এই যুগে এমন খেলোয়াড় খুঁজে পাওয়া একটু কঠিন।
আজকের দিনে ফুটবলারদের জীবন চলে ক্লাবকে কেন্দ্র করে। সারা বছর ক্লাবেই বসবাস করেন তারা, ক্লাবই তাদের ঠিকানা। ক্লাব সতীর্থদের সাথেই আড্ডা, তাদের সাথেই সরা বছরের অনুশীলন। ফলে পারফর্মেন্সের প্রশ্ন এলেও ক্লাবই এগিয়ে থাকে। বিপরীতে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ হয় কম। সেখানে সবার সাথে মেলামেশাও খুব একটা হয় না। ফলে লিওনেল মেসি, নেইমার, রোনালদোরা ক্লাবের হয়ে যতটা ভয়ঙ্কর, তা হয়ে উঠতে পারেন না যার যার জাতীয় দলের হয়ে।
তারপরও এর মধ্যে থাকে কিছু ব্যতিক্রম নাম। যারা ক্লাবের নয়, জাতীয় দলের জন্যই জমিয়ে রাখেন সেরাটা। ফুটবলের এই বিস্ময়কর খেলোয়াড়দের নিয়েই আজকের আয়োজন।
লুকাস পোডলস্কি (জার্মানি)
এই তালিকার সবচেয়ে উজ্জল নাম। বায়ার্ন মিউনিখ বা আর্সেনালের হয়ে একেবারে কিছু করতে পারেননি, তা নয়। তবে যা করা সম্ভব ছিলো, সেই প্রত্যাশা কখনো মেটাতে পারেননি। তিনি স্থানীয় ক্লাব কোলোনের হয়েও খেলেছেন, যেখানে আসলে বেড়ে উঠেছেন তিনি। বায়ার্নের হয়ে ৭১ ম্যাচে ১৫টি এবং আর্সেনালের হয়ে ৬০ ম্যাচে ১৯টি গোল করেছেন। ক্লাবের এই পরিসংখ্যান দিয়ে কল্পনাই করা যাবে না, জার্মানি জাতীয় দলের জন্য তিনি কী করেছেন। তাকে জার্মানির আক্রমণভাগের সর্বকালের অন্যতম সেরা তারকা বলে মানতে হবে। পরিসংখ্যান তা-ই বলে।
বিস্ময়করভাবে এই উইঙ্গার, স্ট্রাইকার জার্মানির হয়ে ১৩০ ম্যাচ খেলেছেন। জার্মান জাতীয় দলের হয়ে তৃতীয় সর্বাধিক ম্যাচ খেলার রেকর্ড তার। পোডলস্কির চেয়ে বেশি ম্যাচ জার্মানির হয়ে খেলেছেন কেবল লোথার ম্যাথাউস ও মিরোস্লাভ ক্লোসা। ক্লোসা ও জার্ড মুলারের পর জার্মানির ইতিহাসের তৃতীয় সেরা স্কোরারও পোডলস্কি। তিনি জাতীয় দলের জার্সি গায়ে করেছেন ৪৯ গোল। জোয়াকিম লোর খুব প্রিয় একজন খেলোয়াড় ছিলেন। ড্রেসিংরুমের সবচেয়ে মজার চরিত্র। জিতেছেন ২০১৪ বিশ্বকাপ।
২০০২ সালের বিশ্বকাপের পর বর্তমান বিশ্বকাপই প্রথম মেজর টুর্নামেন্ট খেলছে জার্মানি পোডলস্কিকে ছাড়া।
এডুয়ার্ডো ভার্গাস (চিলি)
ভার্গাসকে একবার এই প্রশ্নটা করা হয়েছিলো। তিনি নিজেও প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলেছিলেন, “আমি ঠিক জানি না কেন আমি জাতীয় দলের হয়েই ভালো খেলি।”
চিলির অন্যতম জনপ্রিয় ফুটবলার ভার্গাস। জাতীয় দলের লাল জার্সি গায়ে কখনোই খুব একটা হতাশ করেননি। টানা দুটো কোপা আমেরিকা জিতেছেন ২০১৫ ও ২০১৬ সালে, যা এর আগে কখনোই চিলি জিততে পারেনি। দুটো টুর্নামেন্টেই টপ স্কোরার ছিলেন ভার্গাস। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপেই দারুণ পারফর্মেন্স ছিলো তার। স্পেনের বিপক্ষে ২-০ জয়ের পথে খুব গুরুত্বপূর্ণ গোল করেছিলেন।
সবমিলিয়ে জাতীয় দলের হয়ে ৮৫ ম্যাচে তার ৩৫ গোল। কিন্তু ইউরোপে তার ক্লাব ক্যারিয়ারকে এই তুলনায় স্রেফ একটা কেলেঙ্কারি বলা যায়। নাপোলি, ভ্যালেন্সিয়া, কিউপিআর, হফেনহেইমের হয়ে খেলেছেন। কিন্তু কোথাও বলার মতো কিছু করে দেখাতে পারেননি। এখন মেক্সিকোর টাইগার্স দলের হয়ে খেলছেন। আর ইউরোপে ফিরতে পারবেন বলে মনে হয় না।
মউরিসিও ইসলা (চিলি)
আরেকজন চিলির খেলোয়াড় এই তালিকায়। কারণটা খুব সোজা। ইসলা জাতীয় দলের হয়ে যে সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন, তার কিছুই ক্লাবের হয়ে দেখাতে পারেননি। এমনকি উদিনেসের হয়েও শুরুতে দারুণ ফুটবল উপহার দিয়েছিলেন। বর্তমানে ৩০ বছর বয়স্ক এই ফুটবলার রাইট ব্যাকে উদিনেসেতে ছিলেন অসাধারণ কাজের এক খেলোয়াড়। জাতীয় দলের হয়েও দারুণ সাফল্য পেয়েছেন তিনি। জাতীয় দলের হয়ে ১০০ ম্যাচ খেলেছেন। দুটো বিশ্বকাপে দারুণ খেলা উপহার দিয়েছেন চিলিকে। ২০১৫ ও ১০১৬ কোপা আমেরিকা জয়ের পথে ডান দিকে চিলির অন্যতম ভরসা ছিলেন তিনি।
কিন্তু এই ইসলার ক্লাব ক্যারিয়ার একদম পতনের দিকে চলে যায় ২০১২ সালে উদিনেসে ছাড়ার পর। জুভেন্টাসে তিনি ছিলেন বেঞ্চের খেলোয়াড়। এরপর কিউপিআরের সাথে রেলিগেশন দেখেছেন। মার্শেইতেও বলার তো কিছু করতে পারেননি। ক্যালিগারিতে মাঝারি একটা মৌসুম কাটানোর পর এখন তিনি ফেনারবাচেতে খেলছেন। এমন একজন প্রতিশ্রুতিশীল খেলোয়াড়ের ক্লাবে এমন পরিণতি দুঃখজনক।
ফ্যাবিও গ্রোসো (ইতালি)
২০০৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে ১১৯ মিনিটে গ্রোসোর সেই গোলের সেলিব্রেশন কোনোদিন ভোলার মতো নয়। অসাধারণ এক বাঁকানো ও বিস্ময়কর শটে পরাস্ত করেছিলেন জেন্স লেম্যানকে। টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা মুহুর্ত ছিলো ক্লাসিক এই ম্যাচের দৃশ্যটি। পাঁচদিন পর এই গ্রোসো ইতালির হয়ে ফাইনালে শেষ পেনাল্টি নিলেন এবং সেই শট জালে জড়িয়ে যেতেই শুরু হলো উৎসব। ফ্রান্সকে হারিয়ে ট্রফি হাতে তুলে নিলো ইতালি।
পুরো টুর্নামেন্টেই গ্রোসোর পারফরম্যান্স ছিলো অসাধারণ। ২৮ বছর বয়সী গ্রোসোকে আবিষ্কার করাটাই ছিলো একটা বিস্ময়কর ঘটনা। ২৩ বছর বয়স অবধি নিচু ডিভিশনে ফুটবল খেলতেন। এরপর পেরুগিয়া বা পালের্মোর মতো দলে ফেলেছেন। তাকে কেউ সেভাবে কখনো ক্লাবে লক্ষ্যই করেনি। বিশ্বকাপে জাতীয় দলের হয়ে এই পারফরম্যান্স দিয়েই নজর কেড়েছিলেন। এরপর ইন্টার মিলানে ডাক পেলেন। কিন্তু সেখানেও বলার মতো কিছু করতে পারলেন না। লিও ও জুভেন্টাসে খেলেছেন; সেখানেও ব্যর্থ। তার ক্লাব ক্যারিয়ার আক্ষরিক অর্থেই বলার মতো কিছু না। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে ওই বিশ্বকাপের পর ২০০৮ ইউরোতেও দারুণ ফুটবল খেলেছেন।
আসামো জিয়ান (ঘানা)
ঘানার জন্য তিনি একজন সর্বকালের সেরা ফুটবলার। জাতীয় দলের হয়ে ১০৬ ম্যাচে ৫১ গোল করেছেন। আবেদি পেলের সাথে একসাথে নাম উচ্চারিত হয় তার। এটা ঠিক যে, অনেকে মনে রেখেছেন তাকে ২০১০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করার জন্য। কিন্তু ওই টুর্নামেন্টেই ৩টি গোল করেছিলেন তিনি। ২০১৪ বিশ্বকাপে তিনি জার্মানি ও পর্তুগালের বিপক্ষেও গোল করেছিলেন। প্রমাণ করেছিলেন, তিনি আসলেই বিশ্বমানের এক ফুটবলার। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার, ক্লাবের হয়ে এই জিয়ানকে কখনো পাওয়া যায়নি।
ক্লাবের হয়ে মাঝারি একটা সময় কাটিয়েছেন উদিনেসেতে। এরপর রেনে ও সান্দারল্যান্ডেও সময়টা ভালো কাটেনি। ইউরোপে একদমই সুবিধা করতে না পেরে আরব আমিরাত ও চীনের ক্লাবে খেলেছেন। ইউরোপের পারফর্মেন্স বিবেচনায় নিলে খুবই ব্যর্থ ছিলেন তিনি।
সার্জিও রোমেরো (আর্জেন্টিনা)
এজেড থেকে বের হওয়ার পর থেকে, মানে সেই ২০১৩ সালের পর থেকে আর কোনো ক্লাবের সেরা একাদশে খেলা হয়নি এই আর্জেন্টাইন গোলরক্ষকের। মোনাকো, সাম্পোদোরিয়া থেকে এখন আছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। ক্লাবে টুকটাক যা সুযোগ পেয়েছেন, তাতে নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা করলেও শেষ অবধি ক্লাবের এক নম্বর গোলরক্ষক হতে পারেননি তিনি। কোচরা সেই আস্থাটা তার ওপর কখনোই রাখতে পারেননি। কিন্তু এই রোমেরোই জাতীয় দলের হয়ে ছিলেন অসাধারণ।
২০১৫ ও ২০১৬ কোপা এবং ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছেন এই গোলরক্ষক। প্রতি ম্যাচে অসাধারণ পারফরম্যান্স করেছেন আর্জেন্টিনার হয়ে। তিনটি ফাইনালের মধ্যে দুটি হেরেছেন পেনাল্টি শুটআউটে। আর একটি একমাত্র গোলে। এই ৩৬০ মিনিট মাঠের খেলায় হজম করেছেন একটিমাত্র গোল। শুধু এটুকু নয়, ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে দলকে তোলার পথে তার ছিলো নাটকীয় পারফরম্যান্স। সেমিফাইনালে বৈতরণী পার হয়েছিলো আর্জেন্টিনা তার দুই সেভের ওপর ভর করে। কিন্তু সেই খেলোয়াড়টিই ক্লাবে নিজেকে খুঁজে পেলেন না।