ফিলিপ হিউজেস: যাকে আউট করতে পারবে না আর কোনো বোলার

মাইকেল ক্লার্কের ইনজুরি কারণে ভারতের বিপক্ষে আসন্ন টেস্ট সিরিজে ফিলিপ হিউজেসের খেলা প্রায় নিশ্চিত। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও রানের ধারায় ছিলেন, তাই তার ভারতের বিপক্ষে টেস্ট দলে ফিরে আসা শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার তখন।

আবুধাবিতে ফটোগ্রাফি অফ দ্য ইয়ারে জায়গা করে নিয়েছিল ফিলিপ হিউজেসের ছবিটি

শেফিল্ড-শিল্ডের ম্যাচে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে অসাধারণ ব্যাট করছিলেন হিউজেস। মধ্যাহ্ন বিরতির পর যখন ব্যাট করছেন তখন তার নামের পাশে অপরাজিত ৬৩ রান লেখা। এমন সময় শেন অ্যাবোটের হঠাৎ লাফিয়ে উঠা বলে হুক করতে গিয়ে ব্যাটে-বলে ঠিকমতো সংযোগ করতে পারলেন না হিউজেস। মাথায় হেলমেট থাকা সত্ত্বেও বল এসে সোজা আঘাত হানলো তার কানের একটু নিচে ঘাড়ের অংশটায়। এরপর হাঁটুর উপর ভর দিয়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ছিলেন। বিপক্ষ দলের সবাই যখন তার দিকে ছুটে আসছে ততক্ষণে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন হিউজেস। সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কারণে তাকে নিয়ে যাওয়া হল সিডনির সেন্ট ভিনসেন্ট হসপিটালে।

হুক করতে গিয়ে বলটি হেলমেট মিস করে ঘাড়ে লাগার পর পরে যান হিউজেস

সেখানে দুইদিন কোমায় থাকার পর নিজের ২৬তম জন্মদিনের দু’দিন আগে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ফিলিপ হিউজেস। ক্রিকেট বিশ্বকে থমকে দিয়ে অকালেই ঝড়ে পড়েন তরুণ এই ক্রিকেটার। ভারতের বিপক্ষে মাইকেল ক্লার্কের জায়গায় তার খেলার কথার ছিল। সেই মাইকেল ক্লার্কই তার মৃত্যুর পর তার বদলে বক্তব্য রাখেন অশ্রুসিক্ত চোখে।

বোলার শেন অ্যাবোটের স্বাভাবিক হতে অনেকদিন সময় লেগেছিল, দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মিচেল জনসনও খেই হারিয়ে ফেললেন। পুরো ক্রিকেট বিশ্বে শোকের কালোছায়া এসে ঢেকে দিয়েছিল। সাউথ অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউ সাউথ ওয়েলসের ম্যাচটি ঐখানেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। শেফিল্ড-শিল্ডের চলতি দুটি ম্যাচও দিনশেষে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। ফিলিপ হিউজেসের মৃত্যুতে পাকিস্তান বনাম নিউজিল্যান্ডের টেস্টের তৃতীয় দিন স্থগিত করা হয়। পরদিন খেলতে নেমে নিউজিল্যান্ডের বোলাররা কোনো ব্যাটসম্যানকে বাউন্স বল দেননি। এমনকি উইকেট শিকারের পর উদযাপনও করেনি ব্ল্যাক ক্যাপসরা।

ফিলিপ হিউজেসের মৃত্যুতে নীরবতা পালন করছেন নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা

পিছিয়ে দেয়া হয়েছিলো ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া সিরিজও। সিরিজটি যখন অনুষ্ঠিত হয় তখনো ক্রিকেটারদের স্মরণে ছিলো ফিলিপ হিউজেস। স্টিভ স্মিথ, মাইকেল ক্লার্ক এবং ডেভিড ওয়ার্নাররা যখনই ব্যাট করার সময় ৬৩ রানে আসতেন, তখন স্মরণ করতেন হিউজেসকে।

ফিলিপ হিউজেসের ক্রিকেট ক্যারিয়ার অন্য আট-দশজন ক্রিকেটারের মতো নয়। নিউ সাউথ ওয়েলসের ম্যাকভিলেতে এক গরীব কলা চাষির ঘরে জন্ম হিউজেসের। ক্রিকেটার হতে না পারলে হয়তো ঐ পেশাটাই বেছে নিতে হতো তাকে। কিন্তু হিউজেস মেতে থাকতেন ব্যাট বল নিয়ে। মূলত ব্যাটিংটাই তার পছন্দের ছিল, সময় পেলেই ব্যাট হাতে নেমে যেতেন নেট প্র্যাকটিসে।

বাবার সাথে ফিলিপ হিউজেস

ক্রিকেটে তার হাতেখড়ি একেবারে ছোট বয়সেই। মাত্র ১২ বছর বয়সে ম্যাকভিল ক্রিকেট ক্লাবে শতক হাঁকান। এরপর ১৭ বছর বয়সে ম্যাকভিল ছেড়ে সিডনিতে পাড়ি জমান ভালো কিছু করার প্রত্যয়ে। ২০০৬-০৭ মৌসুমে ওয়েস্টার্ন সাবার্বস ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলতে সিডনি যান। সেখানে সিডনি গ্রেড ক্রিকেটে খেলেন হিউজেস। অভিষেক ম্যাচেই খেলেন অপরাজিত ১৪১ রানের দুর্দান্ত ইনিংস।

খুব দ্রুত উন্নতি করতে থাকা হিউজেস ২০০৮ সালে অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন। এর আগেই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে অভিষেক ঘটেছিল তার। মাত্র ১৮ বৎসর ৩৫৫ দিনে নিউ সাউথ ওয়েলসের সিনিয়র টিমে জায়গা করে নেন তিনি। মাইকেল ক্লার্কের পর সবচেয়ে কম বয়সী ক্রিকেটার হিসাবে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে খেলেন হিউজেস। নিজের প্রথম মৌসুমেই ৬২.১১ ব্যাটিং গড়ে করেন ৫৫৯ রান।

ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে মিডলসেক্সের হয়ে খেলার জন্য ডাক পান হিউজেস। সেখানে গিয়ে মাত্র ৩ ম্যাচে ১৪৩.৫০ ব্যাটিং গড়ে করেন ৫৭৪ রান। ঐ মৌসুমে সারির বিপক্ষে খেলেন ১৯৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংস যেটা তাকে আলোচনায় নিয়ে আসে। অল্পদিনেই নির্বাচকদের নজর কাড়েন ফিলিপ হিউজেস।

ম্যাথিউ হেইডেনের অবসরের কারণে ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পেয়ে যান মাত্র ২০ বছর বয়সেই। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেক ইনিংসে ডেইল স্টেইনের বলে আউট হয়ে ফিরেন কোনো রান না করেই। কিন্তু “মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে। হারা শশীর হারা হাসি অন্ধকারেই ফিরে আসে।” সত্যেন্দ্রনাথের লেখা এই দুটো লাইন যেন ফিলিপ হিউজেসের জন্যই। প্রথম ইনিংসে শূন্য রানে ফিরে যাওয়ার পর তিনি খেলেন ৭৫ রানের অসাধারণ দ্বিতীয় ইনিংস। ২০০৯ সালের ৬ই মার্চ অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় টেস্টের জন্য তুলে রেখেছিলেন আসল চমক। ডেইল স্টেইন, মরনে মরকেল, মাখায়া এনটিনি এবং জ্যাক ক্যালিসদের নিয়ে গড়া দুর্ধর্ষ প্রোটিয়া বোলিং লাইনআপকে নাস্তানাবুদ করে ডারবান টেস্টের প্রথম ইনিংসে করেন ১৫১ বলে ১১৫ রান। যার মধ্যে ৮৮ রান এসেছিল শুধুমাত্র বাউন্ডারি থেকেই।

ডারবানে দ্বিতীয় ইনিংসে শতক হাঁকানোর পর উদযাপন করছেন ফিলিপ হিউজেস

১০ই মার্চে ডারবান টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেও শতক হাঁকান ফিলিপ হিউজেস। এইবার কিছুটা রক্ষণাত্মক ভঙ্গীতে খেলে করেন ১৬০ রান। এতে করেই রেকর্ডবুকে নিজের নাম তুলে নেন হিউজেস। সবচেয়ে কমবয়সী ব্যাটসম্যান হিসাবে টেস্ট ম্যাচের দুই ইনিংসেই শতক হাঁকান এই তরুণ ক্রিকেটার। মাত্র ২০ বৎসর ৯৮ দিনে এই রেকর্ড গড়েন তিনি। এর আগে হ্যাডলি ১৯৩০ সালে ২০ বৎসর ২৬৭ দিনে দুই ইনিংসেই শতক হাঁকিয়েছিলেন।

ফিলিপ হিউজেস রেকর্ড বুকে নিজের নাম লেখাতে পছন্দ করেন বলেই হয়তো অভিষেক ম্যাচেই নিজের নামের পাশে তিন সংখ্যার রান যোগ করেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেক ওয়ানডে ম্যাচে খেলেছিলেন ১১২ রানের এক দুর্দান্ত ইনিংস। প্রথম এবং একমাত্র অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার হিসাবে ওয়ানডে অভিষেকে শতক হাঁকান হিউজেস। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঐ সিরিজের ৫ম ম্যাচেও খেলেন ১৩৮ রানের দারুণ এক ইনিংস।

অভিষেক ওয়ানডেতে শতক হাঁকানোর পর উদযাপন করছেন ফিলিপ হিউজেস

২০১৪ সালের নভেম্বরে যখন চলে যান না ফেরার দেশে, তার কয়েক মাস আগেও নতুন রেকর্ডের জন্ম দিয়েছেন হিউজেস। লিস্ট-এ ক্রিকেটে প্রথম অজি ব্যাটসম্যান হিসেবে শতক হাঁকিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকা ‘এ’ দলের বিপক্ষে। ১৫১ বলে অপরাজিত ২০২ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। ক্রিকেটকে দেওয়ার মতো ফিলিপ হিউজেসের ভাণ্ডারে নিশ্চয়ই আরো অনেক কিছুই ছিল। কিন্তু মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয় সদাহাস্য ফিলিপ জোয়েল হিউজেসের।

বিদায়ের আগে হিউজেস অজিদের হয়ে ২৬টি টেস্টে ৩২.৬৫ ব্যাটিং গড়ে করেন ১,৫৩৫ রান। ৩টি শতক এবং ৭টি অর্ধশত রানের ইনিংস ছিল তার ক্যারিয়ারে।

হিউজেস ২৫টি ওয়ানডে ম্যাচে ৩৫.৯১ ব্যাটিং গড়ে ২টি শতক এবং দ্বিগুণ অর্ধশতকের সাহায্যে করেন ৮২৬ রান। বয়স ছাব্বিশের কোঠা স্পর্শ না করতে পারলেও হিউজেসের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে শতকের সংখ্যা ঠিক ২৬টি! প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১১৪ ম্যাচে ৪৬.৫১ ব্যাটিং গড়ে তার রান ৯,০২৩, রয়েছে ২৬টি শতক এবং ৪৬টি অর্ধশতক।

ফিলিপ হিউজেস, তোমায় ভোলেনি ক্রিকেটপ্রেমীরা

স্বল্প জীবনের ক্ষুদ্র ক্যারিয়ারের সাফল্যে ‘লিটল ডন’ নামেও আখ্যা পেয়েছিলেন হিউজেস। ৮ বছর আগে তার অভিষেক সিরিজ শেষে গণমাধ্যমে বলাবলি হচ্ছিল, অস্ট্রেলিয়া পরবর্তী ১০ বছরের জন্য চিন্তামুক্ত। ওপেনিংয়ের দায়িত্বটা নিশ্চিন্তে সঁপে দেয়া যায় হিউজেসের কাঁধে। কিন্তু কে জানত, মাত্র বছর পাঁচেক পরেই তাদেরকেই প্রকাশ করতে হবে হিউজেসের শেষযাত্রার খবর।

ফিলিপ হিউজেস যুগ যুগ ধরে ৬৩ রানে অপরাজিত থাকবেন, যাকে আউট করতে পারবেন না আর কোনো বোলার। কাকতালীয় হলেও সত্য, ফিলিপ হিউজেসের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ২৪৩ রানের ইনিংসটিতে তিনি ছিলেন অপরাজিত। লিস্ট-এ তে ২০২ রানের ইনিংসটিতেও ছিলেন অপরাজিত। এমনকি টি-টুয়েন্টিতেও ছিল তার ৮৭ রানের অপরাজিত ইনিংস।

শুধুমাত্র জীবনের কাছেই হার মেনেছিলেন ফিলিপ জোয়েল হিউজেস।

This article is in Bangla Language. Its written in memory of  australian cricketer Philip Hughes.

Reference:

1. en.wikipedia.org/wiki/Phillip_Hughes
Featured Image: Ryan Pierse/Getty Images

 

Related Articles

Exit mobile version