হ্যারি কেইনের ‘নবযাত্রা’

ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলে প্রতি মৌসুমেই এমন কিছু দলবদলের ঘটনা ঘটে যা শুধু মাঠে না, মাঠের বাইরেও উত্তেজনার এক নতুন মাত্রা যোগ করে। টটেনহ্যামের মালিক ড্যানিয়েল লেভি খুবই একগুঁয়ে একজন মানুষ। হ্যারি কেইনের জন্য এ যাবৎ যত প্রস্তাব এসেছে, একটিও তিনি গ্রহণ করেননি। ব্যাপারটি এমন দাঁড়িয়েছিল যে শুধু কেইনের চুক্তি শেষ হলেই কেবল কেইন যেতে পারবেন।

তবে চুক্তির শেষবর্ষে এসে লেভি আর আটকাননি কেইনকে। এক বছরের চুক্তি বাকি থাকা কেইনের জন্য বায়ার্ন মিউনিখ এমন একটি প্রস্তাব দিয়েছিল, যা ফেরানো সম্ভব হয়নি লেভির পক্ষে। ১২০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে স্পার্সের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলস্কোরার ও সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় পাড়ি জমান জার্মানিতে। আর্সেনাল একাডেমি থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এরপর স্পার্সের একাডেমি থেকে উঠে এসে খুব অল্প সময়েই প্রিমিয়ার লিগে নিজেকে চিনিয়েছেন।  

কেইন এমন একটা সময়ে প্রিমিয়ার লিগ ছাড়েন, যখন অ্যালান শিয়েরারের করা সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ছিল একদম তার সামনে। কিন্তু এত বছর ট্রফিখরায় থাকার পর এবার তার সামনে সুযোগ রয়েছে লিগ এমনকি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়েরও।

প্রিমিয়ার লিগের টপ পাঁচ সর্বোচ্চ গোলদাতা; Image Credit: Author

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই এক ক্লাবে খেলে যাওয়া কেইন ৩০ বছর বয়সে এসে দলবদল করলেন। শুধু ক্লাব না, লিগটাও। কেইনের এই ফলে কেমন ইম্প্যাক্ট পড়তে যাচ্ছে তার সদ্য সাবেক ক্লাব স্পার্স, প্রিমিয়ার লিগ, বায়ার্ন মিউনিখ ও বুন্দেসলিগায়?

যদি স্পার্সের দিক থেকে দেখি, তবে স্পার্স হারালো তাদের প্রায় ৫০% গোলের গোলদাতাকে। গত ১০ বছরে স্পার্সের হয়ে সর্বোচ্চ গোল কেইনের। প্রিমিয়ার লিগে কেইন এই ১০ বছরে গোল করেছেন ২১৩ টি। ২য় অবস্থানে থাকা হিউয়েন মিন সনের গোল কেইনের অর্ধেকেরও কম, ১০৩ টি। তার নিচে থাকা ডেলে আলির গোল আরো অর্ধেকেরও কম, ৫১ টি। ২০২২-২৩ মৌসুমে পুরো টটেনহ্যাম দল যে পরিমাণ গোল করেছে, তার ৪৩% গোলই ছিল কেইনের। প্রিমিয়ার লিগের যেকোনো দলের জন্য যেটি ছিল সর্বোচ্চ। তার নিচে থাকা আর্লিং হাল্যান্ড করেছেন ম্যানচেস্টার সিটির ৩৮% গোল, আর ইভান টোনি ব্রেন্টফোর্ডের ৩৪.৫% গোল।

টটেনহ্যাম নিঃসন্দেহে তাদের একমাত্র গোল মেশিনটি হারাচ্ছে ১২০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে। কেইনকে ছাড়া স্পার্স দলটিকে কল্পনাই করা যেত না এতদিন। গত মৌসুমে হাল্যান্ডের ঝড়ে প্রিমিয়ার লিগের অন্যান্য গোল স্কোরাররা পাত্তাই পাননি তেমন। কিন্তু সেখানে ৩০ টি গোল করে হালান্ডের পেছনে থেকে লিগ শেষ করেন কেইন। সিটি লিগে প্রথম হলেও স্পার্স হয় অষ্টম। অন্য কোনো সময় হলে ৩০ গোল বিনা প্রতিযোগিতায় গোল্ডেন বুট জিতে যেত।

শুধু গোল করা নয়, করানোতেও স্পার্স ছিল অনেকটাই কেইন-নির্ভর। ১ মৌসুম আগেই কেইন একই সাথে ছিলেন লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট যোগানদাতা। গত মৌসুমের প্রতিটা প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচেই তিনি শুরু থেকে ছিলেন। দলের অন্য যেকোনো খেলোয়াড়ের চাইতে সর্বোচ্চ সময় ছিলেন মাঠে। পেপ গার্দিওলা তো আর শুধু শুধু স্পার্সকে “The Harry Kane Team” বলেননি!

২০২০-২১ মৌসুমের গোল্ডেন বুট ও সেরা প্লেমেকারের পুরস্কার জেতেন কেইন; Image Credit: Laurence Griffiths

গত মৌসুমে কন্তের ৩-৪-৩ ফরমেশনের জন্য কেইনকে বার বার নিচে নেমে বল নিয়ে উপরে উঠতে হয়েছে। দুই মিডফিল্ডার নিয়ে খেলা স্পার্সের আক্রমণের শুরুটা হত পুরোপুরিই কেইন-নির্ভর। কেইন নিচে নেমে বল বানিয়েছেন আর সনের জন্য জায়গা তৈরি করেছেন। এই কেইন-সন যুগলের কাছ থেকেই একসাথে গোল এসেছে মোট ৪৭টা।

কেইন চলে যাওয়ায় কেইন-নির্ভর সন কী করতে পারেন, সেটিই দেখার বিষয়। গত ৪ বছরে কেইনকে ছাড়া সন মাঠে ছিলেন খুব অল্প সময়। আর টটেনহ্যামের নাম্বার ৯ স্পটটি এখন পুরোপুরি ফাঁকাই বলা যায়। কারণ রিচার্লিসন আর যা-ই হোক, কেইনের শুন্যস্থান পূরণ করার মতো নন। আর টটেনহ্যামের গোলস্কোরিং অপশন বাড়াতে হবে। গত মৌসুমের ৩য় সর্বোচ্চ গোল এসেছিল রড্রিগো বেন্টানক্যুরের পা থেকে, তাও মাত্র ৫টি। গত ৪ বছরে স্পার্সের কোনো মিডফিল্ডার এক মৌসুমে ৫টির বেশি গোল পাননি। এর আগে ২০১৯-২০ মৌসুমে ডেলে আলি করেছিলেন ৮ গোল।

প্রিমিয়ার লিগে দশ খেলায় এখন অব্দি অপরাজিত থেকে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে রয়েছে টটেনহ্যাম; Image Credit: Premier League

এদিকে এই মৌসুমে নতুন কোচ অ্যাঞ্জ পোস্তেকগলুর অধীনে লিগে অসাধারণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে স্পার্স। এখন অব্দি লিগ টেবিলের প্রথম অবস্থানে তারাই। দারুণভাবে সবাই নতুন খেলার ধরনে মানিয়ে নিয়েছে। এই দলে যদি কেইন থাকতেন, নিঃসন্দেহে দলটি আরো ভয়ংকর হত। পোস্তেকগলুর খেলার ধরন অনুযায়ী তিনি চান তার মিডফিল্ডকে ওভারলোড করে ফেলতে। একজন নাম্বার এইটের মিডফিল্ডার থাকেন মূল দায়িত্বে। এই মৌসুমে স্পার্সের হয়ে কাজটি করে যাচ্ছেন লেস্টার সিটি থেকে দলে নতুন যোগ দেয়া মিডফিল্ডার জেমস ম্যাডিসন। ৩ জন মিডফিল্ডারের সাথে যেকোনো একজন ফুলব্যাক যোগ দিয়ে একটি বাক্সের মতো আকৃতি তৈরি করেন। স্ট্রাইকারের তখন নিচে নেমে বল নিয়ে উপরে উঠার কাজটি আর করতে হয় না। পোস্তেকগলু আসলে এমনই চান যে তার স্ট্রাইকার যেন ডি-বক্সেই থাকেন সুযোগের অপেক্ষায়। একসাথে দু’টি কাজ করা কেইন অবশ্যই এই দায়িত্বে সফল হতেন।

টানা দুইবার মাসের সেরা ম্যানেজার নির্বাচিত হন অ্যাঞ্জ পোস্তেকগলু; Image Credit: Tottenham Hotspurs

তবে কেইন প্রিমিয়ার লিগ ছাড়ায় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন অ্যালান শিয়েরার। তার করা ২৬০ গোলের রেকর্ডটি এখন আরো কয়েক মৌসুম অক্ষত থাকবে আশা করা যায়। কেইন যে ফর্মে ছিলেন, তাতে করে আর ২ মৌসুমেই শিয়েরারের রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলতেন। স্পার্সের হয়ে কেইনের গোল ২১৩টি।

বায়ার্ন থেকে ৩ বছর পর যদি কেইন আবার পিএলে ফিরে আসেন, তবে কিছুটা ক্ষীণ সুযোগও রয়েছে। রেকর্ড ভাঙতে কেইনের প্রয়োজন আর ৪৮টি গোল। তবে ৩৩ পার হওয়া কেউ পিএলে এত গোল করতে পারেননি। ৩৩ পার হওয়ার পর সর্বোচ্চ ৬০টি গোল করেছিলেন টেডি শেরিংহ্যাম ও ২য় সর্বোচ্চ ৩৯টি গোল পেয়েছেন অ্যালান শিয়েরার ও জেইমি ভার্ডি। তবে ৩২ বছরের হিসেবে ধরলে কেইনের হাতে ভাল সুযোগ করেছে। এখন অব্দি ৩২ পার হওয়ার পর ভের্ডি, শেরিংহ্যাম, শিয়েরার, ব্রেডস্লি, রাইট, ল্যাম্পার্ড ৪৮টির বেশি গোল করেছিলেন।

গত ২০ মৌসুমে ১৫ বার (টানা শেষ ১০ মৌসুম) বুন্দেসলিগা শিরোপা জেতে বায়ার্ন; Image Credit: Globe Soccer Award

বায়ার্নে কেইন যা পাচ্ছেন তা হলো রেডিমেড ট্রফি। কেইনের ক্যারিয়ারের এই একটি অপূর্ণতা রয়ে গিয়েছে এখনো। আর টানা ১১টি বুন্দেসলিগা জয়ী বায়ার্নে খেলে বুন্দেসলিগা জয় তো একরকম নিশ্চিতই বলা চলে। সাথে ডিএফবি পোকাল তো রয়েছেই। আর কেইন পাচ্ছেন প্রতি মৌসুমেই ইউসিএল খেলার সুযোগ। এর মধ্যে বায়ার্ন যদি ১-২টি জিতে যায়, তবে কেইনের ক্যারিয়ার প্রায় পূর্ণতা পেয়েই যায়। এদিকে কেইনের কপাল মন্দই বলা চলে। বায়ার্নে তার নিজের প্রথম প্রতিযোগীতামূলক খেলায় সুযোগ ছিল জার্মান সুপার কাপ জেতার। সেই খেলায় দানি অলমোর হ্যাটট্রিকে বায়ার্নকে ৩-০ গোলে হারায় লাইপজিগ।

তবে কেইন কি দিচ্ছেন বায়ার্নকে? লেভানডফস্কি চলে যাওয়ার পর বায়ার্ন একজন খাঁটি নাম্বার নাইনের খোঁজে ছিল। কেইনই হতে পারেন এই জায়গায় বায়ার্নের ত্রাণকর্তা। এখন অব্দি ডেব্যু সিজনে বুন্দেসলিগায় ৩০টি গোল ছিল উয়ে সিলারের ৩০টি। আর ২০১২ সালে ক্লাস ইয়ান হান্টলারের ২৯টি। কেইন কি এই রেকর্ড ভেঙে দেবেন?

আর সবচেয়ে কম ম্যাচ ৩০টি খেলে বুন্দেসলিগায় ৩০ গোল করে খেলোয়াড়ও সিলার। হালান্ডের লেগেছিল ৩২টি ম্যাচ। কেইনের জন্য রয়েছে এই রেকর্ডেরও হাতছানি। আর এক মৌসুমের সব্বোচ্চ গোলের রেকর্ড তো রয়েছেই। আগে এই রেকর্ড ছিল গার্ড মুলারের। ১৯৬৯-৭০ মৌসুমে ৩৮টি, ১৯৭১-৭২ মৌসুমে ৪০টি ও ১৯৭২-৭৩ মৌসুমে ৩৬টি গোল করেন তিনি। সেই রেকর্ড ২০২০-২১ এ এসে ভাঙেন লেভানডফস্কি; তার গোল ছিল ৪১টি। পরের মৌসুমেও তার পা থেকে আসে ৩৫টি গোল। কেইন কি পারবেন এই তালিকায় সবার উপরে নিজের নাম উঠাতে?

জার্মান সুপার কাপে বায়ার্নের হয় নিজের প্রথম খেলায় লাইপজিগের কাছে বিধ্বস্ত হয়ে প্রথম ট্রফি জয়ের সুযোগ হারান কেইন; image credit:  Christian Kaspar-Bartke

ট্রফি জয়ের জন্য বায়ার্ন ছিল কেইনের জন্য সবচেয়ে সহজ পথ। কিন্তু ঘরোয়া শিরোপা তো বায়ার্নের প্রধান লক্ষ্য নয়। সেটি তো ফি-বছর তারা এমনিতেই পেয়ে যায়। কেইন কি পারবেন কোভিড-আক্রান্ত মৌসুমের পর আবারও তাদের ইউসিএল জেতাতে? এ

মন নাটকীয় দলবদলে পরিবর্তনে মুখে রয়েছে দুটি ক্লাবই। দর্শকদের জন্য তৈরি হয়েছে মুখরোচক কিছু গল্প। কেইন যেমন নতুন দিগন্ত দেখিয়েছেন ইংরেজ ফুটবলকে, এখন তার প্রভাব পড়তে পারে জার্মান ফুটবলেও। নিজেদের তারকা ফুটবলারকে হারিয়ে টটেনহ্যাম কিছুটা ক্ষতির মুখে পড়েছে বলাই যায়। আর তারা যে দলবদল থেকে পাওয়া বিশাল পরিমাণ অর্থ যে সঠিক পথে ব্যায় করতে পারে না, তা তারা আগেও দেখিয়েছে গ্যারেথ বেলের দলবদলের সময়। কিন্তু যা-ই ঘটুক না কেন, ফুটবল আমাদের সবসময়ই নতুন বিস্ময়ের মুখোমুখি করে। সাদা জার্সির মায়া ত্যাগ করে লাল জার্সিতে হ্যারি কেইনের নতুন এই যাত্রা ফুটবলের গল্পে আর একটি রোমাঞ্চকর অধ্যায় মাত্র।

This article is in Bangla language. This is on the possible impact of Harry Kane's transfer to Bayern Munich.

Feature Image Credit: Christian Kaspar-Bartke

References:
1. https://www.espn.in/football/story/_/id/38169371/bayern-munich-sign-harry-kane-transfer-tottenham
2. Transfer Market
3. www.premierleague.com

Related Articles

Exit mobile version