়। আশৈশব জেনে এসেছিলাম, বলটা জোরে ছুঁড়লেই উইকেট মেলে, ব্যাটসম্যানদের বেঁধেও রাখা চলে। বলে যে বৈচিত্র্য আনবার দরকার পড়ে, ইনসুইং-আউটসুইং বলেও যে ক্রিকেটে কিছু জিনিস আছে, তা-ই তো অজানা ছিল বছরকতক আগেও। আর আমি তো রান আটকাতে নয়, বরং উইকেটের পিছু ছুটতে চেয়েছি। একেলে টি-২০র চাইতে সেকেলে লাল বলটাই তাই বেশি টানত আমাকে।
কথাগুলো যে বাগাড়ম্বর নয়, সাদা পোশাকি ক্রিকেট পরিসংখ্যানই তো তার প্রমাণ। সিম মুভমেন্ট কিংবা আচমকা বাউন্সারে ব্যাটসম্যানদের হতচকিত করে দেবার ক্ষমতাটা আয়ত্ত্ব করেছিলাম খেটে-খুটে৷ তাই দিয়ে ২০১৮ সালে খেলা ১০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে উইকেট তুলেছিলাম ৫৫ টি। আর এমএসকে প্রসাদ আমাদের জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক হয়ে আসবার পর থেকেই চাইছিলেন, যত বেশি সম্ভব ‘এ’ দলের খেলা আয়োজন করতে। ভারতীয় জাতীয় দলের পাইপলাইনটা আরও মজবুত করাই ছিল উদ্দেশ্য। রঞ্জি ট্রফিতে নিয়মিত ভালো খেলবার পুরষ্কার হিসেবে ওই দলে নিয়ম করেই সুযোগ মিলছিল আমার। ভালো খেলছিলাম সেখানেও, দক্ষিণ আফ্রিকা এ দলের বিপক্ষে এক ম্যাচেই পেয়েছিলাম দু’টো পাঁচ উইকেটের দেখা। আর উসমান খাজা, মার্নাস লাবুশেন, পিটার হ্যান্ডসকম্বদের নিয়ে গড়া অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তো ইনিংসেই তুলেছিলাম আট উইকেট। আমার এই পারফরম্যান্সগুলো নজর এড়ায়নি প্রসাদ স্যারেরও।
“For someone who combined speed and the desire to have variety in his bowling, Siraj has always been on the radar given his consistent performances for the India A side.”
গল্পের এই অব্দি অংশটুকু তোমার জানা। গল্পটা যে তোমারই হাতে লেখা।
***
জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপানোটা আমার জন্যে নতুন কিছু নয়। টি-টোয়েন্টির কল্যাণে সেই স্বাদ পেয়েছি ২০১৭-য়ের নভেম্বরেই। রান বিলানোতে দাতা হাতেম তাঈ বলে ওই অধ্যায়টা থেমে গিয়েছে সাড়ে চার মাসেই। পঞ্চাশ ওভারি ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ব্যাপ্তি তো এর চাইতেও সংক্ষিপ্ত, মাত্র এক ম্যাচেই সীমাবদ্ধ। তবে সেসব নিয়ে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় নীল হইনি বিন্দুবিসর্গও। কেননা, স্বপ্নটা তো দেখেছিলাম ভারতের ওই নীলরঙা টেস্ট ক্যাপ মাথায় তুলবার। যে স্বপ্নের আঁকিবুকি ছিল তোমার চোখেও।
অবশেষে আমাদের সেই সাধ মিটেছে। এই মাসখানেক আগেই। ওদের যে কী একটা দিন আছে না ডিসেম্বরে, ‘বক্সিং ডে’; সেদিনই ভারতের ২৯৭তম টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে বরণ করে নেয়া হয়েছিল আমাকে। অভিষেক ইনিংসেই ৪০ রানে ২ উইকেট নিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, আমি এখানে থাকতেই এসেছি। কারও মনে যদি যৎসামান্য সংশয়টুকুও থেকে থাকে আমার টেস্ট বোলিং সামর্থ্য নিয়ে, তা তো ক্যামেরন গ্রিনকে করা আউটেই উড়ে যাবার কথা। টানা তিন আউটসুইঙ্গারে ব্যাটসম্যানকে সামনে টেনে এনে দেয়া ইনসুইঙ্গার, বড় বড় বোলাররা কি এমনভাবেই ব্যাটসম্যানকে ফাঁদে ফেলেন না?
অভিষেকের রোমাঞ্চ কাটিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে বলগুলো ভালো হয়েছিল আরেকটু। গোটা ক্যারিয়ারজুড়েই আমাকে অতিরিক্ত খরুচে ভাবা মানুষগুলো বোধ করি অবাকই হচ্ছিল। ২১ ওভার বল করেও আমার ইকোনমি রেট দুইয়ের কম, সঙ্গে তিন উইকেট, তাদের তো ভিড়মি খাবারই কথা।
যে ভারতের পেসাররা রাজত্ব করছেন গত কয়েক বছরে, সেই ভারতের বোলিং আক্রমণের নেতৃত্ব দেবার সৌভাগ্যটা আমার হয়েছে ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্টে এসেই। সেই একই টেস্টে চোটাঘাতে জর্জরিত একটা দল, যাদের বোলারদের ঝুলিতে সম্মিলিত উইকেটসংখ্যা ছিল মোটে ১৩, ম্যাচের মধ্যেও হারিয়ে ফেলেছিল এক বোলারকে, তারা মিলেই ভেঙে দিয়েছে প্রতিপক্ষের ৩২ বছর ধরে গড়া দুর্গ। আর তাতে এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে তোমার ছেলেও।
বাবা, ১৯৯৪ সালের ১৩ মার্চ জন্ম নেয়া শিশুকে দিয়ে এমন এক যুদ্ধজয়ের কাহিনীই কি তুমি লিখতে চেয়েছিলে? যদি তাই চেয়ে থাক, তো জেনে রেখো, তোমার গল্প লেখা আজ সম্পূর্ণ হয়েছে।
যথাসময়েই তোমার ছুটি হয়েছে।
ইতি,
মোহাম্মদ সিরাজ।