টেস্ট অভিষেকের দিনদুয়েক আগে অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
“আচ্ছা, লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম ওঠার অনুভূতিটা কেমন?”
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডস টেস্টের প্রথম দিন শেষে নামের পাশে অপরাজিত ১৩৬ নিয়ে ডেভন কনওয়ে যখন সাজঘরে ফিরলেন, তখন অধিনায়ক উইলিয়ামসন সেই প্রশ্নের উত্তরটা দিলেন,
‘Now you know what it’s like, bro!’
লর্ডসে টেস্ট অভিষেকেই নতুন বলে মুখোমুখি হলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা দুই ফাস্ট বোলার জেমস অ্যান্ডারসন ও স্টুয়ার্ট ব্রডের। শুরুটা করলেন বেশ আক্রমণাত্মকভাবে এবং মধ্যাহ্নবিরতির আগেই চলে গেলেন অর্ধশতকের কাছাকাছি।
মধ্যাহ্নবিরতির পর পেসাররা বেশ ভালো সুইং পাচ্ছিলেন। তাই ৬২ বলে ৪৩ নিয়ে দ্বিতীয় সেশনে ব্যাটিংয়ে নেমে কিছুটা সাবধানী ভঙ্গিমা ধারণ করেন কনওয়ে। সেই সময়টায় স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক খেলা থেকে কিছুটা নিরস্ত করে রেখেছিলেন নিজেকে।
দ্বিতীয় সেশনে বাকি ৭ রান যোগ করতে কনওয়ে খেলেন ২৯ বল। ফিফটির পর ইনিংসের মাঝামাঝিতে একটু ধরে খেললেও শতকের কাছাকাছি আসার পরই রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। ১৫২ বলে ৮৯ থেকে ৯ বলের ব্যবধানে চলে গেলেন ১০২ রানে। ব্যক্তিগত ৯৮ রানের মাথায় অলি রবিসনকে দারুণভাবে ফ্লিক করে শতকের আনন্দে ভাসেন কনওয়ে। লর্ডসে অভিষেকে তৃতীয় সফরকারী ব্যাটসম্যান হিসেবে এই কীর্তি অর্জন করেন কনওয়ে। তার আগে দেশের বাইরে টেস্ট অভিষেকে নিউ জিল্যান্ডের হয়ে শতরান করতে পেরেছিলেন কেবল চারজন।
তবে কনওয়ে সেঞ্চুরি করেই সন্তুষ্ট থাকলেন না। তার আরও রেকর্ড করা চাই। দিনের শেষভাগে সৌরভ গাঙ্গুলীর ১৩১ ছাড়িয়ে হয়ে গেলেন লর্ডসে অভিষিক্ত কোনো ব্যাটসম্যানের পক্ষে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের মালিক।
মজার ব্যাপার হলো, কনওয়ে আর সৌরভের জন্মদিন একই দিনে (৮ জুলাই)। কাকতাল আছে আরও। সৌরভের একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ক্যাপ নাম্বার ৮৪, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে কনওয়েরও তাই।
প্রথম দিনশেষে বলেছিলেন,
“আমি খুবই খুশি, কিন্তু আমার কাজ এখনও শেষ হয়নি।”
লর্ডস টেস্টের দ্বিতীয় দিনে সে কথার মানও রাখলেন। আগের দিন যেখানে ফেলে গেছিলেন, ঠিক সেখান থেকেই শুরু করলেন। মধ্যাহ্নবিরতির আগেই ভেঙে ফেললেন আরও একটি রেকর্ড, হামিশ রাদারফোর্ডের ১৭১ টপকে করে ফেললেন নিউ জিল্যান্ডের হয়ে অভিষেকে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে এক ইনিংসে সর্বাধিক রানের রেকর্ড।
চার মেরে শতক করার পর দ্বিশতকটা পূর্ণ করলেন আরো বিস্ময়করভাবে। ম্যাচের দ্রুততম বোলার মার্ক উডকে স্কয়ার লেগ আর লং লেগের মাঝামাঝি দিয়ে সীমানা পার করে। শটটা খেলতে গিয়ে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে ছিলেন, এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন না কনওয়ে। তবে অমন ইনিংসে দ্বিশতক না হলে অন্যায়ই হতো। ডেভন কনওয়ে এবার ঢুকে গেলেন ইতিহাসের পাতায়, ম্যাথু সিনক্লেয়ারের পর দ্বিতীয় কিউই ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেকে করলেন দ্বিশতক। কনওয়ের আগে বিদেশের মাটিতে কোনো অভিষিক্ত উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানই গড়তে পারেননি এ কীর্তি, দেশের মাটিতে কেবল একজন – শ্রীলঙ্কার ব্রেন্ডন কুরুপ্পু।
দ্বিশতকের পরপরই রান আউট হয়েও করে গেলেন আরেকটা রেকর্ড, টেস্ট অভিষেকে রানআউট হওয়া ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ ইনিংসের। যখন আপনি আউট হতেও হতেও এমন রেকর্ড করে যাবেন, তখন বুঝতেই হবে দিনটা আপনার।
তবে ডেভন কনওয়ের এই দিন, এই জীবন দেখার আগের গল্পটা সম্পর্কে না জানলেই নয়। তার জীবনটাই তো টেস্ট ক্রিকেটের মতো, যাতে রয়েছে উত্থান, পতন আর শেষমেশ চোয়ালবদ্ধ দৃঢ়তায় টিকে থেকে সব বাধাকে পরাস্ত করার গল্প।
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে জন্ম ও বেড়ে ওঠা কনওয়ের৷ ১১ বছর আগে ২০১০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের সম্ভাব্য খেলোয়াড়দের তালিকায় থাকলেও মূল দলে জায়গা হয়নি তার। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে খেলেছেন কুইন্টন ডি কক, টেম্বা বাভুমাদের সঙ্গে। কিন্তু তারা যখন দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে মঞ্চ মাতাতে ব্যস্ত, কনওয়ে তখন দ্বিতীয় বিভাগ প্রাদেশিক ক্রিকেটে রানের জোয়ার বইয়েও নিশ্চিত নন যে চারদিনের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের আসরে লায়ন্সের মূল দলে জায়গা পাবেন কি না।
সুযোগ পাননি একেবারে, তা নয়। তবে কোনো নির্ধারিত ব্যাটিং পজিশন ছিল না তার জন্যে। দেখা যেত, টি-টোয়েন্টিতে নামছেন ইনিংস গোড়াপত্তন করতে, আর লিস্ট-এ’তে নামতে হচ্ছে পাঁচ বা সাত নম্বরে৷ আর চারদিনের ক্রিকেটে তো শুধু তখনই ডাক পাচ্ছেন, যখন কেউ চোটে পড়ছে।
২০১৭ সালের মার্চে জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্সে কনওয়ে তুলে নিলেন তার ক্যারিয়ারের প্রথম দ্বিশতক। বিস্ময়করভাবে সেই ম্যাচটিই ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় স্তর তথা প্রাদেশিক ক্রিকেটে কনওয়ের শেষ ম্যাচ। কেননা ঠিক এই ম্যাচটার আগেই প্রেমিকা কিমের সঙ্গে আলাপ করে নিয়ে ফেলেছিলেন একটা কঠিন সিদ্ধান্ত।
দুই ক্রিকেটার বন্ধু ম্যালকম নোফাল ও মাইকেল রিপনের পরামর্শে দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে নিউ জিল্যান্ডে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন কনওয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ঘরবাড়ি, জায়গাজমি বিক্রি করে গটেংয়ের হয়ে দ্বিশতক করার দু’মাসের মধ্যেই নিউ জিল্যান্ডের বিমানে চেপে বসেন।
২০১৭ এর আগস্টে কনওয়ে ও কিম চলে আসেন নিউ জিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে। চারদিনের মধ্যেই যোগ দেন ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট ক্লাবে, খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে। থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্তও হয়ে যায়। তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন যে বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন কনওয়ে, সেটা ছাড়তে হয়েছিল ওয়েলিংটনে এসে।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে নিউ জিল্যান্ডে এসে থিতু হয়েছে এক প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান – কথাটা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না খুব একটা। কানে গেল ওয়েলিংটন দলের কোচ ব্রুস এডগারেরও।
নিউ জিল্যান্ডের লিস্ট-এ আসর ফোর্ড ট্রফিতে সেবার ওয়েলিংটন কয়েক ম্যাচের জন্য পাচ্ছিল না টম ব্লান্ডেলকে। এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানের ডাক পড়েছে জাতীয় দলে। ফলে তাদের প্রয়োজন ছিল একজন উইকেটরক্ষকের। এমন সময়ে ডাক পড়ল কনওয়ের। ফোর্ড ট্রফির সেই তিন ম্যাচে দু’বার অর্ধশতকের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন কনওয়ে।
মজার ব্যাপার হলো, ব্লান্ডেলের অনুপস্থিতিই আবারও কনওয়েকে সুযোগ করে দেয় ওয়েলিংটন দলে। তবে এবার সংস্করণটা আলাদা, টি-টোয়েন্টি।
ছুটিতে কনওয়ের বাবা-মা এসেছিলেন ছেলের কাছে বেড়াতে। কনওয়ে যখন তাদের শহরটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন, এমন সময় ফোন আসে ওয়েলিংটন কোচ ব্রুস এডগারের। ম্যাচের আগে ব্লান্ডেল অসুস্থ বোধ করায় তার জায়গায় ওয়েলিংটনের হয়ে সুপার স্ম্যাশে অভিষেক হয়ে যায় কনওয়ের। সেই ম্যাচের পর আবারও ফোন পান কোচের,
“ম্যাট টেলর অসুস্থ। তুমি কি অকল্যান্ডে যেতে পারবে আমাদের সাথে?”
কনওয়ে বাকি টুর্নামেন্টের সবগুলো ম্যাচই খেললেন, আউট হলেন কেবল একবার। খুব দ্রতই যেন সবকিছু বদলে যাচ্ছিল তার সামনে।
এবার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের পালা। এবং এখানেও টম ব্লান্ডেল। জাতীয় দলে ডাক পড়ায় তার পরিবর্তে ওয়েলিংটনের মূল একাদশে সুযোগ পেয়ে গেলেন কনওয়ে, খেললেন সে মৌসুমের শেষ চার ম্যাচ। তুলে নিলেন নিউ জিল্যান্ডে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি।
“কখনো বই লিখলে সেখানে ব্লান্ডেলের ব্যাপারে একটা অধ্যায় রাখবোই।”
বলছিলেন কনওয়ে। তাই তো, নিউ জিল্যান্ডে থিতু হবার পর সবগুলো বড় ব্রেকথ্রুতে কোনো না কোনোভাবে তো জড়িয়ে ছিলেন ব্লান্ডেলই! এমনকি টেস্ট অভিষেকে যে দ্বিশতক করলেন, সেই অভিষেকটাও তো হলো ব্লান্ডেলের অফ ফর্মের সুবাদেই!
ব্লান্ডেলের সঙ্গে তার সম্পর্কটাও খুব বন্ধুত্বপূর্ণ। ২০১৯ সালে ক্যান্টারবুরির বিপক্ষে অপরাজিত ত্রিশতকের পর কনওয়েকে এক বোতল ওয়াইন উপহার দিয়েছিলেন ব্লান্ডেল।
২০১৮-১৯ মৌসুমে নিউ জিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটের তিন আসরের দু’টিতেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। পরের মৌসুমে নিজেকে ছাড়িয়ে যান কনওয়ে, এবার তিনটিতেই তালিকার শীর্ষের নামটা ডেভন কনওয়ের।
তাই তো আইসিসি যখন গত বছর ঘোষণা করলো যে আগস্টের ২৮ তারিখ থেকে নিউ জিল্যান্ডের হয়ে খেলতে কনওয়ের আর কোনো বাধা নেই, তখনই কেন্দ্রীয় চুক্তিতে তার জায়গা হয়ে যায়৷
টি-টোয়েন্টি অভিষেকের কিছুদিন পর আইপিএলের নিলামে নাম দিলেও কেউ আগ্রহ প্রকাশ করেনি তাকে নিয়ে। তবে চারদিন পরই হ্যাগলি ওভালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ৯৯ রানের ইনিংস খেলেন তিনি৷ এই ইনিংসের পর কনওয়ের উদ্দেশ্যে এক টুইট বার্তায় রবিচন্দ্রন অশ্বিন লিখেছিলেন,
Devon Conway is just 4 days late, but what a knock 👏👏👏 #AUSvNZ
— Mask up and take your vaccine🙏🙏🇮🇳 (@ashwinravi99) February 22, 2021
অশ্বিনের প্রসঙ্গটা যখন এলোই, তখন ‘কিটি লিটার’ এর কথাটা না বললেই নয়। এটা অবশ্য কোনো ক্রিকেটীয় পরিভাষা নয়, বরং এক ধরনের গুঁড়া মাটি যা বিভিন্ন পোষা প্রাণীদের বিষ্ঠা শুষে নেয়। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে সাউদাম্পটনের কিছুটা মন্থর উইকেটে অশ্বিন ও রবীন্দ্র জাদেজাকে খেলা যে কঠিন হবে, সেটা ভালো করেই জানেন কনওয়ে। তাই তো পিচের ওপর এই কিটি লিটার ছড়িয়ে ব্যাটিং অনুশীলন করছেন, যাতে উইকেটে তৈরি হওয়া ক্ষতে পড়ে হঠাৎ অতিরিক্ত টার্ন করা বা লাফিয়ে ও,ঠা বল মোকাবেলা করতে পারেন।
কনওয়ে জানেন, তার জন্য ব্যাপারটা চ্যালেঞ্জিং। তবে প্রথমবার নিউ জিল্যান্ডের বাইরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে এসেই বাজিমাত করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি প্রস্তুত। নিউ জিল্যান্ডে পাড়ি জমানোর পর এর আগে মাত্র একবার ইনিংস উদ্বোধন করার অভিজ্ঞতা থাকলেও চ্যালেঞ্জটা দু’হাতে নিলেন। এলেন, দেখলেন ও জয় করলেন।
দ্বিতীয় বিভাগে রানের জোয়ার বইয়ে মূল দলে খেলার অপেক্ষা থেকে টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরি। জোহানেসবার্গ থেকে ওয়েলিংটন, সেখান থেকে লর্ডস। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকে শূন্য। টেস্ট অভিষেকে দ্বিশতক। ডেভন ফিলিপ কনওয়ে পেরিয়ে হেঁটেছেন অনেকটা পথ, এখন শুধুই উড়বার পালা।