২০১৩/১৪ মৌসুমের বুন্দেসলিগায় বায়ার্ন মিউনিখ বনাম বায়ার লেভারকুসেন ম্যাচ চলছে। ম্যাচে ২-১ গোলে এগিয়ে আছে বায়ার্ন মিউনিখ। দ্বিতীয়ার্ধের কোনো এক সময়ে কোচ পেপ গার্দিওলা দলের ৭ নম্বর জার্সি পরিহিত খেলোয়াড়কে মাঠে নামানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। জার্মানিতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা থাকায় ডাগআউটে সবাই জ্যাকেট, ট্রাউজার পড়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। সাত নম্বর জার্সিধারী খেলোয়াড়টির তো সেসব পরিবর্তন করে মাঠে নামবে হবে! তিনি ডাগআউটের চেয়ারে বসেই ট্রাউজার খুলে শর্টস পড়লেন, শর্টস নেবার সময় জার্সি হাতে চলে আসলে সেটি তিনি ডানপাশে বসা ডেভিড আলাবার গায়ে ছুঁড়ে দেন।
অন্য পাশে বসা ফিলিপ লাম চুপচাপ বসে থাকতে পারলেন না, মুখে চাপা হাসি নিয়ে শীত নিবারণের জন্য নিজের গায়ের কম্বল দিয়ে তাকে কিছু আড়াল করার ব্যবস্থা করলেন। পুরো ডাগআউটে হাসির রোল শীতের ঠাণ্ডাকেও ভুলিয়ে দিচ্ছে। হাসি এবং তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝাই যায়, এ দৃশ্যের সাথে তারা অত্যন্ত পরিচিত। শুধু তারা নয়, এরকম অদ্ভুত দৃশ্যের সাথে অভ্যস্ত তাদের সমর্থকও। মাঠের ভেতর এরকম সব কর্মকাণ্ড করা রসিক খেলোয়াড়টি ব্যাভারিয়ানদের দীর্ঘদিনের সৈনিক ফ্রাঙ্ক বিলাল রিবেরি। সবাই তাকে চেনে শুধু ফ্রাঙ্ক রিবেরি বলে।
ফ্রাঙ্ক রিবেরি নাম বললেই সবার চোখের সামনে ভেসে উঠবে ছোটখাটো গড়নের একজন মানুষ, যিনি ফ্রান্স অথবা বায়ার্ন মিউনিখের জার্সি গায়ে মাঠের ডানপাশ ধরে ম্যারাথন গতিতে ছুটে চলছেন। তার ছুটে চলার গতিকে ফেরারি গাড়ির গতির সাথে তুলনা করে সমর্থকেরা তাকে ভালোবেসে ডাকে ‘ফেরারিবেরি’। তার আরো একটি নাম আছে, তবে সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
৭ এপ্রিল, ১৯৮৩ সালে ফ্রান্সের বুলোঁ সুর মার নামক এলাকাতে নিম্ন মধ্যবিত্ত একটি খ্রিস্টান পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৫ সালে মাত্র ২ বছর বয়সে ভয়াবহ একটি দুর্ঘটনার মুখোমুখি হন তিনি। পরিবারের সাথে গাড়িতে করে যাবার সময় পেছন থেকে একটি ট্রাক তাদের গাড়িকে ধাক্কা দেয়। রিবেরির মুখের ডান অংশে এত মারাত্মক আঘাত লাগে যে, ক্ষতস্থান জুড়তে ১০০ এর বেশি সেলাই এর প্রয়োজন হয়েছিলো। ছোটবেলাতেই এত বড় একটি অঘটন থেকে বেঁচে যাওয়ার পর, তাকে পুনরায় নিজের জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে বেশ সময় লাগে।
তবে ছোটবেলার দুর্ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন তিনি আজীবন ধারণ করছেন। তার ডানপাশে মুখের বিশাল কাটা দাগটি এখনো দেখা যায়। কেটে যাওয়া এ মুখের জন্য তার নাম হয়ে গেছে ‘স্কারফেস’। এত কিছুর জন্য ফুটবল ক্যারিয়ার বেশ দেরি করেই শুরু করেন তিনি। ১৯৯৬ সালে ১৩ বছর বয়সে প্রথম তিনি নিজের শহরের ক্লাব কন্টি বুলোঁ ফুটবল ক্লাবে নাম লেখান। ওই বছরই তার লিঁলেতে খেলার সুযোগ হয়। সেখানে তিন বছর কাটিয়ে আবার ফেরেন নিজ শহরে।
ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে জীবন শুরু করার পর কোনো ক্লাবে স্থায়ী হতে পারেননি। তবে থিতু না হলেও আস্তে আস্তে নামী ক্লাবে খেলার সুযোগ হয়েছে তার। স্টাডে ব্রেসটোয়েস থেকে মেজ, এরপর গ্যালতাস্যারাই এ খেলার সুযোগ হয়েছে। এখানেই দুর্দান্ত গতির কারণে তুর্কি সমর্থকদের কাছ থেকে ফেরারিবেরি ডাকনাম পেয়েছিলেন। ২০০৫ সালে গ্যালতাস্যারাই থেকে ফ্রান্সে গিয়ে নাম লেখান অলিম্পিক মার্সেইতে। এ দলবদল তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়। গ্যালতাস্যারাই থেকে মার্সেই ক্লাবে এসে তার প্রতিভা প্রমাণ করতে খুব বেশি সময় নেননি তিনি। ৩ আগস্ট, ২০০৫ সালে ইনটরেটো কাপে লাজিওর বিপক্ষে তিনি মার্শেই এর হয়ে অভিষেক গোলটি করেন। সে বছর নভেম্বরে লিগে নঁতের বিপক্ষে ৩০ গজ দূর থেকে অবিশ্বাস্য একটি গোল করে সবার দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হন, যেটি পরে লিগ ওয়ানে ‘গোল অফ দ্য ইয়ার’ খেতাব পায়। ফ্রাঙ্ক রিবেরি একদম মোক্ষম সময়ে নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছিলেন। মার্শেইতে নিয়মিত গোল ও চোখ ধাঁধানো পারফর্মেন্সের ফলে ফ্রান্স কোচ রেমন্ড ডমেনেখ তাকে ডাকেন ২০০৬ সালে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ দলে।
রিবেরি ফুটবল খেলার শুরু থেকেই ফ্রান্সের জার্সি গায়ে চড়ানোর যে স্বপ্নটা দেখতেন, মার্শেইয়ে থাকতেই সেটি পূরণ হয়। ২০০৬ সালের ২৭ মে মেক্সিকোর বিপক্ষে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরু হয়। তার দুরন্ত গতি, অসাধারণ ড্রিবলিং করার দক্ষতা ও চোখ ধাঁধানো পাসের সাথে পরিচিত হয় পুরো ফুটবল বিশ্ব। এরকম একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড়কে উপেক্ষা করতে পারেননি ফ্রান্সের কোচ। বিশ্বকাপের শুরু থেকে ফ্রান্স দলে তার জায়গা পাকা হয়ে যায়। স্বপ্নের বিশ্বকাপ কাটে তার, তারকা মর্যাদা পান এ সময়েই। তবে সবথেকে মর্যাদাপূর্ণ প্রশংসা পেয়েছিলেন জিদানের কাছ থেকে। জিদান বলেছিলেন, ‘রিবেরি ফ্রান্স ফুটবলের রত্ন’। প্রায় ১২ বছর পর জিদানের সে কথার মর্ম আজ স্পষ্ট। কিংবদন্তী জিদান রত্ন চিনতে যে একদমই ভুল করেননি।
বিশ্বকাপ শেষে রিবেরিকে মার্শেই থেকে ২৫ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে কিনে নেয় জার্মান জায়ান্ট বায়ার্ন মিউনিখ। রিবেরি মূলত মার্শেইয়ে নিজের প্রতিভাকে তুলে ধরলেও নিজের সবথেকে সেরা সময় কাটিয়েছেন বায়ার্ন মিউনিখের ৭ নম্বর জার্সি পরে।
ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে অথবা পুরো ক্যারিয়ারে তিনি যে অজস্র গোল করেছেন তা কিন্তু নয়। একজন ডান পাশের মিডফিল্ডার অথবা অ্যাটাকে উইঙ্গার, যে পজিশনে তিনি খেলেছেন সবসময় মনোযোগ বেশি থেকেছে গোল করানোর দিকে। দুর্দান্ত গতির সাথে অসামান্য ড্রিবলিং করার দক্ষতার কারণে নিজের সেরা সময়ে বায়ার্ন মিউনিখের ডানপাশে রাজত্ব করেছেন তিনি। ফ্রান্সের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা উইঙ্গার যেমন তাকে নির্দ্বিধায় বলা যায়, তেমনি রিবেরি-রোবেন জুটির অবদানের কথা ব্যাভারিয়ানদের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
ফ্রাঙ্ক রিবেরি যখন তারকা মর্যাদা পেয়ে নিজের ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা পার করছেন, দৃশ্যপটে অনেকটা তখনি আর্বিভাব ঘটে রোনালদো ও মেসির। মেসি ও রোনালদো যেমন তাদের ক্লাবকে ট্রফি এনে দিয়েছেন, তেমনি অন্য কাউকে সুযোগ না দিয়ে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন ব্যক্তিগত অর্জনগুলো। মেসি-রোনালদো যুগের মাঝে পরেও রিবেরি নিভে যাননি। বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ট্রেবল জিতেছেন, তিনবার ডবল ট্রফি জিততে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাছাড়া তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি জার্মানি ও ফ্রান্স উভয় দেশের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
২০১৩-১৪ মৌসুম তার ক্যারিয়ারের সেরা সময় হয়ে থাকবে। বুন্দেসলিগায় সর্বোচ্চ ১৪ অ্যাসিস্ট করে সেবার বায়ার্নকে এনে দিয়েছিলেন ট্রেবল। মেসি ও রোনালদোকে হারিয়ে জিতেছিলেন ইউরোপ সেরার পুরস্কার। প্রথমবারের মতো ব্যালন ডি’অর জেতার সুযোগ ছিলো। তবে সেবার তিনি তৃতীয় হন, ব্যালন ডি’অর পান ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, যেটা রিবেরি একদমই মেনে নিতে পারেননি।
বায়ার্ন মিউনিখের সাথে আছেন দীর্ঘ ১২ বছর। তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন, এটি তার বর্তমান বসতবাড়ি এবং বায়ার্ন ছেড়ে অন্য কোনো ইউরোপের দলে পাড়ি জমানোর ইচ্ছা তার নেই। ক্যারিয়ারের অনেকটা সময় ইনজুরির সাথে লড়েছেন। প্রতি মৌসুমে একবার তাকে বড় ধরনের ইনজুরির সম্মুখীন হতে হয়েছে। ইনজুরি তার চলার পথে কাঁটা হয়ে না দাঁড়ালে ফ্রান্স ও বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ফ্রাঙ্ক রিবেরির গল্পটা ভিন্ন হতে পারতো।
দুর্ঘটনা ও স্মৃতিচিহ্ন
মুখের একপাশে বিশাল একটি ক্ষতের দাগ থাকা বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে নজরে পড়ে। রিবেরি তার মুখের ক্ষতের দাগের জন্য বিন্দুমাত্র লজ্জিত বা অপমানিত বোধ করেন না। তবে তিনি এটি ভাগ্য বলেও মেনে নেননি। তিনি বলেন,
“এটি আমার মুখের একটি অংশ এবং আমি এ নিয়ে গর্বিত। এটি আমাকে শক্তি দিয়েছে ও নিজেকে অগ্রগামী হতে সাহায্য করেছে। আমি বিরক্তিকর ও জঘন্যতম পরিস্থিতিতে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এটাই আমি, এটা আমার মুখ। আমি খুশি আমার মুখ নিয়ে। কেন আমার খুশি হওয়া উচিত নয়?”
ধর্মীয় মনোভাব
রিবেরি জন্মেছিলেন একটি খ্রিস্টান পরিবারে। তবে ওয়াহিবা নামক একজন মুসলিম নারীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার পর তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। একজন মুসলিম হয়ে তিনি নিজেকে নতুনভাবে খুঁজে পেয়েছেন। প্রতিটি ম্যাচের আগে তিনি আকাশের দিকে হাত তুলে প্রার্থনা করে ম্যাচ শুরু করেন। মুসলমান হবার পর নিজের নাম ফ্রাঙ্ক বিলাল রিবেরি ব্যবহার করলেও তার মুসলিম নাম বিলাল ইউসুফ মোহাম্মদ।
জার্মান না হয়েও জার্মানির সেরা
ফ্রাঙ্ক রিবেরি একজন জার্মান না হয়েও ২০০৮ সালে সেরা জার্মান খেলোয়াড়ের পুরস্কার অর্জন করেন। জার্মান ফুটবল ইতিহাসে এমনটা বিরল। এ সৌভাগ্য মাত্র দুজন খেলোয়াড়ের হয়েছে। তার এ পুরস্কার জেতার আগে প্রথম নন-জার্মান প্লেয়ার হিসেবে পুরস্কার জেতেন ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার অ্যালিয়ন।
দ্য প্র্যাঙ্কস্টার
ফ্রাঙ্ক রিবেরি এমন একজন খেলোয়াড়, যাকে দেখে রাশভারী দেখালেও পেছনে লাগার সুযোগ পেলে তিনি তা কখনোই হাতছাড়া করেন না। এ জন্য মিউনিখের সেরা প্র্যাঙ্কস্টার খেতাব তাকে দেওয়া হয়েছে। একবার ব্যালন ডি’অর না পাবার কারণে ভরা মজলিশে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তার অদ্ভুত রকমের কর্মকাণ্ডের হাত থেকে কোনো প্লেয়ার তো দূরে থাক, একজন কোচও বাদ যায়নি। অদ্ভুত হাই-ফাইভ করা, ইন্টার্ভিউয়ের সময়ে বিরক্ত করা, মাঠে একজন প্লেয়ারের পেছনে লেগে জ্বালাতন করার মতো প্রচুর ভিডিও ইউটিউবে ছড়িয়ে আছে। আর খুবই সাধারণভাবে, এসব কর্মকাণ্ডে তার পছন্দের শিকার আরিয়েন রোবেন।
অদ্ভুত স্বভাব
কোনো ম্যাচে খেলতে না পেরে বেঞ্চে বসে থাকলে ক্ষতি নেই। তবে তাকে খেলার মাঝে উঠিয়ে নেওয়াটা তিনি একদমই সহ্য করতে পারেন না। কার্লো আনচেলত্তির সাথে একবার তো একহাত হবার পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো। আর জার্সি খুলে মারা, পানির বোতলে লাথি দেবার মতো ঘটনা খুবই সাধারণ। তবে অদ্ভুতভাবে অন্য খেলোয়াড়ের ম্যাচ ছেড়ে উঠে আসাকে তিনি ভীষণ মজাদার একটি কাহিনী হিসেবে মনে করেন। মাঝে মাঝে তার দিকে তাকিয়ে এমন হাসিতে ভেঙে পড়েন যে, এর থেকে হাস্যকর কাহিনী আর পুরো জার্মানে হয় না!
রিবেরি একবার বলেছিলেন, “আমি যেভাবে অনুভব করি, সেভাবেই খেলি।” কথাটা মন্দ বলেননি তিনি, পুরো ক্যারিয়ারে তিনি ফুটবলকে অনুভবই করে গেলেন। গত ৭ এপ্রিল ৩৬ বছর বয়সে পা দিয়েছেন এই ফরাসি সুপারস্টার। বায়ার্নের উইংয়ের বাঁপাশের ঝড়টা এখন আর সেভাবে ওঠে না। বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে আবারো লিগ শিরোপা জয় করে এখন হয়তো তিনিও ভাবছেন, বুটজোড়া তুলে রাখার এটাই তো মোক্ষম সময়!
Featured image © FC Bayern Official