রোনালদিনহোর প্রতিভা নিয়ে কোনো কালেই কোনোরকম সন্দেহের অবকাশ ছিল না। তার বয়স যখন মাত্র ১৩, তখনই তিনি একবার এক ম্যাচে ২৩ গোল করেছিলেন। দল জিতেছিল ২৩-০ ব্যবধানে। তখনকার গণমাধ্যমে ফলাও করে ম্যাচের খবর আর রোনালদিনহোর কারিশমা প্রচার হয়েছিল।
কিন্তু, একজন পেশাদার ফুটবলার হিসেবে তার যেমন ক্যারিয়ার পাওয়া উচিৎ, সেটা তিনি কোনো সময়ই পাননি। তা না হলে কীভাবে পরাক্রমশালী এক ফুটবলারের ঠাঁই হয় জেলে। ফুটবলের স্বর্গ থেকে চূড়ান্ত পতন হয়েছে তার।
ফুটবল অবশ্যই তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভালবাসা ছিল। তবে, এটা কখনোই তার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়নি। তাই তো বিশ্ব ফুটবলের দুনিয়াতে তিনি চূড়ায় থাকতে পেরেছেন কেবল কয়েকটা বছর।
সেই সময়টা হল ২০০২ বিশ্বকাপের পরবর্তী সময়। প্যারিস সেইন্ট জার্মেই (পিএসজি) থেকে তাকে উড়িয়ে নিয়ে আসলেন স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার তখনকার সভাপতি হুয়ান লাপোর্তা। রোনালদিনহোর ফুটবলীয় যোগ্যতাই তাকে বার্সেলোনাতে নিয়ে এসেছিল।
তবে, রোনালদিনহো’র ফুটবলের বাইরেও যে একটা জীবন আছে, সেই কথাটা এর আগেই বুঝে ফেলেছিলেন লুইস ফার্নান্দেজ। এই ভদ্রলোক যখন পিএসজিতে ছিলেন তখনই টের পেয়েছিলেন যে, রোনালদিনহো কোনো শৃঙ্খলা মানতে চান না। সব সময় পার্টিতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চান।
স্মৃতিচারণা করে ফার্নান্দেজ বলেন,
‘টিম হোটেলে দলের যেকোনো সমাগমেই মেয়েরা আসতো।’
এখানে সাবেক এই পিএসজি কোচের ইঙ্গিতটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এটা তাই মানতেই হচ্ছে যে, রোনালদিনহোর জীবনযাত্রাই তার বিশ্বসেরা ফুটবলার হয়ে ওঠার পেছনে প্রধান অন্তরায় ছিল।
রোনালদিনহোর যেমন বার্সেলোনাকে দরকার ছিল, তেমনি বার্সেলোনারও ঠিক রোনালদিনহোর মতোই কাউকে দরকার ছিল। তাই, বার্সেলোনা বড় একটা সময় ধরে প্রতিভাবান এই ফুটবলারকে সঠিক পথে আনার জন্য সংগ্রাম করে গেছে। তার ফলাফলটা মাঠে পাওয়া গেছে। বার্সেলোনার হয়েই অবিশ্বাস্য সব কীতি মাঠে করেছেন রোনালদো। কিন্তু, মাঠের বাইরে তার জীবনে বার্সেলোনা কর্তৃপক্ষ বরাবরই ছিল বিরক্ত।
রোনালদিনহোর ভুবনভোলানো হাসিটা ন্যু ক্যাম্পের সমর্থকদের প্রিয় ছিল। সেই হাসিটা যেন এই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারের দু’টি ভিন্ন ‘প্যাশন’-এর প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
লা লিগায় নিজের দ্বিতীয় ম্যাচে সেভিয়ার বিপক্ষেই গোল পেয়ে যান তিনি। দিনটা ছিল ২০০৩ সালের তিন সেপ্টেম্বর। তখন থেকেই বার্সেলোনার পোস্টারবয় তিনি। কাতালান ক্লাবে তার শুরুর দিকটায় অবশ্য শৃঙ্খলাজনিত কোনো সমস্যায় তাকে নিয়ে ভুগতে হয়নি বার্সেলোনাকে।
তবে ২০০৬ সালে ক্লাবটি যখন উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে ফেলে, ঠিক তখন থেকেই অবস্থার অবনতি হওয়া শুরু হয়। ভোর পর্যন্ত তার নেচেগেয়ে পার্টি করার ভিডিও ভাইরাল হয়। বার্সেলোনা অবশ্য সেবার তার অনুশীলনে অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে ডায়েরিয়াজনিত সমস্যার কথা বলেছিল।
তবে একটা সময় রোনালদিনহোর পিঠ রক্ষা করা ছেড়ে দেয় বার্সেলোনা। পেপ গার্দিওলা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে, রোনালদিনহোকে ছেড়ে দিতে হবে। ততদিনে লিওনেল মেসি নিজেকে রোনালদিনহোর যোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
মেসির ক্যারিয়ারে অবশ্য রোনালদিনহোর অবদান কম নয়। তবে, গার্দিওলা বিশ্বাস করতেন ড্রেসিংরুমে রোনালদিনহোর উপস্থিতি মাঠের বাইরে মেসিকে উচ্ছৃঙ্খল করে ফেলতে পারে। ফলে, বার্সেলোনার মূল দলের দায়িত্ব নেওয়ার পরই রোনালদিনহো নতুন চ্যালেঞ্জের খোঁজে বের হয়ে যান।
রোনালদো গেলেন এসি মিলানে। তখন অবশ্য জায়ান্ট হতে শুরু করা ম্যানচেস্টার সিটির বিশাল অংকের প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু, রোনালদিনহো গেলেন ইতালিতে। রোনালদো অর্থকে কখনোই নিজের জীবনের বিনোদনের আগে স্থান দেননি। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না।
মিলান দলটায় তখন তারকার মেলা। কার্লো আনচেলত্তির অধীনে রোনালদিনহো, কাকা, ডেভিড বেকহ্যামরা এক সাথে খেলেন। সেটা রোনালদিনহোর ক্যারিয়ারের জন্য নতুন একটা ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হতে পারতো। কিন্তু, ইতালিতে গিয়ে অবস্থার আরো সঙ্গীন হল।
তিনি দিনভর পার্টি করতে লাগলেন। ফুটবল ভুলে বাইরের জীবনটাই তখন তার কাছে আরো বেশি প্রাধান্য পাচ্ছিল। একবার মিলানের পার্টি থেকে তাকে বের করে জোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দিল সমর্থকরা। কারণ, পরদিনই ইন্টার মিলানের বিপক্ষে মহারণ। সেই ম্যাচের গুরুত্ব রোনালদিনহোর কাছে না থাকলেও সমর্থকদের কাছে ছিল।
এর কয়েক বছর বাদে বার্সেলোনা তাকে অ্যাম্বাসেডর হিসেবে নিয়োগ দিল। কিন্তু, যে দিনটা তার ন্যু ক্যাম্পে থাকার কথা ছিল, সেদিন তাকে ক্যাসেলডেফেলস সমুদ্র সৈকতে ফুটবল খেলতে দেখা গেল।
২০০২ সালে ব্রাজিলকে পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা এনে দেওয়া রোনালদিনহো নিজেকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, সেটা বোঝা গেল গেল চার মার্চ। সেদিন রোনালদিনহো ও তার ভাই রবার্তোকে প্যারাগুয়ের দ্য রিসোর্ট ইয়ট অ্যান্ড গলফ ক্লাব থেকে গ্রেফতার করা হয়। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় জানায়, তাদের কাছে যে দু’টি পাসপোর্ট পাওয়া যায়, সেগুলো জাল। আর তাতে দু’জনকেই প্যারাগুয়ের নাগরিক হিসেবে দাবী করা হয়েছে।
প্যারাগুয়ের পুলিশ এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে জানিয়েছে, রোনালদিনহো প্যারাগুয়ে এসেছেন ক্যাসিনো মালিক নেলসন বেলোত্তির আমন্ত্রণে। সেখানে তার দাতব্য সংস্থার কয়েকটা প্রচারণামূলক কয়েকটা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা ছিল রোনালদিনহোর। প্রাথমিকভাবে তাদের জেরা হোটেলেই করা হয়। এরপর সাত মার্চ নেওয়া হয় আদালতে।
কিন্তু, তার জন্য হঠাৎ জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করতে হলো কেন সাবেক এই বার্সেলোনা তারকার? কারণ হলো, সেই ২০১৮ সালেই রোনালদিনহোর আসল পাসপোর্ট জব্দ করেছে ব্রাজিল সরকার। ব্রাজিলের লেক গুয়াইবাতে ২০১৫ সালে বেআইনিভাবে একটি চিনির কল নির্মানের জন্য তাকে ৬.৫ মিলিয়ন পাউন্ড জরিমানা করা হয়, সাথে পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। কিন্তু, একসময় বিশ্ব ফুটবল দাঁপিয়ে বেড়ানো রোনালদিনহোর সেই জরিমানার অর্থ পরিশোধের সামর্থ্য ছিল না। তখন নাকি তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ছিল মাত্র ছয় ইউরো। তাই তিনি আর নিজের পাসপোর্ট ফেরত পাননি।
এর অর্থ হলো, রোনালদিনহোর কার্যত দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। অথচ মজার ব্যাপার হলো, গেল বছরের সেপ্টেম্বরেই তাকে ব্রাজিলের পর্যটন দূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অথচ, তিনিই এখন ভিনদেশি সরকারের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন।
সে যাই হোক, মামলা মোকদ্দমা চলছে এখনো। কারণ, রোনালদিনহোর দাবি, ভ্রমণসংক্রান্ত কাগজপত্র ও পাসপোর্ট ওই দাতব্য সংস্থাই তাকে দিয়েছিল। যদিও, এই সময়টায় রোনালদিনহোর ঠাঁই এখন হয়েছে প্যারাগুয়ের জেল ‘প্যাসিওন এস্পেসিয়ালিজাদা’য়।
তবুও, দিব্যি আছেন তিনি। জেলটা একটু বিশেষ পদমর্যাদাধারীদের কারাবাস। রোনালদিনহোর সাথেই আছেন চারজন রাজনীতিবিদ, এর মধ্যে একজন আবার প্যারাগুয়ের আইনসভার নিম্নকক্ষের সাবেক রাষ্ট্রপতি। এখানেই শেষ নয়, আছেন সাবেক ২৫ জন পুলিশ কর্মকর্তাও।
কথায় আছে না, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে! রোনালদিনহোও তাই কারাগারেই এক ফুটসাল টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন। রোনালদিনহোর পাঁচজনের দলটাই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ফাইনালে প্রতিপক্ষকে ১১-২ গোলে হারিয়েছেন। রোনালদিনহো একাই করেছেন পাঁচ গোল, দু’টো অ্যাসিস্টও আছে।
পুরস্কার হিসেবে একটা ট্রফি পেয়েছেন। সাথে ১৬ কেজি ওজনের শূকরের বারবিকিউ তো ছিলই। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বরাতে রোনালদিনহোর কারাবাসের যে ক’টা ছবি প্রকাশিত হয়েছে, সবগুলোতেই তিনি বেশ হাসিখুশি। রোনালদিনহো বরাবরই এমনই, যেকোনো পরিস্থিতিতেই তিনি নিজের সুখটা খুঁজে নিতে জানেন।
তবে, এই হাসির আড়ালেও শঙ্কা আছে। কারণ দোষ প্রমাণিত হলে তার ছয় মাসের জেল হবে। প্যারাগুয়ের আইন তাই বলে। আদালতে দাঁড়িয়ে রোনালদিনহোর আইনজীবী বলেছেন, রোনালদিনহো এমন অবস্থায় পড়েছেন, কারণ তিনি ‘নির্বোধ’।
রোনালদো ফুটবলের ইতিহাসে যে মানের কিংবদন্তি, তাতে কোনোভাবেই তার সাথে এই বিশেষণটা যায় না!