“ঈশ্বর আছেন, এবং তিনি ফ্রান্স ফুটবল দলে আবার ফিরে এসেছেন।” – থিয়েরি অঁরি
২০০৫ সালের ৩ আগস্ট। পরের বছর জার্মানিতে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব থেকে বাদ পড়ার শঙ্কায় ফ্রান্স ফুটবল দল তখন টালমাটাল। একের পর এক হারে ততদিনে খাদের কিনারায় গিয়ে ঠেকেছে দলটির ২০০৬ বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটি ঘোষণা এলো। শেষবারের মতো নেপোলিয়নের উত্তরসূরিদের স্বপ্নসারথী রূপে আবির্ভূত হতে জিদান ঘোষণা দিলেন অবসর ভেঙে ফিরে আসার। কোনো রাখঢাক না রেখেই থিয়েরি অঁরিও জানিয়ে দিলেন, ফ্রান্স ফুটবল দলে জিদানের জায়গাটা আসলে কোথায়!
অথচ গল্পটা অন্যরকমও হতে পারতো জিদানের জন্য। ক্যারিয়ারের একদম শুরুর দিকে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবাদে জিদানের সামনে সুযোগ ছিল আলজেরিয়ার জাতীয় দলে খেলার। কিন্তু তৎকালীন আলজেরিয়া দলের কোচ জানিয়ে দিলেন, পর্যাপ্ত গতির অভাবে জিদান জাতীয় দলের জন্য বিবেচিত হবেন না! গতিশীলতায় ঘাটতি থাকা সেই জিদানই যখন ফ্রান্স ফুটবলের ‘ঈশ্বর’ বনে যান, স্বাভাবিকভাবেই তখন প্রশ্ন ওঠে, কি করে সম্ভব হয়েছিল এতদূর আসা?
উত্তরটা লুকিয়ে আছে এখন থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে, বিংশ শতাব্দীর সত্তর এর দশকের দিনগুলোতে। জিদান তখন জীবদ্দশার প্রথম ধাপ, অর্থাৎ শৈশবে।
অন্য সব শিশুদের মতো জিদানের শৈশব কখনোই স্বর্ণালী মোড়কে মোড়ানো কোনো স্মৃতি নয়, বরং সেটি দারিদ্র্যে ভরপুর একটি কালো অধ্যায়। ১৯৫৩ সালের দিকে বাবা-মা আলজেরিয়া ছেড়ে ফ্রান্সে এসেছিলেন অভিবাসী হয়ে। অভাব-অনটনের সেই সংসারটিতে জিদানের আগমন ঘটে ১৯৭২ সালের ২৩ জুন।
দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারের চাহিদা মেটাতে ছোটবেলা থেকেই পেশাদার ফুটবলে যোগ দেন জিদান। ফ্রান্সের মার্শেই শহরের অলিগলি তখন তার ফুটবল জাদুতে মোহাবিষ্ট। স্থানীয় ক্লাব ইউএস সেইন্ট-হেনরির হয়ে সেই যে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন জিদান, আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পরবর্তীতে বিশ্বের বড় বড় ক্লাব আর জাতীয় দলের হয়ে মাতিয়েছেন পুরো ফুটবল বিশ্ব, সৃষ্টি করেছেন নতুন ইতিহাস, নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন অসামান্য উচ্চতায়।
পেশাদার ক্যারিয়ারে উত্থান ও জাতীয় দলে অভিষেক
১৯৯১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। পেশাদার ফুটবলে তার প্রথম বড় ক্লাব কানের হয়ে এদিনই জিদান প্রথমবারের মতো গোল করেন। দিনবদলের সুচনা করে দেয়া সেই গোলটি জিদানের করা সবচেয়ে স্মরনীয় গোলের একটি হয়ে আছে। ফলাফলও পেয়েছিলেন হাতেনাতে, ডাক পেলেন FC Girondins de Bordeaux ক্লাব থেকে। ক্যারিয়ারের পরবর্তী চারটি বছর সেই ক্লাবেই কাটান জিদান। সে সময় ক্লাবের হয়ে তার পারফরম্যান্সই খুলে দিয়েছিল জাতীয় দলের দুয়ার।
দিনটি ছিল ১৯৯৪ সালের ১৭ আগস্ট। চেক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচটিতে ফ্রান্সের হয়ে প্রথমবারের মতো জার্সি গায়ে জড়ান জিদান। শুরুতে ২-০ গোলে পিছিয়ে থাকা দলকে উদ্ধার করতে বদলি হিসেবে মাঠে নামেন ম্যাচের ৬৩ মিনিটের মাথায়। একাই দুই গোল করে লজ্জাজনক এক হার থেকে সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দেন দলকে। মূলত ওই ম্যাচটি থেকেই অনাগত এক কিংবদন্তির আগমনী বার্তা পেয়েছিল ফুটবল বিশ্ব।
জাতীয় দলের হয়ে বিশ্ব কাঁপানো
ক্যারিয়ারের শুরুর দুইটি বছর জাতীয় দলে এরিক ক্যান্টোনার ছায়া হিসেবে থাকতে হয়েছে জিদানকে, খুব কমই সুযোগ পেয়েছেন নিজের পুরোটা দিয়ে খেলার। ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে, যখন ক্যান্টোনা নিষেধাজ্ঞার দায়ে এক বছর জাতীয় দলের বাইরে ছিলেন। সে সময়টাতে প্লেমেকার হিসেবে খেলে কোচের যে আস্থা জিদান অর্জন করেছিলেন, সেটিই তাকে ১৯৯৬ ইউরোতে ফ্রান্সের মূল খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হতে বাধ্য করে। ক্যান্টোনাকে ঘিরে দল সাজানোয় অনেকদিনের যে প্রতিষ্ঠিত নিয়ম ছিল, সে টুর্নামেন্টেই প্রথমবারের মতো এটির ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়।
ফ্রান্সের মধ্যমাঠের প্রাণভোমরা হয়ে ‘৯৬ ইউরো মাতানো জিদান, ক্যারিয়ারের একদম শেষ ম্যাচটি পর্যন্ত এই কাজ করে গেছেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে। তাকে ঘিরে দর্শকদের উন্মাদনা কখনোই যে তার পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলতে পারেনি, সেটা তিনি বারবারই প্রমাণ করে দিতেন। সর্বোচ্চ স্বাক্ষর রাখার জন্য বেছে নিয়েছিলেন ১৯৯৮ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটিকে।
টুর্নামেন্টের হট ফেভারিট ব্রাজিলের বিপক্ষে সেই ম্যাচটিতে সবাই যখন রোনালদোর বল নিয়ে অতিমানবীয় প্রদর্শনী দেখার অপেক্ষায়, জিদান তখন জানান দিলেন নিজের ভয়ঙ্করতম উপস্থিতি। পুরো ফুটবল দুনিয়া অবাক হয়ে দেখল, কী করে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের জাদুতে সব হিসাবনিকাশ উল্টে ফেলা যায়। বিধ্বংসী হেডের স্পর্শে ব্রাজিলের কফিনে পেরেক হিসেবে ঢুকালেন দুইটি গোল। হয়ে গেলেন ফ্রান্সের ইতিহাসের চিরকালীন নায়কদের একজন।
অমরত্ব পাওয়ার জন্য ওই ফাইনাল ম্যাচটিই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু জিদান যে এসেছিলেন কিংবদন্তি হতে, সর্বকালের সেরাদের তালিকায় নাম লেখাতে! আর তাই তো বিশ্বকে নিজের ফুটবলশৈলীর সুন্দরতম রূপের সাক্ষী করতে ওই ম্যাচের পর খেলেছেন আরো আটটি বছর। মুগ্ধতায় বুঁদ করে রেখেছেন পুরো ফুটবল দুনিয়াকে, চোখের পলকে জাদুকরী সব কারিকুরিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই জিদান অন্য ধাতুতে গড়া। দিশাহীন দলের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়টাতে তিনি জ্বলে উঠতেন। পথ দেখাতেন নতুন করে, সৃষ্টি করে দিতেন ঐতিহাসিক জয়ের পথ। আর এভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল ২০০০ সালের ‘ইউরো মহাকাব্য’।
জিদান ততদিনে ফ্রান্স ফুটবলের রত্ন হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছেন। ২০০০ সালের ইউরোপিয়ান কাপের মঞ্চটি তাই জিদানের জন্য ছিল মূলত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উপলক্ষ। আর সেটাকে কী দারুণভাবেই না কাজে লাগালেন!
কষ্টেসৃষ্টে গ্রুপপর্ব অতিক্রম করা ফ্রান্সের জন্য, কোয়ার্টার ফাইনালে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করতে সব প্রস্তুতিই সেরে নিয়েছিলো স্পেন। আর সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সবচেয়ে বেশি যার দিকে তাকিয়ে দল, ম্যাচের ৩৩ মিনিটে সেই জিদান আবার মনে করিয়ে দিলেন তাঁর নামের মাহাত্ম্য। ফ্রি কিক থেকে গোল করে দলের জয়ে রাখলেন উজ্জ্বলতম ভূমিকা। সেমিফাইনালে পর্তুগালের বিপক্ষে দেখালেন, কী করে চাপের মুখে মাথা ঠাণ্ডা রেখে খেলে জয় ছিনিয়ে আনতে হয়।
৯০ মিনিটে অমীমাংসিত সেই ম্যাচটির তখন অতিরিক্ত সময়ের খেলা চলছে। ১২০ মিনিট পূর্ণ হতে আর মাত্র ৩ মিনিট বাকি। ঠিক সেই মুহূর্তটিতে পেনাল্টি পেল ফ্রান্স। দৃশ্যপটে আবারও জিদান। পেনাল্টি থেকে গোল করে গোল্ডেন গোল পদ্ধতিতে দলকে পৌঁছে দিলেন ফাইনালে। আর ফাইনালে যখন ইতালিকে পরাজিত করে ফ্রান্স ২০০০ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নাম টুকে নিল, জিদান তখন হয়ে গেলেন ফরাসিদের রূপকথার নায়ক।
পরপর দুইটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স তখন বিশ্ব শাসন করছে, আর সেনাপতির আসনে বসে জিদান দেখিয়ে যাচ্ছিলেন তার অপার ক্ষমতা। জাতীয় দলের হয়ে সম্ভাব্য সবকিছু জেতার পর অবশেষে সেই ঘোষণাটি এল। প্রায় একক নৈপুণ্যে ফ্রান্সকে ২০০৪ ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে তুলে জিদান জানিয়ে দিলেন আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে তার অবসরের সিদ্ধান্ত। ১২ আগস্ট কোয়ার্টার ফাইনালের সেই ম্যাচটিতে গ্রিসের সাথে অযাচিতভাবে হেরে অবশেষে বিদায়ই নিয়ে ফেললেন জিদান।
প্রত্যাবর্তন এবং আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় পর্ব
১৯৯৪-২০০৪, টানা ১০ বছর ফুটবল বিশ্বকে নিজের পায়ের জাদুতে বুঁদ করে রাখা মহানায়কের অবশেষে প্রস্থান ঘটলো। প্রতিকূলতার চোরাস্রোত যার ফুটবল শৈলীর অপার মাধুর্যকে কখনো টলাতে পারেনি, সেই প্রবাদ পুরুষের ‘ট্র্যাজিক হিরো’ হিসেবে বিদায় নেয়া, ফুটবল রোমান্টিকদের মনে যে চিরকালীন একটা ক্ষত তৈরি করে যাবে, এমনটা ভাবা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। আর তাই তো উর্ধ্বাকাশে বসে সৃষ্টিকর্তা চিন্তা করছিলেন অন্য কিছু।
সময়টা ২০০৫ সালের মাঝামাঝি। বাছাইপর্বে টানা পরাজয়ে ফ্রান্সের ২০০৬ বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন ততদিনে জলাঞ্জলি দেয়া হয়ে গেছে। ভরসার প্রতীক হয়ে শেষবারের মতো জ্বলে উঠতে জিদান ঘোষণা দিলেন প্রত্যাবর্তনের। কিংবদন্তির পুনরাবির্ভাবে দিশা ফিরে পেল ফ্রান্স দল। বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে অংশ নিল ২০০৬ বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে।
মূলত দলগত পারফরম্যান্সের জোড়ে ফ্রান্স ওই বিশ্বকাপের ফাইনাল পর্যন্ত গেলেও জিদান আলাদা করে মনে রাখতে চাইবেন কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচটিকে। অনেকের মতেই, জীবনের সেরা ম্যাচটি খেলেছিলেন সেদিন। একযুগ ধরে বিশ্ব মাতানো জিদানের ফুটবল ক্যারিয়ারের হাইলাইটস হিসেবে ধরে নিতে পারেন ওই ম্যাচটিকে। বল পায়ে ফুটবল শৈলীর সর্বোচ্চটা দিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, গ্রিসের সাথে অভিষেক ম্যাচে জোড়া গোল করা জিদান আর এই জিদান অভিন্ন এক চরিত্র। মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন ‘৯৮ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটির কথা, যখন ফ্রান্সের ত্রাতা রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। চোখের কোণে ভেসে উঠছিল স্পেনের বিপক্ষে তার সেই ফ্রি কিক, যা ফ্রান্সকে পৌঁছে দিল ২০০০ ইউরোর সেমিতে। স্মৃতিতে উঁকি দিচ্ছিল অবসর ভেঙে ফিরে এসে ফ্রান্সকে উদ্ধার করার বীরত্বগাঁথা।
৯০ মিনিট দর্শকদের আন্দোলিত করে রাখার যে শপথ নিয়ে ফুটবল মাঠে পদচারণা শুরু করেছিলেন, তা যেন পূর্ণতা পেল ব্রাজিলের সাথে ঐ ম্যাচটিতে। স্কোরকার্ড হয়তো ম্যাচের ৫৭ মিনিটে হওয়া গোলটার জন্য থিয়েরি অঁরিকে কৃতিত্ব দেবে, কিন্তু সেই গোলের পিছনের গল্পটা সাক্ষ্য দিবে জিদানের মাহাত্ম্য। তারই করা অসাধারণ একটি ক্রস থেকে হেনরি বরং গোল না করলেই সেটা অবিশ্বাস্য ছিল।
দলকে সেই বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলে অবশেষে তিনি ঘোষণা দিলেন বিদায়ের। সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বমঞ্চে আবির্ভাব ঘটেছিল তার, আর সেটাকে পূর্ণতা দিয়ে জিদান তখন বিদায় নিচ্ছেন বীরবেশে। কিংবদন্তিদের সংক্ষিপ্ততম তালিকাতেও যার নাম অবধারিতভাবে রাখতে হয়। যখনই খেলেছেন, দলে তার অপরিহার্যতা প্রমাণ করেই খেলেছেন। আর তাই তো সিজার মালদিনির কণ্ঠে ফুটে ওঠে,
“I would give up five players to have Zidane in my squad.”
ক্লাব ক্যারিয়ারে জিদান
স্পটলাইট তার উপর অনেক আগে থেকেই ছিল। অবশেষে ইউরোপের কুলীন ক্লাবগুলোর একটি থেকে প্রথম ডাক এলো ১৯৯৬ সালে। ৩ মিলিয়ন ইউরো ট্রান্সফার ফিতে জুভেন্টাস জিদানকে নিজেদের করে নিল।
জুভেন্টাসকে পরপর দুইটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে তোলা জিদান তখন ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান রত্নদের একজন। সুতরাং রিয়াল মাদ্রিদের চোখ যে তার উপর পড়বে, সেটা অনুমিতই ছিল। আর তাই তো ২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে অবিশ্বাস্য ৬৬ মিলিয়ন ইউরোর ট্রান্সফার ফি’তে জিদানকে নিজেদের দলে ভিরায় স্পেনের সবচেয়ে সফল ক্লাবটি।
২০০১-২০০৬, ক্লাব ক্যারিয়ারের স্বর্ণালী যুগ কেটেছে জিদানের জন্য। সে সময়টাতে রিয়াল মাদ্রিদ আর জিদান ছিল একে অপরের প্রতিশব্দ। অবশ্য রিয়ালের কিংবদন্তির খাতায় যে তার নামটা উঠছে, সেটার বার্তা তিনি প্রথম মৌসুমেই দিয়েছিলেন।
২০০১-০২ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের খেলা চলছে। বায়ার লেভারকুসেনের সাথে রিয়ালের হওয়া সেই ম্যাচটির তখন ৪৫ মিনিট। বাঁ দিক থেকে রবার্তো কার্লোসের ক্রস ডি বক্সে জিদানের ঠিকানা পেল। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক ৪৪ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড। পরের এক সেকেন্ডে যা ঘটলো, চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে সবচেয়ে জাদুকরী এক সেকেন্ড হিসেবে সেটি চিরকাল বেঁচে থাকবে। বাঁ পায়ের অবিশ্বাস্য ভলিতে গোল! জিদান অমর হয়ে গেলেন ইতিহাসের পাতায়। আজকে প্রায় দুই দশক পরও যে গোলটি নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গেলে মাথায় আসবে, ‘ধরণী দ্বিধা হও! মানুষের দ্বারা কি সম্ভব এই গোল করা?’
রিয়ালের হয়ে একটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, একটি লিগ শিরোপা আর দুইটি স্প্যানিশ সুপার কাপ জেতার পর অবশেষে ক্লাব ক্যারিয়ারেও সমাপ্তিরেখা টানলেন জিদান। ২০০৬ সালে ভিয়ারিয়ালের সাথে সেই ম্যাচটিতে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর দর্শকরা এসেছিল শেষবারের মতো মাঠে বসে জিদান জাদু দেখার জন্য। কিংবদন্তির বিদায় উপলক্ষে ক্লাবের জার্সিতে লোগোর নিচে লেখা ছিল,“জিদান ২০০১-২০০৬”। মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে দর্শকদের আবেগতাড়িত করতালি নীরবে জানান দিচ্ছিল জিদানের শ্রেষ্ঠত্ব। জানান দিচ্ছিল, একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হতে যাচ্ছে, যার পরতে পরতে লেখা থাকবে একজন ফুটবল জাদুকরের রূপকথার ইতিহাস। যিনি ১১ সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের বলটাকে সৌন্দর্য্য দিয়ে খেলতেন, যার পায়ের শৈলী বুঁদ করে রাখতো মুগ্ধতাপিপাসু দর্শকের চোখ, শেষবারের মতো সেই প্রবাদপুরুষ মাঠ থেকে বিদায় নিচ্ছেন। গ্যালারিতে বসে থাকা অগণিত লোকদের গায়ে জড়ানো জার্সিটাতে তাই লেখা, ‘Gracius, Zidane’ (ধন্যবাদ জিদান)।
লেখাটি শেষ করব জিদানের ছোটবেলার একটি ঘটনা দিয়ে। শৈশবের দুরন্তপনাকে একপাশে রেখে জিদান তখন স্কুল ফুটবলে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সে সময়ের একটি ম্যাচ তার জীবনদর্শন বদলে দিয়েছিল।
জিদানের দল সেই ম্যাচটিতে হেরে যায়। এতে তার যতটা না কষ্ট হচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি হচ্ছিলো ভয়; ওই ম্যাচের একজন দর্শক যে তার বাবাও ছিলেন! হতাশা আর ভয় বুকে নিয়ে নদীতীরে বসে থাকা জিদান হঠাৎই একটি স্নিগ্ধ হাতের স্পর্শ অনুভব করল পিঠের উপর। আরে, এটা তো তার বাবাই!
হ্যাঁ, জিদান সেদিন তার বাবাকে পাশে পেয়েছিলেন। বাবার কাছে শিখেছিলেন সংগ্রাম করে টিকে থাকার মন্ত্র, হারার আগেই না হেরে যাওয়ার বাণী। আর এটাকেই বুকে ধারণ করে ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় লড়ে গেছেন ফুটবল মাঠের প্রকৃত যোদ্ধাদের একজন হয়ে। যাকে নিয়ে একসময় স্বয়ং পেলে ঘোষণা দিয়েছিলেন,
“জিদান একজন মাস্টার ! ফুটবলটাকে তার মতো করে গত দশ বছর ধরে কেউ খেলেনি। তিনিই বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়!”