আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) সম্প্রতি বৈশ্বিক বাজার নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছে। ১৬-৬৯ বছর বয়সী বিরাট সংখ্যক মানুষের ওপর চালানো এই গবেষণার ফল প্রকাশ করে আইসিসি দাবি করেছে, সারা বিশ্বে এক বিলিয়নের ওপর মানুষ ক্রিকেট দেখে।
যদিও আসল ব্যাপারটা হলো, এই এক বিলিয়নের বড় অংশটাই বসবাস করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে। এই তিনটি দেশের মোট জনসংখ্যা সারা বিশ্বের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি। ফলে এই তিন দেশের অধিকাংশ মানুষ ক্রিকেট দেখা মানেই সেটি একটি বিশাল বাজারের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
এই গবেষণা দেখে অনেকে বলছেন, ক্রিকেট এখন ফুটবলের পরই বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। যদিও বাস্কেটবল এর চেয়ে এগিয়ে আছে বলেই অনুমান করা হয়। তবে এটা সত্যি যে, ক্রিকেট এখন বিশাল একটা বাজার দখল করে আছে। সেটা শুধু দক্ষিণ এশিয়াতে হলেও অনেক বড় বাজার। ক্রিকেট দর্শকের সংখ্যাটা এখন আর সেই আদি যুগের মতো শুধু অভিজাত কিছু হাতেগোনা লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে নেই।
তারপরও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ১৯০০ সালের প্যারিস অলিম্পিকের পর থেকে আর কখনো ক্রিকেট অলিম্পিকের অংশ হতে পারেনি। এমনকি ক্রিকেট কমনওয়েলথ গেমসেও নেই। কিন্তু কেন? এত জনপ্রিয় একটা খেলা কেন এরকম ‘মাল্টি স্পোর্টস ইভেন্ট’গুলোতে থাকবে না!
আইসিসির এই জরিপ বা গবেষণাই বলছে, তাদের দর্শকরা মারাত্মকভাবে চান যে, ক্রিকেট যেন অলিম্পিক ইভেন্ট হয়ে ওঠে। জরিপ চালানো মোট লোকেদের শতকরা ৮৭ ভাগই বলেছেন, তারা ক্রিকেটকে অলিম্পিকে দেখতে চান। কোন ফরম্যাট দেখতে চান, এই প্রশ্নের জবাবে বেশিরভাগই টি-টোয়েন্টির কথা বলেছেন।
তা-ই হওয়ার কথা, সংক্ষিপ্ত সময়ের এই ফরম্যাটই হতে পারে অলিম্পিকে ক্রিকেটের প্রতিনিধিত্ব করা ফরম্যাট।
আইসিসির প্রধান নির্বাহী ডেভ রিচার্ডসন বলেছেন, তিনি আশা করেন ২০২৮ সালের লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিকে ক্রিকেটকে দেখা যাবে। অন্তত সেভাবেই এগোচ্ছেন তারা,
“এটা একটু সময় নিচ্ছে। আমরা এরই মধ্যে আইওসি (ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি) ২০২৪ অলিম্পিকের জন্য যে ডেডলাইন দিয়েছিলো, সেটা মিস করেছি। ফলে প্যারিসে যেতে পারছি না আমরা। তবে আমরা আইওসি ও এলএ (লস অ্যাঞ্জেলস)-এর সাথে ভালো যোগাযোগ রাখছি। আমরা আশা করছি, ২০২৮ অলিম্পিকে ক্রিকেট থাকবে।”
এখন আসলে অলিম্পিকে ক্রিকেট না থাকার কোনো কারণ নেই। আগে ক্রিকেটের দৈর্ঘের কারণেই এটা অলিম্পিকের জন্য সেভাবে বিবেচিত হয়নি। কিন্তু এখন টি-টোয়েন্টির যুগ। এই সময়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের এই খেলা অলিম্পিকে থাকতেই পারে। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকেই এখন ক্রিকেটের ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে অলিম্পিকে যাওয়ার জন্য। আর এটাই ক্রিকেটের জন্য চূড়ান্ত উপায় নিজেদের প্রমাণ করার। তাদের এটা প্রমাণ করতে হবে যে, ক্রিকেট আসলেই একটা বৈশ্বিক খেলা।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, মুখে ডেভ রিচার্ডসনরা যা-ই বলুন না কেন, তারা সবসময়ই বহুবিধ খেলার এরকম আসরগুলো থেকে দূরে থেকেছেন। ক্রিকেট সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো কমনওয়েলথ এলাকায়। অথচ বিস্ময়করভাবে সেই কমনওয়েলথ গেমসেই ক্রিকেট নেই। একমাত্র ১৯৯৮ সালের কুয়ালালামপুর গেমস ছাড়া কখনোই এই আসরে খেলাটাকে দেখা যায়নি।
২০২২ সালের কমনওয়েলথ গেমসে ক্রিকেটকে দেখা যাবে, এমন কোনো সম্ভাবনা ওনেই। বার্মিংহাম আয়োজকরা জানিয়ে দিয়েছেন, তাদের এরকম কোনো পরিকল্পনা নেই। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার গোল্ড কোস্টেও ছিলো না ক্রিকেট। অথচ ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের দুই পরাশক্তি দেশ!
যদিও এত হতাশার মধ্যে একটু আশার কথা শুনিয়েছেন রিকি পন্টিং। অস্ট্রেলিয়ার এই সাবেক অধিনায়ক এখন এমসিসি ক্রিকেট কমিটির সদস্য। তিনি বলেছেন, বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসে মেয়েদের ক্রিকেট থাকলেও থাকতে পারে।
কমনওয়েলথ বা অলিম্পিকের কথা বাদ দিন। এশিয়ান গেমসের আগামী আসর থেকেই আবার বাদ পড়তে যাচ্ছে ক্রিকেট। এশিয়ান গেমস অলিম্পিকের পর সবচেয়ে বড় এই ধরনের আসর। চার বছর আগে ইনচন এশিয়ান গেমসে সাফল্যের সাথে ছিলো ক্রিকেট। কিন্তু এবার আর তারা রাখতে চাইছে না এই খেলাটাকে।
এভাবে দেখা যায় যে, রাগবির মতো একটা খেলা, যেটা ক্রিকেটের তুলনায় অনেক কম জনপ্রিয়, সেটা ১৯৯৮ সালে কমনওয়েলথ গেমসে অভিষিক্ত হয়েছে। এরপর তারা অলিম্পিকেও গেছে। বাস্কেটবলের মতো একটা খেলা; যেটা কমনওয়েলথ এলাকায় মোটেও জনপ্রিয় নয়, সেটা কমনওয়েলথে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু সেই গোল্ড কোস্টেই ক্রিকেটের কোনো জায়গা হয়নি।
এতক্ষণ এই আলোচনার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, কেন এসব গেমসে থাকছে না ক্রিকেট?
একেবারে সাদা চোখে দেখলে এর কারণ ক্রিকেট নিজেই উৎসাহী নয়। সারা বছর ক্যালেন্ডারের প্রতিটা মাস জুড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলতে থাকে বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। সেই সাথে চলতে থাকে আর্থিকভাবে লাভজনক দ্বিপাক্ষিক সফর। আর এর সবকিছুর সঙ্গে আয়োজকদের কাড়ি কাড়ি অর্থ আয় করার সুযোগ জড়িত। গেমসগুলো নিয়মিত খেলা মানেই এসব অর্থ থেকে বঞ্চিত হওয়া।
বাকি দেশগুলোর কথা যেমন তেমন, গেমস খেলতে গেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে ভারত।
ভারত হলো ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বাজারের মালিক। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী ক্রিকেট বোর্ড হলো বিসিসিআই। তারা চাইলে ক্রিকেটে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারে এবং যে কোনো সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারে।
ভারতের অলিম্পিকে ক্রিকেট অন্তর্ভূক্ত করায় প্রধান আপত্তি হলো, তারা দেশে যে স্বাধীনতা ভোগ করে, সেটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়। কোনো খেলা অলিম্পিক স্পোর্টস হলে, তার ওপর ঐ দেশের অলিম্পিক কমিটির একটা খবরদারী তৈরি হয়। ক্রিকেট যদি অলিম্পিকে যায় এবং ভারত যদি সেখানে অংশ নেয়, তখন বিসিসিআইকে ভারতীয় অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের কাছে একটা জবাবদিহি করতে হবে, যেটা তারা একেবারেই চায় না। এমনিতেই ভারতীয় আদালতের হস্তক্ষেপে এখন সে দেশের ক্রিকেট রাজনীতিবিদরা অনেকটা কোনঠাসা অবস্থায় আছেন; এ অবস্থায় তারা আরও বিপাকে পড়তে রাজি নন।
দ্বিতীয় ব্যাপার হলো আইসিসি থেকে ভারতের আয় কমে যাওয়ার ভয়। এই ভয়টা ভারতসহ সকল টেস্ট খেলুড়ে দেশেরই আছে। তবে ভারতের বেশি। কারণ আগামী চার বছরের অর্থনৈতিক চক্রে ভারত আইসিসির কাছ থেকে প্রায় ৪০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাবে, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাওয়া ইংল্যান্ডের চেয়ে প্রায় তিনগুন বেশি।
এখন ক্রিকেট অলিম্পিকে গেলে এই আয়টা কমে যাবে। কিভাবে?
কারণ, ক্রিকেট অলিম্পিকে গেলে আইসিসির তার পরিকল্পনা মতো দুই বছর বাদে বাদে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ করতে পারবে না। তা করলে প্রতি চার বছরে তিনটি টি-টোয়েন্টির বৈশ্বিক আয়োজন হয়ে যাবে। সেটা অসম্ভব একটা ব্যাপার। ফলে আইসিসিকে চার বছরে একটাই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ করতে হবে তখন এবং অন্যটি অলিম্পিককে ছেড়ে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে আইসিসির আয় কমে যাবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে ভারত। ফলে তারা চাচ্ছে না যে, অলিম্পিকে ক্রিকেট যাক।
অলিম্পিকে ক্রিকেট গেলে ভারতের তৃতীয় ক্ষতি হলো আইপিএলের আকর্ষণ কমে যাওয়া ও এর সূচী নিয়ে বিপাক তৈরি হওয়া। অন্তত অলিম্পিকের বছর তাদের সূচীর ওলটপালট করতেই হবে। আর ভারতীয় জাতীয় দল আইপিএলের সময়টা ছাড়া সারা বছর এত বেশি লাভজনক সিরিজ খেলে থাকে যে, এই সূচী নড়বড় হলে তাদের মোট আয়ে বিরাট ধ্বস নামতে পারে।
সম্প্রতি আইসিসি তার ১০৪টি সদস্য রাষ্ট্রকেই টি-টোয়েন্টি স্ট্যাটাস দিয়ে দিয়েছে। তাদের লক্ষ্য ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু এভাবে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর লাভের কারণে ক্রিকেটকে অলিম্পিক, কমনওয়েলথ গেমস থেকে সরিয়ে রাখলে ক্রিকেটের বিশ্বায়ন প্রায় অসম্ভব।
যেসব ছোট ছোট দেশ এখন ক্রিকেটে আগ্রহী হচ্ছে, তারা তাদের সরকার থেকে কোনো সহায়তা পাচ্ছে না। ক্রিকেট রাশিয়ার সভাপতি আশওয়ানি চোপড়া যেমন বলছিলেন,
“একটা নন-অলিম্পিক স্পের্টসের জন্য সরকার থেকে সহায়তা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ক্রিকেট যদি অলিম্পিকে অন্তর্ভূক্ত হতো, সেটা রাশিয়ার জন্য বিরাট একটা ব্যাপার হতো। তখন একটা পদকের কারণে হলেও সরকার ক্রিকেটকে সহায়তা করতো।”
এখন আইসিসিকে ভাবতে হবে, তারা আপাতত টাকার পেছনে ছুটবে, নাকি রাশিয়ার মতো দেশগুলোর পাশে দাঁড়াতে অলিম্পিকে ঢুকবে।