নামটা তার পছন্দই ছিল না মোটে। বাবা যে দলে খেলতেন, সেই বাউরুর গোলরক্ষক বিলেকে নিয়ে গল্প করতে করতে মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল একবার, ‘কাল পেলের খেলা দেখেছিস?’ বাবার রাখা এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো নামটায় স্বয়ং বাবাও বোধ হয় ডাকেননি। এই ঘটনার পর ডিকো ডাকনামেরও ছুটি। বদলে জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেল ওই নামটা। পেলে।
তার কাছে যে নামের কোনো মানে নেই তখনও।
***
ফুটবলটা তিনি ভালোই খেলতেন। এতই ভালো যে, ১৬ বছর বয়সেই ঠাঁই মিলল সান্তোসের মূল দলে। তখনও তো ক্লাব ফুটবলের এত রমরমা দাপট নেই, নিজ ভূমি ছেড়ে পরের দেশের ক্লাবে নিজেকে প্রমাণ করার ধারণাও করে উঠতে পারেনি বিশ্ব। ক্লাবের চেয়ে জাতীয় দলে জায়গা পাওয়াই তাই নিজেকে সেরা প্রমাণের প্রথম ধাপ বলে বিবেচিত। সেই সিঁড়িতে পা ফেললেন ১৬-তেই।
বয়স ১৭ পেরিয়ে ১৮ হওয়ার আগে তো খেলে ফেললেন বিশ্বকাপই। সেই দলে জায়গা পাওয়া নিয়েও কত গল্প! লুইজিনহো ততদিনে করিন্থিয়ান্সের কিংবদন্তি, বিশ্বকাপেও তো তারই খেলার কথা। কিন্তু, হুট করেই অনুশীলনের মাঠে পেলের আবির্ভাব, তার মুখোমুখি হয়েই নাকি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের মনে হয়েছিল, ‘ওকে ছাড়া চলবে না।’ কোচের সঙ্গে তাদের দর-কষাকষি, করিন্থিয়ান্সের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে সঙ্গী চোট, বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচ না খেলা, এবং তারপর…
ব্রাজিলের চিরকালীন দুঃখগাঁথায় যে অধ্যায় পেয়েছে ‘মারাকানাজো’ নাম, পেলে সেই অধ্যায়ের নিবিষ্ট পাঠক নন একদমই; যা ছিলেন তার বাবা। উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচের পর ৮ বছরের পেলে দেখেছিলেন, জীবনের অর্ধেক পার করে ফেলা বুড়োর চোখে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে ব্রাজিলের হারে। তখনই শপথ করে ফেলেছিলেন, বাবাকে বিশ্বকাপ এনে দেবেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে প্রথমবার মাঠে নামলেন। সেদিন গোল না পেলেও পরের তিন ম্যাচে হ্যাটট্রিকসহ ৬ গোল। প্রথমবারের মতো ব্রাজিল পেল বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ।
আঠারোর পেলে তখন উদীয়মান তারকা, বিশ পেরোনোর আগেই ‘জাতীয় সম্পদ’। পেলে নামটা প্রথম কোনো মানে পেল সেবারই। হলো ‘বাবাকে দেওয়া কথা রাখা’।
***
পরে তো আরও দুইবার।
যে বিশ্বকাপের খোঁজে লিওনেল মেসি হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ালেন একটা জীবন, যে বিশ্বকাপ দিয়েগো ম্যারাডোনাকে বানিয়ে তুলল ঈশ্বর, ওই শিরোপা তিনি জয় করেছেন তিনবার। বিশ্বকাপের ভাবনা জুলে রিমের মাথা থেকে বেরিয়েছে বলেই যদি তার নামে একটা ট্রফি দিয়ে দেওয়া যায়, পেলের জন্য ফিফা কী করবে, এই প্রশ্ন রেখেছেন মাইকেল কক্স। যৌক্তিক জিজ্ঞাসাই বটে।
নিন্দুকেরা অবশ্য বলেন, ‘৬২ বিশ্বকাপ-জয়ের কৃতিত্ব তো না খেলেই পাচ্ছেন তিনি। পাল্টা জবাব আসতে সময় লাগার কথা না। খেলেননি বলার চেয়ে তো এটাই বলা ভালো, ‘তাকে খেলতেই দেওয়া হলো না।’
তখন জমানা শরীর-নির্ভর ফুটবলের। বলের দখল নিয়ে ছোট ছোট পাসে খেলার বদলে সোজা প্রতিপক্ষের গোলপোস্টে উড়িয়ে মারাটাই তখনকার কৌশল। আর বলের চেয়ে ফুটবলারদের গোড়ালিতে লাথি মারতেই বেশি আগ্রহী ছিল প্রতিপক্ষ। আর ব্রাজিলকে থামানোর অস্ত্র তো তখন সর্বজনবিদিত। উরুগুয়ের বিপক্ষে কোপা আমেরিকার এক ম্যাচেই ৪২ বার ফাউলের শিকার হয়েছিলেন তিনি, হালেফিলে পুরো মৌসুমেও এতবার ধরপাকড়ের শিকার হন না কেউ। ফিটনেস-পুষ্টিবিজ্ঞানেও আজকের মতো এত গুরুত্ব দেওয়ার অবকাশ ছিল না। সঙ্গে যোগ করুন বাধ্যতামূলক সৈনিকের চাকরি। কোনো ফুটবলার একই সময়ে পাঁচটা ভিন্ন দলের হয়ে মাঠে নামছেন, এই ছবিও তো পেলেই দেখিয়েছিলেন ‘৬২ সালে।
পরের পর ম্যাচ খেলার ধকলে উরুটা বেগড়বাই করেছে বাকি জীবন ধরেই। বদলি ফুটবলার নামানোর নিয়ম চালু হয়নি বলে প্রতিপক্ষের কড়া ট্যাকলে কুঁকড়ে গিয়েও পেলের মাঠে থাকার দৃশ্যও তখন রোজকার। এই নিয়েই তিন বিশ্বকাপ, সাদা-কালো টেলিভিশনেও হাজারটা রঙিন স্মৃতির জন্ম।
বিশ্বকাপের পেলে মানে হয়ে গেল অনন্য, একমেবাদ্বিতীয়ম। পেলে মানে দাঁড়াল সাহস, দম, হার না মানাও।
***
কোথায় আলাদা হয়ে গেলেন পেলে?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ভিডিও আপনার দেখতে পাওয়ার কথা বেশ ক’বারই। কেউ নাটমেগ করছেন, কেউ র্যাবোনা মারছেন, কেউ ডাবল ড্র্যাগ ব্যাকে মুগ্ধ করছেন; কিন্তু প্রতিটা কারিকুরিই শেষ হচ্ছে পেলের কোনো না কোনো ছবি দেখিয়ে। মেসি-রোনালদো-নেইমার-ভিনিসিয়াসরা যে মুহূর্তগুলোতে আজ মুগ্ধ করছেন, পেলে সেসব দেখিয়ে গেছেন অর্ধশতাব্দী আগেই।
আর গোলগুলোও কী দর্শনীয়! ডান পায়ের জোর স্বভাবসুলভ, বাঁ পায়েই বা খারাপ নাকি? ৫’৮” ফুট উচ্চতা নিয়েই ছাড়িয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘদেহী ফুটবলারদের। গর্ডন ব্যাঙ্কসের যে সেভটাকে মানা হয় সর্বকাল-সেরা, সেটাক তো তারই হেডের ফসল।
সত্তরের দশকে পেলের শরীরকে গিনিপিগ বানানো হয়েছিল ল্যাবরেটরিতে। সেখানেই বেরিয়ে এসেছিল, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি নিখুঁত মানবশরীর হিসেবে যে গঠনের ছবি এঁকেছিলেন, পেলে যেন ঠিক তা-ই। তখনকার অন্য অ্যাথলেটদের যেখানে প্রতি মিনিটে ৯০/৯৫ বার হৃদস্পন্দন হতো, পেলের হৃদযন্ত্র প্রতি মিনিটে কাঁপত ৫৬/৫৮ বার। মানে, অন্যদের তুলনায় ক্লান্তি কম ছুঁত তাকে। পা জোড়া ছিল সমান্তরাল, গোড়ালির হাড়গুলো প্রচণ্ড শক্তিশালী। যে কারণে মাত্র ৫’৮” ইঞ্চি হওয়ার পরও দ্রুত দৌড়াতে কোনো বাধা হয়নি উচ্চতা। সঙ্গে উঁচু লাফ বা হাই কিকের পর ‘শক অ্যাবজর্ভার’ হিসেবেও কাজ করেছে পা।
সপ্তাহভরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা তাই ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘শারীরিক কিংবা মানসিক, যে কাজেই এই লোক নিজেকে যুক্ত করতেন, জিনিয়াস হয়ে বেরোতেন।’
কারণ? পেলে মানে ‘স্রষ্টা দিয়েছেন’।
***
পেলে অবশ্য বলতেন, তিনি আলাদা হয়ে গিয়েছেন তার স্পর্শ গুণে। অজস্র প্রমাণও পাওয়া যাবে ঘাঁটলে, পেলের ছাঁচ হিসেবে ওই তিন স্পর্শের ফুটবলের কথাই আসবে।
প্রথম স্পর্শটা বুকে, যে স্পর্শ বলের সঙ্গে সঙ্গে কাছে টানত প্রতিপক্ষকেও। পরেরটা পায়ে কিংবা হাঁটুতে, যে স্পর্শে তিনি ঘুরে যেতেন ১৮০ ডিগ্রি। ওই টার্নের চক্করেই প্রতিপক্ষের পা বাঁধা পড়ত শেকলে, হয়ে যেতেন চলৎশক্তিরহিত। শেষ স্পর্শটাই তার জন্য শিশুসুলভ। গোল করার জন্য যে স্পর্শ লাগত।
খেলা ছাড়ার পর পেলে বলেছিলেন,
‘আমার অনেক সতীর্থই বল নিয়ে ভালো দৌড়াতে পারে, ভালো ট্যাকল করতে পারে। কারিকুরিতেও ওরা ভালো। কিন্তু, ওদের সবাই বোধ হয় বল কিভাবে রিসিভ করতে হয়, এটা জানে না। সম্ভবত ওদের সেই দেখার চোখটা নেই, যা আমার আছে। এটা খুব সম্ভবত শেখানোর জিনিসও নয়।’
সারা পৃথিবী তন্নতন্ন করে পেলে বলে একটা শব্দ পাওয়া যায় হিব্রু ভাষায়। ওখানেই কি লুকিয়ে পেলের ‘যা শেখানো যায় না’ সেই শিক্ষালাভের ব্যাখ্যা?
পেলে মানে তো ‘মিরাকল’। বাংলায় অলৌকিক।
***
“Everyone trembles at the very sound of your name / Pele and Santos still remember your name.”
Olympiacos
একদম যে অখ্যাত, অলিম্পিয়াকোসকে সেই কাতারে ফেলা যাবে না। চ্যাম্পিয়নস লিগের নিয়মিত সদস্য, এ পর্যন্ত ৪৬ বার লিগ এবং ২৮ বার গ্রিক কাপ জিতে দেশের সবচেয়ে সফল দলও, তবুও একটা প্রীতি ম্যাচের জয়ই নাকি তাদের ইতিহাসের সেরা! কারণ তো এটাই, জয়টা পেলের বিপক্ষে। আর তিনি তো সেরা।
বিশ্বাস না হয় তো হোয়াও সালদানাকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন। ১৯৭০ বিশ্বকাপের আগে ব্রাজিল জাতীয় দলের কোচের পদ থেকে ছাঁটাই হওয়া ভদ্রলোক একবার পড়েছিলেন কিছু সিরিজ প্রশ্নের মুখে, ‘ব্রাজিলের সেরা গোলকিপার কে?’ সালাদানা বলেছিলেন, ‘পেলে।’ পরবর্তী প্রশ্ন, ‘বেশ, তাহলে সেরা রাইটব্যাক?’ এবারও উত্তর, ‘পেলে।’ মোটামুটি দলের অর্ধেক পজিশনে পেলের নাম বলার পর সালাদানা খানিক হেসে ভেঙেছিলেন রহস্যটা, ‘পেলে যেকোনো পজিশনেই বিশ্বের সেরা ফুটবলার।’
শুধু কী সালদানো! ববি মুর, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, ইউসেবিওর মতো কিংবদন্তিরা তার শ্রেষ্ঠত্বকে বলেছেন তর্কাতীত। এমনকি যেই দিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে তার তুলনা টানতে চায় দুনিয়া, সেই ম্যারাডোনার কোচ সিজার লুইস মেনোত্তি তো বলছেন, শুধু ম্যারাডোনাকে দিয়ে হবে না, এর সঙ্গে ইয়োহান ক্রুইফ, লিওনেল মেসি, জার্ড মুলার মেশালে তবে পেলে হয়।
মিশেল প্লাতিনির কথাটাই কি সত্যি তাহলে? ‘পেলে হওয়া মানে ঈশ্বরের মতো খেলা!’
***
শুধু সেরাতেই কি পেলের সমাপ্তি?
খেলতে শুরু করেছিলেন যখন, বল কেনারও পয়সা ছিল না। মায়ের মোজায় কাগজ পুরে শিখতে শুরু করেছিলেন ফুটবলের কাড়িকুড়ি। রাস্তার কাদা আর পানি ভরা খানাখন্দ তখন তার প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার, দারিদ্রতা বিপক্ষের গোলরক্ষক। জান-প্রাণ বাজি রেখে ফুটবল খেলেও যে প্রতিপক্ষকে হারাতে পারেননি তার বাবা, গারিঞ্চাসহ অনেকেই।
প্রতিপক্ষ তো তখন গায়ের রঙও। ব্রাজিলে যখন ফুটবল খেলা শুরু হলো, তখন খেলার অধিকার ছিল কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গদেরই। কালো বর্ণের লোকেরা, সহজে যাদের শ্রমিকই বলা যায়, তারা খেলা দূরে থাক, খেলা দেখতেও পারত না। মাঝে লিওনিদাস এসে খানিকদিন এই বর্ণবৈষম্যের বিষবাষ্প দমিয়ে রাখলেও সেই ঢাকনা সরে যেতে সময় লাগেনি। এমনকি ‘মারাকানাজোর’ পরেও বেছে বেছে কৃষ্ণাঙ্গদেরই কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছিল ব্রাজিলে। শ্বেতাঙ্গরা শুভ্র, ম্যাচ হারানোর কলঙ্ক তো তাদের নয়।
পৃথিবীটাও এমন হাতের মুঠোয় চলে আসেনি। দুনিয়া দেখতে হয় পশ্চিমাদের চোখ দিয়ে। যে চোখে তারাই শ্রেষ্ঠ। সেই সময়টায় ব্রাজিলের মতো তৃতীয় বিশ্বের এক দেশে জন্মেও অবিসংবাদিত সেরা হওয়ার এমন দাবি উত্থাপন, পেলে ছাড়া আর কেউ কি পেরেছেন? এখনও?
সর্বকাল সেরা, ১২৮৩ গোল, তিনটা বিশ্বকাপ, খ্যাতি, সম্মান, মর্যাদা – পেলের সমার্থক হয়ে অনেক শব্দই বসেছে কালক্রমে। বিপরীতার্থক শব্দ হিসেবে তৈরি হয়েছে মেসি-ম্যারাডোনাও। তবে এত পালাবদলেও ধ্রুব হয়ে টিকে রইলো বোধ হয় ওই মানেটাই। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তিনি যে বলে যেতে পেরেছিলেন, ‘পেলের মৃত্যু নেই’, তার রহস্যও লুকিয়ে ওখানেই।
তৃতীয় বিশ্ব, দারিদ্র্য, কৃষ্ণকায় – শোষিত হওয়ার ভাগ্য নিয়েই তো জন্মেছিলেন সাও পাওলোর সাদামাটা এক ঘরে। সেই তিনি যখন হয়ে উঠলেন তামাম দুনিয়ার ‘ও রেই’, তখন তো পেলে মানে কেবলই সেরা থাকল না, হয়ে উঠল সেরা হওয়ার ওই বিশ্বাসটা।
রিওর ফাভেলা থেকে ঢাকার বস্তি, ‘পেলে’ তো অক্ষয় হয়ে গেল এই বিশ্বাসেই।